রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ১২তম সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ॥ ৭ জিলহজ ১৪৪৫ হিজরী ॥ ১৪ জুন ২০২৪

॥ আলী আহমাদ মাবরুর ॥
বর্তমানে আমরা বিশ্বের অনেক স্থানেই ফ্যাসিস্ট দর্শনের উত্থান দেখতে পাচ্ছি। এ ফ্যাসিস্ট দর্শনের দোহাই দিয়ে কোনো একটি ধর্ম বা গোত্র বা বর্ণকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হচ্ছে আর অন্য সব ধর্ম ও গোত্রের মানুষকে নির্বিচারে দমন করা হচ্ছে। তাদের ভূমি, আবাসস্থল দখল করা হচ্ছে। আবার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জাতির অভ্যন্তরে নানা ধরনের বিভক্তি-বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আগ্রাসী রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে অন্তত দুটি মতবাদের কথা পরিষ্কার করেই বলা যায়। এর একটি হলো উগ্র হিন্দু মৌলবাদ, যার বিচ্ছুরণ ঘটেছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে। আর অন্যটি হলো জায়নবাদÑ যার আগ্রাসন চলতি সময়ে আমরা গাজায় নিরন্তর দেখতে পাচ্ছি। যদিও জায়নবাদের ধারক-বাহকেরা শুধু গাজা বা ফিলিস্তিন নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যকেও নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর বিশে^র শান্তিকামী মানুষ; বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠী এ দুটি আগ্রাসী ও ধ্বংসাত্মক দর্শনের নেতিবাচক প্রভাব চড়া মূল্য দেয়ার বিনিময়েই মোকাবিলা করে যাচ্ছে।
জায়নবাদ এমন এক ফ্যাসিস্ট মতবাদ, যার চাপে মুসলিমরা; বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ বিগত ৮০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পিষ্ট হয়ে আসছে। জায়নবাদ মূলত ইহুদিদের একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা ইহুদিদের একত্রিত করে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং সেখান থেকে গোটা দুনিয়া রাজত্ব করা। থিওডোর হার্জেলকে জায়নবাদী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা বলে গণ্য করা হয়। তার লেখা ‘ডের জুডেন্সটাটে’ তিনি ভবিষ্যৎ ইহুদি রাষ্ট্রের কথা বলে গেছেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে জাতীয় পুনর্জাগরণ আন্দোলন হিসেবে জায়নবাদের উত্থান ঘটে আর তখন থেকেই এর প্রবর্তকরা তাদের প্রধান লক্ষ্য তথা ফিলিস্তিনে তাদের কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রের ব্যাপারে মনোনিবেশ করেন। এ সময় উসমানীয় সাম্রাজ্য ফিলিস্তিন শাসন করত।
তবে সংগঠিতভাবে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয় ১৮৯৭ সাল থেকে। সে বছরই ইহুদি সাংবাদিক থিওডর হার্জেলের নেতৃত্বে সুইজারল্যান্ডের বাসল নগরীতে ইহুদিদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের মালিকানাধীন কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করা, কৃষি বসতি স্থাপন, বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ছড়িয়ে দেওয়া, বিভিন্ন দেশের সরকারকে জায়নবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলার প্রচেষ্টাসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
