সংবাদ শিরোনামঃ

তুরস্কে জনতার বিজয় ** এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্কের জনগণ রুখে দিল সেনা অভ্যুত্থান ** সঙ্কট নিরসনে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ** ২০ দলীয় জোট ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র ** তুর্কী গণপ্রতিরোধে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান ** রফতানি বাণিজ্যের নতুন চ্যালেঞ্জ : রাজনৈতিক অস্থিরতা ** মানবতাবাদী বিশ্ব ও সন্ত্রাসবাদী বিশ্বের মাঝখানে মুসলমানদের দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে ** সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে প্রয়োজন দলমত নির্বিশেষে সবার ঐক্য : নজরুল ইসলাম খান ** তুর্কী জনগণকে অভিনন্দন ** জাতীয় স্বার্থ বনাম হুকুম তামিল করার দৌড়ঝাঁপ ** এ শিক্ষা আমাদের কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ** দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজেও হরিলুটের অভিযোগ ** দুর্ভোগের আরেক নাম পাইকগাছার কপিলমুনি শহর ** কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক সঙ্কট : সেবা কার্যক্রম ব্যাহত ** কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা ** ইসলামী সংস্কৃতির আলোকেই হোক ঈদ আনন্দ ** বাংলা ভাগের জন্য মুসলমানরা নন হিন্দুরাই দায়ী ** কবির বিশ্বাস ** সানজিদা তাহসিনা বেঁচে থাকবে সবার মাঝে ** জাতির নিকট রেখে গেলেন অনেক প্রশ্ন **

ঢাকা, শুক্রবার, ৭ শ্রাবণ ১৪২৩, ১৬ শাওয়াল ১৪৩৭, ২২ জুলাই ২০১৬

উ প ন্যা স

স্বামীর ভিটে

নাজিব ওয়াদুদ
অনেক রাতে বাড়ি ফিরল সোহাগ। জমিলা তখনও জেগে। তার চোখে ঘুমের ঘোর। রোজকার মতোই খাওয়া-দাওয়া সাজানো ছিলো। তবে অবাক হলো সে। কারণ জমিলাও থালা টেনে নিয়ে বসল। সে যে আজকাল কখন খায়, কী খায়, নাকি খায়ই না জানতে পারে না সোহাগ। কিন্তু এটুকু ছাড়া আর কোনও ব্যতিক্রম নেই। তাই সেটা তার মনে আছর করল না। এমনিতেই তার শরীর-মন দু’টোই খারাপ আজ। সোলেমান শেখের সঙ্গে ঝগড়া করেছে। বেশ কিছুদিন থেকেই বনিবনা হচ্ছে না লোকটার সাথে। ইচ্ছা করে তার কিছু টাকা আটকে রেখেছে শেখ। সেটা চাইতে গিয়েই ঝগড়া। তারপর আফজাল স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে তার মাথা আরও গরম। বেশ কিছুদিন আগে একজোড়া কানের দুল গড়তে দিয়েছিল। বউটাকে দিয়ে যদি একটু মন গলানো যায়। ইচ্ছে ছিল সোলেমান শেখ টাকা দিলে গয়না নিবে। টাকা না পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে ছিল। তবু দুলজোড়ার খবর নিতে গেল সে। গিয়ে শুনল জমিলা তার গলার হার, হাতের বালা বন্ধক রেখে গেছে এই কিছুদিন আগে। হঠাৎ গয়না বন্ধক রাখার প্রয়োজন হলো কেন তার? তা-ও আবার গোপনে? তাকে না জানিয়ে? টাকার দরকার হলে তো তাকে বলতে পারত। 

খাওয়ার পর শোয়া। কিন্তু না শুয়ে বসল সোহাগ। পথে আসতে আসতে নিজেকে বারবার বুঝিয়ে বুঝিয়ে রাগ ধুয়ে তারপর বাড়ি ফিরেছে সে। খুব মোলায়েম সুরে সে বলল, তোর যে ট্যাকার দরকার আমাক্ বুলিস্নি ক্যান্?

বিস্মিত জমিলা। কিন্তু সে-ও আজ কঠিন শাসনে বেঁধেছে নিজেকে। নরম সুরে বলল, আমার ট্যাকার দরকার তুমাক্ কে বুইল্লো?

Ñতাহিলে গয়না বন্ধক রাখলি যে?

থতমত খেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নেয় জমিলা। Ñসত্যি কথা বুইল্বো? একটু থামল, তারপর সোহাগের নীরবতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে বলল, আমার লিজের কামে তুমার ট্যাকা আমি লিতে চাইনি। তাছাড়া তুমার বিলাকের ট্যাকা হাতে লিয়ার ইচ্ছা নাই আমার।

কথাটা এবার বেশ একটু রূঢ় হয়ে গেলো। হয়তো কণ্ঠেও ক্ষোভ প্রকাশ পেলো। কথাগুলো বলে ফেলার পর আফসোস করতে লাগল সে। আজ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল জমিলা কোনও বিষয় নিয়েই ঝগড়া করবে না সোহাগের সঙ্গে, রাগ দেখাবে না। কিন্তু এ বোধ হয় তার বদ-অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

ক্ষেপে গেলো সোহাগও। সারা সন্ধ্যার প্রচেষ্টা, এখনকার প্রয়াস, কোনওটাই আর কাজে লাগল না। সে চীৎকার করে à¦‰à¦ à¦²Ñ à¦†à¦®à¦¾à¦°, আমার, আমার! খালি আমার! তুই কার? বুল্, তুই কার?

উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায় সে। পায়চারী করতে থাকে ঘরময়। টেবিল থেকে বড় আয়নাটা তুলে মেঝেতে ছুঁড়ে মারে। Ñবুল্, তুই কার? বুল্!

হঠাৎ গিয়ে জমিলার মুখোমুখি বসে সোহাগ, বাসন-কোসন সামলাচ্ছিল মেয়েটা, দু’হাতে তার চুল আঁকড়ে ধরে পাগলের মতো ঝাঁকাতে থাকে। Ñতুই কি মানুষ না রে আমেনা? তোর বুকে কি ইট্টুক্ ভালোবাসাও নাই? কার লেগি আগলায়ে রাইখিছিছ্ তোর ভালোবাসা? বুল্ তো!

তারপর হাউমাউ করে কাঁদে। Ñতোক্ আমি ভালোবাসি রে! তোক্ আমি ভালোবাসি। তোর লেগি আমি সব কিছু কর্ইতে পারি...সব! কিন্তু তোর ঘিন্না-অবহেলা আমার আর সহ্য হোচ্ছে না।

বউকে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কাঁদতে থাকে সে। জমিলা সাড়া দেয় না। কিন্তু প্রত্যাখ্যানও করে না। কথাও বলে না সে।

রোজকার মতো ভোর হয়। ঘুম ভাঙ্গে ওদের। নিত্য ভোরের কাজ-কর্ম সারে। সোহাগের এখন বের হওয়ার সময়। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে নামল। বারান্দার ধাপির পাশে বসে ছিল জমিলা, বলল, তুমি বুলে দুকান খুইল্ছো আবার?

