সংবাদ শিরোনামঃ

তুরস্কে জনতার বিজয় ** এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্কের জনগণ রুখে দিল সেনা অভ্যুত্থান ** সঙ্কট নিরসনে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ** ২০ দলীয় জোট ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র ** তুর্কী গণপ্রতিরোধে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান ** রফতানি বাণিজ্যের নতুন চ্যালেঞ্জ : রাজনৈতিক অস্থিরতা ** মানবতাবাদী বিশ্ব ও সন্ত্রাসবাদী বিশ্বের মাঝখানে মুসলমানদের দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে ** সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে প্রয়োজন দলমত নির্বিশেষে সবার ঐক্য : নজরুল ইসলাম খান ** তুর্কী জনগণকে অভিনন্দন ** জাতীয় স্বার্থ বনাম হুকুম তামিল করার দৌড়ঝাঁপ ** এ শিক্ষা আমাদের কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ** দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজেও হরিলুটের অভিযোগ ** দুর্ভোগের আরেক নাম পাইকগাছার কপিলমুনি শহর ** কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক সঙ্কট : সেবা কার্যক্রম ব্যাহত ** কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা ** ইসলামী সংস্কৃতির আলোকেই হোক ঈদ আনন্দ ** বাংলা ভাগের জন্য মুসলমানরা নন হিন্দুরাই দায়ী ** কবির বিশ্বাস ** সানজিদা তাহসিনা বেঁচে থাকবে সবার মাঝে ** জাতির নিকট রেখে গেলেন অনেক প্রশ্ন **

ঢাকা, শুক্রবার, ৭ শ্রাবণ ১৪২৩, ১৬ শাওয়াল ১৪৩৭, ২২ জুলাই ২০১৬

সরদার আবদুর রহমান
প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশ আবহমানকাল ধরেই নদীমাতৃক দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এর যেমন একান্ত নিজস্ব বিপুল ধারা সম্বলিত জলাধার বিদ্যমান, তেমনি অতি নিকট প্রতিবেশী ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর মধ্য দিয়ে আসা নদী-নালাও আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশকে সদা উজ্জীবিত করে রাখে।

বলতে গেলে বাংলাদেশের যে রিভার নেটওয়ার্ক- তার প্রধান উৎস ও প্রবাহই নিকট প্রতিবেশী ভারতের উপর একান্তই নির্ভরশীল। একারণেই ‘অভিন্ন নদী’, ‘আন্তঃসীমান্ত নদী’, ‘আন্তর্জাতিক নদী’ প্রভৃতি শব্দমালার উৎপত্তি ঘটেছে। যেসব নদীতে একাধিক রাষ্ট্রের মালিকানা বা অংশীদারিত্ব আছে, সেসব নদীকে অভিন্ন নদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায়, যে নদী তার উৎস থেকে দীর্ঘ পথের প্রবাহ পরিক্রমায় দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে মিলিত হয়েছে এই ধরনের নদীকে অভিন্ন নদী হিসেবে অভিহিত করা হয়। এদিক থেকে আন্তঃসীমান্ত নদী, সীমান্ত নদী কিংবা আন্তর্জাতিক নদীসমূহকেও অভিন্ন নদী বলা যেতে পারে। আবার, দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদীই আন্তঃসীমান্ত নদী। এগুলোকে বহুজাতিক নদী বা আন্তর্জাতিক নদীও বলা হয়।

বাংলাদেশে আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা মোট ৫৭টি। তন্মধ্যে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত ৫৪টি ও বাংলাদেশ-মায়ানমারের মধ্যে প্রবাহিত রয়েছে তিনটি। এই সংখ্যা যৌথ নদী কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত। বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক সংস্থাসহ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক বাস্তব ও সরেজমিনে পর্যবেক্ষণে যে হালনাগাদ হিসাব পাওয়া যাচ্ছে তাতে উপরোক্ত সংখ্যার ব্যাপক গরমিল দাঁড়িয়েছে। আসলে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের অভিন্ন নদীর সংখ্যা বর্তমান হিসাবে দাঁড়াচ্ছে ১০১টি। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে- যদি দেশের উত্তর ও উত্তরপূর্ব এবং দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলের সীমান্তবর্তী পাহাড়গুলোতে ব্যাপক পরিদর্শন-পর্যবেক্ষণ করা হয়। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, গোমতী, সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, নাফ, কর্ণফুলি ইত্যাদি নদী আন্তঃসীমান্ত নদীর উদাহরণ। হেলসিংকি কনভেনশনে আন্তঃসীমান্ত নদীর যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা হলো দুই বা ততোধিক দেশের সীমান্ত অতিক্রমকারী ভূউপরস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানি প্রবাহভিত্তিক।

আন্তর্জাতিক নদী

International Law Association (ILA)  à¦†à¦¨à§à¦¤à¦°à§à¦œà¦¾à¦¤à¦¿à¦• নদীর সংজ্ঞা দিয়েছে,  ‘An International River is one which flows through or between the territories of two or more states.’ সমকালীন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বলা যায়, যেসব নদী একাধিক রাষ্ট্রের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় সেসব নদীকে আন্তর্জাতিক নদী বলা হয়। পৃথিবীর অধিকাংশ বড় নদীই বহুজাতিক। বহুজাতিক নদী আবার অভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন- সীমানা নদী, সমুদ্রে পতিত নয় এমন বহুজাতিক নদী এবং সমুদ্রে পতিত এমন বহুজাতিক নদী। শেষোক্ত নদীকে আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। গঙ্গা, নীল, আমাজান, দানিয়ূব, ব্রহ্মপুত্র ইত্যাদি আন্তর্জাতিক নদী। বিশে^র প্রায় ২৬১টি নদী আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে এরকম নদী কেবল গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র। ইউরোপের রাইন ও ভল্গা নদী, এশিয়ার মেকং, চেনাব, রাভী, সিন্ধু, দজলা, ইউফ্রেটিস প্রভৃতি নদী আন্তর্জাতিক নদী। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত এমনভাবে যুক্ত যে এর নদীসমূহ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। একারণে বিপুল সংখ্যক নদী ‘অভিন্ন নদী’ হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেছে।