এ সম্মেলনের ২০ বছর পর ১৯১৭ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিন ব্রিটিশ শাসনের আওতায় চলে আসে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জায়নবাদী পরিকল্পনা আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। অবশেষে ১৯৪৮ সালে ১৪ মে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন ত্যাগ করলে জায়নবাদীদের পরিকল্পনা পুরো বাস্তবায়িত হয় এবং ঐ বছরের ১৫ মে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ইসরাইলকে স্বীকৃতি দান করে। এভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের সহায়তায় জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল জন্মলাভ করে। এখানে এ বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার যে, কোনো মুসলিম দেশে ইহুদি হিসেবে বসবাস করা একটি বাস্তবতা আর জায়নবাদী চিন্তার বদৌলতে মুসলিমদের পবিত্র নগরী দখল করে জায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখা একদমই ভিন্ন একটি বাস্তবতা। তাছাড়া জায়নবাদ ইহুদি ধর্ম থেকেও সম্পূর্ণ আলাদা। খোদ ইসরাইলেই অসংখ্য ইহুদিও রয়েছেন, যারা জায়নবাদী চিন্তার সাথে একমত নন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইসরাইল রাষ্ট্রটির শাসনে যারা এসেছে, তারা বরাবরই ইহুদি ধর্মের চেয়ে জায়নবাদের বিকাশে বেশি কাজ করেছে। এ জায়নবাদীরা মনে করে, ‘ফিলিস্তিনের পুরো ভূখণ্ডটি শুধুমাত্র তাদের জন্যই বরাদ্দ। আর যারা তাদের ধর্মবিশ্বাস ও চিন্তাচেতনা লালন করে না, এ ভূখণ্ডে তাদের কোনো জায়গা নেই।’ তাদের এ ন্যক্কারজনক মানসিকতার কারণে মুসলিমরা বিগত ২ হাজার বছর ধরে এ ভূখণ্ডে বসবাস করার পর আজও তারা নিজ ভূমেই পরবাসী। আবার এর বিপরীতে ইউরোপ বা আমেরিকায় জন্ম নিয়েও শুধুমাত্র ইহুদি হওয়ার কারণে যে কেউ সেই পবিত্র ভূখণ্ডে নাগরিকত্ব নিয়ে নিতে পারছে। অনেকেই মনে করেন, কেবল ফিলিস্তিনের মুসলিমরাই বোধ হয় জায়নবাদীদের দ্বারা নির্যাতিত হয়। এটি সত্য নয়। ওই ভূখণ্ডে ইহুদি ছাড়া আর যারাই আছে; এমনকি তারা যদি খ্রিষ্টানও হয়, তারাও একইভাবে জায়নবাদীদের দ্বারা নিষ্পেষিত হয়। সর্বশেষ ক্রিসমাস ডেতে গাজা ও বেথেলহামে বসবাসরত খ্রিষ্টানরা যেভাবে নির্যাতিত হয়েছে, তা জায়নবাদীদের নৃশংসতারই প্রমাণ বহন করে।
জায়নবাদের মতো করেই আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে উগ্র হিন্দু মৌলবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে বিগত দুই দশকে। প্রাগৈতিহাসিকভাবে ভারতবর্ষের সভ্যতার কথা সর্বজনবিদিত। অথচ সেই ভারতে এখন অন্যায়, অবিচার, ধর্মান্ধতার আস্ফালন দেখা যাচ্ছে। উগ্র হিন্দুবাদের ব্যাপক বিস্তারের কারণে ভারতে এখন কেবলমাত্র উগ্র হিন্দুবাদীদেরই অপর গোত্র বা অন্য চিন্তার সমর্থকদের ওপরে স্থান দেওয়া হচ্ছে। এর নেপথ্যে কোনো যুক্তি নেই, আছে কেবলই ফ্যাসিবাদী মানসিকতা।
জায়নবাদ ও উগ্র হিন্দু মৌলবাদ- এ দুটি মতাদর্শের মূল উপজীব্য বিষয় হলো ধর্মান্ধতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ আর প্রতিহিংসা। ভারতে নাগরিকত্ব আইনের নামে, রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠার নামে, ব্যক্তিপূজা ও বিশেষ একটি দলের আধিপত্যকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রমোট করা হচ্ছে। একটি দল বা গোষ্ঠী শ্রেষ্ঠতর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, আর বাকি সবাইকে বলির পাঁঠা বানিয়ে তাদের ওপর জঘন্যভাবে নিপীড়ন করা হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বরাবরই উগ্র হিন্দুত্ববাদী নীতিকে তার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজে লাগিয়েছেন। এ নীতির সারকথা হচ্ছে, ভারতকে যেকোনো উপায়ে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। এখানে অন্য কোনো ধর্মের মানুষ থাকতে পারবে না। এমন বার্তা তিনি তার বিগত দুই শাসনামলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এতে তার সাথে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদসহ অন্যান্য উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতৃবৃন্দ।
