॥ এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী ॥
হযরত ইব্রাহীম (আ.) স্বপ্নে দেখেছিলেন যে- তিনি তার ছেলেকে কুরবানি দিচ্ছেন। এটাকে তিনি আল্লাহর নির্দেশ মনে করেন এবং ছেলেকে কুরবানি করতে নিয়ে যান। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় ছেলের বদলে একটি পশু কুরবানি হয়ে যায়। এ ঘটনা আল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, “অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে চলাফেরা করার মতো বয়সে উপনীত হয়, তখন ইব্রাহীম বলল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি কুরবানি করছি, এখন তোমার অভিমত কী? সে বলেছিল, হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তার পুত্রকে কাত করে শায়িত করল, তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, ‘হে ইব্রাহীম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছো।’ এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। অতঃপর আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কুরবানির বদলে।” (সূরা সাফফাত : ১০২-১০৭)
এভাবে ঈদুল আজহার দিনটি আল্লাহর প্রিয় বান্দা ইব্রাহীম (আ.)-এর পরিবারের তাকওয়া ও আনুগত্যের এক উজ্জ্বল স্মারক হয়ে আছে মানব ইতিহাসে। ঈমানের পথযাত্রায় স্বামীর সাথে স্ত্রী-সন্তান সকলেই হয়েছিলেন সেদিন শ্রেষ্ঠ সহযাত্রী। আজ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে ভোগবাদিতার গ্যাড়াকলে পড়ে পরিবারিক ব্যবস্থায় যে ভাঙনের সুর, তা থেকে মুসলিম সমাজগুলোও দূরে থাকতে পারছে না, সেখানে ইব্রাহীম (আ.)-এর পরিবার মহান রবের তরে ত্যাগ ও আনুগত্যের সর্বোচ্চ নাজরানা পেশ করে অনাগত মানুষের জন্য চির আদর্শনীয় হয়ে আছেন।
সর্বোচ্চ ত্যাগের নাজরানা পেশের আনন্দ পবিত্র ঈদুল আজহা
আমরা জানি, ঈদ শব্দের অর্থ খুশি বা আনন্দ। আর আজহা শব্দের অর্থ হচ্ছে ত্যাগ বা কুরবানি। সুতরাং ঈদুল আজহা হলো ত্যাগ বা কুরবানির আনন্দ। যাকে এককথায় বলা যায়, ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। যেমন- পিতা-মাতা নিজেদের বঞ্চিত রেখে সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ ইফোর্ট দিয়ে যে আনন্দ পায়, আবার কিছু মানুষ অপরের জন্য সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে বা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেও অনাবিল আনন্দ লাভ করে। সত্যিকার অর্থে সে আনন্দ তুলনাহীন।
ঈদুল আজহা প্রকৃত পক্ষে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পরিবারের ত্যাগ-কুরবানির মহান স্মৃতির স্মারক:
পবিত্র কুরআনে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে ‘মিল্লাতে আবি কুম ইব্রাহীম’ তথা মুসলিম জাতির পিতা বলা হয়েছে। তেমনি নিজ পরিবারের জন্যও ছিলেন একজন আদর্শ পিতা। যার পরিপ্রেক্ষিতে তার সুযোগ্য সন্তান শিশু ইসমাঈল (আ.)ও নিজেকে আল্লাহর আদেশের কাছে আনুগত্যের শির নত করে দিয়েছিলেন। প্রমাণ করেছিলেন, শির চির উন্নত, এ শির শুধু স্রষ্টার কাছেই নত হয়, একমাত্র তার আনুগত্যেই উৎসর্গ করা যায়। সেই সাথে একজন মহীয়সী নারী- যার সকল মমতার পরশ হার মেনেছিল মহান রবের আদেশ ও আনুগত্যের কাছে। একজন নারী, যিনি গড়েছিলেন এক মর্যাদাজনক পরিবারের ভিত্তি।
হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পরিবারের এ ঐতিহাসিক নিদর্শনকেই কিয়ামত পর্যন্ত ধরে রাখার জন্য মুসলিম উম্মাহর প্রতি কুরবানি ওয়াজিব করা হয়েছে।
পরিবারকে নির্বাসনে পাঠানো ছিল মহান স্রষ্টার নির্দেশ