বাঁধ-ব্যারেজ-জলবিদ্যুৎ প্রকল্প

বাঁধ হলো নদীর প্রবাহের সাথে সমকোণে (আড়াআড়ি) স্থাপিত প্রতিবন্ধক এবং পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল স্থাপনা, যেমনটা কাপ্তাই বাঁধ। সাধারণত খরোস্রোতা নদীর প্রবাহকে বাঁধ দিয়ে আটকে এর উজানে জলাধার তৈরি করে পানির উচ্চতা বাড়ানো হয়। এরপর জলাধারের নিচে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে এই পানিকে প্রবাহিত করে টারবাইন ঘুরিয়ে উৎপন্ন করা হয় বিদ্যুৎ। সুতরাং বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো বা কমানো মানে জলাধার থেকে পানি ছেড়ে দেয়ার পরিমাণ কম-বেশি করা। বর্ষা মওসুমে নদীতে পানির প্রবাহ বাড়লেও জলাধারে আটকে রাখার কারণে ভাটি অঞ্চলে পানির প্রবাহ কমে যাবে। অন্যদিকে শুষ্ক মওসুমে উজান থেকে পানি কম আসলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনে জলাধার থেকে নিয়মিত পানি ছাড়া হবে, ফলে বাঁধের ভাটিতে পানির প্রবাহ আগের থেকে বাড়বে। অন্যদিকে ব্যারেজ হলো নদীর পানিকে একাধিক গেইট দিয়ে নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রবাহিত করা। ব্যারেজের ঠিক উজানে এক বা একাধিক কৃত্রিম খাল খনন করে নিয়ন্ত্রিতভাবে পানি প্রবাহিত করে আরো ছোট ছোট খাল দিয়ে (তিস্তা ব্যারেজ, বাংলাদেশ) বা পাম্পের মাধ্যমে (জিকে প্রকল্প, বাংলাদেশ) আবাদী জমিতে সেচ দেয়া হয় অথবা অন্য কোন নদীতে পানি প্রবাহ বাড়ানো হয় (যেমন ফারাক্কা ব্যারেজ)। অর্থ্যাৎ ব্যারেজের মূল লক্ষ্যই থাকে একটি নদী থেকে পানি অপসারণ, অন্যদিকে বাঁধের মূল উদ্দেশ্য উজানে পানি সঞ্চয়। ভারতের টিপাইমুখ প্রকল্প শুধু বাঁধ নয়। টিপাইমুখ প্রকল্পের উদ্দেশ্যের মধ্যে এই বাঁধ থেকে ৯৫ কি.মি. ভাটিতে একটি ব্যারেজ (ফুলেরতাল) নির্মিত হয়েছে। উজান এবং ভাটি- দুই দিকেই বাঁধের প্রভাব পড়ে। উজানে কৃত্রিম জলাধারের কারণে এবং ভাটিতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কারণে।

উজানে বাঁধের সাধারণ প্রভাব : (ক) কৃত্রিম জলাধারের কারণে বিশাল এলাকা পানির নিচে নিমজ্জিত হয়, ফলে মানুষের ঘরবাড়ি আবাদী জমিসহ শুষ্ক-শুকনো এলাকা জলাভূমিতে পরিণত হয়। বনভূমি ও অন্যান্য উদ্ভিদ পানির নিচে তলিয়ে পচে গিয়ে বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে, ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রীন হাউস গ্যাস বাড়ায়। (খ) নদীর স্থানে জলাধার তৈরির ফলে পানির উপরিতলের ক্ষেত্রফল বাড়ে, যা স্বতঃবাষ্পীভবনের (ইভ্যাপরেশন) হার বাড়ায়। আগে নদী থেকে যে পরিমাণ পানি বাষ্প হতো, এখন অনেক বেশি পরিমাণ স্বতঃবাষ্পীভূত হয়। এটি প্রকারান্তরে নদীর পানির প্রবাহকে কমিয়ে দেয়। এর পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। এক হিসেব মতে আমেরিকার ‘হোভার ড্যামে’র কারণে সৃষ্ট ‘লেক মেড’ থেকে বাৎসরিক ৩৫০ বিলিয়ন গ্যালন পানি কমে যায় এবং নদীর প্রবাহ কমিয়ে দেয়। (গ) বাঁধের সবচাইতে বড় প্রভাব হলো বাস্তুসংস্থান বিপর্যয়। বাঁধের উজানে স্বাভাবিকভাবেই একটি স্থলজ বাস্তুসংস্থান ছিল। সেটি সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়ে একটি কৃত্রিম জলজ বাস্তুসংস্থান তৈরি হয়। এতে করে অনেক প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়। (ঘ) এছাড়াও বহু প্রজাতির মাছ বছরের একটি বিশেষ সময়ে ভাটি থেকে উজানে যায়। বাঁধের কারণে মাছের এই অভিবাসন সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়ে উৎপাদন কমে বা নিঃশেষ হয়। (ঙ) শুধু পানিই নয়, নদী প্রবাহ বয়ে নিয়ে চলে বিপুল পরিমাণ পলি। বাঁধের ফলে উজানে নদীর গতিবেগ অনেক কমে যায়, পানির পক্ষে এই পলি আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না, তা ধীরে ধীরে নিচে পড়ে জলাধারের বুকে জমতে থাকে। এটি জলাধারের নিচের স্তরের উচ্চতা বাড়িয়ে দেয়।

ভাটিতে এর সাধারণ প্রভাব

(ক) পানিবিদ্যুৎ বাঁধের কারণে স্বভাবতই বর্ষা মওসুমে প্রবাহ কমে, ফলে ভাটি অঞ্চলের স্বাভাবিক জলজ বাস্তুসংস্থান ব্যাহত হয়। যেসকল জলজ প্রাণীর প্রজননে বাৎসরিক বন্যা সম্পর্কযুক্ত, তাদের স্বাভাবিক প্রজনন ব্যাহত হয়। এছাড়াও স্বাভাবিক বন্যায় আশেপাশের স্থলাভূমি থেকে জলজ প্রাণীর প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য নদীতে মেশে। সুতরাং স্বাভাবিক বন্যা ব্যাহত হলে এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় এবং ফলশ্রুতিতে এদের বিলুপ্তি ঘটে। (খ) গভীরতা অনুযায়ী পানির বেগ নদীতে ভিন্ন ভিন্ন হয়। সাধারণত নদীর তলদেশে বেগ কম থাকে আর উপরিতলের ঠিক আগে থাকে সর্বোচ্চ। উলম্ব তল বরাবর পানির বেগের পরিবর্তনের উপর নির্ভর করে নদীর বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ধরনের মাছ অভিযোজিত হয়। এই বেগের পরির্বতন মাছের স্বাভাবিক অভিযোজন বিনষ্ট ও জীবনচক্র ধ্বংস করে। ধ্বংস হয় ভাটির মৎস্য সম্পদ। (গ) ‘নি¤œà¦¾à¦žà§à¦šà¦²’ সমতল ভূমির বৈশিষ্ট্য। প্রাকৃতিক নিয়মে বর্ষায় নদীর পানি উপচে এইসব নি¤œà¦¾à¦žà§à¦šà¦²à¦—ুলো পূর্র্ণ হয়ে সারা বছর জলজ প্রাণীর অভয়াশ্রমে পরিণত হয়; উদাহরণ স্বরূপ বাংলাদেশের হাওড়গুলো। এই নি¤œà¦¾à¦žà§à¦šà¦²à¦—ুলোই আবার শুষ্ক মওসুমে পানি মওজুদের কাজ করে, যা থেকে ছোটছোট নদী-খালগুলো ‘বেইজ ফ্লো’ হিসেবে পানির যোগান পায়। এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে নি¤œà¦¾à¦žà§à¦šà¦²à¦—ুলো সঠিক সময়ে পানি না পাওয়াতে এদের স্বাভাবিক ‘মরফোলজি’ ব্যাহত হবে। আর সেই সাথে এর উপর নির্ভরশীল ছোট ছোট নদী-খালগুলো শুকিয়ে যাবে। (ঘ) বাঁধের ফলে নদীর সমস্ত পলি উজানের জলাধারের নিচে সঞ্চিত হওয়ার কারণে, টারবাইনের মধ্যে দিয়ে পানির যে প্রবাহ ভাটিতে পরিবাহিত হয় তা সম্পূর্ণরূপে পলিমুক্ত থাকে আর তাই এর পলি ধারণক্ষমতাও হয় সর্বোচ্চ। ফলে তা ভাটিতে প্রবাহিত হবার সময় নদীর বুক আর পাড় থেকে মাটি নিয়ে যায়। আর তাই নদী ক্ষয়ের পরিমাণ হঠাৎ করে বিপুলাংশে বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের নদীনির্ভর অবস্থান

