॥ এম. মুহাম্মদ আব্দুল গাফ্্ফার ॥
আরবী ‘কারীব’ শব্দ থেকে কুরবানি শব্দের উৎপত্তি। কারীব অর্থ নিকটবর্তী। কুরবানির আভিধানিক অর্থ হলো আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার নিকটবর্তী হওয়ার প্রচেষ্টা আর এর পরিভাষাগত অর্থ হলো মহান রাব্বুল আলামিনের আদেশ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন।
মুসলিম জাতির পিতা নবী ও রাসূল হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁর জীবনের অনেকগুলো ঘটনার মাধ্যমে এ ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এসব ত্যাগ ও কুরবানির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন বলেই তিনি মুসলিম জাতির পিতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছিলেন। পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইব্রাহীম (আ.) সম্পর্কে এভাবে বর্ণনা এসেছে, ‘তাঁর (ইব্রাহীমের) রব যখন তাঁকে বললেন অবনত ও অনুগত হও, তখনি সে বলল, আমি বিশ্বপালকের অনুগত হলাম।’ (সূরা বাকারা: ১৩১)। জাতির পিতার এ ঘটনার দ্বারা এ কথা অতি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে যে, একমাত্র রাব্বুল আলামিনের উদ্দেশে সবকিছু ত্যাগ করার মাধ্যমেই তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব।
আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর দাসত্ব করা ছাড়া অন্য কোনো পন্থায় তার খেলাফতের দায়িত্ব পালন বা প্রিয় বান্দা হওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর জীবনেরই আরেকটি বিষয়ের বর্ণনা এভাবে এসেছে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘ইব্রাহীম (আ.)-কে তার রব বললেন, আমি তোমাকে সকল মানুষের ইমাম (নেতা) করতে চাই, ইব্রাহীম বললো, আমার সন্তানদের প্রতিও কী এ ওয়াদা? তিনি উত্তরে বললেন, আমার প্রতিশ্রুতি জালিমদের সম্পর্কে নয়।’ (সূরা বাকারা: ১২৪)। মহান রাব্বুল আলামিনের এ ঘোষণা থেকে যে বিষয়টি জানা গেল তার মর্মার্থ হলো বংশগৌরব, অর্থ-সম্পদ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা যার যাই থাকুক না কেন, সে যদি আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার দেয়া জীবনবিধান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অপারগ হয়, তাহলে তার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত খেলাফতের নেতৃত্ব লাভ একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার।
মহান আল্লাহ তায়ালার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন আল্লাহপ্রেমিক বান্দার জন্য খুবই জরুরি। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘তোমরা কিছুতেই প্রকৃত লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা (আল্লাহর পথে) সেসব জিনিস ব্যয় করবে, যা তোমাদের প্রিয় ও পছন্দনীয়, আর যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে আল্লাহ সে সম্পর্কে (অবশ্যই) অবহিত।’ (সূরা আলে ইমরান : ৯২)। মহান রাব্বুল আলামিনের জন্য প্রিয় জিনিস ব্যয় বা ত্যাগ করতে হলে প্রথমে চিন্তাভাবনা করতে হবে কোন বিষয় এবং বস্তুটা মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রিয়। মানুষের অর্থ সম্পদ, সন্তানাদি তো প্রিয় অবশ্যই, তবে নিজের জীবন প্রাণটাকে কেউ অগ্রাধিকার দেয় না- এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইব্রাহীম (আ.)-এর সাথে তাগুতদের সম্পর্ক এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ইব্রাহীম বললেন, তাহলে তোমরা কী আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসবের ইবাদত করছো! যারা তোমাদের না কোনো উপকার করতে পারে আর না কোনো ক্ষতি করতে পারে।’ (সূরা আম্বিয়া : ৬৬)।
হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর এ জবাবে আল্লাহদ্রোহী শক্তি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। পবিত্র কুরআনুল কারীমে তাদের কথা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘তারা বললো ইহাকে আগুনে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ফেলো। আমি (আল্লাহ) বললাম, হে আগুন! ঠাণ্ডা হয়ে যাও এবং নিরাপদ হয়ে যাও ইব্রাহীমের প্রতি।’ (সূরা আম্বিয়া: ৬৮-৬৯)। এ দুটি আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন এবং আল্লাহর উদ্দেশে তাঁর জান কুরবানির প্রস্তুতিতে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে মুসলিম জাতির পিতার আসনটি দান করেছেন।
