সংবাদ শিরোনামঃ

তুরস্কে জনতার বিজয় ** এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্কের জনগণ রুখে দিল সেনা অভ্যুত্থান ** সঙ্কট নিরসনে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ** ২০ দলীয় জোট ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র ** তুর্কী গণপ্রতিরোধে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান ** রফতানি বাণিজ্যের নতুন চ্যালেঞ্জ : রাজনৈতিক অস্থিরতা ** মানবতাবাদী বিশ্ব ও সন্ত্রাসবাদী বিশ্বের মাঝখানে মুসলমানদের দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে ** সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে প্রয়োজন দলমত নির্বিশেষে সবার ঐক্য : নজরুল ইসলাম খান ** তুর্কী জনগণকে অভিনন্দন ** জাতীয় স্বার্থ বনাম হুকুম তামিল করার দৌড়ঝাঁপ ** এ শিক্ষা আমাদের কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ** দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজেও হরিলুটের অভিযোগ ** দুর্ভোগের আরেক নাম পাইকগাছার কপিলমুনি শহর ** কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক সঙ্কট : সেবা কার্যক্রম ব্যাহত ** কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা ** ইসলামী সংস্কৃতির আলোকেই হোক ঈদ আনন্দ ** বাংলা ভাগের জন্য মুসলমানরা নন হিন্দুরাই দায়ী ** কবির বিশ্বাস ** সানজিদা তাহসিনা বেঁচে থাকবে সবার মাঝে ** জাতির নিকট রেখে গেলেন অনেক প্রশ্ন **

ঢাকা, শুক্রবার, ৭ শ্রাবণ ১৪২৩, ১৬ শাওয়াল ১৪৩৭, ২২ জুলাই ২০১৬

উ প ন্যা স

গদ্যময় জীবন

মোশাররফ হোসেন খান
এমনটি যে ঘটবে তা আগে থেকেই কিছুটা বুঝা গিয়েছিল। কথায় বলে, সময়ের এক ফোঁড়-অসময়ের দশ ফোঁড়।

বাসা থেকে বেরুতে আজকাল প্রায় প্রতিদিনই দেরি হয়ে যায় রশিদের।

সাত সকালে উঠেও কোন লাভ হচ্ছে না। এটা, সেটা কত ঝামেলা। গুছিয়ে বেরুতে সেই দেরি। এ থেকে তার যেন আর নিস্তার নেই।

মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় রশিদের।

তারপরও যদি হাতের কাছে সব কিছু পাওয়া যায় তবুও হয়। ঘড়ি মেলো তো চিরুনি নেই। চশমা পাওয়া যায় তো চাবির কোনো হদিস মেলে না।

কী যে হয়েছে!

প্রতিদিনই এটা-সেটা রেখে যায় মনের ভুলে। যখন সেটার প্রয়োজন পড়ে, কেবল তখনই তার খোঁজ হয়।

-কই, কি হলো!-

শব্দটা একটু জোরেই বেরিয়ে এল রশিদের কণ্ঠ থেকে। রুমানা তখনও রান্নাঘরে খুটখাট করছে।

রশিদ জামা কাপড় পরতে পরতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র খোঁজ করছে।

চিরুনিটা কোথাও পেল না এ ঘর ও ঘর করতেই তার বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেল। নিপাত যাক চিরিুনি।

রশিদ চিরুনির চিন্তা বাদ দিয়ে এবার জুতো পরতে গেল। একটা পেল।

অন্যটা গেল কোথায়?

আবার খোঁজাখুঁজির পালা।

-নাহ আর ভাল লাগে না। তুমি কি এদিকে একটু আসবে। জুতো পাচ্ছিনে।-

রুমানা চায়ের কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এল। বললো,

-নাও, তুমি বসে চা খেতে থাকো আর আমি জুতো খুঁজি।

-এমন হলে কি করে পারবো। আজও অফিসে পৌঁছতে নির্ঘাত এক ঘণ্টা লেট হবে।

-দু’একদিন একটু দেরি হলে কিছু হবে না।

-সেটা তো তোমার কথা। চাকরি কাকে বলে তাতো আর জানো না। বুঝতেও চেষ্টা কর না।

-খোঁচা মেরে ছাড়া কথা বলতে পার না।

-না, পারি না।

-তা পারবে কেন?-

-দেখ, অফিসে যাবার সময় মেজাজটা আর খারাপ করে দিও না।

-আমি তোমার কি করলাম?

-কেন, আমার অফিসে যাবার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো একটু গুছিয়ে রাখতে পার না। এক জায়গায় রাখলেই তো হয়। প্রতিদিন এ ধরনের ঝামেলা ভাল লাগে না।

-তোমার জুতো কি আমি লুকিয়ে রেখেছি, যে আমার ওপর ঝাল ঝাড়ছো।

-কেউ লুকোয়নি। কিন্তু একটা জুতো গেল কোথায়? আর এটা কি কোনো কাজের কথা?

রুমানা খাটের নিচে, টেবিলের নিচে, তারপর বারান্দার হাবি-জাবি তছনছ করে অবশেষে পেল জুতোটা। সেও ঘেমে গেছে। আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বললো, নাও।

-কোথায় পেলে?

-সেটা জেনে আর লাভ কি? পাওয়া গেছে, এখন পরে নাও।

-কিন্তু এখনি দেখ ওটা কে নিয়ে গেল?

-সেকি আমি জানি?

-বারে, তুমি জানো না। তাহলে কি জুতোর পা গজিয়েছে।

রুমানা শান্তভাবে বললো,

আহ! রাগছো কেন!

সম্ভবত এটা আদনানের কাজ। হয়তো তোমার জুতো দিয়ে ব্যাট বানিয়েছে।

-কি বললে! জুতো দিয়ে ব্যাট বানিয়েছে।

-তাইতো মনে হয়।

-এত বড় সাহস।

হেসে উঠলো রুমানা। এতে আবার সাহসের কি দেখলে? ছেলেটা কতদিন ধরে একটি ব্যাটের জন্যে বায়না ধরেছে। পেরেছ তাকে একটা ব্যাট কিনে দিতে? পারনি।

-তাই বলে আমার জুতোকে ব্যাট বানাবে?

-তাছাড়া আর কি দিয়ে বানাবে শুনি। দশটা না, পাঁচটা না, একটা মাত্র ছেলে। তাও তো কোনো বায়না ধরে না। ওই একটিমাত্র ব্যাট ছাড়া। সেটাও তুমি তাকে দিতে পারলে না। আজো।

-রুমানা।

-দাও আমাকে যত খুশি ধমক দাও। এটাতো খুব সহজ কাজ।-

-আহা! ধমক নয়। তুমি এখন, এই অফিসে যাবার সময় ছাড়া আর কোনো সময় পেলে না অভিযোগ করার।

-তাতো বলবেই। আমি কেবল অভিযোগ করি। আমার নিজের জন্যে কি কিছু চেয়েছি কখনো? মেয়েটা যে প্রতিদিনই এটা-ওটার জন্যে বায়না ধরে, তাও কি তোমাকে বলি। তোমার সামান্য একটু কিছুতে অসুবিধা হলেই অমনি হইচই শুরু করে দাও। আমি কি সারাদিন শুয়ে-বসে থাকি? সেই ভোরে উঠে বাঁদীর মতো কাজে লেগে যাই। নাস্তা বানানো, মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, আনা, ছেলের স্কুলে পাঠানো, দুপুরের রান্না, রাজ্যির কাপড়-চোপড় ধোয়া, ঘরদোর, কাপড় চোপড় গোছানো-একটা মিনিটও তো অবসর পাইনে। তারপরও তোমাকে খুশি করতে পারলাম না। কোনো ঝি-চাকরও এতটা খাটে না।

বলতে বলতে রুমানার চোখ দুটো ভিজে গেল।

রশিদের মাথাটা ভারী হয়ে উঠলো। রুমানার কথা শুনতে শুনতে।

কথায় কথা বাড়ে। তারচেয়ে চুপ থাকাই ভালো। সে জুতো পরে ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

রাস্তায় নেমেই রিকশার খোঁজ।

এই রিকশা যাবে?- যাবে না।

আবার খোঁজা।

এভাবেই হাঁটছে আর রিকশা খুঁজছে।

এমন সময়ে রিকশাওয়ালাও বেশ মৌজে থাকে।

অফিস টাইম।

মওকাটা তারা ভালো করেই বোঝে। ঘাপটি মেরে থেকে দাও মারে। পনের টাকার ভাড়া বিশ টাকা। বিশ টাকারটা ত্রিশ টাকা।