বাংলাদেশে ৭১০টি ছোটবড় নদীর মধ্যে ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী, যার ৫৪টি ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত। এই সংখ্যা এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত। আর বার্ষিক গড়ে ১০ লাখ ৭৩ হাজার ১৪৫ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি ভারত-নেপাল থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বৃষ্টিপাতের ফলে ২ লাখ ৫০ হাজার ৪০১ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি বাংলাদেশের নদীনালা-খাল-বিল-জলাশয়গুলো পেয়ে থাকে। বরাক-মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদীর মধ্য দিয়ে যথাক্রমে ১৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার, ৭০০ বিলিয়ন ঘনমিটার ও ৫০০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিন্ন নদী রয়েছে ৫৪টি। এসব নদী হলো, ১. রায় মঙ্গল, ২. ইছামতি-কালিন্দী, ৩. বেতনা-কোদালিয়া, ৪. ভৈরব-কপোতাক্ষ, ৫. মাথাভাঙ্গা, ৬. গঙ্গা, ৭. পাগলা, ৮. আত্রাই, ৯. পুনর্ভবা, ১০. তেঁতুলিয়া, ১১. টাঙ্গন, ১২. কুলিক, ১৩. নাগর, ১৪. মহানন্দা, ১৫. ডাহুক, ১৬. করতোয়া, ১৭. তালমা, ১৮. ঘোড়ামারা, ১৯. দেওনাই-যমুনেশ্বরী, ২০. বুড়ি তিস্তা, ২১. তিস্তা, ২২. ধরলা, ২৩. দুধকুমার, ২৪. ব্রহ্মপুত্র, ২৫. জিনজিরাম, ২৬. চিলাখালি, ২৭. ভোগাই, ২৮. নিতাই, ২৯. সোমেশ্বরী, ৩০. যদুকাটা, ৩১. ধামালিয়া, ৩২. নোয়াগঞ্জ, ৩৩. ইউসিয়াম, ৩৪. ধলা, ৩৫. পিয়ান, ৩৬. সারিগোয়াইন, ৩৭. সুরমা, ৩৮. কুশিয়ারা, ৩৯. সোনাই বড়দাল, ৪০. জুরি, ৪১. মনু, ৪২. ধলাই, ৪৩. লংগলা, ৪৪. খোয়াই, ৪৫. সুতাং, ৪৬. সোনাই, ৪৭. হাওড়া, ৪৮. বিজনী, ৪৯. সালদা, ৫০. গোমতি, ৫১. ফেনী-ডাকাতিয়া, ৫২. সেলুনিয়া, ৫৩. মুহুরী ও ৫৪. ফেনী।

অভিন্ন নদীসমূহে ভারতের বাঁধ-ব্যারেজ প্রকল্প

ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ ও তা চালুর পর থেকে বিষয়টি আন্তর্জাতিক আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। হালে আলোচনায় এসেছে ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনা, তিস্তা, মহানন্দা ও বরাক নদী। এমনকি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবহমান অভিন্ন ৫৪টি নদীর প্রসঙ্গও উঠে আসছে। বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য ভয়ঙ্কর সংবাদ হলো, এই অভিন্ন নদীসমূহের প্রায় প্রতিটিতে এবং এর উপনদীগুলোতেও ভারত অসংখ্য প্রকল্প নির্মাণ করেছে এবং আরো প্রকল্পের জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করে চলেছে। এর মধ্যে যেমন আছে বৃহৎদাকার ব্যারেজ, ড্যাম, সেচ ক্যানেল, আছে বিদ্যুৎ প্রকল্পও। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে যেমন অভিন্ন নদীসমূহের পানি উজানে একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে, তেমনি পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের নদী তথা পানিসম্পদের মালিকানা ও অধিকার থেকে এদেশের জনসাধারণ বঞ্চিত হচ্ছে। যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ এবং মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন।

ভারতের নদীকেন্দ্রিক কর্মপরিকল্পনার লক্ষ্য

ভারতের নদীকেন্দ্রিক কর্মপরিকল্পনার লক্ষ্য প্রধানত তিনটি। ১. কৃষি জমিতে সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, ২. জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ৩. বন্যা নিয়ন্ত্রণ। এছাড়াও এসব প্রকল্পের ফলে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন, স্বাদু পানি সরবরাহ প্রকল্প স্থাপন এবং পর্যটন ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো হয়। নদীসমূহ বিভিন্ন উৎস থেকে পানির প্রবাহ লাভ করে থাকে। ১. মূল উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রবাহ, ২. বৃষ্টির পানি, ৩. উপনদীর প্রবাহ ৪. ঝর্ণাধারার পানি এবং লোকালয় থেকে নালা-নর্দমা দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি। ভারতের প্রকল্পগুলোর জন্য মূলত প্রথম তিনটি উৎসকে বেছে নেয়া হয়েছে। বিস্তীর্ণ ভারতজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদীগুলোর বিপুল জলরাশিকে ব্যবহার করে নিজেদের সমৃদ্ধির সোপান গড়ে তুলতে চায় তারা। তাদের গৃহিত কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, নদীর পানি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরের জন্য খাল বা ক্যানেল খনন, এক নদীর সঙ্গে অপর নদীর সংযোগ সাধন, নদীর উচ্চতম স্থানে ড্যাম তৈরি ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন, ব্যারাজ ও ব্রিজ নির্মাণ, নদীর এক বেসিন হতে অন্য বেসিনে পানি স্থানান্তর। ভারত ইতোমধ্যে দৃশ্যমান নদ-নদীগুলোর ওপর ৩ হাজার ৬০০টি বাঁধ বেঁধেছে। আরো ১ হাজার বাঁধের নির্মাণ কাজ চলছে পুরোদমে। গত অর্ধশতাব্দীতে ভারতে বন্যা-খরায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত- এ ব্যাপারে পরিসংখ্যান নেই। ভারত প্রায় সবক’টি উৎসকেই বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। এভাবে এসব উৎসের শতকরা ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে।

গঙ্গা ও উপনদীতে অসংখ্য প্রকল্প

ভারত তার বহু সংখ্যক সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মূল গঙ্গা এবং এর উপনদীগুলোর ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নিচ্ছে। শুধু ফারাক্কা নয়, গঙ্গা-পদ্মাকেন্দ্রিক বাঁধ, জলাধার, ক্রসড্যাম, রেগুলেটরসহ অন্তত ৩৩টি মূল অবকাঠামো নির্মাণ করেছে ও করে চলেছে ভারত। এরসঙ্গে রয়েছে আনুষঙ্গিক আরো অসংখ্য ছোট-বড় কাঠামো। নতুন করে উত্তরাখণ্ড রাজ্য সরকার ৫৩টি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

