সংবাদ শিরোনামঃ

তুরস্কে জনতার বিজয় ** এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্কের জনগণ রুখে দিল সেনা অভ্যুত্থান ** সঙ্কট নিরসনে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ** ২০ দলীয় জোট ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র ** তুর্কী গণপ্রতিরোধে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান ** রফতানি বাণিজ্যের নতুন চ্যালেঞ্জ : রাজনৈতিক অস্থিরতা ** মানবতাবাদী বিশ্ব ও সন্ত্রাসবাদী বিশ্বের মাঝখানে মুসলমানদের দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে ** সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে প্রয়োজন দলমত নির্বিশেষে সবার ঐক্য : নজরুল ইসলাম খান ** তুর্কী জনগণকে অভিনন্দন ** জাতীয় স্বার্থ বনাম হুকুম তামিল করার দৌড়ঝাঁপ ** এ শিক্ষা আমাদের কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ** দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজেও হরিলুটের অভিযোগ ** দুর্ভোগের আরেক নাম পাইকগাছার কপিলমুনি শহর ** কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক সঙ্কট : সেবা কার্যক্রম ব্যাহত ** কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা ** ইসলামী সংস্কৃতির আলোকেই হোক ঈদ আনন্দ ** বাংলা ভাগের জন্য মুসলমানরা নন হিন্দুরাই দায়ী ** কবির বিশ্বাস ** সানজিদা তাহসিনা বেঁচে থাকবে সবার মাঝে ** জাতির নিকট রেখে গেলেন অনেক প্রশ্ন **

ঢাকা, শুক্রবার, ৭ শ্রাবণ ১৪২৩, ১৬ শাওয়াল ১৪৩৭, ২২ জুলাই ২০১৬

আবদুস শহীদ নাসিম
১. সব জাতিরই আনন্দ উৎসবের দিন আছে

পৃথিবীতে রয়েছে অসংখ্য ভৌগোলিক ও সাম্প্রদায়িক জাতির বসবাস। রয়েছে অনেক উন্নত আর অনুন্নত কওম। আরো রয়েছে বিভিন্ন বর্ণ, বংশ ও গোত্রীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। এ সব ধরনের মানুষেরই আনন্দ উৎসবের জন্যে বছরের বিভিন্ন দিন নির্ধারিত আছে। এসব নির্ধারিত দিনে তারা স্ব স্ব পদ্ধতিতে আনন্দ উৎসব পালন করে থাকে। তাদের এ উৎসবের দিনসমূহ নির্ধারিত হয়েছে নিজেদের জাতীয় বা ধর্মীয় কোনো ঘটনা কিংবা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। প্রত্যেক জাতিই তাদের আনন্দ উৎসবে নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও আকীদা বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। এসব উৎসবের মাধ্যমে প্রত্যেক জাতি নিজেদের জাতীয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে। এসব উৎসব প্রত্যেক জাতির নিজস্ব প্রাণ স্পন্দন।

২. ইসলামের উৎসব ঈদ

আমরা মুসলিম। ইসলাম আমাদের জীবন ব্যবস্থা। আমাদের আকীদা বিশ্বাস ও আদর্শের ভিত্তিতে আমাদের রয়েছে স্বতন্ত্র তাহযিব তমদ্দুন ও সভ্যতা সংস্কৃতি। আমাদের আদর্শ ভিত্তিক এই সভ্যতা সংস্কৃতিই আমাদেরকে পৃথিবীর অন্যান্য জাতি থেকে স্বতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।

তাওহীদি ঈমান আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতির ভিত্তি। তাই আমাদের আনন্দ উৎসব, যা আমাদের সংস্কৃতির এক প্রকার বাহন, তাতে আমাদের ঈমান ও আদর্শেরই প্রতিফলন ঘটে থাকে। ইসলামের আনন্দ উৎসব সর্বপ্রকার বাজে হাসি তামাসা ও নিরর্থক জৌলুস থেকে মুক্ত। এখানকার আনন্দ উৎসব বেহুদা কর্মকাণ্ড ও অশ্লীল আচার অনুষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এখানকার উৎসবে শিরক আর ব্যক্তিপূজার নেই কোনো স্থান। কারণ মুমিনদের বৈশিষ্ট্যই তো হচ্ছে :