থমকে দাঁড়াল সোহাগ। রাতের ঘটনার পর তার মনটা অনেক হালকা লাগছে এখন। কান্নার দরকার ছিলো হয়তো। অনেক দিনের জমাট পাথরের মতো দুঃখ ও জ্বালা গলে গলে বেরিয়ে গেছে তার বুক থেকে। কিন্তু নিজেকে বড় ছোট আর হীনও মনে হচ্ছে তার। সকালে উঠে এখন পর্যন্ত জমিলার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি।

আশ্চর্য হলো সে তার কথা শুনে। সে যে আজকাল সোলেমান শেখের সঙ্গ ছেড়ে নিজের সৎ ব্যবসায় মন দিয়েছে সে খবর তাহলে রাখে জমিলা।

Ñদুকানে মুন দ্যাও। পারো তে ঐ সলেমান হারামির সাথে উঠা-বসা বাদ দ্যাও।

একবার আড়চোখে তাকালো সে স্বামীর দিকে। সেটা লক্ষ্য করে উচাটন হয়ে উঠল সোহাগের মন। কিন্তু সামলে নিল নিজেকে।

Ñবেশি রাইত্ কইরো না।

এবার দ্রুত পেছন ফিরে তাকাল সোহাগ। কিন্তু স্ত্রীর মুখটা দেখতে পেলো না। ততক্ষণে বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকছে জমিলা।

তোলপাড় করে উঠল সোহাগের বুক। বুঝে উঠতে পারল না এর মানে। দ্বিধা-সন্দেহে দোদুল্যমান হৃদয়ে শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে গেলো সে।

সত্যি বলতে কি বাইরে আজকাল আর মন টেকে না সোহাগের। বউটা আছে বাড়িতে। তাকে দারুণ ভালোওবাসে সে, যদিও জমিলার মন বুঝতে পারল না এগার বছরের বিবাহিত জীবনেও। ইদানীং মুখোমুখি হলেই কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে ওঠে দুজনেই। চিরকালই এ রকম করে গেলো জমিলা। কিন্তু সোহাগের মধ্যে এটা নতুন এসেছে। ওরা যেন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। মুষ্টিযোদ্ধাদের মতো। জানে এটা খেলা। স্রেফ খেলা। নিয়ম আছে। কানুন আছে। তবু প্রতিদ্বন্দ্বীকে মুষ্ট্যাঘাতে জর্জরিত করতে কী প্রতিহিংসাতেই না তারা মত্ত হয়ে ওঠে। তারাও যেন একে অপরকে কতো জ্বালাতে পারে, কতো তীব্র রূঢ়তায় জর্জরিত করতে পারে তারই প্রতিযোগিতা লড়ে চলেছে।

আজকাল সমিতি নিয়ে মেতেছে জমিলা। গাঁয়ের আরো অনেকেই করেছে এরকম ছোট ছোট সমিতি। কেউ করছে চাষ-আবাদ, কেউ ব্যবসা। কয়েকজনের টাকা মিলে পুঁজি গড়ে উঠছে। যাদের তাতেও হচ্ছে না তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। জিনিসটা খারাপ না, ভেবে দেখেছে সোহাগ। কিন্তু জমিলার প্রয়োজন কী এসবের? এসব সমিতি-ফমিতি করতে নিষেধ করেছিল সে। শোনেনি জমিলা। তার জেদটা যেন এমন যে সোহাগ মানা করছে বলে সেটা তাকে এখন করতেই হবে। ঠিক যেমন নিজে করছে সে। তার কাজ-কাম নিয়ে অবশ্য কখনও মাথা ঘামায় না জমিলা। কিন্তু ‘বিলাক’-এর কথা শুনে চুপ থাকতে পারেনি। এ নিয়ে একদিন কী-ই না ঝগড়া।

শান্ত ভাবেই কথাটা বলেছিল জমিলা। Ñকামডা ভালো না। লোকে ছি-ছাকারি কর্ইবে। আর দেখলে না কবির ভায়ের কী হইলো?

কবির এই গ্রামেরই ছেলে। কালোবাজারি করত। আসলে সে ছিল কামলা। বানেশ্বর হাটের মহাজন সোলেমান শেখের মাল এপার-ওপার করা ছিল তার কাজ। কদিন আগে সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ-এর গুলি খেয়ে মরেছে।

Ñআমি কি কবিরের মুতন কামলা নাকি? আমি কি মাল লিয়ে বর্ডারে যাই? ঘরে বইসি ব্যবসা করি। 

Ñঘরে বইসি ব্যবসা কর্ইলেই বাঁচপে মুনে কর্ইছো? রাজশাই শহরে কতো জনাক্ ধইরিছে সে খবর রাখো তুমি?

ভেতরে ভেতরে দমে যায় সোহাগ। শহরে স্মাগলারদের ধরে মারধর করছে মেজর বারেক। কাউকে কাউকে তো অর্ধ-উলঙ্গ করে মুখে চুনকালি মাখিয়ে গলায় ‘আমি স্মাগলার’ লেখা কাগজ ঝুলিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। কিন্তু কথায় হারতে চায় না সে। Ñআমি তোর কথাত্ চইল্বো নাকি? আমার যা ইচ্ছা তাই কর্ইবো। তোর কী? কী করবি তুই?

ক্ষেপে যায় জমিলাও। Ñম্যা মানুষ বুইলি আমাক্ গ্রাহ্য হোচ্ছে না, না? আমি যা পারি তুমি তা কল্পনাও কর্ইতে পারো না।

Ñজানি, জানি। ম্যা মানুষের শ্যাষ অস্ত্র তো বাপের বাড়ি যাওয়া। নাহয় বিষ খাওয়া। কিংবা গলাত্ দড়ি দিয়ে ঝুলা।

সোহাগের কাছে ভালোবাসা কখনও প্রত্যাশা করেনি জমিলা। উল্টে সোহাগই ভালোবাসার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে এসেছে। ইদানীং যদিও ত্যক্ত-বিরক্ত সে, তবু এ রকম কথা আশাতীত। কথাটা তার মনের মধ্যে ছুরির মতো বিঁধল।

Ñতুমি চাও আমি বিষ খায়ে মরি, না? অসম্ভব! সে ম্যা আমি না। ছিচকাঁদুনি ম্যারে মুতন কাইন্দি বুক ভাসানির মানুষ আমি না। আমি বাঁইচি থাকতে চাই। যে কইরিই হোইক্, যে অবস্থাতেই হোইক্, আল্লা যদ্দিন হায়াত দিইছে তদ্দিন আমি জিয়ায়ে থাকতে চাই।

Ñআমিও জীবনেক্ ভালোবাসি। আমিও দেখতে চাই কী আছে এই জীবনের শ্যাষে। এতোদিন ভুল কইরিছি। তোর মুখের দিক তাকায় আমি আমার সব আশা-আকাক্সক্ষা জলাঞ্জলি দিইছি। কী দিইনি তোক্? কী দিতে চাইনি? আমার সব কিছু তোক্ উজাড় কইরি দিতে চায়ছি। তার বিনিময়ে কী পায়ছি রে আমি? কী দিইছিছ্ তুই আমাক্! ভালোবাসা? শ্রদ্ধা? বন্ধুত্ব? সান্ত¡à¦¨à¦¾? ... একটা সন্তান পর্যন্ত দিতে পারিসনি তুই!

সোহাগের একেকটা কথা লোহার শেলের মতো গিয়ে বিঁধতে লাগল জমিলার হৃদয়ে। তার যন্ত্রণায় হতবাক, নিশ্চল, শক্তিহীন মাংসপিণ্ডে পরিণত হলো সে। ঠক-ঠক করে কাঁপতে লাগল। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে।

কিন্তু আগল খুলে গেছে সোহাগের মনের। সে বলে চলল, আমার মুনডা তিলে তিলে দগ্ধ হয় ইটের মুতন পুড়া খাক হয় গেছে। গাঙের চরের মুতন আমার অন্তরেও এখুন খালি বালুর চড়া। আমার ভিতরে আর কুনু ভালোবাসা নাই। দয়া নাই, মায়া নাই। বিবেক নাই, কিচ্ছু নাই। আমি এখুন যা ইচ্ছা তাই কর্ইবো।

ঝড়ের মতো বাঁধনহীন উচ্চারণে কথাগুলো বলে ক্ষ্যাপা, উ™£à¦¾à¦¨à§à¦¤à§‡à¦° মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সোহাগ। থ মেরে বসে রইল জমিলা। সোহাগের হাতের ধাক্কায় দরজার শিকলটা ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো দুলছে, আর ঠক-ঠক আওয়াজ করছে। তার একেকটা ঘা তার বুকের ভেতর গিয়ে বাজতে লাগল।

কতোক্ষণ এভাবে বসে থাকল তা তার নিজেরই জানা নেই। যেন এতোক্ষণ তার জ্ঞান ছিলো না। বোধ ছিলো না। হিতাহিত বিবেক ছিলো না। সে ছিলো এক অদ্ভূত মায়ার জগতে। সেখানে মানুষ নেই। গাছপালা নেই। বাতাস নেই। সে যেন পদ্মার বিশাল চর। শুধু বালুর ঘূর্ণি। আর তার মধ্যে কিম্ভূতকিমাকার মানুষের মতো কায়া। আর বিচিত্র সব রঙের ফুলঝুরি। বালুর ঘূর্ণিগুলো ওপরে উঠতে উঠতে আকাশ ছোঁয়, আবার সে পাহাড় ভাঙতে ভাঙতে, ঝরতে ঝরতে, চরের ওপর শুয়ে পড়ে।