বিজেপি অধ্যুষিত রাজ্যগুলোয় মুসলমানদের ওপর বিগত এক দশক ধরে নানা ধরনের নিপীড়ন ও দমনমূলক প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। মুসলমানদের ভারতছাড়া করার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবেও বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইন এনআরসি প্রণয়নসহ নানা আইন করা হয়েছে। কাশ্মীরে মুসলমানদের ওপর চালানো হচ্ছে নির্মম নির্যাতন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, একটি দল বা নেতার ক্ষমতায় থাকা এবং পুনরায় আসার জন্য রাষ্ট্রের একটি ধর্মের অনুসারীদের নির্মূলের এমন নিকৃষ্টতম প্রক্রিয়া বিশ্বে বিরল। ভারতের যে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি, তা সমূলে উচ্ছেদ করতে মোদি সরকার দ্বিধা করছে না।
সাদামাটা পর্যালোচনা করলেও এ দুটি আগ্রাসী মতবাদের মধ্যে বেশকিছু সামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়। আর এ সামঞ্জস্যতার কারণে এ দুটি মতবাদের উত্থান ও বিকাশের পথে যেমন মিল পাওয়া যায় তেমনি দুটি মতবাদেরই কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যও লক্ষ করা যায়। প্রথমত, যে বিষয়টি চোখে পড়ে তা হলো, এ দুটি মতবাদের ধারকদের মধ্যে সুসম্পর্ক। ২০১৭ সালে ভারতের ইতিহাসের প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি ইসরাইল সফর করেন। সে সময় থেকেই মোদির সঙ্গে নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। প্রকাশ্যে মোদিকে একাধিকবার ‘বন্ধু’ বলেও সম্বোধন করেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন ‘বিপ্লবী নেতা’ও।’ ২০১৮ সালে নেতানিয়াহু যখন পাল্টা সফরে ভারতে আসেন, তখন এক যৌথ বিবৃতিতে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের’ অঙ্গীকার করেছিল নয়াদিল্লি এবং তেলআবিব। ভারত ও ইসরাইলের মধ্যে বন্ধুত্ব শক্তিশালী হচ্ছে দাবি করে নরেন্দ্র মোদি তখন ইসরাইলের অস্ত্র নির্মাতাদের ভারতে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানান। অন্যদিকে ভারতে গণতন্ত্রের ভিত্তি ও সহিষ্ণুতার ইতিহাসের প্রশংসা করেন নেতানিয়াহু। তিনি তখন দাবি করেছিলেন, ‘ভারতে বসবাসকারী ইহুদিদের কখনোই অন্য দেশের মতো বিদ্বেষের শিকার হতে হয়নি। এটা সম্ভব হয়েছে ভারতের উন্নত সভ্যতা, সহিষ্ণুতা আর গণতন্ত্রের কারণেই।’
ভারত ও ইসরাইলের সম্পর্কের সূত্রপাত ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই। ১৯৪৭ সালে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জাতিসংঘের পরিকল্পনার বিপক্ষে ভোট দেয় ভারত। ১৯৫০ সালে নয়াদিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় ইসরাইলকে। ১৯৫৩ সালে ইসরাইল কনস্যুলেট খোলে মুম্বাইয়ে। তবে ভারত-ইসরাইল সম্পর্ক বেশি ঘনিষ্ঠ হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। ১৯৯২ সালে ভারত পুরোপুরি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে ইসরাইলের সঙ্গে। এরপর মসৃণ গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে দুই দেশের সম্পর্ক। এর ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে মহাকাশ গবেষণা সহযোগিতার জন্য ইসরাইলি মহাকাশ সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। ২০০৬ সালে দুই দেশের মধ্যে কৃষি সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। আর সর্বশেষ এক দশক আগে ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর এ দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভিন্ন উচ্চতায় চলে যায়।
