॥ আবদুল হালীম খাঁ ॥
ঈদের বার্তা শুনলেই আমি সাঁতার না জানা বালকের মতো অথৈ পানিতে ডুবে হাবুডুবু খেতে থাকি। চিন্তায় আমার চেহারা মলিন হয়ে যায়। গলা শুকিয়ে যায়। ভাত-পানি খেতে বার বার গলায় ঠেকে যায়। মনে মনে বলি, হে আল্লাহ! আমাকে বিপদ থেকে হেফাজত করো। পরিবারের বউ-ছেলেমেয়েরা কেউ যেন আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা না করে। সবার মনে শান্তি বহাল রাখ।
চারদিকে ঈদের রব উঠেছে। কে কীভাবে ঈদ উদযাপন করবে, সেই পরিকল্পনা করছে। কেউ কেউ ঈদের মার্কেটিং শুরু করেছে। আমি যেন ঘূর্ণিঝড়ের দশ নম্বর বিপৎসংকেত শুনছি। আমার নড়বড়ে ঘর। জোড়াতালির বেড়া। দুর্বল খুঁটি। আল্লাহ আল্লাহ...।
আমার পরিবার বড় নয়। দুই ছেলে আবির আর জাবির। ছোট মেয়ে খুশি। স্ত্রী লাইলী আর আমি। লাইলীকে খুশি রাখার জন্য চেষ্টা করছি সেই বিয়ের পর থেকে। বিশেষ করে ঈদের কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া সব লাইলীর ইচ্ছেমতো করেছি। লাইলী যদি আটশ’ টাকার শাড়ি চেয়েছে, আমি এক হাজার টাকার শাড়ি কিনে দিয়েছি। পাড়ার মহিলারা যে দামে যত সুন্দর জুতা কিনেছে, আমি লাইলীকে তার চেয়ে সুন্দর ও দামি জুতা কিনে দিয়েছি। লাইলী বলেছে, তুমি আমাকে এত ভালোবাসো কেন? প্রতিবেশী মহিলারা আমাকে হিংসা করে বলে, আহ! কত আদরের বউ গো। স্বামীকে বশ করে আঁচলে বেঁধে ফেলেছে...।
লাইলীর মুখে পাড়ার মহিলাদের কথা শুনে আমি দারুণ খুশি হয়েছি। আমি বলেছি, ওরা আরো বলুক। তোমাকে যে আমি কত ভালোবাসি, তা আরো প্রচার হোক।...
সেই লাইলীকে গত দুই বছর যাবত আমি খুশি করতে পারছি না। ঈদের সময় স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা কী পেলে খুশি হবে, তা কি আমি বুঝি না! অথচ দুই বছর যাবত ঈদের বার্তা শুনলেই লাইলী আর ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে দূরে পালিয়ে থাকার চেষ্টা করছি। আমার জীবনে এ যে কত বড় ট্র্যাজেডি, তা কেউ জানে না।
সমাজের সবাই চলছে পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, তালে তালে। আমি পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছি না। আমার শুকনো মুখ দেখে সেদিন লাইলী জিজ্ঞেস করল, বার বার তোমার গলায় ভাত-পানি ঠেকে যায় কেন?
হঠাৎ এমন হচ্ছে।
কী চিন্তা করছো?
কিছু না।
নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে তোমার!
না, ভালোই আছি।
না, ভালো নেই তুমি।
আমি কষ্ট করে একটু হেসে বললাম, এই যে খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, অফিসে যাচ্ছি...।
কতদিন যাবত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলছ না, মনে হয় তুমি আমাদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছ।
না, না।
অফিসে কোনো সমস্যা হয়েছে?
তেমন কিছু না।
নিশ্চয় তেমন কিছু।
কিছু ঝামেলা হয়েছে।
কী ঝামেলা?
তুমি শুনে কী করবে?
তোমার সমস্যার কথা আমি জানতে পারব না!
আমার সহকর্মীরা সবাই অন্যরকম।
কেমন?
তারা সবাই দুই নম্বরি কাজ করে।
তাতে তোমার কী?