“তারা বাজে ও নিরর্থক কাজ থেকে দূরে থাকে।” (সূরা মুমিনুন : ৩)

জাহেলি সমাজের বাতিল আনন্দ উৎসব পরিহার করে ইসলাম তার আদর্শের ভিত্তিতে দুই ঈদ প্রবর্তন করেছে। দুই ঈদের প্রবর্তন সম্পর্কে আনাস রা. বর্ণনা করেন:

“নবী করিম (সা.) মদীনায় আগমন করার পর দেখলেন মদীনাবাসীদের দুটি (উৎসবের) দিন রয়েছে, যাতে তারা খেলাধুলা করে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের এই দিন দুটি কেমন? তারা বললো, জাহেলি জীবনে আমরা এই দুদিন খেল তামাশা করতাম। রাসূলে করিম (সা.) বললেন, আল্লাহ তায়ালা সেই দু’দিনের পরিবর্তে সেগুলো অপেক্ষা উত্তম দুটি দিন তোমাদের দান করেছেন। একটি হলো আজহার দিন এবং অপরটি ফিতরের দিন।” (আবু দাউদ)

সেই থেকে মুসলমানদের বার্ষিক উৎসবের দিন হিসেবে এই দুটি দিন ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে পালিত হয়ে আসছে।

৩.  ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য ও মর্যাদা

শাওয়াল মাসের পহেলা তারিখে ঈদুল ফিত্র অনুষ্ঠিত হয়। এর পূর্বের মাস রমজান মাস। এ মাসে মুসলমানরা ফরজ হিসেবে সিয়াম সাধনা করে থাকে। পূর্ণ একমাস তারা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে পানাহার ও কামনা বাসনা পরিত্যাগ করে দীর্ঘ রাত জেগে তারাবিহ্র নামাজ আদায় করে। আবার ভোর রাতে সেহেরি খাওয়ার জন্যে জেগে উঠে। এ অনুশীলন গোটা রমজান মাস চলতে থাকে। পূর্ণ একমাস যে তারা এ কঠিন অনুশীলনের মাধ্যমে আল্লাহ্র ফরমান পালন করতে পেরেছে, তারই আনন্দ প্রকাশের জন্যে ইসলাম মুসলমানদের ঈদের জন্যে এদিন নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ হিসেবে দিনটি মুসলমানদের শুকরিয়া আদায় ও আনন্দ প্রকাশের দিন।

মুসলমানরা রমজান মাসে আল্লাহ্র নির্ধারিত পন্থায় পূর্ণ একমাস সিয়াম সাধনা করে। তারা যথাসাধ্য এ দায়িত্ব নির্ভুলভাবে পালন করার চেষ্টা করে। তারপরও মানুষ হিসেবে ভুলত্র“টি হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। সদাকাতুল ফিতর আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাদের সে ভুলত্র“টি মাফ করে দেন। ঈদ উপলক্ষে এ সদাকা প্রদানের অন্যতম তাৎপর্য হলো, এর দ্বারা গরিব ও নিঃস্ব মুসলমানরা ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে। তাই এই ঈদের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সদাকাতুল ফিতর।

ইসলামের পরিভাষায় সদাকাতুল ফিতর হচ্ছে সেই সদাকা, যা রমজানের রোজা শেষ করবার সাথে সাথে বিত্তবানগণ কর্তৃক বিত্তহীনদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।

রাসূলূল্লাহ (সা.) বলেছেন, ঈদুল ফিতরের দিন এলে আল্লাহ তায়ালা রোজাদারদের নিয়ে তার ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করেন। তিনি বলেন, হে আমার ফেরেশতারা, ঐ শ্রমিক কি পুরস্কার পেতে পারে, যে তার কার্য পূর্ণভাবে সম্পন্ন করেছে? ফেরেশতারা জবাব দেয়, প্রভু! তার পূর্ণ পারিশ্রমিক দিয়ে দেয়াই তার পুরস্কার।

