সংবাদ শিরোনামঃ

তুরস্কে জনতার বিজয় ** এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্কের জনগণ রুখে দিল সেনা অভ্যুত্থান ** সঙ্কট নিরসনে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ** ২০ দলীয় জোট ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র ** তুর্কী গণপ্রতিরোধে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান ** রফতানি বাণিজ্যের নতুন চ্যালেঞ্জ : রাজনৈতিক অস্থিরতা ** মানবতাবাদী বিশ্ব ও সন্ত্রাসবাদী বিশ্বের মাঝখানে মুসলমানদের দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে ** সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে প্রয়োজন দলমত নির্বিশেষে সবার ঐক্য : নজরুল ইসলাম খান ** তুর্কী জনগণকে অভিনন্দন ** জাতীয় স্বার্থ বনাম হুকুম তামিল করার দৌড়ঝাঁপ ** এ শিক্ষা আমাদের কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ** দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজেও হরিলুটের অভিযোগ ** দুর্ভোগের আরেক নাম পাইকগাছার কপিলমুনি শহর ** কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক সঙ্কট : সেবা কার্যক্রম ব্যাহত ** কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা ** ইসলামী সংস্কৃতির আলোকেই হোক ঈদ আনন্দ ** বাংলা ভাগের জন্য মুসলমানরা নন হিন্দুরাই দায়ী ** কবির বিশ্বাস ** সানজিদা তাহসিনা বেঁচে থাকবে সবার মাঝে ** জাতির নিকট রেখে গেলেন অনেক প্রশ্ন **

ঢাকা, শুক্রবার, ৭ শ্রাবণ ১৪২৩, ১৬ শাওয়াল ১৪৩৭, ২২ জুলাই ২০১৬

মোবায়েদুর রহমান

১৯৪৭ সালে যখন অবিভক্ত বাংলা ভাগ হয়ে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ হলো তখন কেন বাংলা ভাগ হলো, কেন বাংলা অখণ্ড থাকলো না, এই নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই বিতর্ক চলে আসছে। বিতর্ক এক সময় অপপ্রচারে পর্যবসিত হয়। কে বাংলা ভাগের জন্য দায়ী? মুসলিম লীগ ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ? নাকি কংগ্রেস ও গান্ধী নেহরু? বাংলা যখন ভাগই হলো তখন কেন কলকাতা পশ্চিম বঙ্গে থেকে গেল? কেন ঐ মহানগরীটি পূর্ব বাংলায় এলো না? এই ধরনের বিতর্ক সেই পাকিস্তান আমল থেকেই চলছিল এবং আজও চলছে। এই তো সেদিন ফেসবুকে দেখলাম, একাধিক ব্যক্তি লিখেছেন যে, মুসলিম লীগ নেতারা ৬ কোটি টাকা ঘুষ খেয়ে নাকি কলকাতার ওপর থেকে দাবি প্রত্যাহার করেছিলেন। এই ধরনের উন্মাদ প্রচারণা সেই পঞ্চাশ দশক থেকেই চলছে এবং আজও চলে আসছে। যারা সত্য কথা বলেন এবং সত্যের অন্বেষণ করেন তাদের দুর্ভাগ্য হলো এই যে, তাদের হাতে স্ট্রং মিডিয়া নেই। মনে হয়, এই ঘরানার লোকেরা শক্তিশালী প্রচার মাধ্যমের ওপর ততখানি গুরুত্বও দিতেন না। এর ফলে মিথ্যাটাই সত্যে পরিণত হচ্ছে এবং মিথ্যার আবর্জনার মধ্যে সত্যকে পুঁতে ফেলা হচ্ছে।

কঠোর সত্য হলো এই যে, মুসলমানরা বিশেষ করে মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম বাংলাকে অখণ্ড রাখার এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অক্লান্ত চেষ্টা করে গেছেন। তাদেরকে দৃঢ় সমর্থন দিয়েছেন মুসলমানদের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, বাংলার মুসলিম নেতৃবৃন্দ যথা মওলানা আকরম খাঁ, খাজা নাজিমুদ্দিন, নুরুল আমীন প্রমুখ। কিন্তু তারা সফল হননি। কংগ্রেস এবং ব্রিটিশদের সম্মিলিত চক্রান্ত এবং প্রতিরোধের মুখে তারা পরাস্ত হন। বঙ্গভঙ্গ সম্পর্কে সঠিক চিত্র পেতে গেলে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।