এভাবে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর চূড়ান্ত পরীক্ষা হয় স্বীয় পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে কুরবানির ঘটনার মধ্য দিয়ে। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা এ ঘটনার অবতারণা করেন ‘পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি তোমাকে জবেহ করছি, এখন তুমি বলো তোমার মত কী? সে বললো, যা কিছু আপনাকে আদেশ করা হয়েছে, তা আপনি করুন! ইনশাআল্লাহ (আল্লাহ চাইলে) আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের একজন পাবেন।’ শেষে যখন তারা দুজনই আনুগত্যের মাথা নুইয়ে দিল এবং ইব্রাহীম পুত্রকে ললাটের অভিমুখে শয়ন করিয়ে দিল। এবং আমি আওয়াজ দিয়ে বললাম, হে ইব্রাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্য প্রমাণ করে দেখালে, আমি সৎ লোকদের এরূপ প্রতিফলই দান করে থাকি। নিঃসন্দেহে ইহা একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষার ব্যাপার ছিল।’ (সূরা সাফফাত: ১০২-১০৬)। মহান রাব্বুল আলামিন জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর এ পরীক্ষার দ্বারা তাঁর কুরবানি গ্রহণ করলেন। এ কুরবানিরই ফলস্বরূপ পশু কুরবানির সুন্নত তথা রেওয়াজ মুসলিম সমাজে চালু করে দিলেন। এ কুরবানি ঈদুল আজহা উপলক্ষে পশু কুরবানি করতে হয়। পশু কুরবানির অর্থই হলো মানুষের মধ্যে যে পশুবৃত্তি রয়েছে মূলত তাকেই কুরবানি করে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার নৈকট্য লাভ করা। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘এসব পশুর গোশত, রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাকওয়াই মাত্র তাঁর কাছে পৌঁছে থাকে। তিনি ওসব জন্তুকে তোমাদের জন্য এভাবে অনুগত এজন্য করেছেন, যাতে তাঁর দেখানো পথে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পারো, আর হে নবী! তুমি নেককারদেরে সুসংবাদ দান করো।’ (সূরা হজ : ৩৭)। মহান রাব্বুল আলামিনের এ ঘোষণা দ্বারা পরিষ্কারভাবে বুঝা গেলো যে, পশু কুরবানির দ্বারা নিছক আনন্দ উৎসব নয়, বরং মহান রাব্বুল আলামিনের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি ও তাঁর শুকরিয়া আদায়টাই হলো বান্দার একান্ত কর্তব্য। এ জন্যই করবানির ঈদের পাঁচ দিন বিশেষ তাকবীর প্রত্যেক ফরজ সালাতের পর পাঠ করতে হয়। সে তাকবীরটা (৯ হিজলহজ ফজর নামাযের ফরজের পর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত পাঠ করতে হবে।) তা হলো ‘আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ অর্থাৎ আল্লাহ মহান আল্লাহ মহান, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আল্লাহ মহান আল্লাহ মহান এবং তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা।
কুরবানির পশু জবেহ করে শুধু নিজে আত্মতৃপ্তি করে খাওয়াটাই যথেষ্ট নয়। এ গোশত বিক্রি বা কাউকে পারিশ্রমিকও দেয়া যাবে না। এ গোশত ধনী, গরিব, ফকির-মিসকিন সবাই যাতে খেতে পারে সে সুযোগও ইসলামে রয়েছে। এর দ্বারা যে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়, তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। এ মর্মে একটি হাদীস উল্লেখ করা যেতে পারে ‘হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন, একবার নবী (সা.) একশত উট কুরবানি করে আমাকে গোশত বণ্টন করতে বললে আমি গোশত বণ্টন করে দিলাম, পরে জিনসমূহ বণ্টন করে দিতে বললে সেগুলো বণ্টন করে দিলাম। সর্বশেষ চামড়াগুলো বণ্টন করে দিতে বললে সেগুলোও বণ্টন করে দিলাম। (সহীহ আল বুখারী, কিতাবুল মানাসিক, হাদীস নং-১৬০০)।
শেষ কথা হলো, কুরবানির এসব শিক্ষা ও তাৎপর্য বুঝে মুসলিম সমাজ ঈদুল আজহা উদযাপন করলেই কেবল প্রকৃত কল্যাণ লাভ করা যেতে পারে।
লেখক : সদস্য, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, দরগাহ রোড, সিরাজগঞ্জ।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- কুরবানির ইতিহাস ও তাৎপর্য
- আরাফাতের দিনের গুরুত্ব ও ফজিলত
- জায়নবাদ এবং তার সখা
- নতজানু
- বখতে নসরের চোখ
- আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন-এর দুটি কবিতা
- চাঁদের জোসনা
- আলম শামস-এর একগুচ্ছ
- বিদ্রোহী কবি সম্রাট
- সাফা মারওয়া
- ঈদের নামায
- কুরবানি ঈদের পূর্বপ্রস্তুতি
- আনুগত্য ও ত্যাগের মহিমায় হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তার পরিবার
- কুরবানি ঈদের রান্না
- সংসার
- হজ মহাসম্মেলন
- বিদায় হজের ভাষণ
- নূহা রাহির মিশুবিষয়ক সুসমাচার
- ঈদ ভাবনায় আঁকা জীবন