অসহায় অফিসগামী মানুষ।

বাধ্য হয়ে উঠে পড়ে একটায়। অফিস বলে কথা। চাকরি তো আগে বাঁচুক। বহু পথ হাঁটার পর একটা রিকশা পেল রশিদ। ভাড়া আগের মতোই।

বাসার কাছ থেকে উঠলে যা দিতে হত, এখনও তাই।

পথ কমেছে, কিন্তু ভাড়া কমেনি।

অসহায় রশিদ।

অগত্যা তাতেই রাজি হয়ে উঠে পড়লো।

রিকশায় ওঠার পর তার মনের মধ্যে একটু খচ করে উঠলো। একেতো টানাটানির সংসার। তার ওপর মাসের শেষ দিক। এই সময়ে এতগুলো টাকা রিকশা ভাড়া দেয়া তার জন্যে খুব কঠিন কাজ। কিছুটা বেদনারও।

দেরি হয়ে গেলে যা হয়।

রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। পনের মিনিটের পথ লেগে গেল এক ঘণ্টা। তাও কত ঝক্কি-ঝামেলা।

খুব সকালে বেরুলে একদিকে যেমন বাসে করে ধীরে সুস্থে আসা যায়, তেমনি কিছু আর্থিক সাশ্রয়ও হয়। কিন্তু সেটা প্রায় আজকাল হয়ে উঠছে না। কারণ ইদানীং তার প্রায় প্রতিটি রাতই কেটে যাচ্ছে নির্ঘুম।

রাতে ঘুম না হবার কারণে দিনের সব কাজই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

কোনটাই সুশৃঙ্খলভাবে হচ্ছে না।

হবার কথাও নয়।

মনের মধ্যে যখন ঢেউ খেলে যায় উত্থাল-পাথাল, হৃদয়ের চাতাল যখন ভাঙতে শুরু করে, তখন আর দেহটিই বা স্থির থাকে কেমন করে। শরীরের ওপরেও তার প্রভাব পড়ে।

সেটাই কী স্বাভাবিক।-

বহু কষ্টে রিকশাওয়ালা পৌঁছুলো গন্তব্যে।

এবার তাকে ভাড়া গুণে দেবার পালা।

রিকশা থেকে নেমে পাশ পকেটে হাত দিতেই তার বুকটা কেঁপে উঠলো।

কী ব্যাপার।

মানিব্যাগটা গেল কই।

পথে কয়েকবার জ্যামে পড়েছে রিকশা। কোনোভাবে মানিব্যাগটা কেউ বের করে নেয়নি তো। নাকি সেটা আদৌ আনা হয়নি।

কিছুই ভাবতে পারছে না রশিদ।

দুর্ভাবনা, অস্বস্তি আর অশান্তিতে সে কেবলই ভেতরে ভেতরে কাঁপছে। এ পকেট ও পকেট হাতড়েও যখন টাকা বা মানিব্যাগের কোনো হদিস পেল না, তখন বাধ্য হয়ে রিকশাওলাকে একটু অপেক্ষা করতে বললো।

রিকশাওয়ালাও খুব ত্যাদড়। তার কথায় কোনো রসকষ নেই। কেমন রুক্ষভাবে বললো,

-এইভাবে রাস্তায় খাড়াইয়া থাকুম আর আপনে দিব্যি হাওয়া হইয়া যান। তা হবে না। ট্যাকাটা দিইয়া যান।

-আরে দেব তো। তুমি একটু দাঁড়াও। এক মিনিট। যাব আর আসবো।

-ওরহম তো কত জনই কয়। আর ফেরে না। কমতো আর দ্যাখলাম না।

-বলছি তো আমি এখনিই আসছি। প্লিজ ভাই, একটু অপেক্ষা কর। আমি অন্যদের মতো নই।

-হাছা-মিছা ক্যাডা জানে। যান।-

তার কণ্ঠেও ধমকের সুর।

রশিদের দমটা ভারী হয়ে উঠলো। আরও বেশি।

এও কী এক ধরনের লাঞ্ছনা।

এই লাঞ্ছনার শেষ কোথায়? জানে না সে।

খুব দ্রুত অফিসে ঢুকে এক সহকর্মীর কাছ থেকে বলে-কয়ে রিকশা ভাড়াটা নিয়ে আবার দৌড় দিল রাস্তার দিকে।

এদিক-ওদিক কত খোঁজা-খুঁজি। নাহ। তাকে কোথাও পাওয়া গেল না।

তাহলে কি সে আদৌ বিশ্বাস করতে পারেনি। সেকি মিথ্যুক রাজনৈতিক নেতাদের মতোই মনে করেছে আমাকে।

কী এক লজ্জা, কী এক বেদনা, অপমান আর কষ্টের তীব্র-তীক্ষè যন্ত্রণার কাঁটায় কেবলই বিদ্ধ হতে থাকলো রশিদ।

সামান্য একজন রিকশাওয়ালা তাকে বিশ্বাস করতে পারলো না কেন?

কেন তার ওপর এতটুকু আস্থা রাখতে পারলো না?

তাহলে কি বিশ্বাস এবং আস্থা-দুটোই সমাজ-সংসার থেকে উঠাও হয়ে গেছে?

এ জন্য। কি সমাজ-সংসারে আজ এত হানাহানি, এত অশান্তি আর এত অস্থিরতা।

স্বস্তি পাচ্ছে না রশিদ।

হাতের মুঠোর মধ্যে টাকা। রিকশা ভাড়া। যেটা ছিল তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক।

কিন্তু কী দুর্ভাগ্য!

তাকে সেটা দিতে পারলো না।

অপমান আর আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হতে হতে সে ফিরে এলো অফিসে। সহকর্মীকে টাকাটা ফেরত দেবার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিল নীরবে, নিঃশব্দে।

তার মুখে বিষণœà¦¤à¦¾ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। কেমন মলিন, কেমন বেদনার ভাঁজগুলো ভেসে উঠেছে। ঠিক বাংলাদেশের বিধ্বস্ত সমাজের মতো।

টাকা ফেরত দিতে দেখে সহকর্মী জাদরুল জিজ্ঞেস করলো,

-কি ব্যাপার রশিদ ভাই, রিকশা ভাড়া দেবার জন্যে নিয়া গেলেন, আবার এক্ষুণি ফিরিয়ে দিচ্ছেন?

রশিদের মুখ দিয়ে খুব কষ্টে বেরিয়ে এল-

-গিয়ে দেখি, সে নেই।

-নেই মানে!

-কি জানি। তাকে কোথাও পেলাম না।

 à¦¹à§‡à¦¸à§‡ উঠলো জাদরুল। বললো, রিকশাওয়ালা বোধ হয় পোড়খাওয়া। সেই জন্য সে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারেনি।

-তার মানে?

-মানে তো সহজ। অনেকেই এমনটি করে। দাঁড়াও বলে সে হাওয়া হয়ে যায়। বেচারা রিকশাওয়ালা অপেক্ষা করতে গিয়ে দুদিক থেকেই মার খায়। না পায় ভাড়ার টাকা, আর না পায় অন্য যাত্রী। এই কারণে ওরাও এখন হরিণের মতো সতর্ক।

-তাই বলে আমাকেও বিশ্বাস করবে না।

-আপনি বিশ্বাস্যযোগ্য কি-না তা ওরা জানবে কীভাবে?

-বলেন কি!

