সংবাদ শিরোনামঃ

তুরস্কে জনতার বিজয় ** এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্কের জনগণ রুখে দিল সেনা অভ্যুত্থান ** সঙ্কট নিরসনে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ** ২০ দলীয় জোট ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র ** তুর্কী গণপ্রতিরোধে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান ** রফতানি বাণিজ্যের নতুন চ্যালেঞ্জ : রাজনৈতিক অস্থিরতা ** মানবতাবাদী বিশ্ব ও সন্ত্রাসবাদী বিশ্বের মাঝখানে মুসলমানদের দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে ** সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে প্রয়োজন দলমত নির্বিশেষে সবার ঐক্য : নজরুল ইসলাম খান ** তুর্কী জনগণকে অভিনন্দন ** জাতীয় স্বার্থ বনাম হুকুম তামিল করার দৌড়ঝাঁপ ** এ শিক্ষা আমাদের কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ** দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজেও হরিলুটের অভিযোগ ** দুর্ভোগের আরেক নাম পাইকগাছার কপিলমুনি শহর ** কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক সঙ্কট : সেবা কার্যক্রম ব্যাহত ** কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা ** ইসলামী সংস্কৃতির আলোকেই হোক ঈদ আনন্দ ** বাংলা ভাগের জন্য মুসলমানরা নন হিন্দুরাই দায়ী ** কবির বিশ্বাস ** সানজিদা তাহসিনা বেঁচে থাকবে সবার মাঝে ** জাতির নিকট রেখে গেলেন অনেক প্রশ্ন **

ঢাকা, শুক্রবার, ৭ শ্রাবণ ১৪২৩, ১৬ শাওয়াল ১৪৩৭, ২২ জুলাই ২০১৬

ধ র্ম ও দ র্শ ন

ত্যাগ ও কুরবানি

অধ্যক্ষ মাওলানা যাইনুল আবেদীন
মানব সভ্যতার আজকের যে উৎকর্ষ তার পুরোটা সম্ভব হয়েছে মানুষের ত্যাগ ও কুরবানির বিনিময়ে। সভ্যতার বিকাশে তাই ত্যাগ ও কুরবানির গুরুত্ব অপরিসীম। ত্যাগ ও কুরবানি ব্যতিরেকে কোনো সমাজ ও সভ্যতা বিনির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সাফল্যের পেছনেও থাকে কারো না কারো কুরবানি। পিতা-মাতার ত্যাগ ও কুরবানির বদৌলতে সন্তান প্রকৃত মানুষ হয়। রাসূল (সা.)-এর ২৩ বছরের নবুয়তি জিন্দেগি ত্যাগ ও কুরবানির উজ্জ্বলতম নমুনা। সাহাবীগণ (রা.) ত্যাগ ও কুরবানির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন আমাদের জন্য। সকল নবী-রাসূলকে ত্যাগ ও কুরবানির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হয়েছে। একইভাবে যুগে যুগে যারা ইসলামের আলোকে সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছেন তাদেরকেও ত্যাগ ও কুরবানির নজরানা পেশ করতে হয়েছে। আজকের যুগেও যারা পৃথিবীকে নতুন করে সাজিয়ে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা ও জালিমদের বহুমাত্রিক জুলুমের শিকার হচ্ছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্পর্কে বলেছেন :

অন্যদিকে মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অভিযানে যে নিজের প্রাণ সমর্পণ করে। এই ধরনের বান্দার ওপর আল্লাহ অত্যন্ত স্নেহশীল ও মেহেরবান। (আল বাকারাহ : ২০৭)

পক্ষান্তরে জালিমদের শাস্তি দুনিয়া ও আখিরাতে অবধারিত। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের অনেক জায়গায় সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি জালিমকে আখিরাতে কঠিন শাস্তি দেবেন। আর দুনিয়াতেও তিনি দৃষ্টান্ত করে রেখেছেন আবু লাহাব, ফেরাউন-শাদ্দাদ, নমরুদসহ অনেক জালিমের করুণ পরিণতি এবং আদ-সামুদসহ বিভিন্ন জাতি ধ্বংস হওয়ার ঘটনা।