বাহ্যিক দৃষ্টিতে হযরত ইব্রাহীম (আ.) তার প্রিয়তম স্ত্রী হাজেরা (আ.) ও শিশুসন্তান ইসমাঈল (আ.)কে নির্বাসন দিয়েছিলেন মহান স্রষ্টার হুকুমে। বাহ্যিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কাজটি তখন অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অমানবিক মনে হতে পারতো। কিন্তু এর পেছনে ছিল মহান রবের এক বিশেষ পরিকল্পনা। পবিত্র মক্কাকে কেন্দ্র করে মানবজাতির জন্য এক মহামিলন কেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপন ও একটি সভ্যতার পুনর্জ্জীবন।
অদম্য সাহসিনী নারী মা হাজেরাও মহান রবের আদেশ নির্দ্বিধায় ও নিঃসংকোচে মেনে নিয়েছিল এক আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও ভরসা রেখে মহান স্রষ্টার নির্দেশে আনুগত্যের শির নত করে দিয়েছিলেন।
যখন তিনি শুনলেন, আল্লাহর ইচ্ছাতেই তিনি নির্বাসিত হতে যাচ্ছেন, তখন তিনি দ্বিধাহীনচিত্তে মেনে নিলেন সে সিদ্ধান্তকে। কেননা যে আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহীম (আ.) নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ও বিচ্ছেদের গভীর কষ্ট বুকে নিয়ে স্ত্রীকে নির্বাসন দিচ্ছেন, সে আল্লাহকে হযরত হাজেরাও গভীরভাবে বিশ্বাস করেন। তাই তিনি প্রশান্ত ও দ্বিধাহীনচিত্তে জনমানবহীন মক্কায় এ নির্বাসন মেনে নিলেন।
নিজ ও সন্তানের নিরাপত্তার চিন্তার চেয়েও মহান রবের নির্দেশ মেনে নেয়া ও স্বামীর ব্যথিত চিত্তকে শান্ত করার আগ্রহই ছিল তার কাছে প্রবল। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আল্লাহর ইচ্ছায় যখন নির্বাসিত হয়েছেন, তখন আল্লাহই তাকে রক্ষা করবেন।
শিশু ইসমাঈলকে প্রতিপালনে মা হাজেরার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা
জনমানবশূন্য পাহাড় বেষ্টিত ধু-ধু মরুভূমিতে নির্বাসিত অবস্থায় সম্পূর্ণ একা সন্তান প্রতিপালন করা কতটা কঠিন ও দুরূহ কাজ, তা সহজেই অনুমেয়।
ইব্রাহীম (আ.)-এর রেখে যাওয়া এক মশক পানি ও এক থলে খেজুর শেষ হয়ে যাবার পর পানির পিপাসায় ক্রন্দনরত শিশু ইসমাঈলের জন্য পানির খোঁজে মা হাজেরার সাফা-মারওয়া পর্বতে পেরেশানি নিয়ে ছোটাছুটির পর মহান রবের কুদরতি ইশারায় পানির অভাবে ক্রন্দনরত শিশু ইসমাঈলের পায়ের গোড়ালির আঘাতে সৃষ্টি হয় এক পানির ফোয়ারা, যে কূপের নাম এখন আবে জমজম। এ কূপকে কেন্দ্র করে শুরু হলো মা হাজেরার সন্তান প্রতিপালনের প্রাত্যহিক জীবনধারা। তপ্ত বালুকাময় ধু-ধু মরুভূমিতে তৃণলতাহীন পাহাড়ে নিঃসঙ্গতার মাঝে খাদ্য সংগ্রহ করা আর কোনো খাদ্য না পেলে শুধু জমজমের পানি পান করে থাকা কত যে কষ্টকর বিষয় ছিল, তা কল্পনাতীত। এমন একটি প্রতিকূল পরিবেশে মা হাজেরা শিশু ইসমাঈলকে পাহাড়ের ফলমূল খাইয়ে লালন-পালন করেছেন। আল্লাহর আদেশের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্যের ফলে মহান রবের ইচ্ছায় ফেরেশতারা জানিয়ে দিলেন, এখানেই রয়েছে খানায়ে কাবা, যা পিতা-পুত্র মিলে আবার তা মেরামত করবেন।
এ নির্বাসনের নিভৃতে লুকায়িত ছিল মহান আল্লাহর বিশেষ লক্ষ্য
মহান রবের বিশেষ পরিকল্পনায় এ নির্বাসন হওয়ায় তিনিই হযরত হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাঈলকে শুধুমাত্র হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের আক্রমণ থেকেই শুধু যে রক্ষা করেননি, বরং তিনি নির্জন পাহাড়ে সৃষ্টি করেছিলেন পবিত্র জমজমের প্রস্রবণ- যার পানিধারা শুধু শিশু ইসমাঈল (আ.) আর হযরত হাজেরার প্রয়োজনই মেটায়নি, বরং এ কূপকে ঘিরে একটি সভ্যতার জন্ম হয়েছিল। আজও এ জমজম বিশ্ব মুসলিমকে পরিতৃপ্ত করছে। মা হাজেরা যদি সেদিন নির্বাসিত না হতেন, তাহলে হয়তো তখন মক্কায় কোনো মানুষের আবাদ হতো না আর আব্দুল্লাহর কুটিরেও জন্ম নিতেন না বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানব, মানবতার বন্ধু, বিশ্বমানবতার মহান শিক্ষক রাসূল (সা.)।