ভারত অনেক আগে থেকেই গঙ্গায় বৃহৎদাকার তিনটি খাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এরমধ্যে রয়েছে, ‘আপারগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ এবং ‘নি¤œà¦—ঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট।’ এ ধরনের প্রকল্পের হাজার হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে তারা গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়ে সেচ দেবার ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ‘উপর গঙ্গা খাল প্রকল্পের’ মাধ্যমে উত্তর প্রদেশের ২৫ লাখ একর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যে ৬ হাজার কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ নামের প্রকল্পে মূল ও শাখাসহ খননকৃত খালের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার এবং ‘নিম্নগঙ্গা সেচ প্রকল্পের’ জন্য ৬ হাজার কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। এছাড়াও ভারত গঙ্গার ‘বাড়তি’ পানি কাজে লাগিয়ে ৩ লাখ ১ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেবার জন্য ‘পূর্ব গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ তৈরি করেছে। এর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪০০ কিলোমিটার। এসব ক্যানেল প্রকল্প চাঙা রাখতে নিয়মিতভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ভারতের ভেতরের গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানির উৎস বৃদ্ধির সহায়ক উপনদীগুলোতেও বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পানির জন্য হাহাকার করলেও ফারাক্কায় পানি না থাকার অজুহাতে বাংলাদেশকে পানি বঞ্চিত করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভারত অনেক ভেতরেই বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশমুখী প্রবাহকে বন্ধ করে রেখেছে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রসহ প্রধান নদীগুলো এসব উপনদী থেকে বিপুল পানি প্রবাহ লাভ করে থাকে। গঙ্গা নদীতে পানির প্রবাহ বৃদ্ধির অন্যতম সহায়ক নদী হলো ভাগিরথী, ঘাগরা, কোশি ও গন্ডক। নেপাল থেকে উৎসারিত এসব নদীতেও ভারত নিজ এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করেছে। গঙ্গার উজান থেকে ভাটির দিকে বাম পাশে অবস্থিত এসব নদী সারা বছর গঙ্গাকে নাব্য রাখতে অনেক সহায়ক হয়। গঙ্গার অন্যতম উপনদী গোমতি, রামগঙ্গা, কর্ণালী, ঘাগরা, ধাউলিগঙ্গা প্রভৃতিতে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মূল গঙ্গার প্রবাহ।

ব্রহ্মপুত্র-যমুনার ধারা

ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে বাংলাদেশ ৬৭ শতাংশ প্রবাহ পেয়ে থাকে। বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার উপনদী ও শাখা-প্রশাখার মধ্যে রয়েছে, তিস্তা, ধরলা, করতোয়া, আত্রাই, হুরাসাগর, সুবর্ণসিঁড়ি, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী, দুধকুমার, ধরিয়া, ঘাঘট, কংস, সুতলা  প্রভৃতি। এসব নদীর অববাহিকা হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বিস্তৃত অববাহিকা। তথ্যে প্রকাশ, ভারত তার পরিকল্পনা মোতাবেক গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র দু’টি অববাহিকায় পানির ৩৩টি সঞ্চয়াগার নির্মাণ করবে। প্রতিটি সঞ্চয়াগারের ধারণ ক্ষমতা হবে ১ লাখ ৫০ হাজার কিউসেক। অর্থাৎ ৩৩টি সঞ্চয়াগারের সর্বমোট ধারণ ক্ষমতা হবে প্রায় ৫০ লাখ কিউসেক পানি। এই পানি ভারতের পূর্ব, মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে সেচ কাজে ব্যবহার করা হবে। এর আওতায় থাকবে ৩ কোটি ৫০ লাখ হেক্টর জমি। পাশাপাশি উৎপাদন করা হবে ৩০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ। ইতোমধ্যে স্থাপিত বাঁধের মাধ্যমে ভারত ৩৫ লাখ কিউসেক পানি ধরে রেখেছে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারত এসব সঞ্চয়াগারের মাধ্যমে ধরে রাখতে সক্ষম হবে ৫০ লাখ কিউসেক পানি। বাড়তি ১৫ লাখ কিউসেক পানির ঘাটতি বাংলাদেশকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিবে। গঙ্গার পর ভারত ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করার এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাবে দক্ষিণ ভারতের কাবেরী নদীতে। এ জন্য ১ হাজার ৪৬৬ কিলোমিটার খাল খনন করা হবে। ফারাক্কা থেকে কাবেরী নদী পর্যন্ত মূল সংযোগ খাল ছাড়াও অসংখ্য ছোট ছোট খাল কাটা হবে। এসব খাল অনেক নদী অতিক্রম করবে। নির্মাণ করা হবে পানি সংরক্ষণাগার ও বিদ্যুৎ প্রকল্প। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে গঙ্গার পানি ফারাক্কা পয়েন্ট পর্যন্ত আনা হবে। গঙ্গার পানি ব্যয় করা হবে উত্তর প্রদেশ ও বিহারের বিভিন্ন সেচ প্রকল্পে। পরিণতিতে পদ্মা নদী একেবারে পানিশূন্য হয়ে পড়বে। অপরদিকে ধুবড়ি থেকে ফারাক্কা পয়েন্ট পর্যন্ত সংযোগ খাল কয়েকটি নদীর পানি টেনে নেবে। নদীগুলো হলো, তিস্তা, তোরসা, রায়ঢাক, জলঢাকা, মহানন্দা প্রভৃতি। এসব নদীই বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে প্রবাহিত নদীগুলোর পানির প্রধান উৎস। অন্যদিকে মেঘনা নদী মূলত সুরমা-কুশিয়ারাসহ বিভিন্ন পাহাড়ি নদী এবং এর স্রোতের সঙ্গে মিলিত অন্যান্য জলধারার প্রভাবে স্ফীত থাকে। এই নদী বিভিন্ন স্থানে পদ্মা ও যমুনার প্রবাহও পেয়ে থাকে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-বরাক বেসিনে ভারতের বহুসংখ্যক বৃহৎ-ক্ষুদ্র অবকাঠামো নির্মাণের পরিণতির শিকার হয়ে মেঘনারও প্রবাহ স্বাভাবিকভাবেই সংকীর্ণ হয়ে পড়বে।

তিস্তা ও উপনদীতে নানান প্রকল্প

শুধু গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোই শেষ নয়, উজানে ‘তিস্তা-মহানন্দা ক্যানেল’ নামের প্রকল্পের মাধ্যমে ২৫ কিলোমিটার খাল কেটে তিস্তার পানি মহানন্দায় সরিয়ে নিচ্ছে ভারত। আর মহানন্দায় একটি ব্যারেজ প্রকল্পের সাহায্যে এই বাড়তি পানি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশের বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচের বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশকে কতটুকু পানি দেয়া হবে না হবে তা নিয়ে এক কৃত্রিম দরকষাকষি চালানো হচ্ছে। এছাড়াও ভারত তিস্তার উপরে বহু সংখ্যক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্পের জন্য বিশাল বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করা হচ্ছে। এর ফলে তিস্তার পানি ভারতের অভ্যন্তরেই থেকে যাবে।

পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ে তিস্তার দুই উপনদী রামমাম ও লোধামা নদীতে ১২.৭৫ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন দু’টি বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে। দার্জিলিং থেকে ৭৭ কি.মি দূরে অবস্থিত এই প্রকল্প ১৯৯৫-৯৬ সালে নির্মাণ করা হয়। তিস্তার আরেক উপনদী রঙ্গিত নদীর উপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ২০০০ সালে নির্মাণ করে ভারত। শিলিগুড়ি থেকে ১৩০ কি.মি দূরে অবস্থিত এই প্রকল্পের জন্য ৪৭ মিটার উঁচু বাঁধ ও একটি রিজার্ভার নির্মাণ করা হয়েছে। এই প্রকল্প থেকে ৩৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। ভারত তিস্তা ক্যানেল পাওয়ার হাউজ নামে তিন স্তরে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। শিলিগুড়ির কাছে তৈরি ক্যানেল মহানন্দা ব্যারেজে মিলিত হয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন তিস্তার পানি মহানন্দায় নেয়া যাচ্ছে আবার এই ক্যানেলে উপর পাওয়ার হাউজও নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলো মহানন্দা ব্যারেজ থেকে ৫ কি.মি, ২১ কি.মি ও ৩১ কি.মি পর পর তৈরি করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশে তিস্তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