ত্যাগ ও কুরবানির সংজ্ঞায়ন

ত্যাগ বাংলা শব্দ। এর প্রতিশব্দ হলো, ছেড়ে দেয়া, বিসর্জন দেয়া, বর্জন করা বা ইস্তফা দেয়া। ইংরেজিতে বলা হয় To give up, Sacrifice, forsaking, renunciation, relinquishment. শিরোনামে ত্যাগ বলতে যে অর্থটি যথার্থতা হলো কোনো কিছুর উদ্দেশ্যে নিজের স্বার্থ বর্জন করা।

আর কুরবানি শব্দটি আরবী শব্দ যার অর্থ হলো-উৎসর্গ করা, উপহার দেয়া, সমর্পণ করা। ইংরেজিতে বলা হয় offering, sacrificial, dedication, gift. বস্তুত, কোনো মহান উদ্দেশ্যে নিজের সবকিছু উৎসর্গ করার নাম কুরবানি। এ পৃথিবীতে স্রষ্টার বাণী ও মহিমা প্রচারের জন্য নিজের জীবনমরণ আল্লাহর জন্য সমর্পণ করার নাম কুরবানি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এরশাদ করেছেন :

বলে দিন নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন এবং আমার মরণ বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত।

ত্যাগ ও কুরবানি বনাম ঈমানের পরীক্ষা

পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে :

তিনি (আল্লাহ) জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য যে, কে তোমাদের থেকে সৎকর্মে উৎকৃষ্ট। তিনি পরাক্রমশালী ক্ষমাশীল।

মূলত আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের মাঝে মধ্যে ভালো ও মন্দ অবস্থায় ফেলে যাচাই করতে চান কে অগ্রগামী। তিনি নানা কারণে নানাভাবে ঈমানদারদের পরীক্ষা করেন। ঈমানের দাবিতে সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীদের মধ্যে তিনি পরীক্ষা করে বাছাই করে নেবেন। পবিত্র করআন আল্লাহতায়ালা বলেন :

“মানুষ কি মনে করে যে, তারা এ কথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা ঈমান এনেছি এবং তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আমি তাদেরও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথ্যুকদেরকে।” (২৯ : ২-৩)

অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন :

 “অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি এবং ফল-ফসলের বিনষ্টের মাধ্যমে” (সূরা আল বাকারাহ : ১৫৫)

এমনিভাবে যুগে যুগে প্রত্যেক নবী, রাসূল, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন, তাবে তাবিঈন, মুমিনগণ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন।

ত্যাগ ও কুরবানির তাৎপর্য

ইসলাম শুধু একটা বিশ্বাস ও কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টির নাম নয়; এটি বরং এক চিরন্তন সংগ্রামের পথ। একটা মৌখিক ঘোষণা দানের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি ইসলামে প্রবেশ করে কিন্তু তার ইসলামে টিকে থাকার জন্য দরকার হয় বিশ্বাসের বাস্তব সাক্ষ্য দানের। “আর এভাবে আমি তোমাদের একটি মধ্যপন্থী উম্মত হিসেবে সৃষ্টি করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমণ্ডলীর জন্য এবং যাতে রসূলও সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য (২: ১৪৩) এটা এমন একটা পথ যে পথে চলতে গিয়ে কোনো ব্যক্তিকে প্রতিনিয়ত মিথ্যা-বাতিলের সৈনিকের মোকাবিলা করতে হয় আল্লাহর আনুগত্যের পথে টিকে থাকার নিমিত্তে, ঈমান যত বড় পরীক্ষা তত বড় হবে এটা জেনেই ঈমানের দাবি করতে হবে। পূর্বেকার সকল নবী-রাসূল এবং ঈমানদারদের থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সংগ্রাম-সাধনা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা করেছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তাআলা। মানুষকে কষ্টের মাঝেই সৃষ্টি করেছেন তিনি। “আমরা নিশ্চয়ই মানুষকে সৃষ্টি করেছি শ্রমনির্ভর করে।” (৯০ : ৪) মানুষ চেষ্টা-সাধনা ছাড়া কিছুই অর্জন করতে পারে না বলেও জানিয়েছেন আমাদের রব। “মানুষের জন্য কিছুই নেই শুধু সেই (কল্যাণ) ছাড়া যার জন্য সে চেষ্টা করে।” (৫৩ : ৪৪)