প্রচণ্ড ঝড় উঠল। ঘরের দরজা-জানালা সব খোলা। ঝড়ের তাণ্ডব ঘরের ভেতর সব ওলট-পালট করে ফেলল। তারপর নামল অঝোর বৃষ্টি।

খাটের ওপর আছড়ে পড়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল জমিলা। 

 

পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলো সোহাগ। বাপ-মায়ের আদরের সন্তান। নামটাও তাই রেখেছিল সোহাগ। লাই পেয়ে পেয়ে স্নেহের দড়ি সেই যে লম্বা হয়েছিল তা আর চেষ্টা করেও গোটাতে পারেনি তার বাপ-মা। খেলাধুলা, আড্ডা আর ঘুরে বেড়ানোর নেশায় পেয়ে বসে তাকে। ক্লাস নাইনে পড়া অবস্থাতেই ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে নাম ছোটে তার। শেষ পর্যন্ত এই ফুটবল নিয়েই মেতেছিল। আশপাশে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে সে খেলতে যায়নি। এমনকি জেলার বাইরেও গিয়েছে। নামের সঙ্গে কিছু অর্থও আসতো। তাকে চেনে না এমন মানুষ এ অঞ্চলে মেলা ভার। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার ফল যখন বেরুল তখন দেখা গেলো পাসের তালিকায় তার নাম নেই। তারপরও দু-দু’বার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। সে সময় পর পর মারা গেলো বাপ-মা। লেখাপড়ার পাট সেখানেই চুকল। পৈত্রিক বাড়ি, জমি-জমা, সব ভাগ হয়ে গেলো। ভাইবোনরা ভিন্ন হয়ে যে যার মতো নিজ নিজ সংসার পাতল। সোহাগের ভাগে পড়ল পাঁচ বিঘে জমি। বউ-পরিবার নেই বলে তাকে ঠেলে দেয়া হলো বৈঠকঘর হিসেবে ব্যবহৃত বেড়ার ঘরে। তাতে দুঃখ পায়নি সে। কারণ বাড়িতে থাকতো সে খুবই কম। একা মানুষ, তার কোনও দায়-দায়িত্ব ছিলো না। এখানে-সেখানে খেলে বেড়ানোই তার একমাত্র নেশা ও পেশা হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু চিরকাল দিন এক রকম থাকে না। তার মতো, এমনকি তার চেয়েও ভালো খেলোয়াড়দের জায়গা ছেড়ে দিতে বড় মনঃকষ্ট নিয়ে বাড়িমুখো হতে হলো তাকে। এতদিন সে চলেছে রাজার হালে। আদর-যতœ-সম্মান-হাততালির ঘোরের মধ্যে সময় কীভাবে কেটেছে তা সে নিজেও জানে না। গ্রামের মানুষের কাছে সে হয়ে উঠেছিল অতিথির মতো। সে ভাব কাটতে অবশ্য বেশি সময় লাগল না। শেষ পর্যন্ত গাঁয়ে থিতু হয়ে চাষবাসে মন দিলো। কিন্তু তাতে পরতা হয় না। জমিতে আগের মতো ফসল ফলে না। পদ্মার তীরে তাদের গ্রাম, জমিগুলো সব ডাঙ্গা, উঁচু। নদীর পানির সঙ্গে ওঠানামা করে জমির রস। ফারাক্কা বাঁধের কারণে আশ্বিন মাস থেকেই হু হু করে কমতে থাকে পদ্মার পানি। নদীর বুক জুড়ে মাথা তুলতে শুরু করে দু’কূল জোড়া অসংখ্য চর, ক্রমেই সে সব চর বিস্তৃত হয়, মিশে যায় একটার সঙ্গে আরেকটা, তখন নদী পরিণত হয় মরুভূমিতে। আর বুক শাদা চরগুলো কেবলি উঁচু হয়, উঁচু হয়... আর ডুবতে চায় না ভরা বর্ষাতেও। নদীতে পানি না থাকলে ডাঙ্গাও শুকিয়ে যায়। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যেতে থাকে। মাঘ-ফাল্গুনেই খাল-বিল, পুকুর-নালা সব ফেটে চৌচির। তখন বৃষ্টিই একমাত্র ভরসা। অথচ কয়েক বছর থেকে বৃষ্টি আসছে দেরিতে। আগে হঠাৎ হঠাৎ খরা ছাড়া চৈত্র-বৈশাখের মধ্যেই বৃষ্টি হতো। এখন প্রায়ই দেখা যাচ্ছে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়েও বৃষ্টির দেখা মেলে না। আউশ-পাট বোনাই যায় না। এ অঞ্চলে আউশ ধান ছিল প্রধান ফসল। আমনও কম হতো না। এখন আশ্বিন-কার্তিকে ধানের বুকে যখন থোড় তখন শুরু হয় বৃষ্টির টান। মাটির নিচের পানিও নামতে থাকে। কার্তিক-অগ্রহায়ণে চৈতালী ফসলও বোনা যায় না। জমিতে রস থাকে না যে! কখনও বুনতে পারলেও ফাল্গুন-চৈত্র মাসে রসের টান, আর পদ্মার বুক থেকে উঠে আসা তপ্ত বাতাস ও বালুর ঝাপটায় চৈতালী ফসলের ফুল-পাতা শুকিয়ে যায়। ফলন হয় না। ফারাক্কার অভিশাপে ঋতু বদলায় না শুধু, বাধ্য হয়ে মানুষ বদলায় তাদের চাষ-বাস ও পেশা।

তবু জমি-জিরেত নিয়েই ছিলো সোহাগ। নতুন করে আখের আবাদ শুরু করেছে তারা। আখের চাষ আগেও ছিলো। কিন্তু এখন সেটাই প্রধান ফসলে পরিণত হয়েছে। এতে বেশি পানি লাগে না। একবার সে আখও পোকা লেগে নষ্ট হয়ে গেলো। সে বছর তাকে নতুন করে শুরু করতে দাদন নিতে হয়েছিল বানেশ্বরের সোলেমান শেখের কাছে। কোটিপতি লোকটা। ধান-চালের আড়ত, গম পেশাই ও ডাল ভাঙ্গা মিল, সার-বিষের ডিলারশিপ, আরও অনেক জানা-অজানা ব্যবসা তার। হাট ডাক নেয়। মজুতদারি করে। কালোবাজারির থানদারও সে। আর একটা বড় কারবার সুদখোরি। খুব সহজ হিসাব। যা-ই নিবে চার মাসে দেড়গুণ। বছর ঘুরলে দ্বিগুণ। সুলতানদের গ্রাম নয় শুধু, আশপাশের আরও অনেক গ্রামেই তার খদ্দের আছে। উপায় নেই। শুকনো মওসুমে পানির অভাবে মাটি শুকিয়ে যায়, আর বর্ষা এলে খাল বেয়ে ঘোলা পানি উঠে আসে গ্রামের মাঠে, বিলে, সব ডুবে যায়। বহু কালের পুরনো মাটির বাঁধটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিচু হয়ে গেছে। বর্ষায় হঠাৎ স্রোতের তোড় সইতে পারে না। ভারত তখন নাকি ফারাক্কা বাঁধের সবগুলো গেট খুলে দেয়। নদীর চরপড়া বুকে পানি ধরে না। ধাক্কা মারে বাঁধটায়। ব্রিটিশ আমলের বাঁধটার সংস্কার হয়নি কত কাল। শুকনোর কালে খরা, বর্ষাকালে বন্যা, এই এখন তাদের ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং বছরের দুই ফসলের জন্যেই দাদন লাগে গরিব কৃষকের। সোলেমান শেখের সুদের কারবার এখানকার তিন-তিনটা ব্যাংকের চেয়ে কম জম-জমাট নয়। আড়ালে-আবডালে লোকে তাকে কসাই বলে ডাকে। কথাটা মিথ্যে নয়। পাই-পয়সার হিসাবেও ছাড় নেই তার কাছে। তো সেই লোকটাই কেমন করে ভালোবেসে ফেলল সোহাগকে। বলল, এসব কইরা চলবো না, বুঝলে? ব্যবসা কর। ব্যবসাতে লক্ষ্মী! একদিন, দু’দিন, লোভ বসে যায় সোহাগের মনে। বড়লোক হওয়ার সাধ কার না জাগে! ব্যবসা করে তার চোখের সামনেই তো আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হলো কত জন।