বাংলাকে এক রাখার বিরুদ্ধে

কংগ্রেসের অপপ্রচার

মাউন্ট ব্যাটেনের পার্টিশন প্ল্যানে বলা হয় যে, বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশনে বাংলার হিন্দু ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাংলা ভাগ করা হবে। বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে এবং বাংলাকে এক রাখার জন্য বাংলার নেতা সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম এবং ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা শরৎ চন্দ্র বসু সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নেন। তাদেরকে সমর্থন জানান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মওলানা আকরম খাঁ, খাজা নাজিমুদ্দিন, নুরুল আমীন, ফজলুর রহমান (বর্তমান বেক্সিমকোর অন্যতম মালিক সালমান রহমানের পিতা) প্রমুখ। তখন কংগ্রেসের তরফ থেকে এই মর্মে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয় যে, বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার হিন্দু সদস্যরা যাতে করে যুক্ত বাংলার পক্ষে ভোট দেয় সেজন্য মুসলিম লীগ হিন্দু সদস্যদেরকে ঘুষ দিচ্ছে। এই পটভূমিতে একই বছর অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ৮ জুন  শরৎ বসুর কাছে একটি চিঠি লেখেন মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী। চিঠিটি নি¤œà¦°à§‚প :

"I have now discussed the scheme roughly with Pandit Nehru and then Sarder. Both of them are dead against the proposal and they are of opinion that it is merely a trick for dividing Hindu and Scheduled Caste leaders. With them it is not merely a suspicion but almost a conviction. They also feel that money is being lavishly expended in order to secure Scheduled Caste Votes. If such is the case, you should give up the struggle at least at present. For the unity purchased by corrupt practices would be worse than a frank partition, it being a recognition of the established division of hearts and the unfortunate experiences of the Hindus. I also see that there is no prospect of transfer of power outside the two parts of India."

অনুবাদ : “আমি বিষয়টি নিয়ে পণ্ডিত নেহরু এবং সরদারের সাথে কথা বলেছি। উভয়েই ঐ প্রস্তাবের (যুক্ত বাংলা প্রস্তাব) ঘোরতর বিরোধী। তারা মনে করেন যে, হিন্দু এবং তফশীলি জাতিকে বিভক্ত করার উদ্দেশ্যে এটি একটি চালবাজি। তারা এ ব্যাপারে শুধু সন্দেহই করেন না, এটি তাদের দৃঢ় বিশ্বাস। তারা মনে করেন যে, অখণ্ড বাংলার সপক্ষে তফশীলি সম্প্রদায়ের ভোট কেনার জন্য দেদারছে টাকা খরচ করা হচ্ছে। তাই যদি হয় তাহলে অন্তত এই মুহূর্তের জন্য আপনার সংগ্রাম (যুক্ত বাংলার পক্ষে) স্থগিত করা উচিত। কারণ, বাংলা বিভক্তির চেয়েও টাকা দিয়ে বাংলার অখণ্ডতা ক্রয় আরো খারাপ। আমি আরো দেখতে পাচ্ছি যে, ভারতকে দুই ভাগে ভাগ করার বাইরে (পাকিস্তান ও ভারত) ক্ষমতা হস্তান্তরের আর কোন সম্ভাবনা নাই।”

মি. গান্ধী টাকা পয়সা ছিটানোর যে অভিযোগ করেছেন সেটি সর্বৈব মিথ্যা। পরবর্তীতে শরৎ বসুর কথায় সেটি আরো পরিষ্কার হয়ে যায়। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া যায় যে, যুক্ত বাংলার সপক্ষে ভোট দানের জন্য মুসলিম লীগ টাকা পয়সা ছিটিয়েছিল, তাহলেও তো অন্তত একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মুসলিম লীগ তথা মুসলমানরা বাংলাকে এক ও অখণ্ড রাখার পক্ষে কতখানি সিরিয়াস ছিলেন।

মিথ্যাচারে শরৎ বসুর ক্রোধ

মি. গান্ধীর এই চিঠি এবং সেখানে দুর্নীতির উল্লেখ শরৎ বসুকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। তিনি গান্ধীর কাছে নি¤à§‡œà¦¾à¦•à§à¦¤ টেলিগ্রাম পাঠান।

"Information false, punish informants, if information true, punish bribe-givers and bribe-takers."