সফলতার জন্য ত্যাগ ও কুরবানির অপরিহার্যতা

আল্লাহ তায়ালা যে সফলতার ওয়াদা করেছেন তা ত্যাগ ও কুরবানি ব্যতিরেকে অর্জন করা সম্ভব নয়। তিনি পরীক্ষা করে দেখবেন সাফল্য পাওয়ার সত্যিকার উপযুক্ত কারা। মহান আল্লাহ বলেন :

“তোমাদের কি এই ধারণা যে, তোমরা জান্নাতে চলে যাবে, অথচ সে লোকদের অবস্থা অতিক্রম করনি যারা তোমাদের পূর্বে অতীত হয়েছে। তাদের আক্রমণ করেছিল দারুণ বিপর্যয় এবং চরম দুর্দশা, আর তারা কেঁপেছিল, শেষ পর্যন্ত রাসূল ও তাঁর সঙ্গে যারা ঈমান এনেছিল তারা বলল ‘আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?’ আল্লাহর সাহায্য অবশ্যই নিকটবর্তী।” (২:২১৪)

ক. ত্যাগ ও কুরবানি সাহসিকতার অনুঘটক

ত্যাগের মানসিকতা এমন একটা অন্তর্গত সম্পদ, যা মুমিনকে সাহসিকতার উচ্চতম মাত্রায় পৌঁছে দেয়। আল্লাহ তাদের প্রশংসা করেছেন এবং তাদের জন্য বিরাট প্রতিদানের ওয়াদা করেছেন। মহান আল্লাহ বর্ণনা করেন এভাবেÑ

যারা আহত হয়ে পড়ার পরও আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশ মান্য করেছে, তাদের মধ্যে যারা সৎ ও পরহেজগার, তাদের জন্য রয়েছে মহান সওয়াব। যাদের লোকেরা বলেছে যে, তোমাদের সাথে মোকাবিলা করার জন্য লোকেরা সমাবেশ করেছে বহু সাজ-সরঞ্জাম; সুতরাং তাদের ভয় কর। তখন তাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হয়ে যায় এবং তারা বলে, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট; কতই না চমৎকার কামিয়াবি দানকারী। (আল ইমরান : ১৭২-১৭৩)

খ. সামষ্টিক শৃঙ্খলার জন্য ত্যাগ ও কুরবানি

ইসলাম গড়ে তুলতে চায় একটা সামষ্টিক শৃঙ্খলাধীন সমাজ, যা সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ থেকে দীনের প্রসারে নিবেদিত থাকবে আল্লাহর রাস্তায় অবিরত সংগ্রামের মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালোবাসেন তাদেরকে যারা তাঁর রাস্তায় এমনভাবে কাতারবদ্ধ হয়ে লড়াই করে যেন এক সীসাঢালা দালান।” (সূরা আস-সফ : ৪)

ত্যাগ ও কুরবানির বিষয়সমূহ

ত্যাগ ও কুরবানির বিষয়গুলো দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগ হচ্ছে ওইসব বিষয়া যা বস্তুগত অস্তিত্ব সম্পন্ন বা যাকে সংখ্যায় গণনা করা যায়। এগুলোর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সময়, সম্পদ ও জীবন। জীবনের ক্ষেত্রে নিজের জীবন, সন্তান, স্বামী বা স্ত্রী, পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন, ইত্যাদি অন্তর্ভূক্ত।

দ্বিতীয় ভাগে হচ্ছে ঐ সমস্ত বিষয় যার কোন বস্তুগত সত্ত্বা নেই বা যা বাহ্যিকভাবে পরিমাপ ও করা যায় না। এই ভাগের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে আশা, আকাক্সক্ষা, আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, অভিমত প্রভৃতি।

প্রথমভাগ : বস্তু ও গণনাবাচক বিষয়

ক. সময়ের কুরবানি : সময় জীবনের অংশ। সময় মূলত আমলেরই অংশ। তাই সময় কিভাবে ব্যয় করা হয়, তা আল্লাহ তাআলা দেখতে চান। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন :

 “মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ তাআলাকে ভয় কর। প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, আগামীকালের জন্য সে কী প্রেরণ করে তা চিন্তা করা। আল্লাহ তাআলাকে ভয় করতে থাক। তোমরা যা কর, আল্লাহ তাআলা সে সম্পর্কে খবর রাখেন।” (সূরা হাশর : ১৮)

খ. সম্পদ ও অর্থকড়ির বিসর্জন : এ সবের কুরবানির দাবি আল্লাহ তাআলা করেছেন। এ সমস্ত কিছু মানুষ ভলোবাসে। কিন্তু আল্লাহর কাছে যা আছে, তা এ থেকে উত্তম। আল্লাহর রাস্তায় সম্পদের কুরবানি মূলত এগুলোতে বৃদ্ধি দান করে। তিনি বলেছেন :

“এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। তোমরা নিজেদের জন্য যা কিছু অগ্রে পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে উত্তম আকারে এবং পুরস্কার হিসেবে বর্ধিতরূপে পাবে।” (৭৩:২০)

গ. জীবনের কুরবানি : মানুষ স্বভাবতই মরণশীল। মরণ থেকে কেউ পালিয়ে থাকতে পারবে না। এমনকি রাসূলগণও মৃত্যুবরণ করেন। যেকোনো মৃত্যুর চেয়ে আল্লাহর রাস্তায় জীবন দান অনেক বেশি শ্রেয়। আর আল্লাহর রাস্তায় জীবনের কুরবানি মানে অন্য সব মৃত্যুর ন্যায় কোন মরণ নয়। এটা এক অনন্য সমৃদ্ধ জীবনে প্রবেশের উন্মুক্ত দুয়ার। “আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদের তুমি কখনো মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত। আল্লাহ নিজের অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তার প্রেক্ষিতে তারা আনন্দ উদযাপন করছে। এ জন্য শহীদরা বারবার আল্লাহর রাস্তায় মরতে চাইবে। বুখারী ও মুসলিমে আনাস (রা.)-এর বর্ণনা করা হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের জানিয়েছেন, “যারা জান্নাতে প্রবেশ করেছে তাদের কেউ আর দুনিয়ায় ফিরে আসতে চাইবে না, আর তার জন্য দুনিয়াতে কিছু নেইও; তবে শহীদ ছাড়া। সে দুনিয়ায় ফেরত আসতে চাইবে এবং শাহাদাতের যে মর্যাদা অবলোকন করবে সে জন্য আল্লাহর রাস্তায় দশবার মরতে চাইবে।” এমনকি রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে কামনা করতেন আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাত লাভের।

দ্বিতীয় ভাগ : অবস্তুগত বিষয়

১. ভালোবাসার কুরবানি ২. পারিবারিক ভালোবাসার কুরবানি ৩. বন্ধুত্ব কুরবানি ৪. ব্যক্তিগত মতামত ৫. আবেগ-অনুভূতি ৬. মেজাজ ও রুচি ৭. আত্মমর্যাদাবোধ ইত্যাদি। সামাজিক শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু সমাজ কাঠামো বিনির্মাণের জন্য এসবের কুরবানি করতে হয় তখন যখন এটা পরিস্ফুট হয়ে উঠে যে এগুলোর কুরবানিই হচ্ছে সমাধান।

যুগে যুগে ত্যাগ ও কুরবানির নজরানা

কুরআন ও হাদিসের পাতায় পাতায় সোনার হরফে লিপিবদ্ধ রয়েছে অতীতের আম্বিয়া (আলায়হিমুস-সালাম) ও তাঁদের সঙ্গী-সাথীদের ত্যাগ ও কুরবানির কীর্তিগাথা। আল্লাহ সূরা আল ইমরানের ১৪৬ নম্বর আয়াতে সংগ্রামে অবিচল নবী ও তাঁর সাথীদের চমৎকার বর্ণনা পেশ করেছেন।

