॥ মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ॥
‘কুরবানি’ ফার্সি, উর্দু ও বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ। ‘কুরবানি’ আরবি ‘কুরব বা কুরবান’ শব্দ থেকে নির্গত। কুরব-এর আভিধানিক অর্থ নৈকট্য বা সান্নিধ্য। এজন্য একে কুরবানি বলা হয়। কেননা কুরবানির মাধ্যমে বান্দার প্রভুর নৈকট্য অর্জন করাই উদ্দেশ্য। এই অর্থে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশে বান্দার পালনকৃত যেকোনো ইবাদতকে কুরবানি বলা যায়। কিন্তু ইসলামী শরীয়তে কুরবানি বলা হয়- নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নির্ধারিত পশু জবেহ করা। পবিত্র কুরআনে কুরবানির একাধিক সমার্থক শব্দ ব্যবহার হয়েছে। ১. নহর: নহর অর্থ গলায় ছুরি চালানো। আল্লাহ তায়ালা সূরা কাউসারে কুরবানির অর্থে নহর শব্দ উল্লেখ করেন। এজন্য কুরবানির দিনকে ইয়াওমুন নহর বলা হয়। ২. নুসুক : নুসুক অর্থ কুরবানির পশু। (আল-কামূসুল জাদীদ) কুরবানির সমার্থক অর্থে নুসুক শব্দটি সূরা আন’আমের ১৬২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা হয়। ৩. মানসাক : যার অর্থ ইবাদতের পদ্ধতি ও পন্থা। (আল-কামূসুল জাদীদ) কুরআনে মানসাক শব্দটিও কুরবানির সমার্থক অর্থে ব্যবহার হয়েছে। (সূরা হজ: ৩৪)। হাদিসে কুরবানির সমার্থক শব্দ আজহা বা উজহিয়্যা’ ব্যবহার হয়েছে। এজন্য হাদিসের ভাষায় কুরবানির ঈদকে ইয়াওমুল আজহা বলা হয়।
কুরবানির ইতিহাস এক প্রাচীন ইতিহাস। হযরত আদম আ.-এর যুগ থেকেই কুরবানির বিধান প্রচলিত। প্রথম কুরবানি সংঘটিত হয় তাঁর পুত্রদ্বয় হাবিল ও কাবিলের মাধ্যমে। তখন কুরবানি কবুল হওয়া না হওয়া ছিল স্পষ্ট। যার কুরবানি কবুল হতো আসমান থেকে এক টুকরো অগ্নিশিখা এসে তার পশুকে জ্বালিয়ে দিত। হাবিল ও কাবিল উভয়ে প্রভুর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে কুরবানি পেশ করল। হাবিল ছিল মেষ পালক, তাই সে একটি বকরি কুরবানিস্বরূপ পেশ করে। কাবিল ছিল কৃষক, তাই সে কিছু শস্যদানা পেশ করল। কিন্তু কাবিল ভালো শস্যদানা রেখে খারাপ শস্যদানা কুরবানি হিসেবে পেশ করে। আল্লাহ তায়ালা হাবিলের কুরবানি কবুল করেন, তাই আসমান থেকে অগ্নিশিখা এসে তার পশুটি জ্বালিয়ে দিল। পক্ষান্তরে কাবিলের কুরবানি কবুল হয়নি বিধায় তার শস্যদানা পড়ে থাকল। এটিই ছিল ইতিহাসের সর্বপ্রথম কুরবানি, যার বর্ণনা কুরআনে পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আপনি তাদের আদমের পুত্রদ্বয়ের বাস্তব ঘটনা পাঠ করে শোনান। যখন তারা আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশে কুরবানি নিবেদন করল, তখন তাদের একজনের (হাবিলের) কুরবানি কবুল করা হলো আর অপরজনের কবুল করা হলো না। সে (কাবিল) বলল, আমি তোমাকে হত্যা করব। সে (হাবিল) বলল, আল্লাহ আত্মসংযমীদের কুরবানি কবুল করেন। (সূরা মায়েদা : ২৭)।