অনুবাদঃ “যদি আপনার খবর মিথ্যা হয় তাহলে যারা খবর দিয়েছে তাদেরকে শাস্তি দিন। আর যদি খবর সত্য হয় তাহলে যারা ঘুষ দিয়েছে এবং যারা ঘুষ খেয়েছে তাদেরকে শাস্তি দিন।”

এই টেলিগ্রাম পেয়ে গান্ধী বিব্রত হন। কারণ ঘুষের অভিযোগের তদন্ত করার মতো মানসিক প্রস্তুতি তার ছিল না। তিনি শরৎ বসুকে এই বলে শান্ত করার চেষ্টা করেন যে, যেহেতু অধিকাংশ হিন্দু এবং কংগ্রেস বাংলাকে ভাগ করার বিষয়টি মেনে নিয়েছে তাই এখন তার পক্ষে (শরৎ বসুর পক্ষে) চুপচাপ বিষয়টি মেনে নেওয়াই উচিত। যা-ই হোক, গান্ধীর এই চিঠির পরদিন অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ৯ জুন শরৎ বসু জিন্নাহর কাছে নি¤à§‡œà¦¾à¦•à§à¦¤ চিঠি লেখেন :

জিন্নাহর কাছে শরৎ বসুর চিঠি

"My dear Jinnah, I have to thank you most sincerely for your courtesy and cordiality toward me and for the consideration you gave to my suggestions. Bengali is passing through the greatest crisis in her history, but she can yet be saved. She can be saved if you will kindky give the following instructions to Muslim Members of the Bengal Legislative Assembly.

I. At the Meeting to be held of all members of the Legislative Assembly (other than Europeans) at which a decision will be taken on the issue as to which Constituent Assembly the province as a whole would join if it were subsequently decided by the two parts to remain united, to vote, neither for the Hindustan Constituent Assembly nor for the Pakistan Constituent Assembly, and to make it clear by a statement in the Assembly or in the press or otherwise, that they are solidly in favour of Bengal having a Constituent Assembly of its own.

The request I am making to you is in accordance with the views you expressed to me when we met. But it seems to me that if you merely expressed your views to your Members and not gave them specific instruction as to how to vote, the situation cannot be saved. I hope you will do all in your power to enable Bengal to remain united and to make her a free and independent State."

অনুবাদ : “প্রিয় জিন্নাহ, আপনার কাছে আমি যে সব সুপারিশ করেছিলাম সেগুলো আপনি বিবেচনা করেছেন এবং আমার প্রতি যে সৌজন্য ও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বঙ্গদেশ তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সঙ্কটের মধ্যদিয়ে এখন অতিবাহিত করছে। তবে এখনও সময় আছে তাকে বাঁচানোর। বঙ্গদেশকে বাঁচানো যেতে পারে যদি আপনি অনুগ্রহ করে বঙ্গীয় আইন সভার মুসলিম সদস্যের প্রতি নি¤à§‡œà¦¾à¦•à§à¦¤ নির্দেশ জারি করেন।

১. ইউরোপীয় সদস্য ছাড়া ঐ আইন সভার সমস্ত সদস্যের যে সভা অনুষ্ঠিত হবে সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে যে এই প্রদেশ অর্থাৎ বঙ্গদেশ সামগ্রিকভাবে অর্থাৎ অখণ্ডভাবে কোন গণপরিষদে জয়েন করবে। তারা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে যে, তারা ভারতীয় গণপরিষদে যোগ দেবে না, পাকিস্তান গণপরিষদেও যোগ দেবে না। তারা অখণ্ড থাকবে। তারা আইন সভায় বিবৃতি দিয়ে হোক অথবা সংবাদ পত্রে বিবৃতি দিয়েই হোক, তারা ঘোষণা করবে যে বাংলার একটি নিজস্ব আইন সভা থাকবে। তারা সেই আইন সভার পক্ষে দৃঢ় সমর্থন জানাবে।

আমি আপনাকে এই অনুরোধ করছি আপনার ইচ্ছা অনুসারে, যে ইচ্ছা আপনি প্রকাশ করেছিলেন যখন আমাদের দুজনের দেখা হয়। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যে, বাংলাকে অখণ্ড রাখার পক্ষে মুসলিম লীগ সদস্যদের কাছে আপনি শুধুমাত্র আপনার মতামত দিয়েছিলেন। তবে বাংলাকে অখণ্ড রাখার পক্ষে কিভাবে ভোট দিতে হবে, সে ব্যাপারে তাদেরকে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো নির্দেশ দেননি। আমি আশা করি, বাংলাকে অখণ্ড রাখার জন্য এবং তাকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র করার জন্য আপনার ক্ষমতায় যা যা আছে তার সব কিছুই আপনি প্রয়োগ করবেন।”