দ্বিতীয় যে মিল এ দুটি আগ্রাসী দর্শনের ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়, তা হলো মিথ্যাচার এবং আরো স্পষ্ট করে বলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মিথ্যাচার। হিটলারের ‘হোলাকোস্ট’ নামক বাগাড়ম্বরিতাকে কাজে লাগিয়ে জায়নবাদীরা প্রচার করেছিল যে, ফিলিস্তিনই হলো তাদের ‘প্রতিশ্রুত ভূখণ্ড’ আর আল আকসা মসজিদের নিচেই রয়েছে তাদের তথাকথিত টেম্পল। কিন্তু পরবর্তীতে পশ্চিমা; এমনকি ইহুদি প্রত্নতাত্বিকদের বয়ানেই জায়নবাদীদের এ দাবিটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। এক্ষেত্রে তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসরাইল ফ্লিনটসটেইনের কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি নিশ্চিত করেছেন, কথিত টেম্পল নিয়ে জায়নবাদীরা যা বলেছে পুরোটাই মিথ্যা এবং কাল্পনিক একটি গল্প। এরকম কোনো টেম্পলের অস্তিত্বই সেখানে নেই। এ পর্যন্ত যেটুকু খননকার্য পরিচালনা করা হয়েছে, তাতে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, আরো কয়েক হাজার বছর পূবেই সেই কথিত টেম্পল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অনেকগুলো ইহুদি রেফারেন্সে এবং পশ্চিমা প্রত্নতত্ত্ববিদের নানা অনুসন্ধানে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ যার কথা বলা যায়, তিনি হলেন ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক ড. কেইটলিন কাবিনোস। ১৯৬৮ সালে তিনি যখন জেরুসালেমে ব্রিটিশ স্কুল অব আর্কিওলোজির খনন প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন, তখন তিনি জেরুসালেমজুড়ে অসংখ্য খননকার্য সম্পাদন করেছিলেন। পরবর্তীতে ‘ইসরাইলি মিথের জালিয়াতি’ প্রকাশ করে দেয়ার অভিযোগে তাকে ফিলিস্তিন থেকে বের করে দেয়া হয়। তিনি নিশ্চিত করেছিলেন, জায়নবাদীরা আল আকসা মসজিদের নিচে সুলাইমানের টেম্পল থাকার যে দাবি করে তার কোনো সত্যতা নেই। (তথ্যসূত্র: আভি শারিত; হারিতজ; হাউ ইজরাইল টেকস ইটস লাস্ট ব্রিথ)।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, জায়নবাদীরা যেমন আল আকসার নিচে টেম্পল অব সুলেমন থাকার দাবি করে ঠিক একইভাবে ভারতের উগ্র হিন্দু মৌলবাদীরাও অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের নিচে একটি রামমন্দির থাকার দাবি করে বসে। ভারতে ঐতিহাসিকরা মোটামুটি একমত যে, মোগল আমলে বাবরের একজন সেনাপতি মীর বাকি ১৫২৮ সাল নাগাদ অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে দেড়শ বছর আগে থেকে হুট করে ভারতের হিন্দু সমাজের একটা বড় অংশ দাবি করতে শুরু করে যে, তাদের আরাধ্য দেবতা শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থানের ওপরই ওই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। ভারতের ধর্মীয়-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে বহু দশক ধরে সবচেয়ে বিতর্কিত ও রক্তক্ষয়ী ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে এ বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিরোধ। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতে বর্তমানে ক্ষমতাসীন বিজেপির শীর্ষনেতাদের উপস্থিতিতেই উগ্র কট্টরপন্থী বিভিন্ন হিন্দু সংগঠনের সদস্যরা অযোধ্যার ওই বিতর্কিত জমির ওপর অবস্থিত বাবরি মসজিদের স্থাপনাটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।