বিভিন্ন যুগে কুরবানির ইতিহাস : আদম আ.-এর যুগ থেকে শুরু করে মুহাম্মদ সা.-এর যুগ পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর যুগেই কুরবানির বিধান ছিল। যদিও পদ্ধতিগত ভিন্নতা ছিল, কিন্তু সবারই উদ্দেশ্য ছিল প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জন করা। পবিত্র কুরআনে তার বর্ণনা পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানি নির্ধারণ করেছি। আল্লাহ তাদের যে চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, তা জবেহ করার সময় যেন আল্লাহর নাম স্মরণ করে। তোমাদের আল্লাহ এক আল্লাহ। সুতরাং তোমরা তাঁর অনুগত থাক। আপনি নমনীয়দের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। (সূরা হজ : ৩৪)। বর্তমান কুরবানির ইতিহাস হযরত ইবরাহীম আ.-এর যুগ থেকে। ইবরাহীম আ. ছিলেন নিঃসন্তান। সন্তানের জন্য ছিল তাঁর দীর্ঘ প্রতিক্ষা। জীবনের নব্বই বছর কেটে গেল সন্তানের আশায়। তিনি সবসময় সন্তানের জন্য দোয়া করতেন। হে প্রভু! আপনি আমাকে একটি নেক ও সৎ সন্তান দান করেন। (সূরা সফফাত: ১০০)।
প্রভু ইবরাহীম আ.-এর দোয়া কবুল করলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, সুতরাং আমি তাকে একটি সৎকর্মশীল পুত্রসন্তানের সুসংবাদ দান করলাম। (সূরা সফফাত : ১০১) অতঃপর পুত্র ইসমাইল যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার এবং পিতার কাজে সহযোগিতা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইবরাহীম আ. এক পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। তিনি স্বপ্ন দেখলেন প্রিয় সন্তান ইসমাইলকে জবেহ করছেন। নবীগণের স্বপ্ন যেহেতু ওহি, তাই তিনি বিলম্ব না করে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। পুত্রকে ডেকে স্বপ্নের বিবরণ শোনালেন। হে বৎস! আমি স্বপ্নে তোমাকে জবেহ করতে দেখেছি, এখন তোমার মতামত কী? পুত্র উত্তর দিল, হে প্রিয় বাবা! আপনি যা নির্দেশিত হয়েছেন, তা পালন করুন, ইনশাআল্লাহ! আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। পুত্র ইসমাইল যদিও শিশুসন্তান, কিন্তু তিনিতো ভবিষ্যতে নবুয়্যত লাভ করবেন, তাই বাবাকে নবীসুলভ উত্তর দিলেন। আল্লাহ তাদের পিতা-পুত্রের কথোপকথন কুরআনে বর্ণনা করেন।” যখন সে তাঁর পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো। তখন ইবরাহীম (তাঁর পুত্রকে) বলল, হে বৎস! আমি স্বপ্নে তোমাকে জবেহ করতে দেখেছি। এখন তোমার মতামত কী? সে উত্তর দিল, হে প্রিয় বাবা! আপনি যা নির্দেশিত হয়েছেন, তা পালন করুন। আপনি অবশ্যই আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। (সূরা সফফাত : ১০২)।
পিতা-পুত্র প্রভুর নির্দেশিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত। রওনা হলেন মিনাপ্রান্তরে। পুত্র ইসমাইলকে প্রভুর নির্দেশে কুরবানি করা হবে। পথিমধ্যে শয়তান তিন তিনবার ইবরাহীম আ.-কে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে। ইবরাহীম আ. প্রত্যেকবার পাথর নিক্ষেপ করে তার ধোঁকার জাল নস্যাৎ করে দেন। আর সেই তিন স্থানেই বর্তমানে হাজীগণ পাথর নিক্ষেপ করে থাকেন তাঁর স্মরণে, যা ইবরাহীম আ.-এর দৃঢ়তার নিদর্শন। অবশেষে ইবরাহীম আ. পুত্র ইসমাইলকে নিয়ে মিনায় পৌঁছে গেলেন। পুত্র ইসমাইল পিতাকে বললেন, বাবা! আপনি আমাকে ভালোভাবে বেঁধে নেন; যেন আপনার কোনো কষ্ট না হয় এবং আপনার জামা গুটিয়ে নেন; যেন রক্তের ছিটা না পড়ে। বাবা! আমার পক্ষ থেকে মাকে সালাম পৌঁছে দিয়েন। এবার ইবরাহীম আ. পুত্রকে শুইয়ে ছুরি চালাতে লাগলেন, ঠিক সে মুহূর্তে আসমান থেকে প্রভুর আওয়াজ শুনতে পেলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন তারা আনুগত্য প্রকাশ করল এবং সে পুত্রকে শোয়াল, আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছ। আর আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি।’ (সূরা সফফাত : ১০৩-১০৫)।