অকেজো হবার পথে বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্প

তিস্তার পানি ভারতের একতরফা প্রত্যাহারের ফলে অকেজো হয়ে পড়ছে বাংলাদেশের তিস্তাসহ উত্তরাঞ্চলের সেচ প্রকল্পগুলো। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলীয় অংশে সেচ সঙ্কট নেই, কিন্তু বিপরীতে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ আবাদযোগ্য জমিতে চলছে পানির জন্য হাহাকার। ভারত শুধু গজলডোবায় বাঁধ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি- শুকনো মওসূমে দেড় হাজার কিউসেক করে পানি তার অংশের মহানন্দায় প্রত্যাহার করে নিয়ে যাচ্ছে। বর্ষা-বন্যায় কিছু পানি থাকলেও শুকনো মওসুম শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই চরের বিস্তার ঘটতে থাকে। এই সময় বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারেজের নীচে পর্যাপ্ত পানি থাকার আশা করা হলেও বিরাজ করছে বিপরীত চিত্র। একারণে তিস্তা প্রকল্পের অধীন সাড়ে ৭ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেবার কার্যক্রমও শিঁকেয় উঠতে বসেছে। ভারত তার অসংখ্য প্রকল্পের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ করা শুরু করলে বাংলাদেশের তিস্তার অপমৃত্যূই ঘটবে না- বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহও ব্যাপক হ্রাস পাবে।

মহানন্দাকেন্দ্রিক প্রকল্প

বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া সীমান্তের বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টের পশ্চিম-উত্তর কোণে মহানন্দা নদীর ওপর বিশাল এক বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। ১৯৭৯-৮০ সালে ‘ফুলবাড়ি ব্যারেজ’ নামে খ্যাত এই বাঁধটি তৈরি করে তারা। এই ব্যারেজের মাধ্যমে তিনটি ইউনিটে সাড়ে ২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ৬৭৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এই সঙ্গে প্রতিবছর শুষ্ক মওসুমে ফিডার ক্যানেলের সাহায্যে পানি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের সেচ কাজ করছে। বিপরীতে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি নিচে নেমে যাওয়ার কারণে সেচ কাজ বিঘিœà¦¤ হচ্ছে। বাঁধের মাধ্যমে পানি আটকে রাখায় শুষ্ক মওসুমে জেলার নদ-নদীগুলোকে মরা নদীতে পরিণত করছে।

বরাক ভ্যালিতে ৩০ প্রকল্প

ভারত আন্তর্জাতিক নদী বরাক ও তার উপনদীগুলোতে টিপাইমুখসহ ৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ছোট-বড় এসব প্রকল্প-বাঁধের মাধ্যমে তারা প্রায় ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সেচ ব্যবস্থারও সম্প্রসারণ ঘটানো হবে। এসব বাঁধের কারণে বরাক নদীতে কার্যত ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পাবে। অন্যদিকে ভাটির দেশ বাংলাদেশ হবে বরাকের পানি থেকে বঞ্চিত। ফলে সুরমা-কুশিয়ারা নদী পানিশূন্য হয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট ও সন্নিহিত অঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। আন্তর্জাতিক নদী বরাক একাধারে ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে এটি ত্রিদেশীয় তথা আন্তর্জাতিক নদীর মর্যাদা লাভ করেছে। পাহাড়ি নদী হবার কারণে বিপুল খরস্রোতা বরাক ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস হিসেবে অবদান রেখে চলেছে।

ভারতের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে ভারত প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ও সেচের সুবিধা পেলেও বাংলাদেশ হবে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার উজানে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এই বাঁধ নির্মাণে ভারতের মনিপুরের নাগরিকরাও প্রবল আপত্তি জানিয়ে আসছে। মনিপুর রাজ্যের টিপাইমুখে ভারতের বৃহত্তর প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ ছাড়াও বরাক ও তার শাখা ও উপনদীগুলোকে কেন্দ্র করে আরো ২৯টি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ চলছে।

আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প

ভারত প্রায় ২০ বছর যাবৎ বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে পানি এক স্থান হতে অন্য স্থানে সরিয়ে নেয়ার জন্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৩৮টি বিভিন্ন নদীর মধ্য দিয়ে সংযোগ স্থাপনের  পরিকল্পনা নেয়। এর বিশেষ দিক হচ্ছে নদীর এক বেসিন হতে যেখানে পানির ঘাটতি রয়েছে সেখানে পানি স্থানান্তর করা। এজন্য তারা ১২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩০টি খাল খননের মাধ্যমে সংযোগ চিহ্নিত করেছে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী বর্ষার সময় অতিরিক্ত পানি সঞ্চিত রাখার জন্যে সারাদেশে মোট ৭৪টি জলাধার ও বেশ কিছু বাঁধ নির্মাণ করা হবে। ফলে বর্ষার সময়ের সঞ্চিত পানি শুকনো মওসুমে বিভিন্ন স্থানে কৃষি ও অন্যান্য কাজের জন্য সরবরাহ করা যাবে। এতে একদিকে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি যেমন রোধ করা যাবে অন্যদিকে তেমনি খরার আশঙ্কাও দূর হবে বলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ধারণা।

ভারত এই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ ইতোমধ্যে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এই কার্যক্রমের আওতায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বেসিনের ৩৮টি নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে এসব নদীর পানি ব্যাপকহারে প্রত্যাহার করে নেবে। এর ফলে ভাটির দেশ বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী পানিশূন্য হয়ে পড়বে। প্রকল্পের আওতায় ১৭,৩০০ কোটি ঘনমিটার পানি গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র থেকে প্রত্যাহার করে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ অঞ্চলের শুকনো এলাকায় নিয়ে যাওয়া হবে। ভারতের এই প্রকল্পের লক্ষ্য হলো, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর এই পানি প্রবাহ ব্যবহার করে ১২,৫০০ কিলোমিটার খাল খনন, ৩ কোটি ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান এবং ৩৪ হাজার মেগাওয়াট পানি-বিদ্যুৎ উৎপাদন। হিমালয়ান অঞ্চলের যে সব নদী এই সংযোগের আওতায় আসবে তার মধ্যে রয়েছে, কোসি-মেচি লিঙ্ক, কোসি-ঘাগরা লিঙ্ক, গন্ধক-গঙ্গা লিঙ্ক, ঘাগরা-যমুনা (ইয়ামুনা) লিঙ্ক, সারদা-যমুনা লিঙ্ক, যমুনা-রাজস্থান লিঙ্ক, রাজস্থান-সবরমতি লিঙ্ক, চুনার-সোন ব্যারাজ লিঙ্ক, সোন ব্যারাজ-গঙ্গার দক্ষিণাঞ্চলীয় উপনদীসমূহের সংযোগ, মানাস-সঙ্কোশ-তিস্তা-গঙ্গা (ফারাক্কা) লিঙ্ক, যোগীঘোপা-তিস্তা-ফারাক্কা লিঙ্ক, ফারাক্কা-সুন্দরবন লিঙ্ক, গঙ্গা-দামোদর-সুবর্ণরেখা লিঙ্ক, সুবর্ণরেখা-মহানদী লিঙ্ক প্রভৃতি। এই পরিকল্পনা প্রণয়নে ভারত দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে।