অথচ এ সংকটের সমাধান করার উদ্যোগ নেয়া হয় ১৮৬০ সালেই। মসজিদের নিচে আদৌ কোনো মন্দির আছে কিনা, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেয়া হয় আর্কিওলোজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া তথা এএসআইকে। এএসআই-এর প্রথম মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার কিছুদিনের মধ্যেই ১৮৬২-৬৩ সালে আলেক্সান্ডার কানিংহাম অযোধ্যায় জরিপ পরিচালনা করেন। তার অন্যতম প্রাথমিক আগ্রহের বিষয় ছিল মসজিদের নিচে মন্দিরের অস্তিত্ব শনাক্ত করা। কানিংহাম তার প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘এখানে কোনো উঁচু ঢিবির ধ্বংসাবশেষ (ভাঙা মূর্তি এবং ভাস্কর্য খোদিত স্তম্ভ¢ দ্বারা আবৃত) নেই, যার মাধ্যমে অন্যান্য প্রাচীন শহরের মতন এটিকে চিহ্নিত করা যায়। তবে শুধুমাত্র একটা অনিয়মিত আবর্জনার স্তূপের সঞ্চয়ন এখানে রয়েছে, যা থেকে ইট খুলে নিয়ে গিয়ে ফয়েজাবাদ শহরের সকল পাড়ার বাড়িঘর নির্মিত হয়েছে।’ তিনি বেশকিছু ব্রাহ্মণ্য মন্দিরের কথা নির্দেশ করেন। তবে উল্লেখ করেন যে, এগুলোর সবই আধুনিক নির্মাণ এবং সম্ভবত মুসলিমদের দ্বারা ধ্বংসকৃত পুরনো মন্দিরগুলোর ওপরেই এগুলো তৈরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, যদিও তিনি কয়েকটি মন্দিরের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেছিলেন, তবে বাবরি মসজিদের সাথে এটির কোনো যোগসূত্রতা ছিল না; বাবরি মসজিদের কোনো উল্লেখ তিনি আদৌ করেননি। অন্যভাবে বললে, তিনি রামের সাথে সংযুক্ত বেশকিছু ঐতিহ্য নথিবদ্ধ করার সময়েও বাবরি মসজিদ ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের ওপর নির্মিত এমনটি কোথাও উল্লেখ করেননি। (তথ্যসূত্র: Four Reports Made During the Years 1862-63-64-65, Vol-I, Archaeological Survey of India, New Delhi).
এই গবেষণাটি সাম্প্রতিক সময়ে করা হয়নি। এখানে বিজেপি বা কংগ্রেস কিংবা অন্য কোনো দলেরও কোনো প্রভাব নেই। এটি করা হয়েছে প্রায় ১৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে। যখন ভারতে ব্রিটিশ শাসন ছিল এবং বাবরি মসজিদ নিয়েও কোনো রাজনৈতিক বিতর্ক তখন ছিল না। তাই ব্রিটিশদের আমলে করা এ গবেষণার ওপর আস্থা রাখা যায়। কিন্তু এরকম আরো অনেক দলিল থাকার পরও উগ্র হিন্দুবাদীরা তাদের উদ্ভট দাবি উত্থাপন করেই যেতে থাকে। আর বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর তাদের সেই আন্দোলন পালে হাওয়া পায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে অপপ্রচার চালানো হয়। বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার করা হয়। এরই জেরে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদ ভেঙে সেখানে রামমন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় প্রদান করে।
সর্বশেষ জায়নবাদ ও উগ্র হিন্দু মৌলবাদের যে মিলের কথা বলা যায়, তা হলো এ দুটি মতবাদের ধারকদের মধ্যেই একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের দেখা পাওয়া যায়। জায়নবাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ইসরাইল নামক যে রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তা মূলত ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড। এ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে একসাথে সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে ১৯৪৮ সালে নিজেদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এরপর ১৯৬৭ এবং ১৯৭৩ সালে তারা আরো কিছু ভূখণ্ড ইসরাইল দখল করে নেয়। এমনকি মিশর ও জর্ডানের অনেকখানি এলাকাও তারা দখল করে নেয়। আর সর্বশেষ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে অধিকৃত পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকা ইসরাইলের অংশ দাবি করে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় মানচিত্রটি উপস্থাপন করেন তিনি। ভাষণ দেওয়ার সময় মধ্যপ্রাচ্যের দুটি মানচিত্র দেখান নেতানিয়াহু। প্রথমটি ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির বছর ১৯৪৮ সালের। আর পরেরটিকে তিনি আখ্যা দেন নব্য মধ্যপ্রাচ্য নামে। সেখানে অধিকৃত পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকাকে ইসরাইলের অংশ দাবি করা হয়। এর পরপরই এ নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানায় ফিলিস্তিন। নেতানিয়াহু জানান, সৌদি আরবের সঙ্গে তার দেশের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে তা মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন আকার দেবে। তবে এ আলোচনায় ফিলিস্তিনকে অন্তর্ভুক্ত করার সৌদি ও মার্কিন আহ্বানকে নাকচ করে দেয় ইসরাইল। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিয়ে নেতানিয়াহু জানান, আঞ্চলিক চুক্তিতে ফিলিস্তিনের অংশগ্রহণ কোনোভাবেই কাম্য নয়।
অন্যদিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর এ খায়েশি মানচিত্র প্রকাশের ৩ মাস আগে ভারতের নতুন পার্লামেন্ট ভবন উদ্বোধনের সময় মোদি প্রশাসন বিতর্কিত একটি কাজ করে। নতুন সংসদ ভবনে একটি ‘অখণ্ড ভারতের’ মানচিত্র রাখা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, আফগানিস্তান, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা সব দেশকেই দেখানো হয়েছে। এ মানচিত্র বিতর্কের ঝড় তুলেছে আশপাশের প্রতিটি দেশেই। ভারতের এ কাজে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নেপালের রাজনৈতিক নেতারা। এদিকে ধর্মের অজুহাত দিয়ে ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বলে অভিযোগ করেছে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মুমতাজ জাহরা বেলুচ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পার্লামেন্ট চত্বরে ‘অখণ্ড ভারত’-এর ছবি এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্যে পাকিস্তান সরকার বেশ অবাক। বেলুচ বলেন, অখণ্ড ভারতের মানচিত্র দিয়ে প্রতিবেশী দেশটির সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারা ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোকে শুধুমাত্র নতজানুই রাখতে চায় না, তারা সংখ্যালঘুদেরও নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।
‘অখণ্ড ভারত’র এ ধারণাটি কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের মূল মতাদর্শগত চিন্তার অন্যতম। উগ্র হিন্দুবাদীরা মনে করে, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা হলো একটিই রাষ্ট্র অর্থাৎ অখণ্ড ভারতের অন্তর্ভুক্ত। ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের দাবি, অখণ্ড ভারত ও হিন্দুরাষ্ট্র একই সূত্রে গাঁথা। ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার লক্ষ্যেই আরএসএসের চিন্তা অনুসারে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র রাখা হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। এ দুই মতাদর্শের এতসব সামঞ্জস্য এবং সখ্য সম্বন্ধে প্রতিটি মানুষ বিশেষ করে মুসলিমদের অনেক বেশি সচেতন হওয়া দরকার। কারণ এ দুটি আগ্রাসী মতবাদের অন্যায্য কার্যকলাপের প্রধানতম ভিকটিমই হয় মুসলিমরা। অন্তত বিগত একশ বছরের ইতিহাস এবং চলমান বাস্তবতা তেমনটাই শিক্ষা দেয়।
লেখক : সাংবাদিক ও অনুবাদক।



অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।