তারা বলে, ভাইজান, আপনি ঠকছেন, আমাদের ঠকাতে চাচ্ছেন। আমি তাদের সঙ্গে দুুই নম্বরি কাজ করি না কেন? ঈদ আসছে। জিনিপত্রের দাম প্রতিদিন হুহু করে বাড়ছে। আমাদের বেতন তো প্রতিদিন বাড়ছে না। বউ-পোলাপানের জন্য কেনাকাটা তো বেতনের টাকায় কুলাচ্ছে না। তাই একটু...।
তুমি কী বলেছ?
আমি বলেছি, ভাই, আমি না খেয়ে মরব, তবু দুই নম্বরি কাজ করতে পারব না। এ অবস্থায় আমি তাদের কাছে খুব চাপে পড়ে আছি।
আমার স্ত্রী কোনো অন্যায় পছন্দ করে না। আমাকে সবসময় সততা অবলম্বন করতে পরামর্শ দেয়। কিন্তু ওর টেনে টেনে চলার অভ্যাস নেই। লাইলী ধনীর মেয়ে। ওর নজর অনেক ওপরে। ছেলেমেয়েদের সেভাবে গড়ে তুলছে। লাইলীর এ স্বভাব আমি খুব পছন্দ করি। এজন্য আমি ওকে আরো বেশি ভালোবাসি। কিন্তু ওযে আমার রোজগারের সীমাবদ্ধতার কথা বোঝে না।
গতবার থেকে লাইলীকে অনেক বুঝিয়ে আমার সমমনা করে পরিবারের খাই-খরচটা কিছু কমানোর জন্য পরিকল্পনা নিয়েছি। আমার পরিকল্পনা এ পর্যন্ত বাইরের কাউকে বলিনি। লাইলীকে বলতে নিষেধ করেছি। বিষয়টা একান্ত আমাদের নিজস্ব। পরিবারের অক্ষম কর্তার পরিকল্পনা।
লাইলীকে খুব বিনীতভাবে বলেছিলাম, দেখ, জিনিসপত্রের দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার কারণে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। বড় ছেলেটা এবার কলেজে গেল। ছোট তিনটা স্কুলে। মাসে যে বেতন পাই, তা দিয়ে পনেরো দিন চলতে পারি না। ধারকর্জ করে চেপে চেপে চলছি। এভাবে তো আর চলা যাচ্ছে না। এখন আমাকে একটা পরামর্শ দাও। লাইলী বলেছিল, আমি কী পরামর্শ দেব? তুমিই পরামর্শ দাও।
আমার কথা মানবে তুমি?
মানব না কেন?
আমাদের খাওয়া খরচ কমাতে হবে।
কীভাবে কমাবে, বল।
আমাদের খাদ্য আইটেমের একটা রুটিন করতে হবে।
কেমন রুটিন করতে হবে?
প্রতি সপ্তাহে দুদিন জাই খেতে হবে। তাতে তরকারি, মরিচ, মসলা, তেল, পেঁয়াজ লাগবে না। আর দুই দিন খেতে হবে খিচুরী। এতেও তরকারি লাগবে না। আর দুই দিন খেতে হবে বউ ক্ষুদা ভাজি। এতেও তরকারি লাগবে না। লাগবে শুধু কয়টা পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ। তরকারির প্রয়োজন হবে না। বউ ক্ষুদা মানে ক্ষুদ ভাজি তুমি কী কভু খেয়েছো? আমার মা আগে ক্ষুদ ভাজতেন। কী যে মজা লাগতো। আর একদিন দুপুরে মিষ্টি আলু খেতে হবে। আলুতে মরিচ, লবণ, মসলা কিছু লাগে না। শুধু পানি দিয়ে সিদ্ধ করলে খাওয়া যায়। এতে আমাদের খাদ্যে বৈচিত্র্য আসবে। বাচ্চারা মজা করে খাবে। অবশ্য সপ্তাহে দুবেলা মাছ আর গোশতের ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে বাচ্চাদের মেজাজ বিগড়ে যাবে। মাছ ও গোশত রান্নার সময় পানি বেশি করে দিয়ে জোস (ঝোল) বেশি বানাতে হবে। তখন