আন্তর্জাতিক অভিমত

প্রভাবশালী ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘ভারত যখন থেকে গঙ্গার পানি সীমান্তে তার দিকে সরিয়ে নিয়েছে তখন থেকে বাংলাদেশের দিকের সর্বনাশ হয়েছে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের মতে, এ বাধা বাংলাদেশের দৈনন্দিন জীবনের বহু দিকের ওপর গুরুতর সঙ্কট সৃষ্টি করেছে, ধানের চাষ আর কাগজের কল পরিচালনা থেকে শুরু করে ফেরি চলাচল আর পানির কূপ পর্যন্ত। একজন গবেষক অনুমান করেছেন, পানি সরিয়ে নেয়ার ফলে ‘পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্রতম’ এই দেশে বার্ষিক লোকসানের পরিমাণ চার বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে।’ ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘পানীয় জলের জন্য কোনো কোনো গ্রামবাসীকে ২০০ ফুট গভীর পর্যন্ত কুয়া খনন করতে হচ্ছে। একতরফা এবং বিতর্কিতভাবে ফারাক্কা বাঁধ তৈরির ফলে গঙ্গার পানির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের বহু মানুষের জন্য অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা দেখা দিয়েছে। বিগত ২৫ থেকে ৩০ বছরে এই বাঁধ এ অঞ্চলের পরিবেশও ধ্বংস করেছে। একদিকে ফারাক্কা, অন্য দিকে তিস্তার ওপরে গজলডোবা, ব্রহ্মপুত্রের পর আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনা এবং মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা টিপাইমুখ বাঁধ যদি তৈরি হয়, তবে বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষই আর্সেনিকসহ নানান বিপর্যয়ের শিকার হবে।

অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের একটি অভ্যন্তরীণ পরিপত্রে অভিযোগ করা হয়েছে, ভারতের বাঁধগুলো আধুনিক মানের বিচারে অনিরাপদ। বিশ্বব্যাংকের ‘চলমান নিরাপদ বাঁধ প্রজেক্ট’ জরিপে ২৫টি বাঁধের উপর প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, এদের কোনটিই পানি ধারণ সম্পর্কিত প্রশ্নে সঠিক নকশায় তৈরি হয়নি। এদের মধ্যে ২টি বাঁধ বন্যা প্রতিরোধের জন্য যেভাবে তৈরির কথা ছিল তার চেয়ে ৭ গুণ বেশি বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে। বিশ্বব্যাংকের জরিপে বলা হয়, ভারতের হাজার হাজার মানুষ বাঁধ-কবলিত ঝুঁকিতে রয়েছে। ভারতের প্রকৌশলীরাও এসব বাঁধ প্রবল ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।

সিঙ্গাপুর ভার্সিটিতে গবেষণার ফল

ভারত আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে হিমালয় অববাহিকা অঞ্চলে ৩০০টি ড্যাম তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটানো, দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জ¦à¦¾à¦²à¦¾à¦¨à§€ চাহিদা মেটাতে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও বিশ্বসংস্থা ও বিজ্ঞানীদের মতে এর ফলে এই অঞ্চলের ৯০ ভাগ এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিজ্ঞানীরা ড্যাম তৈরির এই প্রজেক্ট বাস্তবায়নের বিষয়ে  ভারতকে পুনঃবিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন। সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী তাদের গবেষণায় নতুন তথ্য দিয়েছেন যে, এই পরিকল্পনা ভারতের অন্যান্য উৎস যেমন নিউক্লিয়ার, কয়লা, সৌর ও বায়ু থেকে শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে  সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। সিঙ্গাপুরের ইকো-বিজনেস ডটকম-এর এক রিপোর্টে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ভারত সরকার মনে করছে যে, প্রস্তাবিত এই ড্যামগুলো শক্তির যোগান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশ রক্ষার কাজ করবে। কিন্তু একটি গবেষণায় নেতৃত্ব দানকারী সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মহারাজ কে. পণ্ডিত মনে করেন, হিমালয় উপত্যকার নদীগুলোর উপর এতগুলো বাঁধ নির্মাণ হলে তা লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুহারা করবে এবং প্রাকৃতিক সস্পদের বিনাশ ঘটাবে। তিনি আরো বলেন, এটি শুধুমাত্র হিমালয় উপত্যকা অঞ্চলের মানুষদেরই ক্ষতি করবে এমনটি নয় বরং এর ভাটি অঞ্চলের মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করবে। অধ্যাপক পণ্ডিত ইকো বিজনেসকে দেয়া এক ই-মেইল সাক্ষাৎকারে আরো বলেন, হিমালয় হচ্ছে একটি তরুণ পর্বতমালা এবং এর ভূতাত্ত্বিক গঠন খুবই অস্থিতিশীল ও ভূমিকম্প প্রবণ। সে জন্য আমাদের অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে খুবই সতর্ক হতে হবে। তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, এই বাঁধ পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হবে এবং সেটা একমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমেই সম্ভব। মডেলিং ও মাঠ পর্যায়ে তথ্য ব্যবহার করে তিনি এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, চীনের কুইমিং ইন্সটিটিউট অব বোটানি ও চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্স-এ গবেষণাকারী তাঁর দল জানান, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে হিমালয় উপত্যকার প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এই প্রকল্পের ২৭ ভাগ এলাকার ঘন বনভূমি ও জীব-বৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন করবে। গবেষণায় ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়, ড্যাম প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ১ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গবেষণায় আরো বলা হয়, এই বাঁধ পরিকল্পনা বিশ্বের যে কোন জায়গার বাঁধ প্রকল্পের চেয়ে ৬২ গুণ বড় এবং তা এই অঞ্চলে মরুকরণ সৃষ্টি করবে, ২২ প্রজাতির ফুলগাছ ও ৭টি সরিসৃপ প্রাণির বিলুপ্তি ঘটাবে। গবেষণায় আরো বলা হয়, মৎস্য প্রজাতির বংশ বৃদ্ধির জন্য যে পানির প্রাচুর্যতার প্রয়োজন হয়- এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মাছের প্রজনন, বংশ বৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যে দারুণভাবে ব্যাঘাত ঘটবে এবং এর প্রভাব ভবিষ্যতে জেলে সম্প্রদায় তথা মানুষের জীবন যাত্রার উপর পড়বে। এই গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, ভারত সরকারের একটি টেকসই শক্তি উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া প্রয়োজন। এই গবেষণায় ভারত সরকারের জন্য কিছু সুপারিশ প্রদান করে। এর মধ্যে রয়েছে, সরকার যদি বর্তমানে বিদ্যমান শক্তি উৎপাদনকেন্দ্র, শক্তি সরবরাহ ও বাঁধগুলো যথাযথ ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণে নিতে পারে তাহলে শক্তি উৎপাদনের জন্য নতুন করে এতোবেশি ড্যাম তৈরির প্রয়োজন নেই। বাঁধ তৈরির প্রকল্প কমানো হলে তা হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার বনভূমির হারিয়ে যাওয়া ও মানুষের সম্পদ ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা করবে। সেই সাথে বাঁধের কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব লাঘব করবে। বনভূমির ক্ষয় কমানো মানে বিভিন্ন প্রজাতির হারিয়ে যাবার ঝুঁকি কমে যাওয়া। এই প্রেক্ষিতে তাঁরা এসব বাঁধ নির্মাণ কাজ বাতিলের আহ্বান জানান।