আল্লাহ বলেন, হে আমার ফেরেশতারা, আমার দাস ও দাসীরা তাদের উপর ধার্যকৃত ফরজ (রোজা) পূর্ণ করেছে। অতপর আমার বড়ত্ব প্রকাশ করতে করতে দোয়ার জন্যে বেরিয়ে পড়েছে। আমার সম্মান, শৌর্য, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও উচ্চতার কসম, আমি অবশ্যি তাদের দোয়া কবুল করবো। এরপর তিনি তার বান্দাহ ও বান্দীদের সম্বোধন করে বলেন, যাও ফিরে যাও! আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম আর তোমাদের সমস্ত মন্দকে কল্যাণ দ্বারা পরিবর্তন করে দিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, অতপর তারা (ঈদগাহ থেকে) ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে যায়। (বায়হাকি)

৪. ঈদের দিনের সুন্নত কাজ

ঈদের দিন এমন কিছু করণীয় সুন্নত ও মুস্তাহাব কাজ রয়েছে, যা কিনা রাসূলে করিম (সা.) নিজের জীবদ্দশায় করে গেছেন। সেগুলো হচ্ছে :

সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদের সাজ পোশাকের ব্যবস্থা করা।

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠা।

মিসওয়াক করা।

ফজরের নামাজের পর ঈদের নামাজের জন্যে গোসল করা।

নতুন ও পরিচ্ছন্ন কাপড় চোপড় পরা।

সুগন্ধি ব্যবহার করা।

ঈদগাহে যাবার আগে সাদাকাতুল ফিতর পরিশোধ করা।

সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া।

ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাবার আগে কিছু মিষ্টি খাওয়া।

ঈদুল আজহার দিন কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া এবং কুরবানির পশুর কলিজা বা গোশ্ত দিয়ে খাওয়া আরম্ভ করা।

ঈদের নামাজ ঈদগাহে পড়া। নবী করিম (সা.) কেবলমাত্র বৃষ্টির দিন ঈদের নামাজ মসজিদে পড়েছেন।

পায়ে হেটে ঈদগাহে যাওয়া।

ঈদগাহে একপথে যাওয়া, অন্য পথে আসা।

ঈদগাহে যাবার সময় তাকবীর পড়া।

ঈদুল ফিতরে তাকবীর আস্তে পড়া এবং ঈদুল আজহায় উচ্চস্বরে পড়া।

ঈদের নামাজের পরে খুতবা দেয়া। খুতবা দেয়া সুন্নত, কিন্তু শোনা ওয়াজিব।

৫. রাসূলের যুগে ঈদ উৎসব

ঈদের বয়স ‘চৌদ্দশ’ বছর। চৌদ্দশ বছর ধরে মুসলিম উম্মাহ দুই ঈদ উদযাপন করে আসছে। রাসূলের যুগে রাসূলে করিম (সা.) ঈদের সূচনা করতেন দু’রাকাত নামাজ আদায় এবং একটি ভাষণ দানের মাধ্যমে। তিনি সাহাবাদের নিয়ে উম্মুক্ত মাঠে চলে যেতেন। সেখানে গিয়ে আজান এবং ইকামত ছাড়াই নিজের নেতৃত্বে সবাইকে নিয়ে দু’রাকাত নামাজ পড়তেন। নামাজের সালাম ফেরানোর পর তিনি সবাইকে বসতে বলতেন। সবাই বসে পড়তো। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতেন। তাদের উপদেশ নসীহত করতেন এবং পথ-নির্দেশনা দান করতেন। তিনি দুটি ভাষণ দিতেন। প্রথম ভাষণের পর ক্ষাণিকটা বসে আরেকটি ভাষণ দিতেন। দ্বিতীয় ভাষণে মুসলমানদের উন্নতি, সাফল্য ও কল্যাণের জন্যে দু’আ করতেন এবং ইসলামের শত্র“দের উপর বদদোয়া করতেন।

রাসূলের যুগে মহিলারাও রাসূলের সাথে মাঠে গিয়ে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে ঈদের সূচনা করতেন। রাসূল (সা.) পুরুষদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার পর মহিলাদের কাছে এসে তাদের উদ্দেশ্যে আলাদা ভাষণ দিতেন। তিনি তাদের বেশি বেশি দান করার উপদেশ দিতেন।