জোসই তরকারির কাজ করবে। আর একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে- ডাল রান্না করার সময় ডালের পরিমাণ কম দিয়ে পানি বেশি দিতে হবে। মসুর ডাল একবার রান্না করে কিন্তু দু-তিনবার খাওয়া যায়। এতে লাকড়ি খরচ কম হবে। আর একটি কাজ করতে হবে গরমের মৌসুমে একবেলা পান্তা আর শীত মৌসুমে একবেলা কড়কড়া খেতে হবে। কড়কড়া খেতে লাগবে দু-তিনটা শুকনো মরিচ পুড়ে, দুটি পেঁয়াজ, একগলা রসুন কেটে লবণ মিশিয়ে মেখে ভর্তা করে ভাতের সাথে মাখতে হয়। এর সাথে যদি কিছু তেঁতুল মিশিয়ে দিতে পারো, তবে দারুণ মজা হবে। একদিন যদি খাও তবে প্রতিদিন ইচ্ছে করবে।
আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগে বলতে ভুলে গেছি। তা হলো আলুর দাম খুব চড়া হলেও চালের দামের চেয়ে কম। এজন্য তোমার করতে হবে কী- আমাদের পাঁচজনের একবেলা যে পরিমাণ চাল লাগে তার অর্ধেক আলু কেটে টুকরো টুকরো করে দিয়ে ভাত রান্না করবে। ভারী মজা হবে। নেদারল্যান্ডসের অধিবাসীরা সারা বছর শুধু আলু খায়, তা তুমি জানো। তাদের স্বাস্থ্য আমাদের চেয়ে অনেক ভালো। এতে আমাদের খরচ আরো কম হবে।
আমি যেসব খাদ্যের কথা বলছি, এগুলো প্রয়োগ করার দায়িত্ব কিন্তু তোমার। তুমি এ খাদ্যের গুণাগুণ ছেলেমেয়েদের কাছে খুব হাসি-খুশিমুখে ব্যাখ্যা করবে। মনে করো আমরা পাঁচজন একত্রে খেতে বসেছি। শুধু ডাল দিয়ে ভাত খাচ্ছি। আমি বলব, আজ ডাল তো খুব মজা হয়েছে রে। এমন মজার ডাল হলে তো আর অন্য আইটেমের প্রয়োজন পড়ে না। ডাক্তাররা বলেন, বেশি বেশি ডাল খাবেন আর বাচ্চাদের খাওয়াবেন। তাতে তাদের হাড় শক্ত ও মজবুত হবে। তারা আরো বলেন, এক ওয়াক্তে এক তরকারি খাবেন, একাধিক তরকারি খাবেন না। তাতে পেট ভালো থাকবে, পেটে অসুখ হবে না। এ নিয়ম কিন্তু আমাদের প্রিয়নবী সা.-এর সুন্নত।
আরেকটি বিষয় হলো তেল। তেল বেশি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তেল পেটে হজম হয় না। তরকারি ও ভর্তায় প্রথম অল্প ব্যবহার করবেন। তারপর আস্তে আস্তে খাওয়া ছেড়ে দেবেন। ডাক্তাররা আরো বলেন, বেশি বেশি কচু খাবেন। কচুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি, ডি রয়েছে। এতে চোখের দৃষ্টিশক্তি ও পেশিশক্তি বৃদ্ধি করে। কচু কিনতে হয় না। পথে-ঘাটে, মাঠে ও বাড়ির আশপাশে প্রচুর পাওয়া যায়। কচু ভর্তা, ভাজি ও রান্না করে খাওয়া যায়। অথচ টাকা লাগে না।
শোন লাইলী, আমরা এভাবে খাওয়া শুরু করলে প্রতিদিন বাজারে যেতে হবে না। বাজারের মাছে ফরমালিন, তেল, মরিচ, হলুদ, জিরা মসলায় ভেজাল। কসাইরা মরা গরু জবাই করে বাজারে বিক্রি করে। এসব তো পত্রিকায় মাঝে মাঝেই দেখছি। এমন আর কত সমস্যা। কোথায় যাবো লাইলী বলো তো!