গান্ধীর কাছে শরৎ বসুর জবাব

আমরা আগেই বলেছি যে, গান্ধীর এই চিঠিতে শরৎ বসু ক্ষিপ্ত হন। ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি তার কাছে একটি টেলিগ্রাম পাঠান। অন্যদিকে জিন্নাহর কাছে একটি চিঠি লেখেন। জিন্নাহর কাছে চিঠি লিখেই তিনি ক্ষান্ত হননি। তার ৬ দিন পর অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন গান্ধীর কাছে শরৎ বসু কড়া ভাষায় তার জবাব দেন। তিনি লেখেন,

"I can say definitely and emphatically that there was nothing in the nature of trickery... the feeling or suspicion that money is being expended to secure Scheduled Caste votes is entirely baseless.

My faith remains unshaken and I propose to work in my own humble way for the unity of Bengal. Even after the raging and tearing campaign that has been carried on in favour of partition, I have not the slightest doubt that if a referendum were taken, the Hindus of Bengal by a large majority would vote against partition. The voice of Bengal has been stifled for the moment but I have every hope that it will assert itself."

অনুবাদ : “আমি সুনিশ্চিতভাবে এবং জোর দিয়ে বলতে পারি যে, এখানে ছলচাতুরির কোন ব্যাপার ছিল না। তফশীলি জাতির ভোট নেওয়ার জন্য টাকা খরচ করা হচ্ছে বলে যে ধারণ বা সন্দেহ জন্মেছে, সেটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

আমার বিশ্বাস অবিচল রয়েছে এবং আমি বাংলার ঐক্য ধরে রাখার জন্য আমার সাধ্যমত চেষ্টা করে যাবো। বাংলার বিভক্তির জন্য যে প্রবল প্রচারণা চলছে তারপরেও আমি বলতে চাই যে, বাংলার বিভক্তির জন্যে যদি কোন গণভোট (রেফারেন্ডাম) গ্রহণ করা হয় তাহলে, আমার মনে সন্দেহের কোনো অবকাশ নাই যে, বাংলার হিন্দুদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে ভোট দেবে। এই মুহূর্তে বাংলার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু আমার বিপুল বিশ্বাস যে একদিন তাদের মতামত প্রতিষ্ঠিত হবেই।”

আইন সভার যৌথ অধিবেশন

ব্রিটিশ সরকার স্থির করে যে, ঐ বছর অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বিভক্তি না ঐক্য, এই প্রশ্নে বাংলা এবং পাঞ্জাব আইন সভার সদস্যরা ভোট দেবেন। বাংলায় প্রথমে সমস্ত সদস্য আইন সভার অধিবেশনে একসাথে মিলিত হন। এরপর পশ্চিম বঙ্গ ও পূর্ব বঙ্গের সদস্যরা আলাদা আলাদাভাবে বৈঠক করেন। বাংলার যৌথ অধিবেশনে ১২৬ জন সদস্য পাকিস্তানে যোগ দেয়ার সপক্ষে ভোট দেন। পক্ষান্তরে ৯০ জন সদস্য ভারতে যোগ দেয়ার পক্ষে মত দেন। কংগ্রেস নেতা জেসি গুপ্ত দেশের বাইরে ছিলেন। তাই তিনি ভোট দিতে পারেননি। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সুপরিকল্পিতভাবে অধিবেশনে যোগদান করেননি, সুতরাং তিনিও ভোট দেননি। ময়মনসিংহের সদস্য মওলানা শামসুল হুদা এবং দিনাজপুরের তফশীলি ফেডারেশনের সদস্য রূপ নারায়ণ ভোট দানে বিরত থাকেন। তারা ছাড়া তফশীলি জাতির ৪ সদস্য পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষে ভোট দেন। দুই জন প্রখ্যাত কমিউনিস্ট সদস্য ভোট দানে বিরত থাকেন। এরা হলেন, সারা ভারতের বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা, প্রায় ২৫ বছর ধরে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং রতন লাল ব্রাহ্মণ।