সমাজ, পরিবেশ ও নৈতিক অবনতির কারণে পরবর্তীকালে মহিলাদেরকে নামাজের জামাতে আসতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু নবী করিম (সা.)-এর জামানায় তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ন্যায় ঈদের জামাতেও শরিক হতেন এবং এজন্যে তাদের উৎসাহিত করা হতো। উম্মে আতীয়া (রা.) বলেন : “আমাদের (মহিলাদের) নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, আমরা যেনো ঈদে ঋতুবতী এবং পর্দানশীন মহিলাদের ঈদগাহের দিকে বের করে আনি, যাতে করে তারা মুসলমানদের জামাত ও দোয়ায় শরিক হতে পারে। তবে ঋতুবতী মহিলাদের নামাজ থেকে আলাদা থাকতে বলা হয়েছে।” (বুখারি, মুসলিম)

রাসূলে করিম (সা.) ঈদগাহে যেতেন একপথে আর ফিরে আসতেন অপর পথে। পথিমধ্যে তকবীর পড়তেন। সালাম-কালাম এবং মুসাফাহা ও গলাগলি করতেন। দরিদ্রদের খোঁজ খবর নিতেন। দান-সদাকা করতেন। সকলকে ঈদের আনন্দে শরিক করতেন।

এভাবে রাসূল (সা.) এবং সাহাবাগণ আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে সূচনা করতেন ঈদের। তারপর মানুষের কল্যাণ ও সেবা করার মাধ্যমে খুশি ও আনন্দ ছড়িয়ে দিতেন ঘরে ঘরে, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে।

৬. বিশ্বাসের বিশ্বজনীন উৎসব

সারা বিশ্বের একশ পঞ্চাশ কোটি মুসলমানের হৃদয় জুড়ে ঈদ আসে প্রতি বছর। ঈদের আনন্দ অনুভব করে মুসলিম সমাজের প্রতিটি সদস্য। ঈদ ধনী গরিব, সাদা কালো সকল মুসলমানের জন্যেই সমান। আরব আজম তথা এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া- যেখানেই আছে মুসলিম, সেখানেই আছে ঈদ। ঈদের আনন্দে সকল মুসলমানের সমান অধিকার। ভৌগলিক সীমানার সাথে নেই এর কোনো সম্পর্ক। এর সম্পর্ক বিশ্বাস ও আদর্শের সাথে।

মুসলিম কোনো ভৌগোলক জাতি নয়, ভাষা কেন্দ্রিক জাতি নয়, নয় নিরেট কোনো ধর্মীয় জাতি। মুসলমান একটি উম্মতের নাম। ‘মুসলিম উম্মাহ’ হিসেবে এর পরিচয়। কতগুলো সুনির্দিষ্ট বিশ্বাস ও বিধানের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে এ উম্মাহ। তাই এটি একটি আদর্শিক উম্মাহ। অর্থাৎ মুসলমান একটি আদর্শিক জাতির নাম। সারা বিশ্বের মুসলমান একই বিশ্বাস ও বিধানের অনুসারী। একই সাংস্কৃতিক মূল ধারার অধিকারী তারা। কারণ তাদের সভ্যতা সাংস্কৃতি তো তাদের আদর্শ প্রসূত।

সারা বিশ্বের মুসলমান এক আল্লাহ্তে বিশ্বাসী, রিসালাতে বিশ্বাসী, আখিরাতে বিশ্বাসী। এক কিতাব আল কুরআনের তারা অনুসারী, এক রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-এর তারা অনুগামী। এক আল্লাহ্র সন্তুুষ্টি ও তাঁর পুরস্কারের তারা আকাংখী। তারা সকলেই আল্লাহ্র শাস্তি থেকে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট। সুতরাং গোটা বিশ্বের সমস্ত মুসলমান একমুখী। রাসূলে করিম (সা.) বলেছেন :

“গোটা মুসলিম উম্মাহ্ এক দেহ স্বরূপ। তার কোনো একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটা দেহ কষ্ট অনুভব করে।”

সত্যি তাই। দূর প্রাচ্যের ফিলিপিন, মধ্য এশিয়ার আফগানিস্তান, মধ্য প্রাচ্যের সিরিয়া, ফিলিস্তিন, আফ্রিকার আলজেরিয়া, ইউরোপের বসনিয়া চেচনিয়ায়ও যদি কোনো মুসলমান বিপদগ্রস্ত হয়, তবে সেজন্যে বাংলাদেশের মুসলমান দু:খ অনুভব করে, তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। দু:খের মতো মুসলমানদের একজনের আনন্দও সকলের। মূলত একই বিশ্বাস ও আদর্শের রজ্জুতে বাঁধা বলেই তারা মানসিকভাবে পরস্পর এতোটা আপন।