-এটাই সে বাস্তব বলে মনে করেছে।

ভেবেছে, ‘আর টাকা পাওয়া যাবে না। এখন অন্য যাত্রীর সন্ধানে যাই।’ ওদের কোনো দোষ নেই ভাই। এই আমরা, ভদ্রবেশিরাই ওদেরকে এমন সন্দেহপ্রবণ এবং আতঙ্কিত করে তুলেছি।

-কিন্তু ওর কাছে তো আমি ঋণী। এই ঋণ কীভাবে পরিশোধ করবো। যতদিন ওকে না পাচ্ছি, ততোদিনই তো আমি দায়বদ্ধ থাকছি।

-কি আর করবেন। প্রতিদিন খোঁজ করতে থাকুন।

-কিন্তু এর চেহারাটাও তো আমার মনে নেই।

-আপনি চিনতে না পারলেও সে ঠিকই আপনাকে চিনে রেখেছে। পথে কোনোদিন দেখা হলে দেখবেন, সেই আপনাকে চিনে নেবে। হাজার হোক, ওদের ঘামঝরা উপার্জন তো! কেমন করে। মানুষ সুখের কথা ভুলে যায়। কিন্তু ভুলতে পারে না কেবল কষ্টের কথা। নিঃশ্বাসের মতোই এটা সবাই ধারণ করে থাকে।

-ঠিকই বলেছেন। দোয়া করুন, আমি যেন ওর ঋণ শোধের সুযোগটা পাই।

রশিদ চেয়ারে এসে বসলো।

রশিদ, নাকি বিশ্বস্ত এক জড়পদার্থ, কিংবা খোলশূন্য মৃত পেঁপে গাছের পচা খোলস।

তার মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।

অনবরত ঘামছে। এখন মনে পড়লো, সকালে প্রেসারের ওষুধটা খেতেও সে ভুলে গেছে।

সম্ভবত প্রেসার বেড়ে গেছে। সেই সাথে হৃদস্পন্দনটাও। কামার শালার হাফর যেন। কেবলই ওঠানামা করছে।

এই মুহূর্তে তার ক্ষোভ আর রাগটা গিয়ে পড়লো, রুমানার ওপর।

কেন, সে একটু খোঁজ-খবর রাখতে পারে না।

সময় মতো যদি হাতের কাছে ওষুটা পেতাম তাহলে কি আর এই অবস্থা হতো। কোন দিকেই বা সে খেয়াল রাখে।

বুঝবে, যদি ঝড়ে ভাঙা কলাগাছের মতো কাত হয়ে পড়ে থাকি।

হাড়ে হাড়ে বুঝবে তখন। বেখেয়াল থাকার মজাটা কি।

সীমান্ত প্রহরী আর স্ত্রীর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য খুঁজে পায় না সে। দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তারা একটু বেখেয়াল হলেই সমূহ বিপদ।

আবার একটু পরেই ভাবে। তারই বা দোষ কি।

দুটো ছেলে-মেয়ের দেখাশুনা করা, সংসারের যাবতীয় কাজ কাম-এর মধ্যে আবার সংসারের সকল দায়-দায়িত্ব পালন করা-এমন কি কাঁচা বাজারসহ সব কিছুই তো তাকে সামলাতে হয়। এত ঝক্কি-ঝামেলা সামাল দেয়া কম নয়।

রুমানার প্রতি এতক্ষণ যে অভিযোগ ছিল, এখন তার বদলে এক ধরনের সমবেদনা এবং কৃতজ্ঞতাবোধ এসে স্থান করে নিল।

এ যেন দারুণ খরার পর এক পশলা বৃষ্টির প্রতি সকৃতজ্ঞ দৃষ্টি।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো রশিদ।

বাথরুমে ঢুকে হাতে মুখে পানি দিয়ে একটু ফ্রেশ হবার চেষ্টা করলো। মাথায় পানি দিল।

বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়ালো। তারপর নিজেকে দাঁড় করালো অনন্ত জিজ্ঞাসার মুখোমুখি।

কোনো জবাব নেই। প্রশ্নই কেবল স্থির।

কিছুতেই স্থির কিংবা শান্ত হতে পারছে না রশিদ।

কী এক অশান্তির আগুন কেবলই জ্বলে উঠছে ভেতরে।

সে অস্থিরভাবে বাথরুম থেকে বেরিয়ে চেয়ারে এসে বসলো।

পিওনকে ডেকে চা দিতে বললো।

চায়ের কাপে কেবল চুমুক দেবে, এই সময়ে রুমে প্রবেশ করলো আমিন।

তার এলাকার ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।

রুমের দক্ষিণের জানালা দিয়ে ফুরফুর করে বাতাস ঢুকছে। সামনে দুলছে জানালার পর্দা দোল খাওয়া খেজুরের পাতার মতো।

পিওনকে ডেকে তার জন্য আর এক কাপ চা দিতে বললো। তারপর আমিনকে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছ?

-ভালো।

-এর মধ্যে কি বাড়িতে গিয়েছিলে?

-হ্যা, এইতো এলাম।

-আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলে?

-জ্বি।

-বাড়ির সবাই ভালো আছো তো?

-তা একরকম আছে। চাচাজিকে দেখলাম বেশ অসুস্থ। এখন আর বাজারেও যেতে পারেন না। তিনি আপনার কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।

-কই?

-এই তো, নিন।

কাপের চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল নেই রশিদের। আকর্ষণও নেই।

তার সামনে এখন গড়ে না ওঠা বহুতল ভবনের বহু পুরনো, বিবর্ণ নকশার মতো আব্বার চিঠি।

হরফগুলো কেমন বাঁকাতেড়া। বাক্যগুলোও প্রায় অসম্পূর্ণ। দু’একটা বানানও ভুল হয়ে গেছে।

আব্বার চিঠিতে এ যাবত যা ছিল অকল্পনীয়।

বাংলার পণ্ডিত হিসাবে সারা এলাকায় তার সুনাম-সুখ্যাতি। সবার মুখে মুখে।

সেই পণ্ডিত ব্যক্তির লেখার এই দুরবস্থা দেখে রশিদের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, তিনি কতটা অসুস্থ অবস্থায় কালযাপন করছে।

প্রচণ্ড রোদে পুড়ে যাওয়া ধানের লালচে পাতার মতো তার ফ্যাকাশে চেহারাটি ভেসে উঠলো রশিদের সামনে।

আব্বার চিঠির প্রতিটি বর্ণই একেকটি বিষাক্ত তীরের ফলার মতো বিঁধে যেতে থাকলো তার হৃদয়ের গভীর থেকে গভীরতম স্থানে।

কী বেদনা!

কী কষ্ট।

কী যে যাবতার কালিতে তিনি অক্ষরগুলো বসিয়েছেন, তা রশিদ অনুভব করতে পারলো।

কেন পারবে না।

তিনি তো তারই পিতা। তাকে বুঝে উঠতে এতটুকু তো কষ্ট হবার কথা নয়।

চিঠি পাঠের সাথে সাথে তার করণীয় কি-তাও জানান দিয়ে গেল তার বিবেক। এখন উচিত, বাড়িতে গিয়ে আব্বাকে সাথে করে এনে এখানে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। ছেলে হিসাবে এটা তার কর্তব্যও বটে। যে বৃক্ষ সারাটি জীবন ছায়া দিয়েছে, সেই বৃক্ষের প্রতি অবহেলা বা কর্তব্যহীনতা-সে তো অকৃতজ্ঞতারই নামান্তর।

কর্তব্য!

এখানে এসেই হোচট খেল রশিদ।

কত কর্তব্যই তো রয়ে গেল। একটাও সে পালন করতে পারছে না। সংসারের কত চাহিদা, কত প্রযোজনীয় দিক, কত কর্তব্য-কিন্তু কোনোটাই কি পূরণ করা যাচ্ছে-

যতই ভাবে রশিদ, ততই নিজেকে নিষ্ফলা জমিনের মতো ব্যর্থ মনে হয়।

বেতনের গোনা টাকা। তার তিন ভাগই তুলে দিতে হয় ভাড়ার জন্য বাড়িওয়ালার হাতে। বাকি একভাগ দিয়ে ছেলেমেয়ের স্কুলের বেতন, টিউশনি ফিস, সারা মাসের সংসার খরচ, তার ওপর আব্বা-মায়ের জন্য কিছু পাঠানো-সব মিলিয়ে একটা বেহাল অবস্থা।

কোনোটাই সটিকভাবে পালন করা যায় না।

একজন কামার-কুমার বা রাজমিস্ত্রির মতো সে নিপুণ হতে পারলো না। সর্বত্রই দগদগ করছে তার ব্যর্থতার ক্ষত। কিন্তু আমিই বা কি করতে পারি।

রশিদ নিজেই প্রশ্ন করে নিজের কাছে।

কিন্তু উত্তর মেলে না। সংসার এমনি জটিল এক গরল অংক, কোনো হিসাব মেলাতে পারে না রশিদের মতো সৎ চাকরিজীবীরা। অথচ এই তার সামনেই এরোপ্লেনের মতো কেমন তরতর করে দ্রুত ওপরে ওঠে যাচ্ছে কতজন।

কী জৌলুস তাদের চারপাশ।

ঘরে ফ্রিজ, ফোন, কম্পিউটার, রঙিন টিভি। বাচ্চারা পড়ে নামিদামি স্কুলে। মাসে টিউশন ফিস দেয় তিন/চার হাজার টাকা। বাসা ভাড়া তার চেয়ে দ্বিগুণ। কেমন ঝকমকে এক-একটা সংসার। কি চাকচিক্য। তাদের সংসার যেন জাফলং কিংবা কক্সবাজারের সি বিচ।

তাদের পাশে রশিদকে দাঁড় করালে মনে হবে লিলিপুট। দাঁড়িয়ে আছে হিমালয়ের পাদদেশে। ওপর থেকে দেখলে যাকে মানুষ নাকি তৃণ-কিছুই অনুমান করা যায় না।

তাদের চেয়ে তার যোগ্যতা কম কিসে?

বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো একটু বেশিই আছে।

তারপরও সোনার হরিণ ধরার মতো ঐ একটিমাত্র যোগ্যতা না থাকার কারণে রশিদকে তিলে তিলে নিঃশেষ হতে হচ্ছে। যক্ষ্মার রোগীর মতো কেবলই ক্ষয়ে যাচ্ছে তার ভেতরটি।

কেন এমনটি হচ্ছে?

সেকি সাপ ধরার কৌশল এবং সাপের বিষদাঁত সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে? পাকা সাপুড়ে হলে আর তাকে বিষে জর্জরিত হতে হত না।

রশিদও জানে, এ জন্য তার বিকেই দায়ী। সে পারে না কোনো রকম চালাকি বা ধূর্তমির আশ্রয় নিতে। পারে না অর্থের জন্য বিবেক, চরিত্র এবং সততাকে হত্যা করতে। আর পারে না বলেই এইভাবে পড়ে আছে পাথরচাপা কষ্টের মধ্যে।

অবশ্য কষ্ট ভাবলে কষ্ট, সুখ ভাবলেই সুখ। এটাও সে উপলব্ধি করে।

নৈতিক পরাজয়ের মধ্যে যে গ্লানি আছে, যে লাঞ্ছনা আছে তার চেয়ে ঢের সুখের জীবন-আর্থিক কষ্টের।

এই সুখ নৈতিক বিজয়ের।

এই সুখ সততার।

এর সাথে অর্থ কিংবা প্রাচুর্যের কোনো সম্পর্ক নেই। এ এক আলাদা তৃপ্তিদায়ক আনন্দ।

রশিদ অনেক গভীর প্রদেশে প্রবেশ করায় চা এবং আমিনের প্রতি কিছুক্ষণের জন্য উদাসীন হয়ে পড়েছিল। আমিন জিজ্ঞেস করলো, কিছু ভাবছেন নাকি ভাই?

-না। কী আর ভাববো।

-তবুও কেমন যেন লাগছে আপনাকে।

-ও কিছু না। এবার বল, তুমি আবার কবে যাচ্ছো?

খুব তাড়াতাড়িই। আপনাকেও যেতে বলেছেন চাচী। চাচাজানও বোধ হয় সে কথা লিখেছেন। আর এবার নির্বাচনেও আপনার উপস্থিতি সবাই আশা করছে। এ জন্য আপনার দ্রুত যাওয়া উচিত।

-নির্বাচন?

রশিদের মুখ থেকে বেরিয়ে এল কথাটি। সেই সাথে একটুকরো হাসি।

সেটা ঘৃণার নাকি বিদ্রুপ বা বিতৃষ্ণার তা বুঝা গেল না। রশিদ বললো, যে ধরনের রক্তপাত ও সাংঘর্ষিক নির্বাচন এখানে হয়, সেটা কখনই কাম্য হতে পারে না। এই ধরনের নির্বাচনের বিকল্প অন্য কোনো পন্থা খুঁজে বের করা উচিত।

আমিন অবাক হলো কিছুটা। জিজ্ঞেস করলো, নির্বাচন নিয়ে আপনার কোনা কৌতূহল নেই?

-আছে বৈকি। তবে এটাও এখন মনে হয়, এ ধরনের নির্বাচন আর ক্ষমতার বদলে দেশের জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তনই হয় না। হয় কেবল হাতের বদল।

-বলেন কি!

-রাজনীতিতে থেকে এতকাল যা বুঝেছি, যা উপলব্ধি করেছি, তাই বলেছি। শাসকদের স্বভাব, চরিত্র বদল না হলে কেবল ক্ষমতার পালাবদল দিয়ে কিছুই হবে না। কেন তোমার মনে নেই ঐ কবিতাটির কথা।

-কোন টা।

-ঐ যে সেদিন পত্রিকায় বেরিয়েছে।

-জানি না তো।

-কবিতাটি আমার খুব ভালো লেগেছে। পেপার থেকে কেটে রেখেছি। শুনবে?

রশিদ একটি ফাইলের নিচ থেকে পেপার কাটিংটা টেনে বার করে পড়তে লাগলো :

 

“কী আর বদল হবে! দৃশ্যপট অবিকল তাই।

যেমনটি ছিল বিশ শতকে: সূর্য দিন রাত-

অবিরাম হানাহানি, সংঘর্ষ আর রক্তপাত

সাতভূতে ভাগাভাগি, অবশেষে পাথরের ঘাই!

 

কী আর বদল হবে। হতে পারে হাতের বদল।

ম্যাজিকও রয়ে যাবে, রয়ে যাবে রুমালের খেলা

যথারীতি লাল হবে রাজপথ, ঢেউয়ের মেলা।

হতে পারে যুদ্ধের কৌশল আর রিমোট বদল!

 

কী আর বদল হবে! রয়ে যাবে পশুর স্বভাব-

অনাহুত খরতাপে মাটি হবে কেবলি চৌচির

স্বপ্নভাসা চোখগুলো পূর্ববৎ হয়ে যাবে থির,

আকাশ খামচে ধরে কেঁদে যাবে পুরনো অভাব।

 

কী আর বদল হবে। থেকে যাবে আগের আদল

একুশ শতক! সে তো রক্তভেজা হাতের বদল।”

 

-বা! চমৎকার তো।

আমিন আমুল শিহরিত হলো। বললো, ঠিক আমাদের মনের কথাটিই কবি লিখেছেন। কবিতাটি আমাকে দেবেন?

-না, এটা আমি যতেœà¦° সাথে সংরক্ষণ করে রাখবো। আর মিলিয়ে দেখবো এর প্রতিটি বর্ণের সাথে আমাদের বাস্তবতা। আশা করছি মিলে যাবে। সত্য প্রমাণিত হবে কবিতাটি। তুমি কি বলো?

-আমারও তাই মনে হয়।

আমিন উঠে দাঁড়ালো। বললো, এখন আমাকে যাবার অনুমতি দিন।

-আরে, এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন?

-একটু অন্য জায়গায় যেতে হবে। ক্লাস বন্ধ। ভার্সিটিতে ধর্মঘট চলছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাব। সব মিলিয়ে একটু ঝামেলার মধ্যে আছি।

-আবার ঝামেলা কিসের?

আমিন মাথা চুলকিয়ে বললো, আসল ঝামেলা অর্থনৈতিক। বাড়ি যাবার টাকাও নেই। যা এনেছিলাম ঋণ শোধ করতেই শেষ হয়ে গেছে। এখন হাত একেবারেই ফাঁকা। কী যে করি।-

আমিন না বললেও রশিদ বুঝতে পারলো, তার এখন কি করা উচিত। এমন সময়ে তাকে সহযোগিতা করতে না পারলে তার নিজের কাছেও খারাপ লাগবে।

একটু ভেবে বললো, দুশ্চিন্তা করো না। আল্লাহ পাক একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করে দেবেন। তুমি যাবার আগে আমার সাথে দেখা করে যেও। তোমার সাথে আমারও কিছু কাজ আছে।

-ঠিক আছে, আসবো।

-আগেই ফোনে একটু জানিয়ে দিও।

-আচ্ছা।

আমিন চলে গেল।

আর রশিদের পথটা দীর্ঘ থেকে আরও দীর্ঘতর হয়ে উঠলো।

কী অমসৃণ!