সোলেমান শেখই বুদ্ধি দিলো। Ñট্যাকা নাই তো কী হইছে! জমি ব্যাচো এক বিঘি। কিছু দাদন ল্যাও আমার কাছ থাইকা। আর মাল আমি বাকিতে লিয়ার ব্যবস্থা কইরা দিমু।

তা-ই করল সোহাগ। বানেশ্বর বাজারে দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করে দিলো। কসমেটিক্স, মনোহারী জিনিসের ব্যবসা। ব্যবসাতে সত্যিই লক্ষ্মী! উন্নতি হতে লাগল। শেখ বলে, ব্যবসা, ট্যাকা-পাইসা, সব তকদিরের জিনিস, বুঝ্লা মিয়া! তকদিরে থাকলে সুময় লাগে না।

হাতে টাকা এলে কতো রকমের সখ জাগে মানুষের মনে। কিন্তু এই যৌবন কালে ঘরে একটা যুবতী বউ না থাকলে কোনও সখ জমে না! তাছাড়া বয়স তো কম হলো না। মেয়ে দেখতে লাগল সোহাগ। চোখের সামনে কতো মেয়ে ঘুরে বেড়ায়, কতো জনকে ভালোও লাগে, কিন্তু বিয়ের জন্যে যোগ্য মেয়ে পাওয়া যায় না। হতাশ হচ্ছিল সে। শেষে ঘটক লাগালো।

সেদিন ছিলো হাটবার। দোকানে বসে ছিলো সোহাগ। এখন তার একটা কর্মচারী হয়েছে। ছেলেটা বেশ কাজের। বিচার-বিবেচনা আছে। আদব-কায়দাও চমৎকার। সে-ই আসল কাজ করে। সোহাগ শুধু ক্যাশে বসে টাকা-পয়সার লেন-দেন করে। সপ্তাহের বাকি ছয় দিনের সমান বেচা-কেনা একেকটা হাটের দিনেই হয়। সেদিনও খদ্দের কম ছিলো না। ব্যস্ত ছিলো সে। কিন্তু ওর মধ্যেই হঠাৎ তার চোখ পড়ল লোকটার ওপর। জব্বার মুনশী। বাস থেকে নামল। সঙ্গে একটা মেয়ে। যুবতী। নিশ্চয় তার মেয়ে। তার মনে পড়ে মুনশী চাচার একটা মেয়ে ছিলো বটে। তার নামটা কোনও মতে স্মরণ করতে পারল না সে। সে-ই নাকি? বাব্বাহ! এত্তো বড় হয়ে গেছে! চেনাই যায় না। তারা শুধু একই গ্রামের নয়, একই পাড়ার মানুষ। তবু, বাইরে বাইরে ঘুরতো বলে পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে তার ওঠা-বসা কমই ছিলো। জব্বার মুনশীকে তার খুব ভালোই মনে পড়ে। তাই দেখেই চিনেছে। কিন্তু মেয়েটার চেহারা সে ভুলেই গিয়েছিল। কাজের লোকটাকে দিয়ে ডাকাল সে মুনশীকে।

Ñআসেন চাচা, আসেন। বসেন।

কর্মচারী ছেলেটা বেশ সভ্য-ভব্য, দু’টো টুল এগিয়ে দিলো সে।

Ñতুমি রহেজুদ্দিন ভায়ের ছেলি না?

Ñজে চাচা। এক গাল হাসল সোহাগ। Ñআপনের মুনে আছে দেখছি?

হাসলো মুনশীও। Ñতুমার বাপের চেহারাডা একদম তুমার মুতনই ছিলো। তুমার চায়ে আরো লম্বা ছিলো তুমার বাপ। তে তুমি কয় নম্বর, বাপ?

Ñছুটু। সকলার ছুটু আমি। সোহাগ।

Ñও! তুমি তো খালি খেইলি বেড়াতে। ভালো আছো বাপ?

চা-মিষ্টি আনালো সোহাগ।

মেয়েটা চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। শাড়ি পরা, মাথায় ঘোমটাও আছে। তবে কুমারী মেয়ে তা বোঝা যায়। কারণ, মাথার ঘোমটা বারবার পিছলে যাচ্ছে। চোখে-মুখে অপার কৌতূহল। ঘুরে ঘুরে তাকে দেখছিল সোহাগ। একবার চোখাচোখিও হলো।

বাপের ভিটা দেখতে এসেছে মুনশী। জীবনের তাগিদে গ্রাম ছেড়েছে, কিন্তু মনের টান যায়নি। মেয়েটাও অনেকদিন থেকে বলছিল।

সুযোগ পেয়ে সোহাগ বলল, এডি কি আপনের সেই ম্যা, চাচা?

Ñহ্যাঁ! হায় রে আল্লাহ, চিনতে পারোনি তুমি? আমার ম্যা, জমিলা।

জমিলা। মনে মনে আওড়ায় নামটা, আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে মেয়েটাকে। একটু একটু করে যেন মনে পড়তে থাকে। একটা চটপটে, ডানপিটে, রাগী ধরনের মেয়ের কথা স্মরণ হয় তার। Ñআচ্ছা, এ-ই কি হুসেনেক্ বদনা ছুঁইড়ি মাইরিছলো না?

খাওয়া বন্ধ হয়ে যায় মেয়েটার। ড্যাব-ড্যাব করে তাকাল সে কথকের দিকে। লাজুক হেসে মুনশী বলল, ঠিক মুনে পইড়িছে তুমার। তে ম্যা-র আমার রাগ ইট্টুক বেশিই ছিলো। ছুটু বেলার কথা। তখুন ভালো-মুন্দ বুদ্ধি ছিলো না। এ্যাখুন অবশ্য ঠিক হয় গেছে। বড়ো হয়ছে তো! 

মেয়েটাকে, মানে জমিলাকে সেদিনই মনে ধরে সোহাগের। মুনশীও মেয়ের জন্যে পাত্র খুঁজছিল। ছেলে হিসেবে সোহাগ খারাপ কী? দেখতে-শুনতে ভালো। বংশ বনেদী। উঠতি ব্যবসা। বেশ খানিকটা জমি-জিরাতও আছে। নেই বলতে একটা ভালো বাড়ি। পকেটে টাকা থাকলে সেটা হতে কতক্ষণ! বিয়ে একেবারে পাকাপোক্ত করে গেলো মুনশী। 

তারপর তাদের দাম্পত্যের এগার বছর পেরিয়ে গেলো এর মধ্যেই। কিন্তু মেয়েটাকে আজও বুঝে উঠতে পারল না সোহাগ। কী চমৎকার সংসারী, গোছানো স্বভাবের মানুষ। তাকে ঘর-বাড়ি নিয়ে কখনও ভাবতে হয় না। পুরনো বেড়ার বাড়ি ভেঙ্গে মূল ভিটা ছেড়ে নতুন জমিতে নতুন ইটের বাড়ি তুলেছে। সেটা জমিলার বাপ-দাদার ভিটার কাছেই, পাড়ার শেষ প্রান্তে। সে বাড়ি বানাতে হাতে-বুকে-ঠেলে কাজ করেছে সে। এমন মেয়ের বিরুদ্ধে সংসারের প্রতি টান নেই এই অভিযোগ সে করতে পারে না। হয়তো তার স্বভাবটাই এমন। এমন সব মানুষ হয়তো থাকে, তারা ভালো, কিন্তু তাদেরকে বোঝা যায় না। মানে সবাই বুঝতে পারে না।