ইবরাহীম আ. আসমানী ডাক শুনতে পেয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখেন জিবরাঈল আ. একটি উন্নত দুম্বা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, যা আল্লাহ তায়ালা জান্নাত থেকে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি তার জন্য একটি মূল্যমান দুম্বা পাঠিয়েছি। (সূরা সফফাত: ১০০)। অতঃপর ইবরাহীম আ. পুত্র ইসমাইলের পরিবর্তে ঐ দুম্বাটি কুরবানি করেন। আল্লাহ তায়ালার নিকট ইবরাহীম আ.-এর কুরবানি ছিল অধিক প্রিয়, তাই কিয়ামত পর্যন্ত আগত লোকদের জন্য আল্লাহ তায়ালা কুরবানির বিধান দান করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি তাকে পরবর্তী লোকদের মাঝে স্মরণীয় করে রেখেছি। ইবরাহীমের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আর আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। (সূরা সফফাত : ১০৮- ১১০)।
কুরবানির তাৎপর্য : জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখের বিশেষ আমল পশু কুরবানি করা, যা ইবরাহীম আ.-এর সুন্নত। যার নিকট নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা বা এর সমপরিমাণ অর্থ থাকবে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব। কুরবানি যদিও ফরজ বিধান নয়, তা সত্ত্বেও ইসলামী শরীয়তে কুরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। রাসূল সা. জীবদ্দশায় কখনো কুরবানি ত্যাগ করেননি। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানি করার জন্য আলী রা.-কে অসিয়ত করেন। তাবিঈ হানাশ (রা.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আলী (রা.)-কে দুটি দুম্বা কুরবানি করতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী (দুটি কেন)? তিনি বললেন, রাসূল সা. আমাকে অসিয়ত করেছেন, আমি যেন তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানি করি। তাই তাঁর পক্ষ থেকেও কুরবানি করেছি। (আবু দাউদ: ২৭৯০)। যাদের কুরবানি করার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করবে না তাদের ব্যাপারে রাসূল সা. অনেক কঠিন সতর্কবাণী করেন। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেন, যার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটও না আসে। (ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা: ২২৬)।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- আরাফাতের দিনের গুরুত্ব ও ফজিলত
- জায়নবাদ এবং তার সখা
- নতজানু
- বখতে নসরের চোখ
- আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন-এর দুটি কবিতা
- চাঁদের জোসনা
- আলম শামস-এর একগুচ্ছ
- বিদ্রোহী কবি সম্রাট
- সাফা মারওয়া
- ঈদের নামায
- কুরবানি ঈদের পূর্বপ্রস্তুতি
- আনুগত্য ও ত্যাগের মহিমায় হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তার পরিবার
- কুরবানি ঈদের রান্না
- সংসার
- হজ মহাসম্মেলন
- বিদায় হজের ভাষণ
- নূহা রাহির মিশুবিষয়ক সুসমাচার
- ঈদ ভাবনায় আঁকা জীবন
- কুরবানির শিক্ষা