“আর আরো কত নবী যুদ্ধ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে ছিল প্রভুর অনুগত বহু লোক, আর আল্লাহর পথে তাদের উপরে যা বর্তেছিল তার জন্য তারা অবসাদগ্রস্ত হয়নি, আর তারা দুর্বলও হয়নি, আর তারা নিজেদের হীনও করেনি। আর আল্লাহ্ ভালোবাসেন ধৈর্যশীলদের। তারা আর কিছুই বলেননি শুধু এ কথা à¦›à¦¾à§œà¦¾Ñ à¦¹à§‡ আমাদের রব! আমাদের গুনাহগুলো মাফ কর এবং আমাদের আচরণের বাড়াবাড়িগুলোও। আর আমাদের কদমগুলোকে দৃঢ় করে দাও এবং কাফিরদের ওপর আমাদের বিজয় দান কর।”

হজরত ইবরাহিম (আ.) যাঁর মিল্লাতের আমরা অনুসারী, তাঁকে একের পর এক পরীক্ষা করেছেন আল্লাহ। অসংখ্য কুরবানি তিনি দিয়েছেন নিজের দেশ, পরিবার, সন্তান ইত্যাদি। তারপর আল্লাহ তাঁকে মানবতার জন্য ইমাম নির্ধারিত করেছেন। “আর স্মরণ করো! ইবরাহিমকে তাঁর প্রভু কয়েকটি নির্দেশ দ্বারা পরীক্ষা করলেন, এবং তিনি সেগুলো সম্পাদন করলেন। তিনি বললেন “আমি নিশ্চয়ই তোমাকে মানবজাতির জন্য ইমাম করতে যাচ্ছি।” (সূরা বাকারাহ : ১২৪) আর আমাদের জন্য প্রেরিত রাসূল ও শিক্ষক মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর সাথীদের কুরবানির ইতিহাস আমাদের জানাই আছে। দুনিয়ার ইতিহাসের বর্বরতম আচরণ করা হয়েছে রাসূলুল্লাহর (সা.) সাথে, তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে এবং আপন মাতৃভূমি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাঁর সাথীদের (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সাথেও কঠিনতম আচরণ করা হয়েছে।

হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বিভিন্ন সময় সাহাবাগণের সাথে আলোচনায় বসতেন, তারা আলোচনা করতেন কাকে কী ধরনের নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে ইসলাম গ্রহণ করার কারণে, এরকম একটি আলোচনায় একবার এক সাহাবী কিছু না বলে শুধু নিজের পিঠের কাপড় সরিয়ে দিলেন, আর তাদের দেখালেন। হজরত ওমর (রা.) বলেন, আমি কখনো এ রকম পিঠ দেখিনি, তোমার কী হয়েছিল? তিনি বলেন, মক্কার মুশরিকেরা আমাকে নির্যাতনের সময় আগুনের মাঝে দীর্ঘক্ষণ ধরে পাথর গরম করতেন, এরপর আমার পিঠের ওপর সেই পাথরগুলো ছেড়ে দেয়া হতো, আমাকে সেই উত্তপ্ত পাথরের ওপর শুইয়ে দেয়া হতো, এতে আমি অনুভব করতাম যে আমার পিঠের মাংস পুড়ে যাচ্ছে আর আমি পোড়া মাংসের ঘ্রাণ পেতাম, আর এ কারণেই আজকে আমার পিঠে তোমরা এই গর্তগুলো দেখতে পাচ্ছ।