কী দুর্গম! পথ নয়, মনে হচ্ছে কেউকারার্ড।

ভেবেছিল আব্বা-আম্মার জন্যে কিছু টাকা পাঠাবে। এখন তার সাথে যুক্ত হয়ে গেল ছেলেটার চিন্তাও। ওর জন্যও তো কিছু করতে হবে।

আমিন চলে গেলে রশিদ এবার কাজে মন দিল। কিন্তু কাজেও মন বসছে না।

পাতি হাঁসের মতো এক ভরাট দুশ্চিন্তার পুকুরে কেবল মাথা ডুবিয়ে আবার ভেসে উঠছে। সাঁতার কাটছে ঘূর্ণায়মান দুঃসময়ের ঘোলা পানিতে।

পালক ঝাড়তেও তার খুব ক্লান্তিবোধ হচ্ছে।

জীবন এখন তার কাছে ক্লান্তিকর সদরের মতো মহাদূরবর্তী পথ বলে মনে হচ্ছ।

 

কোনো কোনো রাত মহাকালের মতো এতদীর্ঘ হয়, যা শেষই হতে চায় না।

আজকের রাতটি ঠিক তেমনি মনে হচ্ছে রশিদের কাছে।

কী দীর্ঘরাত! কী ভীষণ গাঢ়তর অন্ধকার। এর মধ্যেই তিনবার বিছানা ছেড়ে উঠেছে। বাথরুমে গেছে। চোখে মুখে পানি দিয়ে আবার ঘুমাবার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু প্রত্যেকবারই ব্যর্থ হয়েছে।

চোখে ঘুম নেই। তেপান্তরের তালগাছের মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সেই যেন মহানগরীর জাগ্রত প্রহরী।

গত রাতটাও তো কেটে গেছে এইভাবে।

শোবার পর যদি চোখে ঘুম না আসে, তাহলে তার মতো কষ্ট আর নেই।

নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যাবার কথা।

কিন্তু তাও যাওয়া হয় না। গেলেই তো টাকা খরচ। সংসারের ওপর এটা একটা বাড়তি চাপ।

সে দিন ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল।

মাঝে মাঝে সে নিজেই ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আগে তবু অল্পমাত্রায় ওষুধেই কাজ হতো। এখন মাত্রা বাড়িয়েও আর ঘুম আসে না।

ডাক্তার বলেছিল, এবার যে ওষুধ দিচ্ছি, তাতে ঘুম না এসে পারবে না। রাতে ভাত খাবার আধা ঘণ্টা আগে এটা খাবেন।

রশিদ ডাক্তারের কথা মতো তাই করেছে। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না।

বাধ্য হয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে একদিন ওষুধ খাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে।

ওষুধ খেয়েও যদি ঘুম না আসে, তাহলে আর তো খেয়ে কী লাভ।

বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে ঘানিটানা গরুর মতো ক্লান্ত হয়ে পড়লো রশিদ।

রাগে-ক্ষোভে সে বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের দরোজাটা আস্তে করে খুললো।

ছিটকিনি খোলার শব্দে আবার রুমানার ঘুমটাও ভেঙে না যায়। সেই কি তার খেয়াল আছে।

রাত বারোটার আগে রুমানা বিছানায় যেতে পারে না। আবার উঠতে হয় ভোরে আজানের সাথে সাথে। দিনে তার বিশ্রামের কোনো অবকাশ নেই। সুতরাং তার দিকে একটু খেয়াল না রাখলে হবে কেন?

রশিদের মধ্যে এই বিবেকটা এখনও মরে যায়নি। ভাবে, আমি কষ্ট করছি, করে যাই। আমার কষ্টের সাথে অন্যকেও কষ্ট দেয়া অন্যায়।

দরোজাটা এমন আস্তে করে খুললো, বিড়ালের মতো, এমন সতর্কতার সাথে যে, রুমানা ঠিক পেল না।

তার দুই পাশে শুয়ে আছে ছেলে আদনান আর মেয়ে ফারিহা।

সবার দিকেই চোখ গেল রশিদের। আহ! কী প্রশান্তির সাথে গাঢ় ঘুমের মধ্যে সবাই ডুবে আছে। যেন শীতের কুয়াশায় ভেজা সবুজ ঘাস। কোমল। প্রকাণ্ড। থাক ওরা ঘুমাক।-

রশিদ বারান্দায় বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলো।

চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ।

আশপাশে কেউ জেগে নেই। কোনো ঘরেই আলো জ্বলছে না। এমনকি যে, ফ্যাক্টরি সারা রাত ঘর ঘর শব্দে মুখর করে তোলে, সেটাও আজ শান্ত।

ফ্যাক্টরি থেকে কোনো শব্দ আসছে না। কেবল সেখানে একটা লাইট জ্বলছে।

রেল লাইনের ওপাশে মেইন রাস্তার বাতিগুলো অফ করা। সম্ভবত নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করার দায়ও করপোরেশন অনুভব করেনি।

মাঝে মাঝে সাঁ সাঁ গতিতে দু’একটা ট্রাক ছুটে যাচ্ছে।

এই গভীর রাতে ট্রাকের শব্দটা চারপাশের অন্ধকারাচ্ছন্ন নীরবতা কিছুটা হলেও ভেঙে যাচ্ছে।

গ্রিলের ফাঁক দিয়ে রশিদ তাকিয়ে আছে দূরে।

বড় রাস্তার দিকে।

তার দৃষ্টিতে থকথকে অন্ধকার আর নিমিষ, গাঢ় শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই।

শরীর ও মনের ক্লান্তির ভার তার মাথাকে চেপে ধরেছে গ্রিলের সাথে। এই মুহূর্তে তাকে মনে হচ্ছে, সে যেন এক অসহ্য বন্দিখানায় জিম্মি হয়ে আছে। এর থেকে মুক্তির আর কোনো পথ নেই। দরোজা নেই। এমনকি বাইরের আলো-বাতাস প্রবেশেরও কোনো ফাঁক-ফোঁকর নেই। ছিপি আঁটা শূন্যতার বোতল। বাষ্পরুদ্ধ।

কেন এমন মনে হচ্ছে?

নিজেই প্রশ্ন করে, আবার। নিজেই তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে ঘেমে উঠে।

তাড়া খাওয়া শিয়ালের মতো কেবল ছুটতে থাকে অনিশ্চয়তার ঝোপ-জঙ্গলে। এর মধ্য দিয়ে রশিদ আরও বেশি ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়ে।

তার পা দুটোও কেমন কাঁপছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আর দাঁড়ানো তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

ঝড়ের দাপটে হেলে পড়া গাছের মতো সেও কিছুটা সকাত হয়ে পড়লো। বারান্দা থেকে আবার ঘরে প্রবেশ করে দরোজাটার ছিটকিনি লাগাতেই একটা মৃদু শব্দ হলো।

এতটুকু শব্দেই জেগে গেল রুমানা। জিজ্ঞেস করলো,

-কি, এখনো ঘুমাওনি?

-নাহ!

-তাহলে আর কখন ঘুমাবে? না ঘুমিয়ে শরীরটার তো বারটা বাজিয়েছ।

-ঘুম না এলে কী করবো?

-ওষুধ খেয়েছ।

-ওসব ফালতু। কোনো ওষুধেই কাজ হচ্ছেনা।

-তাহলে ডাক্তারের কাছে যাও। শরীটার দিকে খেয়াল রাখতে হবে তো।

-আর শরীর।-

-ওভাবে বলছো কেন?

রুমানা খাট থেকে নেমে এল।

তার চোখে তখনও ঘুমের রেশ।

রশিদ বললো, আহ! তুমি আবার নেমে এলে কেন? যাও, ঘুমাও।

রুমানার গলায় কী এক বেদনার স্বর, আচ্ছা বলতো তোমার কী হয়েছে?

-আমার আবার কী হবে।

-না, দেখছি-ক’দিন থেকে তুমি কেমন বিষণœ হয়ে আছ। মনমরা। চিন্তাযুক্ত। আবার মেজাজটাও খিটখিটে। কিুছুই সহ্য করতে পারছো না। বলোতো, সমস্যাটা কোথায়?

-সমস্যা?

-নিশ্চয়ই।

-না, তেমন কিছু না।

-আমার কাছে লুকিয়ে কী লাভ, বলতো। তুমি আমাকে সব সময় এড়িয়ে যাও।

রুমানার কণ্ঠে অভিযোগের সুর।

-এড়িয়ে যাব কেন?

-নয়তো কি! কোনো কথাই তুমি আমাকে খুলে বল না। কেন, আমি কি এই সংসারের কেউ নেই?

-ওভাবে বলছো কেন?

-তবে কীভাবে বলবো।

-তুমি দেখছি, দুপুর রাতে রেগে যাচ্ছ।

-রাগাই তো উচিত।

-আমাকে ভুল বুঝো না, প্লিজ।

-ভুল বুঝার সুযোগটাতো তুমিই করে দিচ্ছ।

-সত্যিই?

-তাছাড়া কি। সব সময় নিজের মধ্যে শামুকের মতো কষ্ট লুকিয়ে রাখ। বেদনা লুকিয়ে রাখ। কেন? আমার সাথে তো একটু বলতেও পার। নাকি আমাকে তুমি বিশ্বাস কর না?

-আহ রুমানা!-

রুমানা!

