রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ১২তম সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ॥ ৭ জিলহজ ১৪৪৫ হিজরী ॥ ১৪ জুন ২০২৪

॥ মাওলানা মুফতি মো. ওমর ফারুক ॥

ঈদ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ খুশি বা আনন্দ। ঈদ বলতে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদকে বোঝায়। প্রতি বছর মুসলিম উম্মাহ দুটি ঈদ উদযাপন করে। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিন, যা ঈদুল ফিতর নামে পরিচিত। আর একটি জিলহজ মাসের দশ তারিখ, যা ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ হিসেবে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর নিকট পালিত হয়। যার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। ঈদ মুসলমানদের আনন্দের দিন, পুরস্কারপ্রাপ্তির দিন দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর ফল বা রেজাল্ট প্রকাশের দিন। কিন্তু রেজাল্ট কাদের জন্য, যারা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা দিয়েছে, তারাই কেবল ফলের প্রত্যাশা করতে পারে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এদেশে মাহে রমজানের এক মাসের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেও অনেক মুসলমান প্রথম সারির পুরস্কার নেয়ার লোভে সবার আগের কাতারে বসেন। বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা যতই সেজেগুজে বসবে। কোনো লাভ নেই। তারা সেদিন মাঠ থেকে অপদস্থ হয়ে, তিরস্কৃত হয়ে বাড়ি ফিরবে। যদিও তা বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখা যায় না।
প্রাত্যহিক জীবনেও দেখা যায়, কেউ হাসে, কেউ কাঁদে, কেউবা জীবনের সকল রঙ্গখেলার সমাপ্তি ঘটিয়ে হাসপাতালের বিছানায় অথবা জেল-হাজতের ভেতরেই জীবন নামের ইতি টানেন। কবর নামক বাহনে চড়ে পরপারে রওনা করেন। খুশি বা আনন্দ দুনিয়ায় সবার জন্য সবসময় নয়। কালের আবর্তনে জীবনের খেলাঘরে যারা ভালো করে, তারাই কেবল সফল। তদ্রƒপ ঈদের আনন্দ, খুশি, পুরস্কার তাদের জন্যই, যারা জীবনের পরতে পরতে মহান মাবুদের নির্দেশিত পথে পথ চলতে বদ্ধপরিকর।
ঈদের নামাযের হুকুম : ঈদে দুই রাকাত নামায পড়া ওয়াজিব। এতে সকল ইমাম ঐকমত্য পোষণ করেছেন। রাসূল (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর থেকে নিয়মিত তা আদায় করেছেন। জীবনে কখনো তরক করেননি।
নামাযের ওয়াক্ত বা সময় : সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্য মধ্য আকাশে উপনীত হওয়ার মধ্যবর্তী যে কোনো সময় পড়তে হবে। সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে গেলে এ নামায পড়া যাবে না। কোনো কারণবশত সূর্য মধ্যগগনে উপনীত হওয়ার পূর্বে নামায আদায় করতে না পারলে ঈদুল ফিতরের নামায পরের দিন ও ঈদুল আজহার নামায ১২ জিলহজ পর্যন্ত ওই ওয়াক্তে আদায় করা যাবে।
ঈদের নামাযের স্থান : ঈদের নামায ও জুমার নামাযের মতো জামাতে পড়তে হবে। একাকী এ নামায আদায় করা যাবে না। জুমার নামায মসজিদেই আদায় করা হয়। ঈদের নামায মাঠে পড়া উত্তম ও সুন্নত। বিনা ওজরে ঈদের নামায মসজিদে আদায় করা মাকরূহ। (ঝড়, বৃষ্টি তুফান, মাঠের ব্যবস্থা না থাকা) ইত্যাদি ওজরে ঈদের নামায মসজিদে পড়া যায়।
এর দলিলসমূহ উল্লেখ করা হলো
১. রাসূল (সা.)-এর জীবনে মাত্র একবার প্রবল বৃষ্টির কারণে ঈদের নামায মসজিদে পড়েছিলেন। আর বাকি সারা জীবনই মাঠে পড়েছেন।
২. রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন যে, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহে গিয়ে ঈদের নামায আদায় কর। (বুখারী শরীফ)।
৩. হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন কিছু খেজুর বা মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য না খেয়ে ঈদগাহে যেতেন না। (বুখারী শরীফ)।
৪. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যেতেন এবং দুই রাকাত নামায আদায় করতেন। যার আগে বা পরে আর কোনো নামায পড়েননি। তিনি আরো বলেন, রাসূল (সা.) এক পথে ঈদগাহে যেতেন এবং অন্য পথে ঈদগাহ হতে বাড়ি ফিরতেন।
৫. হযরত জাবীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূল (সা.) দুই ঈদের উদ্দেশে বের হতেন এবং তাঁর পরিবার-পরিজনকে বের হওয়ার নির্দেশ দিতেন। (মুসনাতে আহম্মদ)।
৬. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূল (সা.) দুই ঈদের নামায আদায়ের জন্য ঈদগাহের দিকে বের হতেন এবং তার কন্যা ও স্ত্রীগণকেও বের হতে নির্দেশ দিতেন।