নিদারুণ কষ্ট ও মুসিবতে পতিত ছিলেন সাইয়িদুনা খাব্বাব (রা.)। তিনি ছিলেন এক মহিলার দাস ও পেশায় কামার। ইসলাম গ্রহণের পর মক্কার মুশরিকরা তাঁর দ্বারা কাজ করিয়ে নিয়ে তাঁকে মূল্য দেয়া থেকে বিরত থাকত। তারা এমনকি তাঁকে জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর শুইয়ে দিয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখত। আর এ অবস্থায় তাঁর চামড়া, রক্ত, চর্বি ও গোশ্ত গলে গিয়ে আগুন নিভে যেত। এমনকি তাঁর পিঠে এ জন্য অনেক গর্তও হয়ে গিয়েছিল। এই দুর্বিষহ অবস্থায় খাব্বাব (রা.) রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে এসে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করেন না, আমাদের জন্য দোয়া করেন না?” রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, “তোমাদের পূর্বে এমন ব্যক্তিরা পার হয়েছেন যাদের মধ্য থেকে কোনো এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে এসে একটা গর্তে পুঁতে দেয়া হতো; তারপর করাত এনে তার মাথার উপর রেখে তা চালিয়ে দিয়ে তাকে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়া হতো; এবং লোহার চিরুনি দিয়ে তার হাড় থেকে তার গোশ্তগুলো ছাড়িয়ে নেয়া হতো। কিন্তু এটাও তাকে তার দীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারত না। আল্লাহর কসম, আল্লাহ অবশ্যই এই দাওয়াতকে পূর্ণতা দান করবেন। আর একজন সওয়ার সানআ থেকে হাজরামাউত পর্যন্ত ভ্রমণ করবে যাতে তাকে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করতে হবে না এবং কোনো দুশ্চিন্তাও করতে হবে না শুধু তার পালিত পশুর ব্যাপারে নেকড়ের ভীতি ছাড়া। (সহীহ আল বুখারী) আর এঁদের পথ ধরেই যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা ত্যাগ ও কুরবানির নমুনা পেশ করেই চলেছেন। আর এই ধারা কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে।

কুরবানির পথের দুটো হাতিয়ার : সবর ও সালাত

আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ ও তাঁর রাস্তায় কুরবানিতে অবিচল থাকার জন্য দরকার হয় আল্লাহর সাহায্যের। আর সেই সাহায্য অর্জনের হাতিয়ার হচ্ছে সবর ও সালাত। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “হে ঈমানদাররা, সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য গ্রহণ কর। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সবরকারীদের ভালোবাসেন।” [সূরা বাকারাহ : ১৫৩]। শত্রুদের মোকাবিলায় ময়দানে অটল থাকার জন্য দরকার প্রচণ্ড ভয় শ্রদ্ধা করো, যেন তোমরা সফলকাম হতে পারো।” [৩ : ২০০]

পরিশেষ : পৃথিবীর ইতিহাসে যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহব্বত ও ভালোবাসায় আত্মত্যাগের মহান সোনালি অধ্যায় রয়েছে তেমনি রাসূলের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করার প্রয়াস চালিয়ে একদল লোকের নির্মম পরিণতির শিক্ষণীয় অধ্যায় আছে। রাসূলের (সা.) কটূক্তিকারী দুনিয়াতেই সাজা ভোগ করে। রাষ্ট্রীয়ভাবে শায়েস্তা করা না হলে আল্লাহর কুদরতে সে করুণ পরিণতি ভোগ করে। আল্লাহ তায়ালা সূরা আল ইমরানের ২১ নম্বর আয়াতে বলেন,

“যারা আল্লাহর বিধান ও হিদায়াত মানতে অস্বীকার করে এবং তাঁর নবীদের অন্যায়ভাবে হত্যা করে আর এমন লোকদের প্রাণ সংহার করে, যারা মানুষের মধ্যে ন্যায়, ইনসাফ ও সততার নির্দেশ দেবার জন্য এগিয়ে আসে, তাদের কঠিন শাস্তির সুসংবাদ”

ফেরাউন, নমরুদ, আবু লাহাব, আবরাহারা সে আজাবের স্বাদ নিচ্ছে। এ জগতেও তারা অবমাননার মরণ পেয়েছে।

আজ আমাদের অনেকের জীবনে জেল-জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, ফাঁসির রায় এগুলো নতুন হলেও ইসলামী আন্দোলনে তা একেবারেই পুরাতন। আজো পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে মুসলমানদের সাথে চলছে একই আচরণ। সময়ের আবর্তনে যেমনি রাতের গভীরতার পর সুবে সাদেকের আলোকরশ্মি দেখা দেয়। অনুরূপভাবে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় জালিমদের পতন ঘটবে। আর মজলুম মানবতা খুঁজে পাবে ন্যায় ও ইনসাফের সৌধের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি সুন্দর সমাজ। এই জন্য প্রয়োজন ধৈর্য, হিকমাত ও সাহসিকতার সাথে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদের জন্য পথ করে দেন এবং রহমাত দান করেন যারা তাঁর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ ও কুরবানি করতে প্রস্তুত থাকে। তিনি ঘোষণা করেছেন :

আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন।

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।