ডাকটি এই গভীর রাতে তার কাছে খুব মিষ্টি লাগলো।

রশিদের কণ্ঠে ডাকটি আর একবার শুনতে ইচ্ছে করছে তার। সে রশিদের আরও কাছে এসে নরম স্বরে বললো, আচ্ছা, বলো তো আমি কি তোমার কষ্টের কথা জানার কোনো অধিকার রাখিনে! নাকি সেই যোগ্যতাও আমার নেই।

-আছে রুমানা। তোমার অনেক যোগ্যতা আছে। তোমার মধ্যে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা আর নিত্য অভাবের সাথে সাগরভাঙ্গা জেলেদের মতো যুদ্ধ করার দৃঢ়তা না থাকলে আমি কি এই শহরে টিকতে পারতাম? কবে পাততাড়ি গুঁটিয়ে পদ্মা পার হয়ে যেতে হতো।

হেসে উঠলো রুমানা।  তাহলে অবশেষে স্বীকার করলে। যাক, শুনে খুশি হলাম।

-কেন করবো না? যা সত্য তা স্বীকার না করাও এক ধরনের কাপুরুষতা। এ ধরনের হীনম্মন্যতায় অন্তত আমি ভুগিনে।

একটা হাই তুলে আবারও হাসলো রুমানা। বললো, থাক, ঢের হয়েছে। এবার শুতে যাও। সকালে আবার অফিস আছে না!

-কিন্তু পোড়া চোখে যে ঘুম আসছে না।

-আহা, চেষ্টাতো করতে হবে।

-করছিই তো।

-তাই বলে সারারাত কেবল পায়চারি করে কাটাবে?

-কী করবো! বোধহয় এটাই আমার ভাগ্যের লেখন।

-এরকম করলে তো সেই লেখনও মুছে যাবে।

-সেটা হলেও তো শব্দ হতো না।

-কী বললে! তুমি আজকাল এত হতাশ হয়ে যাচ্ছ কেন? আগে তো এমন ছিলে না। তোমার সেই সাহস, আত্মবিশ্বাস আর পর্বতসমান ধৈর্য কোথায় গেল? কেন তুমি দিন দিনই কেবল হতাশার মধ্যে ডুবে যাচ্ছো? আমিও তো তোমাকে বুঝে উঠতে পারছিনে। কেমন তালাবদ্ধ বাক্সের মতো রহস্যজনক হয়ে যাচ্ছ।

হাসলো রশিদ। বললো, তুমি কেন, আজকাল আমি আমাকেই বুঝতে পারছি না। মাঝে মাঝে কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। অস্পষ্ট হয়ে ওঠে পুরনো পুথির ঝাপসা অক্ষরের মতো। তখন মনে হয় এই সংসার, পরিচিত মানুষ, চারপাশ, সমাজ-পৃথিবী, সব-সবই আমার অচেনা। আমিও তাদের কেউ নই। যেন ভিন্ন গ্রহের এক অচিন মানুষ।

রুমানা এবার একটু গভীর হলো। বললো, আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি তোমাকে একজন মানসিক ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন।

-মানসিক ডাক্তারের কাছে?

-হ্যাঁ।

-কেন, আমি কি পাগল হয়ে গেছি?

-হওনি। তবে হতেও আর বেশি বাকি নেই।

-তুমি আমাকে পাগল ভাবছো।-

রশিদ খুব সিরিয়াস হয়ে উঠলো, পুরুষ মানুষ কখনো কখনো পাগলামী কিংবা ছেলেমানুষী করে। এটা দোষের কিছু নয়। আবার সময়ে ঠিক হয়ে যায়। এখন যাও তো, ঘুমিয়ে পড়। রাত শেষ হতে চললো। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেব নাকি।

-না, তার দরকার নেই। পাগল মানুষের মাথায় হাত দিলেই কি। আর-------

-বাব্বা! মেযে মানুষের মতো আবার দেখছি অভিমানও আছে ষোল আনা! রুমানার মুখে সরল হাসি। এস।-বলে রশিদের হাত ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল।

রুমানা একটু পরে চলে গেল তার খাটে।

রশিদ চোখ বন্ধ করে আছে।

চোখ দুটো জ্বালা করছে। মাথাটাও কেমন ভার ভার।

খুব চেষ্টা করলো ঘুমানোর।

১০০ থেকে এক পর্যন্ত গুণলো কয়েকবার।

এসব কোনো কৌশলই আজ আর কাজে আসছে না। ঘুরে ফিরে তার চোখের সামনে ঘুমের বদলে যেটা ভেসে আসছে তার নাম-বেদনা, বিষন্নতা আর এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার জলোচ্ছ্বাস।

নিজের সাথেই কেবল কথা বলে যাচ্ছে রশিদ।

-তারপর? তারপর কী হবে! ভাবে রশিদ। ছেলে-মেয়ে এখনো ছোট। শরীর চালিয়ে কোনো রকমে। বিকল গাড়ির মতো সংসারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতি মাসে অফিস থেকে অগ্রিম নিতে হয়। কতদিনই বা আর চাকরি করা যাবে। ওদিকে বাড়িতেও মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই নেই। এদেরকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবে? কোন কূলে ভিড়াবে তাই দিশাহীন তরী? কোন কূলে? ভাবে, অন্যদের মতো আমি তো কৌশলী সাঁতারুও নই।

এসব যতই ভাবে, ততই এক গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকে রশিদ।

তার বুকের ভেতরে উথলে ওঠে বেদনা আর হতাশার তুফান।

সামনে আকাশের মতো কেবলই শূন্যতা। এত শূন্যতার মধ্যে, এত অনিশ্চয়তার মধ্যে কীভাবে জীবন যাপন করা যায়।

সময় ও সংসার নামক রেসে সে নিজেকে পরাজিত মনে করে। নিজের কথা বাদ দিলেও, বাকি কজন-এরাই বা কী করবে। তার অনুপস্থিতিতে তাদের কী হবে।

কোথায় যাবে!-ওদের জন্য কোনো রকম পাথেয় কিংবা আশ্রয়স্থল কিছুই তো রইলো না।-

আর ভাবতে পারে না রশিদ।

থেকে যেতে বাধ্য হয়। ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়া গাড়ির মতো। এক সময় লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আল্লাহ। তুমিই একমাত্র ভরসা। তুমিই আমার ও এই ভাসমান দিশাহীন তারার যাত্রী কটি প্রাণীর জামিনদার। তোমার ওপরই সোপর্দ করলাম। তুমি হেফাজত করো।

ব্যস!

রশিদের এই প্রার্থনা ও কামনায় তার মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তি নেমে এল। বুকের তোলপাড় আর মস্তিস্কের উষ্ণতা কমে গেল। কেমন এক নির্ভরতার উপত্যকায় হেলান দিয়ে সে হেমন্তের হাওয়ার মতো হালকা হয়ে উঠলো। মৃত্যুগুহা থেকে ফিরে আসা ব্যক্তির মত সে ভারশুন্য মাথার বালিশটা উল্টে নিয়ে চোখদুটো বন্ধ করলো রশিদ।

এবার তার চোখ জুড়ে প্রার্থিত বৃষ্টির মতো ঘুম নেমে এল। গভীর ঘুম।-রশিদ নয়, যেন সাগরের নিচে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে এক প্রদীপ্ত প্রবাল।

 

 

গত একটা সপ্তাহ দারুণ ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে রশিদের।

অফিসের কাজের চাপ এত বেশি যে মাথা সোজা করে একটু বিশ্রাম নেবারও সময় পায়নি।

চাকরি করার এই এক বিড়ম্বনা।

অবশ্য কাজে ফাঁকি দিতে পারলে অন্য কথা। তাদের জন্য সুখের কোনো দোষ নেই।

অসৎদের জন্য খোলা থাকে হাজারো দরোজা।

কিন্তু যারা সৎ, যারা সততার সাথে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে চায়-তাদের জন্য তেমন ধরনের কোনো সহজ রাস্তা থাকার কথা নয়। কারণ, বিবেক নামক এক ভয়ঙ্কর দারোয়ান কিংবা অজগর সকল সময় সৎদের সামনে পাহারায় রত।

অসততার জন্য বিবেকের সেই দংশন অত্যন্ত মারাত্মক।

যারা সৎভাবে জীবন যাপন করতে চায়-তারা কখনো চায় না ওই দারোয়ান কিংবা অজগরের মুখোমুখি হতে।

রশিদও সতর্কভাবে পরিহার করে চলতে চায় অসততার পথ।

প্রকৃত অর্থেই তো ওটা কোনো পথ নয়।

অসততা এবং পাপকেও অনেকে ‘পথ’ বলে।

কিন্তু রশিদ ভেবে পায় না, ওগুলো আবার পথ হয় কীভাবে?