জমিলা ঘরে আসার পর থেকে তার ব্যবসায় বরকত হয়েছে। নিজের যথেষ্ট পুঁজি থাকলে এতোদিনে সে লাখপতি বনে যেত। তাছাড়া ইদানীং ব্যবসাতে মন বসাতে পারছে না সে। টাকা বানানোর জন্যে যে নেশা দরকার তাতে আজকাল যেন ঘাটতি দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে। শুরুটা যেভাবে হয়েছিল, মাঝখানে যেভাবে বাড়ছিল, ব্যবসার হাল এখন আর সে রকম নেই। আসলে মন ভালো নেই তার। লোকে বলে, ঘরে শান্তি না থাকলে বাইরের স্বস্তি নষ্ট হয়। সোহাগের হয়েছে সেই অবস্থা। অথচ জমিলার সঙ্গে ঝগড়া নেই তার। অভিমানও নেই। শুধু একটাই দুঃখ তার মেয়েটার মনের হদিস পেলো না সে।

মেয়েটার কোনও চাহিদা নেই যেন। কেন নেই সেটাই জট পাকায় সোহাগের মনে। তার বাসনা, তার কাছে জমিলা কিছু দাবি করুক, চাক তার কাছে, এটা দাও, ওটা দাও, এই চাই, ওই চাই করে করে প্রতিদিন, সারাক্ষণ, জ্বালাতন করুক তাকে। শাড়ি-গয়না কোনও কিছুর প্রতি তার মোহ নেই। অন্তত সে রকম কোনও লক্ষ্মণ তার মধ্যে দৃষ্টিগোচর হয় না। অথচ দিলে প্রত্যাখ্যানও করে না। একেবারে নিরাসক্তও নয়, আবার আহ্লাদে উদ্বেলও হয় না। স্বামীর কাছ থেকে কিছু চেয়ে পাওয়ার সখ, আনন্দ বা অধিকার কি সে  অনুভব করে না?

প্রথম প্রথম সন্দেহ করেছে সোহাগ, মেয়েটার কি অন্য কোনও পুরুষের প্রতি গোপন টান আছে? সম্ভাব্য অনেকের কথাই ভেবেছে সে। হোসেন তার মধ্যে একজন। আপন চাচাতো ভাইবোন ওরা। একই বাড়িতে এক সঙ্গে মানুষ হয়েছে ছোটতে। মুনশীর সঙ্গে সে-ও সিংড়ায় গিয়েছিল। বেশ কিছু কাল থেকেছে সেখানে। এখানে চলে আসার পর সিংড়ায় খুব একটা যেত না সে। সম্পর্ক থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া হোসেনের সঙ্গে জমিলার সম্পর্ক থাকলে তাদের মধ্যে বিয়ে দিতে মুনশীর আপত্তি থাকার কথা নয়। ছেলে হিসাবে হোসেনও এমন খারাপ কিছু নয়। বংশ তো একই। সহায়-সম্পত্তি বেশি না থাকলেও কর্মঠ ছেলে। বিয়ে দিয়ে সিংড়াতে রেখে দিলে ভালোই হতো বরং মুনশীর জন্যে। তার তো ছেলেমেয়ে মাত্র দুটি। এসব গবেষণা-চিন্তা-ভাবনার পরেও অনেক চালাকি-চাতুরী করে, পর্যবেক্ষণে রেখে দেখেছে সোহাগ, সন্দেহ করার মতো কিছু পায়নি। হ্যাঁ, একসঙ্গে মানুষ হওয়া চাচাতো ভাইবোনের মধ্যে কিছু সৌহার্দ্য, কিছু ভালোবাসা, কিছু টান, কিছু মান-অভিমান থাকতেই পারে। সে রকম কিছু হয়তো কখনও কখনও লক্ষ্য করেছে। তার বেশি কিছু নয়। অনেক ভেবে দেখেছে সোহাগ, স্রেফ এগুলোকে গর্হিত ভাবা কষ্টকল্পনা বৈ কিছু নয়। তাহলে কি স্রেফ ব্যাপারটা এই রকম যে, মনে মনে যে রকম একটা পুরুষের কল্পনা জমিলা করেছিল সোহাগের মধ্যে তা পায়নি? কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারে না সে। বউ-এর মন পাওয়ার জন্যে কী-ই না সে করেছে। দীর্ঘদিন একাদিক্রমে লেগে থেকে, একটা একটা করে তার পছন্দগুলো আবিষ্কার করেছে, আর সেগুলো এনে হাজির করেছে। সেসব দূরে ঠেলে দেয়নি জমিলা, কিন্তু তার মন গলেছে এমন কোনও আলামতও পাওয়া যায়নি। তারপর ভেবেছে সন্তান হলে হয়তো ঠিক হয়ে যেত। আল্লাহ সে নেয়ামত থেকেও তাদের বঞ্চিত করে রেখেছে। কতো বলেছে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্যে কোনও মতে রাজী হয়নি সে।

ইদানীং হতাশ এবং ক্লান্ত সোহাগ। তাদের দু’জনের সংসার এখন চলছে যান্ত্রিক নিয়মে, ঘড়ির কাঁটার মতো, যেমন করে দম দেওয়া আছে, তেমন করেই ঘুরছে তাদের জীবনের কাঁটা। তারা দু’জন যেন চাবি দেওয়া দু’টো খেলনা পুতুল। তবে মাঝে-মধ্যে এমন সব আচরণ করে জমিলা যে তার ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না সোহাগ। যেমন সেদিন রাতে ভাত না খাওয়ার ব্যাপারটা। কেন খেলো না? কার ওপর রাগ? কিসের জন্যে রাগ?

সকালে কোনও গোলমাল হয়নি। গোলমাল তাদের মধ্যে তো কখনই হয় না। সেদিনও হয়নি। সারাদিন সে বাইরে ছিলো। মাঝে-মধ্যে এটা হয়। হ্যাঁ, বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়েছে। তা-ই বা আর কতো! এমনিতে প্রায়ই তো সাড়ে ন’টা-দশটা বাজেই। সেদিন এগারটা পেরিয়ে গিয়েছিল। অপেক্ষা করতে করতে হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছিল। কিন্তু ঘুমাতেও পারেনি। একা, নির্জন বাড়িতে সেটা নিশ্চয়ই কষ্টের ব্যাপার। কিন্তু তার জন্যে তাকে গালাগালি করুক না! যা আসে মুখে বলুক। তাতেও শান্তি পাবে সে। তার নীরব, প্রতিবাদহীন, প্রতিক্রিয়াহীন আচরণ তাকে আরও কষ্ট দেয়।

জমিলা কি তার জন্যে উৎকণ্ঠায় থাকে? তার আচরণ দেখে সোহাগের কখনও তা মনে হয়নি। সেদিন রাতেও তার চোখে-মুখে তেমন কোনও আভাস-ইঙ্গিত সে দেখতে পায়নি। যেন এটাই স্বাভাবিক, এর অপেক্ষাতেই ছিলো সে, তা যত কষ্টের কারণই হোক, এ রকম নিরাসক্তি ও ঔদাসীন্যই দেখা গেছে তার মধ্যে। হয়তো সে ধরে নিয়েছে যে, ব্যাপারটা কষ্টের কিন্তু এটাই তার ভবিতব্য, এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনও উপায় নেই, তাই নির্বিকার চিত্তে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে। আবার ভাবে, যদি তাই হবে তাহলে ভাত না খাওয়ার অভিমান, শরীর স্পর্শ করতে না দেওয়ার রাগ, এসবের কারণ কী?