৭. হযরত আয়শা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলোÑ মহিলারা কি ঈদের নামাযের জন্য ঈদগাহে যাবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই। জিজ্ঞেস করা হলো “যুবতী মেয়েরাও কি বের হবে”? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাসূল (সা.) আরো বলেন, নিজের কাপড় না থাকলেও কোনো সঙ্গী-সাথীর কাপড় পড়ে ঈদগাহে যাবে। (তিবরানী)।
৮. হযরত উম্মে আতীয়াহ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূল (সা.) আমাদের ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে যুবতী, অন্তঃপুরবাসিনী ও হায়েজ সম্পন্না মহিলাদের ঈদগাহের মাঠে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। (মুসনাতে আহম্মদ)।
৯. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূল (সা.) একবার ঈদের দুই রাকাত সালাত আদায় করেন এবং এর আগে-পরে আর কোনো সালাত আদায় করেননি। তারপর তিনি মহিলাদের কাছে আসেন এবং তাদের সদাকা করার নির্দেশ দেন। তখন উপস্থিত মহিলারা নিজেদের কানের দুল, নাকের বালা ইত্যাদি দান করল, সাথে হযরত বিলাল (রা.)ও উপস্থিত ছিলেন। (বুখারী শরীফ)।
১০. ইজমা : উল্লেখিত হাদিস ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহর ওপরে সকল আলেম-ওলামা ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে বিনাওজরে ঈদের সালাত মসজিদে পড়া মাকরূহ। ঈদের মাঠ থাকা অবস্থায় ঈদের নামায মসজিদে আদায় করা যাবে না।  
১১. হযরত বুরাইদা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূল (সা.) কিছু না খাওয়া পর্যন্ত ঈদগাহে বের হতেন না এবং ঈদুল আজহার দিন নামায না পড়া পর্যন্ত কিছু খেতেন না।
আমাদের করণীয় : উপরোক্ত হাদিসে কারীমাহ ও মাসাআয়ালার কিতাব থেকে এটা পরিষ্কার যে ঈদের নামায ঈদগাহে পড়া সুন্নত। কোনো ওজর ব্যতীত মসজিদে ঈদের নামায পড়া মাকরূহ।
মাসআয়ালা-১ : ঈদের নামায মসজিদে না পড়ে ঈদগাহে পড়া সুন্নত আর ঈদের মাঠ শহরের বাইরে হওয়া সুন্নত। কেননা রাসূল (সা.) আজীবন মদিনার পাশে বিশাল প্রান্তরে ঈদের নামায আদায় করেছেন। শুধু বৃষ্টির কারণে জীবনে একবার ঈদগাহে না গিয়ে মসজিদে নামায আদায় করেছেন। হাদিসটি ইমাম আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন।
মাসআয়ালা-২ : ফতোয়ার কিতাব দুররে মুখতারে রয়েছে ঈদের নামাযের জন্য বৃহৎ ময়দানে বের হওয়া সুন্নত। যদিও জামে মসজিদ থাকে এবং লোক সংকুলান হয়।
মাসআয়ালা-৩ : ঈদের নামাযের জন্য ইমাম সাহেব বিশাল প্রান্তরে বের হওয়া সুন্নত। ইমদাদুল ফতোয়া ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা নং-৬১০। দুররে মুখতার ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা নং-৭৭৬। আহসানুল ফতোয়া ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা নং-১১৯। ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়ায় রয়েছে ঈদের নামায ঈদগাহে গিয়ে পড়া সুন্নত। ঝড়-বৃষ্টি অথবা অন্য কোনো ওজর থাকলে মসজিদে পড়া জায়েজ। তবে রাসূলের অনুসরণের ফজিলত থেকে বঞ্চিত থাকবে। ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা নং-২৯৬।
হযরত বকর ইবনে মোবাশ্বের আল আনসারী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার দিন আমরা রাসূল (সা.)-এর সাথে ঈদগাহে যেতাম এবং রাসূল (সা.)-এর সাথে নামায আদায় করে বাড়ি ফিরতাম। আবু দাউদ, পৃষ্ঠা-১৬৪।
সর্বোপরি পবিত্র কুরআনে সূরা হাশরের ৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমাদের জন্য রাসূল (সা.) যা নিয়ে এসেছেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেছেন তা বর্জন কর ।
আরো এরশাদ হচ্ছে, “হে নবী! আপনি বলুন তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তাহলে আমার অনুসরণ কর, তাহলেই তোমরা আল্লাহর ভালোবাসা পাবে, আর তিনি তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেবেন, নিশ্চয় তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়াময়। (সূরা আলে ইমরান : ৩১)।
শেষ কথা : গ্রামের ছোট ছোট পাঞ্জেগানার সামনে অথবা ছোট ছোট মসজিদের সামনে তো দূরের কথা, স্বয়ং রাসূল (সা.) মদিনা শহরেই ঈদের নামায আদায় না করে শহরের সন্নিকটে মদিনার পাশে এক বিশাল মাঠে আজীবন ঈদের নামায আদায় করেছেন। মাত্র একবার প্রবল বৃষ্টির কারণে মসজিদে ঈদের নামায আদায় করেছেন।
তাই আসুন, ঈদের নামায মসজিদের মধ্যে বা মসজিদের সামনে সামান্য এক টুকরা জায়গা, যা ঈদের মাঠের জন্য নির্ধারীত নয়, সেখানে আদায় না করে ঈদের মাঠে বৃহৎ আকারে পড়ার ব্যবস্থা করা। যা সুন্নত ও উত্তম। আল্লাহ আমাদের সকলকে দীনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।
লেখক : গবেষক, ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিশিষ্ট ব্যাংকার।



অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।