যে কোনো অর্থেই হোকনা কেন, ‘পাপ’ কখনো ‘পথ’ হতে পারে না। তাহলে এতদিন পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত। কারণ বিলুপ্তি ঘটতো সততা, মানবিকতা আর পবিত্রতা। এখনো যেহেতু পৃথিবী ধ্বংস হয়নি, সুতরাং বুঝাই যায়-কিছু হলেও ‘প্রকৃত মানুষ’ পৃথিবীতে অবশিষ্ট আছে। আর তারা আছে বলেই পৃথিবীর ভারসাম্য টিকে আছে।

কাজের চাপে এখন মাঝে-মাঝেই রাত করে বাসায় ফিরতে হয় রশিদকে।

রুমানার এসব নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। কারণ সেও বোঝে, এই পরিশ্রমটুকু আছে বলেই তো এই নিষ্ঠুর শহরে এখনও কোনো রকমে আছি।

এটুকু শেষ হলে সবই শেষ।-তখন সামনে কেবল ধূ ধূ মরূপ্রান্তর।

রাত নয়টা বেছে গেল আজ।

রশিদ বাসায় ফিরে হাতমুখ ধুয়ে কেবল বসতে যাবে, এমন সময় আদনান এসে জিজ্ঞেস করলো, আব্বু মোজা ইংরেজি কি?

রশিদ কিছুটা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকলো। জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার?

-স্যার এই শব্দটার ইংরেজি পারছে না।

আপনার কাছে জিজ্ঞেস করতে বললেন।

রশিদের মুখে এসেও জোর করে থামিয়ে রাখলো, ‘কি আশ্চর্য! তোমাদের পড়ায় সে, বিএ পড়ে, অথচ সামান্য ‘মোজা’ ইংরজিটা জানে না। তাহলে সে তোমাদেরকে কী পড়ায়।

ওদের মাস্টার তখনও বসে আছে। ফারিহা জোরে জোরে পড়ছে। তার পড়ার শব্দ শুনতে পেল রশিদ।

আদনানকে মোজার ইংরেজটা বলে দিয়ে এক বিরক্তি ও বিব্রতকর পরিবেশে খাটের পাশে পা ঝুলিয়ে বসলো।

তার মনে হলো-এতদিন যেভাবে মাস্টারের ওপর ওদের লেখা-পড়ার ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলাম, এটা ঠিক হয়নি। অন্তত একটু খোঁজ-খবর নেয়া দরকার ছিল। সে কি পড়াচ্ছে আর এরা কি শিখছে।

সময়ের অভাব থাকলেও রশিদ তাগাদাটা এখন অনুভব করতে পারছে। সংসারের শত কষ্টের মধ্যেও ছেলে-মেয়ের পড়ানোর পেছনে প্রচুর খরচ করতে হয়। সে তো কেবল ওদেরকে প্রকৃত যোগ্য ও মানুষ করার জন্যই।

ওদের নিয়েই তো তার সবজি বাগান।

ওদের নিয়েই তো যত স্বপ্নের ভুবন নির্মাণ করা।

সেই স্বপ্নের চারাগুলো কীভাবে বেড়ে উঠছে, একটু বুঝে ওঠার প্রয়োজন বোধ করলো রশিদ।

রাতে খাবার সময় ফারিহা বললো, আব্বু আপনার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।

-খুবই জরুরি?

হাসলো রশিদ।

মেয়েটা এই রকমই।

ওর বড় আব্বুসহ বাড়ির সকলেই ওকে খুব বুদ্ধিমতী বলে জানে। লেখাপড়ায় মনোযোগী দেখে তারা দারুণ খুশি।

লেখাপড়ার পাশাপাশি আবার কবিতা লেখা, ছবি আঁকা প্রভৃতির দিকেও মেয়েটার বেশ ঝোঁক।

ছেলেটা আবার অন্য প্রকৃতির।

খেলার দিকে তার আকর্ষণ বেশি।

দু’জন দুই মেরুর।

তবুও খারাপ লাগে না রশিদের। মানুষতো এরকমই হয়।

একেকজন একেক রকম।

ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের।

ভিন্ন রুচি ও স্বভাবের।

সবাইকে একই রকম, একই ছাঁচে ফেলে দেয়ার কোনো মানে হয় না। তবে কেন্দ্রীয় চরিত্র ও লক্ষ্য অভিন্ন থাকতে হবে-এ ব্যাপারে রশিদের মধ্যে কোনো প্রকার দ্বিধা বা সংশয় নেই। সেই কিন্দ্রীয় বিষয়টি হলো- বাহ্যিক যত গুণপনাই থাকনা কেন, প্রকৃত মানুষ হতে হবে। প্রকৃত শিক্ষায় ও চরিত্রে নিজেকে আলোকিত করে তুলতে হবে।

এখানে কোনো প্রকার সমঝোতা চলতে পারে না।

রশিদ অবশ্য এদিকে কম-বেশি খেয়াল রাখার চেষ্টা করে।

যতটুকু সম্ভব, ছেলে-মেয়েকে পারিবারিকভাবে আদর্শ ও ঐতিহ্যগত দিক থেকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করে।

পারিবারিক শিক্ষাই বড় শিক্ষা।

সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষা, জ্ঞান, আদর্শ ও ঐতিহ্যের পাঠশালা তো পরিবার কেন্দ্রিক হওয়াই উচিত। পরিবার থেকেই যদি সন্তানরা মানুষ হবার শিক্ষা না পায় তাহলে তাদের বেপরোয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়ে যায়।

এটা বোঝে রশিদ।

ফারিহা খুব সামান্য খায়। খাবার প্রতি তার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। এ জন্য সবার আগেই তার খাওয়া শেষ।

মুখটা একটু ভার হয়ে গেল। রশিদ সামলে নিল পরিবেশটি।

রুমানা বললো, বাপের কাছে প্রশ্রয়টা তো ভালোই পাও। দাবিও আদায় হয়ে যায়। আমার দাবি আর জানাবো কাকে।

-তোমার আবার কি দাবি।

রশিদের প্রশ্নে রুমানা একটু বাঁকা চোখে তাকালো। বললো, নাহ! থাক। আমার কোনো দাবি নেই। তোমার মেয়ের দাবিটার কথা কি একটু জানতে পারি?

-ও তো কিছুই চায়নি।

-ওই যে কানে কানে কি বললো।

-দাবির কথা বলেনি। বলেছে জরুরি কথাটা পরে বলবে।

-বুঝেছি।

-কি?

-নিশ্চয়ই মা-মনি এমন কিছু চাইবে, যা একটু গুরুত্বপূর্ণ।

-কি জানি!

মায়ের কথা শুনে ফারিহা মিট মিট করে হাসছে।

খাওয়া শেষ হলে সারাদিনের পরিশ্রান্ত শরীরটা বিছানায় টানটান করে ছেড়ে দিল রশিদ। ক্লান্তি নেমে এসেছে তার দেহ-মনে।

ফারিহা তার স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে রশিদের মাথার কাছে এসে বসলো। বললো, মাথায় হাত দিয়ে দেই, আব্বু।

-দাও।

ফারিহা রশিদের মাথায় চুলে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে দিচ্ছে।

খুব ভালো লাগছে তার। বললো, মা-মনি।-

-জ্বি।

-কি যেন জরুরি কথা ছিল। এখন বলবে?

-ফারিহা খুবই সতর্ক। কথা বলার পরিবেশ-পরিস্থিতিও সে বোঝে। রশিদের মাথার চুল টানতে টানতে বললো,

-আব্বু!

-বলো, মা।

-আমার একটা বক্স কিনে দেবেন? আমাদের ক্লাসের মিনা কিনেছে। খুব সুন্দর।

-তাই।

-হ্যাঁ। মাত্র পঞ্চাশ টাকা দাম।

-ও বাবা! দামও জেনে এসেছো?

-জ্বি।

-কোথায় পাওয়া যাবে সেটা?

-ওই তো আমাদের স্কুলের পাশের দোকানো।

-কবে লাগবে?