হতে পারে এর পেছনে আসলে অন্য কোনও কারণ আছে। হয়তো তার শরীর খারাপ ছিলো। হয়তো বৃদ্ধ বাপ-মায়ের কথা মনে করে দুঃখ পাচ্ছিল। এসব কষ্টের কথা প্রিয় কাউকে বলতে পারলে হালকা হয় বুক। তা পারেনি। কিংবা হোসেন মাছ দিয়ে গেছে। গেছে তো গেছে। মাঝে-মধ্যেই দিয়ে যায়। তা নিয়ে কোনও অভিমান-রাগের তো প্রশ্ন তো আসে না। কারও ওপরেই না। তার ওপরে তো নয়-ই। এই অভিমান কেবল তখনই আসতে পারে, কেবল তখনই, যখন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় কোনও অপ্রকাশিতব্য যন্ত্রণায়, কোনও অকহতব্য দুঃখের জ্বালায়। কী সেটা? কিসের যন্ত্রণায় নিজেকে পোড়ায় মেয়েটা? আর তাকেও জ্বালায়? অস্থির হয়ে ওঠে সে।

 

বানেশ্বরের বাজার ভাঙ্গে এশার আজানের বেশ পরে, যখন সত্যিকারের রাত নামে গভীর হয়ে। সোহাগ অবশ্য অত দেরি করে না। এশার আজানও হয়, সে-ও দোকানের শাটার নামায়। দোকান বন্ধ করে সোলেমান শেখের গদীতে গিয়ে খানিকক্ষণ গল্প করে। তারপর বাড়ি। তখন বেশ রাত হয়। কিন্তু আজ আর স্থির থাকতে পারে না সোহাগ। তার মন আনচান করতে থাকে। সকালের কথা মনে পড়ে বারবার। Ñবেশি রাইত্ কইরো না। কথাটা খুবই সাধারণ। সারাদিনের জন্যে বাড়ি থেকে কাজে বেরিয়ে যাওয়া স্বামীর প্রতি একজন স্ত্রীর, বিশেষ করে যে থাকে একেবারেই একাকী, তার পক্ষে এ রকম কথা বলা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এতোদিনের দাম্পত্যের জীবনে এমন কথা কখনও শোনেনি সে। এর মধ্যে ভালোবাসা, আকুলতার গন্ধও হয়তো নেই। তারপরেও কথাটা নতুন। অভাবিতপূর্ব। সে কথাটাই বারবার তার কানে অনুরণিত হতে হতে, তার হৃদয়ের আকুলতার প্রভাবেই হয়তো বা, এক ধরনের রঙ পায়। সেটা যেন একটা আকাক্সক্ষা, একটা তৃষ্ণার লাজুক প্রকাশ হিসেবে প্রতিভাত হয় তার কাছে।

মাগরিবের নামাজের পরই দ্রুত দোকান বন্ধ করে সে। বাড়ি যাওয়ার আগে একবার সোলেমান শেখের গদীতে আজও যেতে হবে। টাকা পেলে জমিলার বন্ধকি গয়না তুলে নিয়ে যাবে। সেটা আজকের জন্যে নিশ্চয়ই একটা ভালো কাজ হবে।

গদীতে নেই শেখ। তখন গুদাম চত্বরের অফিসে গেলো সোহাগ। বাইরে গেটের মুখে আলো জ্বলছে। লোহার গেটের ভারি পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকল সে। অফিস ঘরের দরজার কাছে যাওয়ার আগে আধখোলা জানালা। সেই জানালা গলে শাদা আলো পড়ছে বাইরের বারান্দায়। সেটা পেরোতেই একটা কথা কানে এলো তার। দাঁড়িয়ে পড়ল সে।

শেখ বলছে, ঐসব সমিতি-টমিতি সব ফিনিশ কইরা দিতে হইবো। আজ বাঁধডা কাইট্যা দে, গাঙের পানিতে ডুইব্যা ভাইস্যা যাউক সব কিছু। আর ঐ হারামি মাস্টার... ওই শালার লাশ চাই বুঝলি! গাঙ্গের পানিতে ভাসায়ে দিবি অর লাশ।

মাস্টার লোকটা সমাজসেবী। পদ্মা শুকিয়ে যাওয়ায় ফসল হয় না দেখে বিকল্প উপায় অনুসন্ধানে কাজ করছে সে। সরকারি কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে মিলে সে নানান ফিকির বের করছে। যেমন হোসেনদের কলার আবাদ। আর ছোট ছোট সমিতি গড়ে কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। লোকজন আজকাল মহাজনদের কাছ থেকে দাদন না নিয়ে ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছে। সেজন্যে লোকটার ওপর মহাজনদের রাগ। টাঙ্গন গ্রামে সোলেমান শেখের জমজমাট দাদন ব্যবসা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তাই মাস্টারের ওপর তার ক্রোধের সীমা নেই। 

স্বার্থে লাগলে রাগ হতেই পারে, তাই বলে এতদূর! শিউরে উঠল সোহাগ। এ সময় ঘরে ঢোকা ঠিক হবে কিনা ভাবতে লাগল সে। বরং ফিরে যাওয়াই ভালো মনে করে ঘুরল সে। তখনই ঘর থেকে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো কে একজন। তাকে দেখে হৈ হৈ করে উঠল লোকটা। Ñকে? এই, কে ঐডা?

লোকটার কণ্ঠ চিনতে পারল না সোহাগ। এক ঝলক দেখে তাকে চিনতেও পারল না। কোনো নতুন লোক হবে হয়তো। থতমত খেয়ে দৌড় লাগাল সে। লোকটা ধর-ধর করে চেঁচিয়ে উঠল। হৈ চৈ শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সবাই। তাড়া করল তাকে। আলোতে পেছন থেকে তাকে চেনা যাবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বাজারে গেলে ঠিকই তারা খুঁজে বের করবে তাকে। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই তাকে যে কোনও মূল্যে পাকড়াও করতে চাইবে তারা। তাছাড়া শেখের এই ষড়যন্ত্রের খবর জানাতে হবে গ্রামবাসীকে। দৌড়তে দৌড়তেই এসব চিন্তা তার মাথায় ভিড় করল। সেজন্যে বাজারে না গিয়ে বাড়ির পথে এগুলো সে। গুণ্ডাদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে একটু এগিয়ে মাঠের মধ্যে খানিকক্ষণ লুকিয়ে থাকল। সেদিকে কেউ এলো না দেখে বাড়ির পথ ধরল শেষে। ওরা হয়তো বাজারের দিকে গেছে। এই ফাঁকে পালাতে হবে। গ্রামে গিয়ে শেখের সব ষড়যন্ত্রের কথা বলে দেবে সে, ভাবল সোহাগ। বাঁধ কেটে দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ভেসে যাবে গোটা à¦—à§à¦°à¦¾à¦®Ñ à¦˜à¦°-বাড়ি, গরু-ছাগল, ক্ষেতের ফসল, সব কিছু। সেটা সে হতে দেবে না। এতো বড় সর্বনাশ হতে দিতে পারে না সে। আর সাবধান করে দিতে হবে মাস্টারকেও। আগে-ভাগেই। আর তার জন্যে হয়তো অপেক্ষা করছে জমিলা। বলেছে, বেশি রাইত্ কইরো না। নিশ্চয়ই তার জন্যে আকুল হয়ে অপেক্ষা করছে সে।

আসলে অনেক দিন থেকেই বলছিল সোলেমান শেখ। তার মহাজনী সুদের ব্যবসা মার খাচ্ছিল। কালোবাজারিরও অসুবিধা হচ্ছিল। গ্রামবাসীকে ‘ম্যানেজ’ করতে চেয়েছিল। গ্রামের লোকদের ওপর সোহাগের প্রভাব আছে, তাই তাকে এ কাজে ব্যবহার করতে চাইছিল শেখ। রাজী হয়নি সোহাগ। এখন অন্য পথ নিয়েছে শেখ। লোকটা যে এতো সাংঘাতিক তা তার ধারণার অতীত ছিল।

আকাশে ঘন মেঘ। দূরে বিজলি চমকাচ্ছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। তার কাছে টর্চ লাইট আছে, কিন্তু জ্বালাচ্ছে না। পাছে আলো দেখে শত্রুরা টের পেয়ে যায়। তীক্ষè চোখে, কান সজাগ রেখে চলেছে সে। পায়ের নিচে রাস্তাভর্তি কাদা।