হুমকির মুখে বাংলাদেশের নিরাপত্তা

একজন বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, ফারাক্কা বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প-কারখানা সবকিছুতে মারাত্মক ক্ষতি করেছে। বাংলাদেশে পানির অভাবে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায় : ১. উত্তরাঞ্চলে প্রায় ২ কোটি মানুষ সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; ২. দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৪ কোটি মানুষ ও এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; ৪. গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না; ৫. অতিরিক্ত লবণাক্ততার জন্য জমির উর্বরা শক্তি কমে গেছে; ৬. দেশের প্রায় ২১ শতাংশ অগভীর নলকূপ ও ৪২ শতাংশ গভীর নলকূপ ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না; ৭. গঙ্গার পানি চুক্তির (১৯৯৬) পর বাংলাদেশে গঙ্গার পানির অংশ দাঁড়িয়েছে সেকেন্ডে ২০ হাজার ঘনফুটের কম। অথচ ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে শুস্ক মওসুমেও বাংলাদেশ ৭০ হাজার কিউসেকের চেয়ে কম পেতো না; ৮. প্রায় ১৫০০ কি.মি. নৌ পথ বন্ধ হয়ে গেছে; ৯. ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় হাজার হাজার হস্তচালিত পাম্প অকেজো হয়ে গেছে; ১০. ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের বিষাক্ত প্রভাবে পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় টিউবওয়েলের পানি খাবার অযোগ্য হয়ে পড়েছে; ১১. বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় প্রচলিত ধান উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে; ১৩. মাছের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে; ১৪. লবণাক্ততার কারণে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের প্রায় ১৭ ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। ১৫. পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এক সমীক্ষায় উল্লেখ করেছে, ফারাক্কায় বাঁধ দেয়ার কারণে বাংলাদেশের প্রায় ৯৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবছর ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

উৎসেই বিপন্ন গঙ্গা

বিশ্বের ৯০০টি নদীর ওপর কিছুকাল আগে এক গবেষণা চালানো হয়েছে। এতে দেখা গেছে, এদের মধ্যে গঙ্গা নদী দ্রুত হারিয়ে যাবার পথে। এই সঙ্গে আরো জানা যায়, ভারতের সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এমন ৪৫টি নদীর সাগরগামী প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ২০০৪ সালের রেকর্ডে দেখা গেছে, ৫৬ বছরের মধ্যে গঙ্গা নদীর প্রবাহ ২০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। মার্কিন কলারোডার এক বায়ুমন্ডল বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ তথ্য জানায়। রিপোর্ট আরো জানায়, এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে গঙ্গার প্রবাহ পুরোপুরি হারিয়ে যাবে। জুন ২০১০-এ প্রকাশিত ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের তথ্য মতে, উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে পানির স্তর নেমে গেছে। উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন জেলা যেমন বারানসি, এলাহাবাদ, বাল্লিয়া, ঘাজিপুর, মির্জাপুর, কান্নায়ুজ এবং কানপুর ডেহাটে পানির লেভেল ৩.২২ মি. থেকে ১৪.৭ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমেছে।

ভারত এর প্রায় সবক’টি উৎসকেই বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করছে বলে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়। এভাবে এসব উৎসের শতকরা  ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে নদীতে মাত্র ১০ ভাগ পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছে বলে সূত্রে প্রকাশ। যা প্রধানত বৃষ্টির ফলে জমা হচ্ছে। নদীর বিপন্ন হবার পেছনে প্রধানত মানুষের সৃষ্ট বাধা-প্রতিবন্ধকতাকেই দায়ী করা হয়। ভারতের নদীকেন্দ্রিক অসংখ্য প্রকল্প তার উদাহরণ।

ভারতের কম্পোট্রলার ও অডিটর জেনারেল ২০১৩-এর এপ্রিল জানান, উত্তরাখণ্ডের রাজ্য সরকার তাদের ৫৩টি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রজেক্ট বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে ভাগিরথী এবং অলোকানন্দা নদী পথে পানি শুকিয়ে যাবে। উত্তরাখণ্ডের গভর্নরও এ কথা জানান, ইতোমধ্যে শ্রীনগরে নদীর বেড শুকিয়ে গেছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানি সরবরাহের জন্য উপনদীগুলো থেকে পানি প্রত্যাহার করে নেবার দরুন এটা হয়েছে। যদি সবগুলো প্রজেক্ট এভাবে চলতে থাকে তাহলে জলজ প্রাণী ও জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। রিপোর্টে আরো বলা হয়, নদীর পাশে যেসব বসতি রয়েছে নদী শুকিয়ে যাবার কারণে তারা অভিগমন করবে এবং সাংস্কৃতিক সঙ্কট দেখা দিবে। প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হলে নদীগুলোর ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নেয়া হবে। মাত্র ১০ ভাগ পানি প্রবাহিত হবে। গত ২০১০-এর  ১ ফেব্রুয়ারি ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, ভারতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে পানি সরবরাহ কার্যক্রমের কারণে গঙ্গা হারিয়ে যাবে। উত্তরকাশির কাছে ১২টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। পরিবেশবিদ ও স্থানীয়রা এ ব্যাপারে সরকারকে হুঁশিয়ারী দিয়েছেন যে, ‘যদি এইসব প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে ভারতের এই পবিত্র নদীর ২৫০ কি.মি. এলাকায় পানি প্রবাহ থেমে যাবে।’

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত গঙ্গা-পদ্মার দৈর্ঘ্য আড়াই হাজার কিলোমিটারের বেশি। আর বাংলাদেশে প্রবেশ থেকে চাঁদপুরের মেঘনার সঙ্গে মিলিত হবার স্থান পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য তিনশ’ কিলোমিটার। উত্তর ভারতের হরিয়ানা থেকে দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থানের একাংশ, মধ্যপ্রদেশের অংশবিশেষ এবং পশ্চিম ভারতের বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ এই সাতটি প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা গঙ্গা-বেসিনভুক্ত দেখানো হয়েছে। এসব এলাকায় গঙ্গার পানিভিত্তিক অসংখ্য বাঁধ, জলাধার, ক্রসড্যাম, রেগুলেটর প্রভৃতি অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বাঁধের পর বাঁধ দিয়ে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার ফলে মূল গঙ্গা তার উৎসের কাছে হারিয়ে যেতে বসেছে। ৫৬ বছরের মধ্যে গঙ্গা নদীর প্রবাহ ২০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে বলে সূত্রে প্রকাশ। সব মিলিয়ে ভারতের নানা উচ্চাভিলাষি কর্মপরিকল্পনার শিকার হয়ে ভাটির দেশ বাংলাদেশ এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশ

পানি সমস্যা নিয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্মরণাপন্ন হওয়াটা নতুন কোন ঘটনা নয়। ভারতকে পানি অপসারণে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ এই বিষয়টি প্রথমে জাতিসংঘে উপস্থাপন করে। ১৯৭৬ সালের ২৬ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ভারতকে বাংলাদেশের সাথে আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয়টির সুরাহার করার নির্দেশ দিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। কয়েকবার বৈঠকের পর উভয় দেশ ৫ নভেম্বর ১৯৭৭ সালে একটি চুক্তি করে। চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ ও ভারত পরবর্তী পাঁচ বছরের (১৯৭৮-৮২) জন্য শুষ্ক মওসুমে গঙ্গার পানি ভাগ করে নেবে। ১৯৮২ এর অক্টোবরে উভয় দেশ ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে পানি বণ্টনের একটি চুক্তি করে। নভেম্বর ১৯৮৫ সালে আরও তিন (১৯৮৬-৮৮) বছরের জন্য পানি বণ্টনের চুক্তি হয়। কিন্তু একটি দীর্ঘ চুক্তির অভাবে বাংলাদেশ তার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য গঙ্গার পানি ব্যবহারে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কোনো চুক্তি না থাকায় ১৯৮৯ সালের শুষ্ক মওসুম থেকে ভারত একতরফা প্রচুর পরিমাণ পানি গঙ্গা থেকে সরিয়ে নেয়। ফলস্বরূপ বাংলাদেশের নদ-নদীতে পানি প্রবাহের চরম অবনতি ঘটে। ১৯৯২ সালের মে মাসে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের এক বৈঠকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও সেসময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ভারত বাংলাদেশকে সমান পরিমাণ পানি দেবার ব্যাপারে সম্ভাব্য সকল কিছু করবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশেকে দেয়া তার কথা রাখতে ব্যর্থ হন। অবশেষে, ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে দিল্লিতে ভারতের অকংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেব গৌড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যেটি মাঠপর্যায়ে সঠিকভাবে প্রতিপালিত হয় না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতিসংঘের পানিবিষয়ক রীতিটিকে উপেক্ষা করা চলবে না, এটাকে ফাইলবন্দী করে ড্রয়ারে ঢোকানো হলে বিপদ আছে। ভারত তার নিজ দেশের কৃষি, সেচ ও জলবিদ্যুৎ এর  প্রয়োজন দেখিয়ে যে নদী ও পানি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তার মধ্যে সবচাইতে বিপজ্জনক উদ্যোগ হলো আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। পৃথিবীর ইতিহাসে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের মাধ্যমে পানি ব্যবহারের যতো উদ্যোগের নজির আছে তার সবই একই বেসিন বা একই অববাহিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এক অববাহিকা থেকে অন্য অববাহিকায় পানি সরিয়ে নেয়ার কোন নজির ইতিহাসে না থাকায় পানি বা নদী বিষয়ক আর্ন্তজাতিক আইনে এ বিষয়ক কোন বিধি বিধানও নেই। এ উদ্যোগ যে প্রকৃতির বিরুদ্ধে এক অভুতপূর্ব অপরাধ এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে হিমালয় অঞ্চলের নদীসমূহের পানি, যা বাংলাদেশের নদ-নদীর পানিপ্রবাহের অন্যতম প্রধান উৎস, তা অন্যত্র সরিয়ে নেয়ায় বাংলাদেশ যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা বলাই বাহুল্য।

সমাধান কোন পথে

পানি সঙ্কট পারমাণবিক সঙ্কটের ভয়াবহতাকেও ম্লান করে দেয়। পানির অভাবে এ দেশে বড় ধরনের সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হবে, যা পার্শ্ববর্তী দেশেকেও আক্রান্ত করতে পারে। তাই :

১. সর্বপ্রথম ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে তাদের আগ্রাসী নীতি পরিত্যাগ করতে হবে।

২. পানি সমস্যা দ্বিপাক্ষিকভাবেও সমাধান করা যাবে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানির সুষ্ঠু ব্যবহারের স্বার্থে নদী বিষয়ে ভারত, বাংলাদেশ, চীন, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে একটি আঞ্চলিক পানি ফোরাম গঠন করতে হবে।

৩. নেপালে জলাধার নির্মাণ করে হিমালয়ের পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা গেলে শুকনো মওসুমে ফারাক্কায় পানি প্রবাহ ১ লাখ ৩০ হাজার কিউসেক থেকে ১ লাখ ৯০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাতে সবাই লাভবান হবে।

৪. জলাধারের সাহায্যে নেপাল প্রতিবছর প্রায় সাড়ে দশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম, যা নেপাল বাংলাদেশেও রফতানি করতে পারে।

৫. গঙ্গার পানি বণ্টনের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদীর বিষয়ও আলোচনাভুক্ত করতে হবে। পানি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এই নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের মতে, বাংলাদেশ সব সময় অববাহিকাভিত্তিক পানিব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কথা বলে আসছে। ভারত নিজের দেশে তাদের আন্তঃপ্রাদেশিক নদী নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে বিবাদের সমাধান পেতে অববাহিকার রাজ্যগুলোকে একত্র করে সমাধানের লক্ষ্যে পৌঁছাচ্ছে। আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ক্ষেত্রে পৃথিবী এই পদ্ধতিই অবলম্বন করে। কাজেই বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার উজানে জলাধার নির্মাণ করতেই হবে। অন্যথায় শীতকালের স্বল্পপ্রবাহের সমাধান করা সম্ভব নয়। ভারতের দিক থেকে এত দিন যুক্তি ছিল, গঙ্গার ক্ষেত্রে নেপালে জলাধার নির্মাণ করতে হবে। নেপাল তৃতীয় দেশ, কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য ছিল দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থাপনা। এই রাজনৈতিক যুক্তিতে তারা এতোদিন বাংলাদেশের ব্যাপারে নেপালের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়নি। আমরা বলেছি, ব্রহ্মপুত্রকে ব্রহ্মপুত্রের মতো দেখতে হবে, গঙ্গার সঙ্গে মেলানো যাবে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের সঙ্গে ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশের সামনে অনেক কঠিন সময় আসছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক নদী কনভেনশন ১৯৯৭ সালে নদী অববাহিকার দেশগুলোর জনগণের নদীর ঐতিহাসিক প্রবাহের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা আইন করেছে। তাই এ কনভেনশনটি তিস্তাসহ সব অভিন্ন নদীর পানির ওপর অধিকার স্থাপনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে তিস্তার পানি ব্যবহার নিয়ে কোনো ‘লোক দেখানো চুক্তি’ চায় না। তারা চায়, ভারত ও বাংলাদেশ তিস্তার পানি চুক্তি সম্পাদনকালে জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের নদী কনভেনশনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে। বিশ্বের অভিন্ন নদীগুলোর মধ্যে ইউরোপের ১১টি দেশ দানিউব নদীর পানিবণ্টন নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছে। এশিয়ার মেকং নদীর পানিবণ্টনে ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্পুচিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশকে সহযোগিতা করেছে জাতিসংঘ। এভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো, ভারত ও পাকিস্তান প্রভৃতি দেশের মধ্যে অভিন্ন নদীর পানির পরস্পর নায্য হিস্যা প্রাপ্তিতে একমত হতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় তার ব্যতিক্রম হচ্ছে কেন- তা বোধগম্য নয়। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের আশু করণীয় হলো :

১. ভারতের নদীসংক্রান্ত মহাপরিকল্পনার বিষয়টি অবশ্যই জাতিসংঘে উত্থাপন করতে হবে।

২. এসংক্রান্ত ‘কনভেনশন’-এ বাংলাদেশকে অনুস্বাক্ষর করতে হবে।

৩. বিষয়টি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ফোরামে জোরালোভাবে আলোচনায় নিয়ে আসতে হবে।

৪. অভিন্ন নদীর বিষয়গুলোকে আন্তর্জাতিক ফোরামসমূহে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে।

৫. সরকারিভাবে এর সার্বক্ষণিক ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখতে হবে।

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।