এতক্ষণ লাইলী আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। শুনে শুনে আমার মুখের দিকে চোখ তুলে বলল, এত বুদ্ধি তুমি কোথায় পেলে শুনি?
অভাব আমাকে বুদ্ধি দিয়েছে।
লাইলী ধনী বাপের মেয়ে হলেও আমার মতো অক্ষম-অসহায় সাথীটির করুণ অবস্থা বোঝার মতো হৃদয় আছে। জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করতে রাজি হয়ে গেল। এ পরিকল্পনা অনুসারে আমরা চলছি। লাইলীর বুদ্ধিমত্তার কারণে এ পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা বিদ্রোহ করেনি।
এরপর লাইলী বলল, ঈদের ব্যাপারে কী করতে চাও? সামনে আছে আর মাত্র তিন দিন। এবার আমি বিপদে পড়ে গেলাম। কী বলি! লাইলীই আমাকে উদ্ধার করার জন্য বলল, সামনে বাচ্চাদের পরীক্ষা। তারপর আবার ভর্তি। বইপত্র কিনতে হবে। তোমার বেতনের টাকায় ঈদ করলে তো ওদের পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর এক মাস আবার চলব কেমনে? এ কথা বলেই থেমে কতক্ষণ চুপ করে রইল। আমি মহাবিপদ গুনতে লাগলাম। আমার মুখ ম্লান হয়ে গেল। এ সময়ে লাইলী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, এবার অন্যভাবে ঈদ করতে চাই। আমি খুব কাতরকণ্ঠে বললাম, কীভাবে করতে চাও?
মাকে ফোন করে বলেছি, মা দুই বছর যাবত তোমার সঙ্গে ঈদ করি না। এবার তোমার সঙ্গে ঈদ করব। বাচ্চারা তোমাকে দেখতে চাচ্ছে। ঈদের পরই পরীক্ষা। ঈদের পরে তো ওরা যেতে পারবে না।
মা বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ বাচ্চাদের নিয়ে আয়। কতদিন যাবত ওদের দেখি না। আমি বলেছি, ঈদ তো বুধবার দিন। আমি ওদের নিয়ে সোমবার দিন আসছি। হাসুকে দুপুরে বাসস্ট্যান্ডে থাকতে বলো। মা বলল, আবিরের বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এসো।
আমি বলেছি, বাসায় একটু কাজ আছে। কাজটা সেরে সে মঙ্গলবার দিন বিকালে আসবে।
আচ্ছা, মা এসো। খুব ভালো হবে।
আমি ঈদ নিয়েই চিন্তা করছিলাম। ঈদের চিন্তাটা আমার বুকের ওপর যেন হিমালয় পর্বতের মতো চেপে পড়েছিল। আর লাইলী আমার বুকের ওপর থেকে সেই হিমালয় পর্বতটা যেন এক ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল। লাইলীকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব!
লাইলী তো শুধু আমার স্ত্রী নয়। লাইলী আমার অভিভাবক। আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি। লাইলী অন্ধকার রাতে আমার পূর্ণিমার চাঁদ। আমার কষ্ট ব্যথার মলম। আমার জীবনদায়িনী সুধা।
লাইলীর মতো এত বুদ্ধিমতি ও ভালো বউ না থাকলে এতদিনে আমার মাথায় চুল একটাও থাকতো না।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- কুরবানির ইতিহাস ও তাৎপর্য
- আরাফাতের দিনের গুরুত্ব ও ফজিলত
- জায়নবাদ এবং তার সখা
- নতজানু
- বখতে নসরের চোখ
- আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন-এর দুটি কবিতা
- চাঁদের জোসনা
- আলম শামস-এর একগুচ্ছ
- বিদ্রোহী কবি সম্রাট
- সাফা মারওয়া
- ঈদের নামায
- কুরবানি ঈদের পূর্বপ্রস্তুতি
- আনুগত্য ও ত্যাগের মহিমায় হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তার পরিবার
- কুরবানি ঈদের রান্না
- সংসার
- হজ মহাসম্মেলন
- বিদায় হজের ভাষণ
- নূহা রাহির মিশুবিষয়ক সুসমাচার
- কুরবানির শিক্ষা