আইন সভার আলাদা

আলাদা অধিবেশন

এরপর পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত সদস্যরা আলাদা অধিবেশনে মিলিত হন। এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বর্ধমানের মহারাজা উদয় চাঁদ মেহতা। এই অধিবেশনে ৫৮ জন সদস্য বাংলা ভাগের পক্ষে ভোট দেন। বিপক্ষে অর্থাৎ বাংলা এক রাখার পক্ষে ভোট দেন ২১ জন সদস্য। এই অধিবেশনে জ্যোতি বসু এবং রতন লাল ব্রাহ্মণ বাংলা বিভক্তির পক্ষে ভোট দেন।

পূর্ব বঙ্গের সদস্যরা নুরুল আমীনের সভাপতিত্বে আলাদা অধিবেশনে মিলিত হন। এ অধিবেশনে ১০৬ জন সদস্য বিভক্তির বিরুদ্ধে অর্থাৎ বাংলাকে এক ও অখণ্ড রাখার পক্ষে ভোট দেন। এদের মধ্যে ছিলেন তফশীলি জাতির ৪ জন সদস্য। এবারও শেরে বাংলা একে ফজলুল হক অধিবেশনে যোগদান করেননি, তাই ভোটদানে বিরত থাকেন। এভাবে কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার ঐক্যের ফলে পশ্চিম বঙ্গের হিন্দুরা বিভক্তির পক্ষে ভোট দিয়ে বাংলাকে ভাগ করেন এবং তাদের অংশকে অর্থাৎ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের অন্তর্ভূক্ত করেন। আর খণ্ডিত বাংলার মুসলমান অধ্যুষিত অংশ অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে যোগ দেয়। এই ভোটা ভুটিরই ফলশ্রুতিতে বাংলা ভাগ হয়। তাই পরবর্তীকালে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী বড় গলা করে বলেন, “কংগ্রেস ভারতকে ভাগ করেছে। আর আমি বাংলাকে ভাগ করেছি।” সেই শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর সাথে কোয়ালিশন করে ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার প্রধান মন্ত্রী নিযুক্ত হন।

শেখ মুজিবুর রহমান

এতক্ষণ আমরা মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কথা বলেছি। এবার দেখুন, বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এ সম্পর্কে কী বলেছেন। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের ৭৩-৭৪ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “১৯৪৭ সালের জুন মাসে ঘোষণা করা হলো ভারতবর্ষ ভাগ হবে। কংগ্রেস ভারতবর্ষকে ভাগ করতে রাজি হয়েছে এই জন্য যে, বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব ভাগ হবে। আসামের সিলেট জেলা ছাড়া আর কিছুই পাকিস্তানে আসবে না। বাংলাদেশের কলকাতা এবং তার আশপাশের জেলাগুলোও ভারতবর্ষে থাকবে। মওলানা আকরম খাঁ সাহেব ও মুসলিম লীগ নেতারা বাংলাদেশ ভাগ করার বিরুদ্ধে তীব্রপ্রতিবাদ করলেন। বর্ধমান ডিভিশন আমরা না-ও পেতে পারি। কলকাতা কেন পাব না? কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা বাংলাদেশ ভাগ করতে হবে বলে জনমত সৃষ্টি করতে শুরু করল। বাংলাদেশ যে ভাগ হবে, বাংলাদেশের নেতারা তা জানতেন না। সমস্ত বাংলা ও আসাম পাকিস্তানে আসবে এটাই ছিল তাদের ধারণা।”

তিনি আরো বলেছেন, “এই সময় শহীদ (সোহরাওয়ার্দী) সাহেব ও (আবুল) হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের তরফ থেকে এবং শরৎ বসু ও কিরণশঙ্কর রায় কংগ্রেসের তরফ থেকে এক আলোচনা সভা করেন। তাদের আলোচনায় এই সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশ ভাগ না করে অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করা যায় কিনা? শহীদ সাহেব দিল্লিতে জিন্নাহর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার অনুমতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। বাংলাদেশের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা একটা ফর্মুলা ঠিক করেন। বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি একটি ফর্মুলা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে। যতদূর আমার মনে আছে, তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষদ হবে। সেই গণপরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্তান না পাকিস্তানে যোগদান করবে, নাকি স্বাধীন থাকবে। যদি দেখা যায় যে, গণপরিষদের বেশি সংখ্যক প্রতিনিধি পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষপাতি, তবে বাংলাদেশ পুরোপুরিভাবে পাকিস্তানে যোগদান করবে। আর যদি দেখা যায় বেশি সংখ্যক লোক ভারতবর্ষে থাকতে চায়, তবে বাংলাদেশ ভারতবর্ষে যোগ দেবে। যদি স্বাধীন থাকতে চায়, তাও থাকতে পারবে। এই ফর্মুলা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু দিল্লিতে জিন্নাহ ও গান্ধীর সাথে দেখা করতে যান। শরৎ বসু নিজে লিখে গেছেন যে জিন্নাহ তাকে বলেছিলেন, মুসলিম লীগের কোনো আপত্তি নাই, যদি কংগ্রেস রাজি হয়। ব্রিটিশ সরকার বলে দিয়েছে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একমত না হলে তারা নতুন কোনো ফর্মুলা মানতে পারবেন না।’