৭. বাংলাদেশে ঈদ উৎসব

ইতিহাসের কালতিক্রম করে ঈদের সেই ঐতিহ্য চলে এসেছে আমাদের কালেও। মদীনার সেই ঈদ ছড়িয়ে পড়েছে কালক্রমে সারা বিশ্বে।

বাংলাদেশ একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ। এখানে ঈদ আসে মহাসমারোহে। ঈদ উদযাপনের জন্যে এখানে প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় মাস খানেক আগে থেকেই। আবার ঈদ চলে যাবার পরও এর আমেজ থাকে প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে।

আমাদের মাঝে বছর ঘুরে আসে ঈদুল ফিতর। রাসূলে করিম (সা.) এই ঈদকে সার্বজনীন করার জন্যে এক অনুপম ব্যবস্থা দিয়ে গেছেন। সমাজে যারা দরিদ্র, অর্থের অভাবে ঈদের খুশিতে শরিক হতে পারেনা, তারা যেনো ঈদের খুশিতে শরিক হতে পারেন, সেজন্যে রাসূলে করিম (সা.) বিত্তবানদের উপর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য সামগ্রী বা তার মূল্য দরিদ্র মুসলিমদের দান করার নির্দেশ দিয়েছেন। তা যেনো ঈদ শুরু হবার আগেই দেয়া হয়, সে নির্দেশও দিয়েছেন। এই দানটির নাম সদাকাতুল ফিতর বা ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দান। বাংলাদেশের মানুষ দানশীল। সদাকাতুল ফিতর ছাড়াও তারা এ মাসে ব্যাপকভাবে অভাবীদের দান করেন।

৮. ঈদের সাজ ও বাজার

ঈদ উপলক্ষে সারা বিশ্বের মুসলিমদের মতো বাংলাদেশের মুসলিমদের মধ্যেও আরেকটি প্রথা সেই প্রথম থেকেই চলে আসছে। তাহলো নতুন জামা কাপড় কেনা। ঈদ আসার পনের বিশ দিন আগে থেকেই কেনা কাটার ধুম লেগে যায়। বাজারেও আসে নতুন নতুন ডিজাইনের জামা কাপড়। সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেক পরিবারেই নতুন নতুন জামা কাপড় কেনা হয়। নিজেদের জন্যে কেনা হয়। আত্মীয়-স্বজনের জন্যে কেনা হয়। বন্ধু বান্ধবদের উপহার দেয়া হয়। এতিম, বিধবা ও গরিবদের দান করা হয়। অনেক লোক ঈদ উপলক্ষে জাকাতের টাকা দিয়ে গরিবদের জামা-কাপড় কিনে দেন। এভাবে ঈদ উপলক্ষে কদাচিৎই কোনো মুসলিম নতুন জামা কাপড় থেকে বঞ্চিত থাকেন।

ঈদের সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের হাট বাজারগুলো হয়ে উঠে জমজমাট। বাংলাদেশের বাজারগুলোতে তো ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে থেকে ঢোকাই মুশকিল হয়ে পড়ে। পুরুষ, মহিলা, শিশু, কিশোর সকলেই বাজারে যায়। প্রচণ্ড ভীড়ের চোটে অনেক মহিলা বাজারে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অনেক অসৎ ব্যবসায়ীরা ঈদের সময় জিনিসপত্রের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এসময় কালো বাজারীরাও তৎপর হয়ে উঠে। সরকারের উচিত ঈদের সময় বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা।

৯. মেহমানদারির সার্বজনীন ঈদ

ঈদ উপলক্ষে সার্বজনীন মেহমানদারির রেওয়াজও প্রচলন করা হয়েছে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব এবং যে কোনো মুসলমান যে কোনো মুসলমানের বাড়িতে মেহমান হতে পারে। মেহমানদারী করা এবং মেহমান হওয়া ঈদের অনিবার্য অংশ। সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা আগে থেকেই মেহমানদারী করার প্রস্তুতি নেন। এমনকি দরিদ্র মুসলমানরাও ঈদের দিন কিছু না কিছু মেহমানদারি করার প্রস্তুতি নেন। ঈদের দিন মুসলমানদের ঘরে সাধারণ আমন্ত্রণ থাকে। মেহমান এলে ধনী-গরিব প্রতিটি মুসলমান আনন্দ অনুভব করেন। প্রত্যেকেই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী মেহমানদারী করেন। আমন্ত্রণ, আপ্যায়ন ও মেহমানদারীর এই ধারাবাহিকতা ঈদের পরেও কয়েকদিন চলতে থাকে।