হঠাৎ তার মনে হলো বাম দিকে মাঠের মধ্যে একটু শব্দ শুনল। সেদিকে তাকাল সোহাগ। কিন্তু এমনই গভীর অন্ধকার যে কিছুই চোখে পড়ে না। শব্দটাও আর পাওয়া যাচ্ছে না। কাদা-পানিতে কোনও জলজ প্রাণী বা জন্তুর নড়াচড়ার শব্দ হবে হয়তো, ভাবল সে। আর তখনই তাকে অতর্কিত চমকে দিয়ে গুলির শব্দ উঠল। পরপর কয়েকবার। সোহাগের মনে হলো তার বাম জানুতে জোরে ধাক্কা মারল কেউ। পড়ে গেলো সে। যন্ত্রণায় ভয়ে চীৎকার করে উঠল। আবার গুলি। সাঁই-সাঁই করে তার মাথার ওপর দিয়ে ছুটে গেলো পর পর কয়েকটা। কয়েকজন মানুষের ছুটে আসার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ওরা যে শেখের গুণ্ডা, তাকে মারতে ওঁৎ পেতে ছিলো, তা বুঝতে আর বাকি থাকে না তার। ক্ষতস্থান ছুঁয়ে দেখল ভেজা। গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে। বাম হাত দিয়ে চেপে ধরে উঠল সে। ওরা ছুটে আসছে। Ñশালারে লাগছে মুনে লয়। র্ধ শালারে।

পেছনে সরতে লাগল সোহাগ। পথে থাকলে ওকে ধরে ফেলবে গুণ্ডারা। সে বামে, ওরা পথের যেদিকে আছে সেদিকেই নামল। রক্তের চিহ্ন দেখে দেখে তাকে অনুসরণ করবে ভেবে দ্রুত গায়ের জামা খুলে শক্ত করে বাঁধল ক্ষতটার ওপরে। তারপর ছুটল। গুণ্ডারা পথের ওপর উঠে টর্চ মেরে মেরে খুঁজছে তাকে। মাঠের মধ্যে পানি এখন। দৌড়ানো তো দূরের কথা দ্রুত হাঁটতেও পারছে না সোহাগ। পায়ে গুলির ক্ষত। তার ওপর শব্দ হবে এই ভয়। সামনে একটা পাটের জমি। তার মধ্যে ঢুকে একটুখানি বসল সে।

গুণ্ডারা একবার রাস্তার এদিকে, আরেকবার ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করছে। তারপর এক জায়গায় জড়ো হলো ওরা। টর্চের আলো গুণে সোহাগের ধারণা হলো গুণ্ডারা সংখ্যায় চার-পাঁচ জন হবে। হয়তো পরামর্শ করল ওরা। তারপর পথের ডানে মাঠের মধ্যে নেমে গেলো। ওটা বানেশ্বরে ফেরার পথ নয়। টাঙ্গনে যাওয়ার সোজা, সংক্ষিপ্ত মেঠো রাস্তা। দিনের বেলা, বা শুকনোর সময় টাঙনের লোকেরা ঐ পথেই আসা-যাওয়া করে। গুণ্ডারা ঐ পথে এগুলো মানে তাকে না পেয়ে হয়তো বাঁধ কাটতে গেলো, সন্দেহ হলো সোহাগের। এখন যে কোনও উপায়ে তার বাড়ি ফেরা দরকার। তখন হঠাৎ তার অনুভব হলো খুব দুর্বল লাগছে। শরীরটা ভারি হয়ে উঠেছে। কষ্ট করে পাটের ক্ষেতের আরও ভেতরে ঢুকল সে। একবার ত্বরিত টর্চ জ্বেলে দেখল রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার পা। তখনও গলগল করে রক্ত ঝরছে। এ অবস্থায় বাড়ি পৌঁছা তার পক্ষে অসম্ভব। রক্তক্ষরণ হয়ে পথেই মারা যাবে। কিংবা হয়তো আবার পড়বে গুণ্ডাদের সামনে। তার চেয়ে কাছের কোনও লোকালয়ে ওঠা ভালো। এই ঘটনার কথা লোকজনকে জানানো দরকার। তাছাড়া বাঁচতেও চায় সে। চিকিৎসা পেলে সে বেঁচে যাবে। মনে জোর পেলো সোহাগ। গা থেকে গেঞ্জিটা খুলল। কষে বাঁধল ক্ষতটার ওপর। এখন ভীষণ যন্ত্রণা বোধ হচ্ছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হলো। পাটক্ষেতের আলে উঠল সে। পাশের গ্রামের দিকে এগুলো। সেখানকার অনেক লোক তার চেনাজানা।

 

বিছানায় বসে অপেক্ষা করছিল জমিলা। কখন যে তন্দ্রা এসে গেছে টের পায়নি। ধড়মড় করে কাত হয়ে পড়ে গিয়ে সম্বিত ফিরল তার। তখন সব মনে পড়ল। স্বামীকে বরণ করার জন্যে সেজে-গুজে তৈরি হয়ে আছে সে। আজ তাদের বাসর হবে। নতুন করে। মানুষটাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে। তাড়াতাড়িই ফিরবে সে। সে যে তার জন্যে দিওয়ানা-প্রাণ!

কিন্তু এখনও ফিরল না কেন? তার মনে হলো অনেকক্ষণ থেকে বসে আছে সে। এখন অনেক রাত। সে নিজেই অবাক হয়ে অনুভব করল অজানা আশঙ্কায় তার হৃদয়ে হাহাকার শুরু হয়ে গেছে।

বিছানা থেকে নামল জমিলা। বাইরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। টিনের চালে তার গানের ঝুমঝুম শব্দ। সেই শব্দ ছাপিয়ে তার কানে ঢুকল লোকজনের চীৎকার-চেঁচামেচি। তার বুকে কে যেন হাতুড়ি পেটাতে লাগল। হারিকেন হাতে নিয়ে বারান্দায় বেরুল সে। সেকি! উঠোনভর্তি পানি। পানি তো নয়, পানির স্রোত! এমন বৃষ্টি তো হয়নি!ভয়ে চীৎকার করে উঠল সে। নিশ্চয়ই বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। গাঙের পানি ঢুকছে হু-হু করে। একবার এ রকম হয়েছিল। তখন অনেক ছোট ছিল সে। এসব ভাবল সে, কিন্তু ভয়ে নিচে নামতে পারল না। চীৎকারে গলা ফাটাতে লাগল।

কিছু নেই। শুধু পাকা বাড়ি কয়েকটা। আর বড় বড় কিছু গাছ মাথা জাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের ঘর-বাড়ি, আসবাব, পোশাক-আশাক, তৈজস-পত্র, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী, কুকুর-বিড়ালের মরদেহ ভেসে বেড়াচ্ছে যত্র-তত্র। অনেকগুলো মানুষের লাশ উদ্ধার হয়েছে। যেন নূহ নবীর প্লাবন বয়ে গেছে। পদ্মা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে টাঙনসহ আরও কয়েকটা গ্রাম। এই গ্রামগুলো যেন ছিলোই না কোনও দিন। সবখানে শুধু পানি আর পানি। ঘোলা পানির স্রোত বয়ে চলেছে উত্তরে। যেন গাঙটা পশ্চিম থেকে এসে এখানে একটা শাখা খুলে দিয়েছে উত্তরমুখো।

ময়নার বাপ, খালেক হাজী, ছুরাতন বেওয়া এবং এদের মতো আরও পাঁচ জন মুরুব্বী ও এগার জন শিশুর লাশ পাওয়া গেছে। খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না আরও অনেকের। গভীর রাতের অকস্মাৎ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে ওরা। ছুটে এসেছে সরকারি-বেসরকারি উদ্ধারকারীরা। মানুষ সরে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ে। এ রকম বন্যার কবলে কখনও পড়েনি এ অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু কেউ ভেবে পেলো না এভাবে বাঁধ ভাঙল কী করে!