মহান রবের পক্ষ থেকে স্বপ্নে পেলেন যে নির্দেশ: শিশুপুত্র ইসমাঈল তখন কৈশোরেও পদার্পণ করেননি। আবারো তাকে ও তার পরিবারকে করা হলো চরম পরীক্ষার মুখোমুখি। স্বপ্নের মাধ্যমে হযরত ইব্রাহীম (আ.) মহান রবের পক্ষ থেকে নির্দেশ পেলেন সন্তানকে কুরবানি করার।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও মা হাজেরার পরম আদরের ধন ইসমাঈল। শেষ বয়সে এসে ইব্রাহীম (আ.) ও মা হাজেরা যে পুত্রসুখ লাভ করেছিলেন এবং যার মাধ্যমে ইবরাহীম (আ.) পৃথিবীতে পরবর্তী বংশধারা চলমান থাকার চিন্তা করেছিলেন, সে আশাটিও যেন সাময়িক তিরোহিত হয়ে গেল।
স্ত্রী ও মা হিসেবে হযরত হাজেরার ভূমিকা
দীর্ঘ নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে মা হাজেরা কষ্টের পর কষ্টের সাগর পেরিয়ে যে সন্তানকে প্রতিপালন করেছেন পূর্বের মতো এখানেও তিনি হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর ইচ্ছার কোনো প্রতিবাদ করলেন না। বললেন না যে, এ পুত্রকে তো তুমি পূর্বেই নির্বাসন দিয়েছিলে। কত কষ্টে আমি একে সহায়হীন অবস্থায় প্রতিপালন করেছি। তার ওপর তোমার কীসের অধিকার? কোন অধিকারে আমার পুত্রের গলায় তোমার প্রভুকে সন্তুষ্ট করার জন্য ছুরি চালাতে যাচ্ছ? তা তো তিনি বললেনই না, বরং স্বেচ্ছায় পুত্রকে সাজিয়ে দিলেন। এ কুরবানি পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর জন্য যতটা কষ্টকর ছিল, মা হাজেরার জন্য ছিল তার থেকে লাখোগুণ বেশি বেদনাদায়ক।
এত বিরাট আত্মত্যাগের শক্তি তাদের কাছে এটাই ছিল যে, এটা আল্লাহর নির্দেশ। কল্পনাতীত আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন সেদিন তিনজন মানব-মানবী।
যোগ্য পিতার যোগ্য উত্তরসূরি পুত্র ইসমাঈল
পুত্র ইসমাঈলকে যখন পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁর প্রতিপালকের নির্দেশের কথা জানালেন, তখন তিনিও দ্বিধাহীনচিত্তে পিতার কর্তব্য পালনে নিজেকে কুরবানি দিতে এগিয়ে গেলেন। তিনি বললেন-
হে পিতা আপনার প্রভুর নির্দেশ পালনে এ ব্যাপারে আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) এবং মা হাজেরার কুরবানি ছিল পুত্রের প্রাণ আর ইসমাঈলের কুরবানি ছিল তার নিজের জীবন। এ কুরবানি কোনো সাময়িক সময়ের জন্য নয়, পুরো জীবনের জন্য। এ কুরবানি যুদ্ধের ময়দানে উত্তেজনার বশে বা কোনো তাৎক্ষণিক আবেগীয় কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না।
ঠাণ্ডামাথায় ছিল এ কুরবানির ইচ্ছা। তাই তো এটা পরিণত হয়েছে মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম কুরবানি হিসেবে।
মহান রবের অশেষ করুণা
হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে চললেন কুরবানি দিতে। আর তিনি যখন চোখ বাঁধা অবস্থায় পুত্রের গলায় ছুরি চালালেন চোখ খুলে দেখতে পেলেন ভিন্ন দৃশ্য। স্বীয়-পুত্রের স্থলে কুরবানি হয়েছে একটি দুম্বা। আর নিজ পুত্র দাঁড়িয়ে আছে তাঁর পাশে। মহান আল্লাহর অসীম করুণা ও রহমত। তিনি বাঁচিয়ে দিলেন শিশু ইসমাঈলকে আর কবুল করলেন হযরত ইব্রাহীম (আ.) পরিরের সর্বোচ্চ কুরবানিকে।
আদর্শভিত্তিক পরিবারের মূল টার্গেট