ঈদ উপলক্ষে নানা রকম খানা পাকানো হয়। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা আইটেম সংখ্যা বাড়াতে থাকেন। প্রতি বছরই পুরাতন আইটেমের সাথে কিছু নতুন আইটেম যুক্ত করা হয়। মহিলাদের মধ্যে খাবার তৈরির ধুম পড়ে যায়। তারা নানা রকম সুস্বাদু খাবার তৈরি করেন। খাবার তৈরি করে তারা দারুণ আনন্দ পান এবং তার চাইতেও বেশি আনন্দ পান মেহমানদারী করে।

১০. অনাবিল আনন্দের ঈদ

ঈদুল ফিতরে ঈদের নামাজ পড়ার পরই শুরু হয় বেড়াবার এবং মেহমানদারী করার পালা। ঈদের দিন বাংলাদেশের রাস্তাঘাট-ঘরবাড়ি ঈদময় হয়ে উঠে। আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের বাড়ি যাওয়া আসাতে গ্রাম গঞ্জ, শহর বন্দর মুখরিত হয়ে উঠে। সবাই নতুন নতুন জামা কাপড় পরে দলে দলে এবং একাকী যাওয়া আসা করছে। যাদের পক্ষে সম্ভব তারা আতর-সুগন্ধি লাগিয়ে বেরুচ্ছে। ফলে ঈদের দিন সৃষ্টি হয় এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ও পরিবেশের।

ঈদগাহে, রাস্তাঘাটে, ঘরে ঘরে, বাড়িতে বাড়িতে অবতারণা ঘটে আরেকটি মনমাতানো দৃশ্যের। সেটি হলো সালাম আদান প্রদানের, হাতে হাত মিলানোর, বুকে বুক মিলানোর এবং গলাগলি করবার দৃশ্য! কী মনোরম দৃশ্য! যেনো এ সমাজের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের আপনজন। হায়, আমাদের প্রতিটি দিনই যদি ঈদের দিনের মতো হতো!

শিশু কিশোররা ঈদকে উপভোগ করে সবচেয়ে বেশি। ঈদ সমাগত হলে ওরা অধীর হয়ে পড়ে। ঈদকে বরণ করার জন্যে ওদের ব্যস্ততা থাকে সবচেয়ে বেশি। ওদের কিন্তু নতুন জামা কাপড় চাই-ই। শিশু কিশোররা যখন নতুন জামা কাপড়-টুপি পরে ঈদগাহে যায়, তারা যখন কোলাকুলি করে, যখন মেহমান হয় এবং মেহমানদারী করে, তখন সেটা হয় সবচাইতে বেশি আনন্দের।

আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে ঈদের আরেকটি বড় আনন্দ আছে। সেটা হলো, যারা শহরে চাকরি করে, ব্যবসা করে, পড়ালেখা করে, ঈদ উপলক্ষে তারা গ্রামে ফিরে। ঈদের ছুটি আসার আগে থেকেই তাদের বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। গ্রামের বাড়িতে বাবা মা, স্ত্রী, পুত্র কন্যা, ভাইবোন এবং অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের জন্যে তারা সামর্থ্য অনুযায়ী কেনাকাটা করেন। এভাবে গ্রামের বাড়ির ঈদকে সাধ্যানুযায়ী খুশিতে আনন্দে ভরে দেবার মতো প্রস্তুতি নিয়ে তারা রওয়ানা করেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। এসময় বাড়ি যাবার কষ্ট সীমাহীন। যানবাহনে ঠাঁই নেই। বাস-ট্রেনের ছাদে উঠে এবং দরজায় ঝুলে জীবন বাজি রেখে রওয়ানা করেন অনেকে।