বিকেল নাগাদ জানা গেলো আসল কথা। লোক পাঠিয়ে বাঁধ কেটে দিয়েছে সোলেমান শেখ। সোহাগ সে খবর জানতে পেরেছিল। সে ছুটে যাচ্ছিলো গ্রামে। শেখের গুণ্ডারা তাকে গুলি ছুঁড়ে আহত করে। অনেক কষ্টে পালিয়ে পাশের গ্রামে পৌঁছেছিল সে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। লোকেরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার শরীর রক্তশূন্য হয়ে পড়েছিল। সেখানে চিকিৎসা করেও তাকে বাঁচাতে পারেনি ডাক্তাররা। কিন্তু অজ্ঞান হওয়ার আগেই অনেক কথা বলতে পেরেছে সে। সে খবর বারুদের আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে বানেশ্বর বাজারে। তারপর আশপাশের গ্রামে। তারপর সর্বত্র। শত শত মানুষ বানেশ্বর বাজারে সোলেমান শেখের বাড়ি ঘেরাও করে। পুলিশ আসে। সরকারের লোকেরা আসে। জনতাকে শান্ত ও নিবৃত্ত করার পর শেখকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ওরা।

জমিলা পাথর হয়ে গেছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল মাস্টার। স্বামীর লাশ দেখে এতটুকুও কাঁদেনি সে।

কিছু পানি নেমে গেলো আশপাশ খাল-বিল ডুবিয়ে-ভাসিয়ে। বাকিটা ধীরে ধীরে ফিরে গেলো পদ্মায়। গোটা গ্রামে এখন কাদা আর কাদা। কারও কারও ভিটের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। সব মাটি সমান। খাদ-খন্দক-পুকুর-নালা কাদা-পানিতে ভরা। মাঠময় আটকে রয়েছে বন্যার পানি। ফসলের চিহ্ন নেই কোথাও। গাছপালা উপড়ে পড়ে আছে এখানে-সেখানে। বসবাসের অযোগ্য এই কাদা-পানির মধ্যেই গ্রামে ফিরতে শুরু করল লোকেরা।

 

ঘর-সংসার আবাদ-পানি রেখে কতদিন আর বসে থাকা যায়। জব্বার মুনশী যাওয়ার জোগাড় করে। মেয়েকে নিয়ে যেতে চাইছিল সে। কিন্তু কোনোমতেই রাজি নয় জমিলা। ভাঙবে তবু মচকাবে না এমনই দড়ো মেয়ে তার, জানে মুনশী। এমনিতেই বাপের ওপর অভিমান আছে তার। সেই যে বিয়ের পর-পর কয়েকবার আসা-যাওয়া করেছে, তারপর কতদিন বাপের বাড়ি যায়নি! ছোট ভাইটার বিয়ে হলো। সে নিজে এসেছিল তাকে নিতে। তবু যায়নি। এবারও গোঁ ধরেছে। এ গোঁ ভাঙ্গা যাবে না জেনেও শেষবারের মতো মেয়েকে বোঝায় মুনশী। Ñএকা একা কী কইরি থাক্পি রে মা?

Ñআমার কুনু অসুবিধা হবে না।

Ñকী কইরি দিন চইল্বে সেকথা ভাইবিছিছ্?

Ñক্যান?আমার সুয়ামির ব্যবসা আছে, জমি-জিরাত আছে, আমার অভাব কিসের? আমি ব্যবসা কইরবো, আবাদ কইরবো...

Ñতুই ম্যা মানুষ, একলা...

Ñক্যান?আমার কি বুদ্ধি নাই?গতরে শক্তি নাই?পাড়া-প্রতিবেশী নাই?

হার মানে মুনশী। মহা ফাঁপরে পড়ে সে। মেয়ে তো এখনো যুবতী। সারাটা জীবন পড়ে রয়েছে সামনে। পাশে স্বামী নাই, সন্তান নাই, বাপ নাই, ভাই নাই... জীবন কি এতই সোজা? আবেগের জোরে অনেক কিছুই বলা যায়। কিন্তু আবেগ চিরদিন থাকে না। রূঢ় বাস্তবতার আগুনে আবেগের রস শুকাতে সময় লাগে না। তবু অবুঝ মন মেয়ের। স্বামীর ভিটে ছেড়ে যেতে চায় না। মেয়ের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে জব্বার মুনশী। 

পাড়ার লোকেরা ভাবে, হঠাৎ ভারি স্বামীভক্ত হয়ে উঠেছে মেয়েটা। এমন তো ছিলো না আগে!

কিন্তু ভাবে না সে নিজে কিছু। তার এই অস্বাভাবিক স্বাভাবিকতাই অস্বাভাবিক ঠেকে সবার কাছে। তার একটাই কথা। Ñকী হয়ছে আমার? মানুষের কি সুয়ামি মরে না? তাই বুইলি সুয়ামির ভিটি ছাইড়ি পালায়ে যায় মানুষ? কেউ কর্ইলেও কর্ইতে পারে। আমি সে রকুম মানুষ না। তার কণ্ঠে প্রতিজ্ঞার সুর বেজে ওঠে।

তার এই কথা শুনে মুনশীর মনে পড়ে অনেক আগের একটি কথা। এই জমিলাই তাকে à¦¬à¦²à§‡à¦›à¦¿à¦²Ñ à¦•à¦¬à§‡ দ্যাশ মরুভূমি হয়া যাবে বুইলি বাপ-দাদা চোদ্দ পুরুষের ভিটি রাইখি পালায়ে যাবেন আপ্নে? ক্যান?আপনের মুতন সব লোকই যদিল্ পালায়ে যায় তাহিলে কী হবে? 

মেয়ের একথা শুনে জমিলার মা বলেছিল, ঠিকই তো!

সেদিন অনেক যুক্তি দেখিয়েছিল জব্বার মুনশী। তারা মন থেকে না মানলেও প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেনি। তবে সিংড়ায় গিয়ে তার লোকসান হয়নি। এখানে থাকলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতো সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

জমিলার স্বামীর ভিটে আঁকড়ে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় যেন তাকে বিদ্রুপ করতে থাকে। কে জানে এভাবেই মেয়েটা তার ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে কিনা!

অগত্যা একাই চলে যাওয়ার উদ্যোগ নেয় জব্বার মুনশী। কিন্তু কী বলে বিদায় নিবে সেকথা ভাবতে গিয়ে তার চোখ দুটো অশ্রুতে ভরে উঠলো। বারান্দায় থামের সঙ্গে ঠেস দিয়ে বসে আছে জমিলা। তার পাশে এক হাতে থামের ওপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির ময়না। হঠাৎ ওয়াক-ওয়াক করে উঠলো জমিলা। সে দ্রুত ছুটে গেলো বাড়ির কাণ্ঠার দিকে। তার পেছন পেছন ময়না। Ñকী হলো বুবু, কী হলো?

সামান্য কিছু ওঠে কি ওঠে না, শুধু ওয়াক-ওয়াক।

Ñবুবু?

চোখ তুলে তাকালো জমিলা। কী তরল, কোমল, দরদ-উথলানো চোখ! তার মুখটা দুহাতের তালুতে নিয়ে ময়না ফিসফিস করে à¦‰à¦ à¦²Ñ à¦¬à§à¦¬à§!

চোখ বুঁজলো জমিলা। তাকে জড়িয়ে নিলো ময়না। ছোট্ট মেয়ের মতো ক্লান্তিতে ময়নার বুকে নিজেকে সঁপে দিলো সে।

হতভম্ব মুনশী। সে বুঝে পেলো না কাঁদবে না হাসবে।

সে বেলা আর যাওয়া হলো না তার।

বিকেলে বারান্দায় বসে বাপের দিকে মুখ তুলে তাকাতে গিয়ে প্রথম মা হওয়ার লজ্জায় লাল হয়ে গেলো জমিলা।

মুনশী বলল, আমেনা, মা রে! আমি আর যাবো না। আমি আবার এখিনে চইলি আসপো। 

ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় গেলো, বিস্মিত দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো জমিলা। তারপর বকা খাওয়া ছোট্ট বালিকার মতো ফুলতে ফুলতে হঠাৎ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। মেয়েকে বুকে টেনে নিলো মুনশী। Ñতুই পার্ইলে আমি পারবো না ক্যান? বুল্? মরুভূমি হোইক্ আর না হোইক্ আমি এই দ্যাশেই থাক্পো। তখন শেষ বিকেলের লালচে আলোয় দিগন্তবিস্তৃত চরাচর জুড়ে কতো যে রঙের খেলা! আজ এই বিশাল দুকূলপ্লাবী গাঙের এক কোণে যেভাবে ডুবে যাচ্ছে সূর্যটা, আগামীকাল সেভাবেই তার এই বিপুল কোলের আরেক কোণ থেকে জেগে উঠবে নতুন একটি সোনালী ভোর, ঘনায়মান সন্ধ্যার রহস্যময়তার গভীরে যেন ঘটে চলেছে তারই স্বপ্ন রচনার কাজ।

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।