ফারিহা একটু চুপ থেকে বললো, যেদিন আপনার সুবিধা হয়।

মেয়ের কথায় খুশি না হয়ে পারলো না রশিদ। এত্তুটুকু মেয়ে, অথচ সেও বোঝে যে, চাইলেই হবে না। কিনে দেবার জন্য প্রয়োজনীয় টাকাও আব্বুর কাছে থাকতে হবে।

রশিদ বললো, ঠিক আছে। পকেটে টাকা আছে। শনিবার স্কুলে যাবার সময় তোমার আম্মুকে নিয়ে যেতে বলো।

ফারিহা দারুণ খুশি। তার সেই খুশির দ্যুতিতে সমগ্র ঘরটি যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। পৌষের পাকা ধানের ক্ষেতের মতো।

রশিদ জানে, পকেটে যে টাকা আছে তা দিয়ে বক্স কিনলে, তাকে অর্ধেক পথ হেঁটে আর বাকি পথ বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিসে যেতে হবে।

তা হোক।

সেই কষ্টের চেয়েও এখন তার কাছে মেয়ের এই আনন্দ ও খুশিটুকুর মূল্য অনেক-অনেক বেশি।

এর সুখটাও অন্যরকম। এই সুখটুকু থেকে সে এই মুহূর্তে আর বঞ্চিত হতে চায় না।

ফারিহা খুশিতে ডগমগ।

সে দৌড়ে চলে গেল অন্য ঘরে।

ওর মায়ের সাথে ফিসফিস করে কি যেন বললো।

মা-মেয়ের হাসির শব্দে রশিদের বুকটা ভরে উঠলো এক অপার আনন্দে। যে শ্রাবণের টই-টুম্বুর পুকুর।

কয়েকটি মাকড়সা, টিকটিকি আর তেলাপোকা ছাদের গায়ে ঘুরাফেরা করছে। একটি পোকা শিকারের জন্য ওৎ পেতে আছে বাদামী রঙের টিকটিকি। সে কেবল সুযোগের অপেক্ষায়।

রশিদ ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আসলে ছাদ নয়, ছাদকে অতিক্রম করে তার দৃষ্টি এবং শসৃতি চলে গেছে শৈশব-কৈশোরে।

আব্বার কাছ থেকে নতুন জামা, নতুন জুতো কিংবা সামান্য একটা কিছু পেয়েই কী যে খুশি হয়ে উঠতো।

মনে পড়ছে, শীতের সময়ে আব্বা সুতির নতুন চাদর কিনে আনলে খুশিতে সেই রাতে তার ঘুম হতো না। সকালে, খুব ভোরে-সেই নতুন ভাঁজ ভাঙ্গা চাদর গায়ে দিয়ে ভাপওঠা পুকুর পাড়ে বসে থাকতো। যাতে পাড়ার ছোটরা, তার সাথীরা সেটা দেখতে পায়।

আবার নতুন লুঙ্গি কিনে আনলেও তেমনটি করতো। দিনে পরার পর রাত্রে শুবার সময় সেটা খুলে ভাঁজ করে রেখে দিত বালিশের নিচে। যেন মহা মূল্যবান কোনো সম্পদ। পরদিন আবার পরতো। কত সাবধানে। যেন ভাঁজ না ভাঙে। যেন ধুলো না লাগে। কত সতর্কতা। যতদিন ময়লা না হবে, যতদিন মা সেটা জোর করে ধুয়ে না দেবে ততোদিনই চলতো এই ধরনের প্রক্রিয়া। খুশির ঢলে উপচে উঠতো সেই সময়গুলো। অন্য কোনো  কিছুর বিনিময়ে সেই খুশি কেনা সম্ভব হত না। সে এক সম্পূর্ণ আলাদা এক অনুভূতির কম্পন।

এখন সময় কত বদলে গেছে।

ঢাকা শহরের ছেলে-মেয়েদের কাছে নতুন জামা-কাপড় পাবার তীব্র আনন্দের সেই বহিঃপ্রকাশ নেই। এগুলো তাদের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাদের আনন্দ আর উৎসবে এখন যুক্ত হয়েছে কত কিছু। টিভি, ভিসিআর, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ই-মেইল, ফোন, ফ্যাক্স আরও কত কিছু।

শহরের ছেলে-মেয়েরা তাদের আনন্দ বা বিনোদনের জন্য কত বিচিত্র উপাদান হাতের কাছেই পেয়ে যাচ্ছে।

এখন আর এরা শরৎ, হেমন্ত, শীত, বর্ষা কিংবা বসন্তের মতো প্রকৃতির নানা বৈচিত্র্যের মাঝে আনন্দ খোঁজে না। জোছনা, পূর্ণিমা কিংবা সূর্য বা নক্ষত্রের দিকেও তাকায় না। তাকায় না ঢেউ তোলা মেঘমালার দিকেও। নতুন ফসল, শ্রাবণের নদী, শরতের কাশফুল, গরুর হাম্বা ডাক, বাবুই পাখির বাসা বা বাদুড়ের কিচির মিচির শব্দ, হাঁসের প্যাক প্যাক ডাকের মধ্যে এরা আর আনন্দের কোনো উপাদান খোঁজে না। ওসব চেনে না, জানেও না।

কিন্তু রশিদ তো ভুলতে পারে না তার সেই শৈশব মাড়ানো পথের কথা, মাঠের কথা, থই থই নদী কিংবা শাপলা ভাসা সেইসব খাল-বিলের কথা।

তার কেবলই মনে পড়ে। দোলা দিয়ে যায় তার হৃদয়ে।

কম্পন তোলে এক অন্য রকমের অনুভূতি। নিজের মনেই আবৃত্তি করতে থাকে :

 

“উত্তর-বর্ষায় জেগেছে নতুন ভোর। শরতের

স্নিগ্ধ শিরশিরে আবৃত্ত। কৃষকের ভারী পদছাপ

পড়ে আছে নরোম ঘাসের বুকে। অবিকল যেন

ভেজা মাটির শরীরে পাঁচটি আঙুল এঁকে গেছে

কোনো এক মহৎ শিল্পের সুষমামণ্ডিত ছবি।

 

এ আমার সবুজ ফসল আর সিক্ত মৃত্তিকার

নিজস্ব অর্জন। ঘুঘরো বা কেঁচা আঁকা চিত্রকর্ম,

প্রচ্ছদ কী বিস্ময়কর। পৃথিবীর আর কোন

শিল্প আছে এর সাথে তুলনীয়? ভ্যানগগ নন,

নন লিউনার্দো কিম্বা এ্যানজেলো, এ আমার দেশ-

বৈচিত্র্যে ভাস্বর-জগৎ বিখ্যাত এক স্থির চিত্র।”

 

এইভাবে শহরের মানুষেরা কি কখনো ভাবে নিজের দেশটি সম্পর্কে।

ছোটদের কথা বাদ দেয়াই ভাল।

অথচ কী বৈচিত্র্যপূর্ণ এই দেশ!

নেই এর গ্রাম বাংলায়।

না, সেই ভাবে সম্ভবত শহরের কেউই গ্রাম বাংলাকে মনে রাখেনি।

একটা আফসোসের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রশিদের বুক থেকে। যেন বাতাসভর্তি বেলুনের মুখটা হঠাৎ করেই খুলে গেল এবং তা প্রসারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো তার খাটে, ঘর এমনকি পুরো বাসাটিতেই।

 

 

খুব ভোরে কলিংবেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল রশিদের।

এত সকালে আবার কে এল।

শেষ রাতে ঘুমুবার কারণে তখনও তার চোখদুটো ঢুলুঢুলু। কলিংবেলের আওয়াজে রুমানারও ঘুম ভেঙে গেছে। ও ঘর থেকে বললো, দরোজা খুলে একটু দেখতো, কে এল।-

রশিদ গেটের চাবিটা হাতে নিয়ে দরোজা খুললো। দোতলা থেকে জিজ্ঞেস করলো, কে?-

-আমি, আমি আমিন। গেট খুলুন দুলাভাই। রশিদ দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেল। চারপাশ তখনও কুয়াশাচ্ছন্ন।

তখনও ঘুমে বিভোর ফ্লাটের সবাই। এমনকি পুরো শহরটিই।

ভোর চারটেয় শহরের আর কেইবা ওঠে? এখানে তো ভোরের সূর্যের আলোর কেউ গায়ে মাখে না। পুবের ডগমগে চমৎকার সূর্যের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। গেট খুলে রশিদ বললো। এস। রাতের গাড়িতে এলে।

-হ্যাঁ। বাস থেকে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম।

-এত ভোরে পথে নামা তোমার ঠিক হয়নি। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটতো।

-আরে দুলাভাই। দুর্ঘটনার ওপর হাত আছে কার? ঘটলে ঘটতো। ওসব আমি কেয়ার করিনা।

-তোমার তো দেখছি

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।