ওদিকে বাড়ির আপনজনরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ থাকেন - কখন এসে পৌঁছুবে তার কলিজার টুকরা। মা ছেলের পথ চেয়ে থাকেন, স্ত্রী স্বামীর পথ চেয়ে থাকেন, সন্তানেরা বাবার পথ চেয়ে থাকে। শেষমেশ আপনজনরা নিদারুণ কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি এসে পৌঁছায় আর ভুলে যায় পথের সমস্ত কষ্টের কথা। আপনজনদের পেয়ে বাড়ির লোকেরাও হৃদয়াবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠে।

আসলে ঈদ ইসলামী উম্মাহর এক অনন্য কালচার। ঈদ ইসলামী সমাজে বয়ে আনে ঐক্য ও একতার বারতা। ঈদ ইসলামী সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে ভ্রাতৃত্ববোধে, সহমর্মিতায়। ঈদ মিলনের ও আপনত্বের বার্তা বয়ে আনে। ঈদ মুসলমানের হৃদয়কে উন্মুক্ত ও প্রসারিত করে দেয় আকাশের মতো। ঈদ দূর করে দেয় জীবনের সব গ্লানি, হৃদয়ের সব কালিমা। ঈদের দিনের খোলা হৃদয়, মিষ্টি হাসি আর ঐক্য ও একতার এই অনুপম আবেশ বর্তমান ঘুণে ধরা মুসলিম সমাজকে গড়ে তুলতে পারে, উন্নত ও শ্রেষ্ঠতম জাতি হিসেবে।

তাই আমাদেরকে ঈদের শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে। একমাস সিয়াম সাধনার পর আমাদের সামনে সমাগত হয় ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতর মূলত রোজা ভাঙ্গার খুশির দিন। একমাস ঠিকমতো রোজা আদায় করতে পারার খুশির দিন।

১১. প্রশিক্ষণ কোর্সের সমাপনী উৎসব

ঈদ মাসব্যাপী মহান আল্লাহর গোলামি ও তাবেদারিতে নিজেকে নিবেদিত করতে পারার খুশির দিন। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার সময় একজন মুসলমান যে সততা, সত্যনিষ্ঠা ও আল্লাহভীতির পরিচয় দিয়েছে, সারা বছর সেটাই তার জীবনাদর্শ হওয়া উচিত। সূর্যোদয়ের আগেই সে সেহেরি খাওয়া শেষ করে দেয়। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সে পানাহার বন্ধ করে দেয়। এমনটি করে সে আল্লাহ্র নির্দেশ পালন করে। সারাদিন দিনের বেলায় সে ক্ষুধায় পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ে, কিন্তু পানাহার করেনা। কামনা বাসনা চরিতার্থ করেনা। পানাহার ও কামনা চরিতার্থ করার কোনো সুযোগই সে গ্রহণ করেনা। কারণ, সে এক আল্লাহ্কে ভয় করে। সে কারো দাসত্ব করে না, দাসত্ব করে এক আল্লাহ্র। সূর্যাস্তের সাথে সাথে সে রোজা শেষ করতে বিলম্ব করেনা। এক্ষেত্রেও সে সময় মতো ইফতার করে আল্লাহ্র নির্দেশেরই অনুবর্তন করে।

পুরো এক মাসব্যাপী মুসলমান এভাবে আত্মসংযম, সততা, সত্যনিষ্ঠা, আল্লাহ্ভীতি, আল্লাহ্র গোলামি ও আনুগত্য এবং নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতার যে অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে, ঈদুল ফিতর সেই মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ কোর্সের সমাপনী উৎসব অনুষ্ঠান। এ দিনটি মাসব্যাপী সফল প্রশিক্ষণ গ্রহণের সমাপনী উৎসবের দিন।

রমজানের এক মাসের প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে যদি বছরের বাকি মাসগুলোতে সততা ও দক্ষতার সাথে জীবনের সমস্ত কাজ পরিচালনা করা হয়, তবেই মুসলিম জাতি হিসেবে আমরা ফিরে পেতে পারি আমাদের সেই হারানো গৌরব। তবেই সফল হতে পারে আমাদের ঈদ। আমরা কি পারিনা আমাদের ঈদের আনন্দকে রোজার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে জীবন ও সমাজ পরিচালনার দীপ্ত শপথে পরিণত করতে? আমরা কি পারিনা ঈদের শিক্ষার ভিত্তিতে আমাদের সমাজ বিনির্মাণের শপথ নিতে?

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।