শেখ মুজিবুর রহমান আরো জানান, ‘শরৎ বাবু কংগ্রেসের নেতাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কারণ সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল তাকে বলেছিলেন, ‘শরৎ বাবু পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই।’ মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত নেহরু কোন কিছুই না বলে শরৎ বাবুকে সরদার প্যাটেলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর মিস্টার প্যাটেল শরৎ বাবুকে খুব কঠিন কথা বলে বিদায় দিয়েছিলেন। কলকাতা ফিরে এসে শরৎ বসু খবরের কাগজে বিবৃতির মাধ্যমে একথা বলেছিলেন এবং জিন্নাহ যে রাজি হয়েছিলেন সে কথা স্বীকার করেছিলেন।”

শেখ মুজিবুর রহমান আরো লিখেছেন, “জিন্নাহর জীবদ্দশায় তিনি কোনোদিন শহীদ সাহেবকে দোষারোপ করেন নাই। কারণ, তার বিনা সম্মতিতে কোনো কিছুই তখন করা হয় নাই। খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব ১৯৪৭ সালের ২২ এপ্রিল ঘোষণা করেছিলেন, ‘যুক্ত বাংলা হলে হিন্দু মুসলমানের মঙ্গলই হবে’। মওলানা আকরম খাঁ সাহেব মুসলিম লীগের সভাপতি হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার রক্তের উপর দিয়ে বাংলাদেশ ভাগ হবে। আমার জীবন থাকতে বাংলাদেশ ভাগ করতে দেব না। সমস্ত বাংলাদেশই পাকিস্তানে যাবে।’ এই ভাষা না হলেও কথাগুলোর অর্থ এই ছিল। আজাদ কাগজ আজও আছে। ১৯৪৭ সালের কাগজ বের করলেই দেখা যাবে।”

মিজানুর রহমান চৌধুরী

মিজানুর রহমান চৌধুরী ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন অত্যন্ত সিনিয়র নেতা এবং এক সময় শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহচর। তিনি বাংলাকে অখণ্ড রাখার ব্যাপারে মুসলিম লীগের ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট কথা বলেছেন। তার গ্রন্থ, ‘রাজনীতির তিন কালের’ ২০ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “বাংলা ভাগ নিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ভোটাভুটির দিকে নজর দিয়ে দেখুন। ‘১৯৪৭ সালের ২০ জুন নিখিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভায় বাংলা ভাগের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটগ্রহণ হলে দেখা যায়, আলাদা আলাদা বৈঠকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোতে কংগ্রেস, শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা এবং জ্যোতিবসুর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির মোট ৫৮ জন বিধায়ক বাংলা ভাগের পক্ষে এবং ২১ জন বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের ১১৬ জন লীগ সদস্য বাংলা ভাগের বিপক্ষে এবং ৩৪ জন কংগ্রেস সদস্য বাংলা ভাগের পক্ষে ভোট দেন। তফসিলি ফেডারেশনের ৫ জন বিধায়ক বাংলা ভাগের বিপক্ষে ভোট দেন।”

ওপরের এই সুদীর্ঘ আলোচনার পর কারো মনে আর সন্দেহের কোন অবকাশ থাকা উচিত নয় যে, মুসলিম লীগ, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আকরম খাঁ, খাজা নাজিমুদ্দিন, নুরুল আমীন, আবুল হাশিম ও ফজলুর রহমানসহ মুসলিম লীগ বাংলাকে এক ও অখণ্ড রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস, মি. গান্ধী, মি. নেহরু, মি. প্যাটেল, শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী ও কমিউনিস্ট পার্টির জ্যোতি বসুদের কারণে বাংলা ভাগ হয়েছে। সেদিন বাংলা ভাগ হয়ে যে অংশটি প্রথমে পূর্ববাংলা এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান হয়েছিল সেই অংশটিই বর্তমানের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Email: journalist15@gmail.com

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।