ইব্রাহীম (আ.)-এর পরিবার মহান আল্লাহর আনুগত্যকে সমুন্নত রেখে অনাগত পরিবারগুলোর জন্যে এক্সাম্পল সেট করে গেছেন।
এই জিলহজ মাস এবং কুরবানি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মুসলিম পরিবারের মূল্যবোধ কেমন হওয়া উচিত। যে পরিবারে পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততির মূলবোধের মধ্যে মিল ও সমন্বয় নেই, সে পরিবার ইসলামী আদর্শচ্যুত পরিবার, ত্যাগ নয় ভোগসর্বস্ব পরিবার।
# মুসলিম পরিবারের মূল্যবোধের ভিত্তি হলো আল কুরআন ও সুন্নাহ। হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পরিবারের প্রতিটি সদস্যের এ ত্যাগের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে যেকোনো আদর্শের তাত্ত্বিক বিষয়টি মুখ্য নয়, বরং বাস্তবে সে আদর্শ প্রতিফলিত করাই হচ্ছে মূল বিষয়।
# তাই মুসলিম পরিবারের জন্য কুরবানি শুধু ভোজ উৎসব নয়, বরং আনুগত্য, ত্যাগ, আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধির উৎসব হতে হবে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “বলো, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ, সবকিছু বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালার জন্য।” (সূরা আন’আম : ১৬২)।
আল্লাহর কাছে পৌঁছে শুধু তাকওয়া
যে অকুণ্ঠ ঈমান আর ত্যাগের মহিমায় উদ্দীপ্ত হয়ে ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ (আ.) সেদিন স্বীয় প্রাণাধিক পুত্রের স্কন্ধে ছুরি উত্তোলিত করেছিলেন, আমরা কুরবানির পশুর গলায় ছুরি দেওয়ার সময়ে ইব্রাহীমের সেই ঈমান ও ত্যাগের সুর যদি হৃদয়তন্ত্রীতে অনুরিত না হয়, দেহ আর মনের মাঝে মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের আকুল আগ্রহ যদি উদ্বেলিত না হয়, তা হলে এ কুরবানির উৎসব শুধুমাত্র ভোজ পর্ব আর পশু কেনার প্রতিযোগিতা পর্বেই পর্যবসিত হবে। কারণ মহান আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সাবধান করে দিয়েছেন, ‘কুরবানির পশুর রক্ত, গোশত কোনো কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে কেবল তোমাদের তাকওয়া বা আল্লাহভীতি।’ (সূরা হজ : ৩৭)।
মূলত আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর বিধানের প্রতি আনুগত্য ও সন্তুষ্টির জন্যই কুরবানি করা।
আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করার জজবা সৃষ্টি করা, হযরত ইব্রাহীমের (আ.)-এর নিজ পুত্র কুরবানির মতো ও আনুগত্যের আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করা, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে জীবনের সকল ক্ষেত্র তাঁর বিধানের প্রতি আনুগত্যে শির নত করে দেয়াই হচ্ছে কুরবানির প্রকৃত তাৎপর্য। ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর হুকুমে পুত্রকে কুরবানি করেছিলেন অর্থাৎ তিনি এর দ্বারা পুত্রের মহব্বতকে কুরবানি করেছিলেন। আল্লাহর ভালোবাসার চাইতে যে পুত্রের ভালোবাসা বড় নয়, এটিই প্রমাণিত হয়েছিল তাঁর আচরণে। আর আল্লাহ এটাই চেয়েছিলেন। এটাই হলো প্রকৃত তাকওয়া বা আল্লাহভীতি।
ঈদুল আজহার মূল আহ্বান হলো মহান আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়, ‘তোরা ভোগের পাত্র ফেলরে ছুড়ে, ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ’। অর্থাৎ সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। সম্পদের মোহ, ভোগ-বিলাসের আকর্ষণ, সন্তানের স্নেহ, স্ত্রীর মহব্বত সবকিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রতি আত্মসমর্পণ করা।
স্বামী, স্ত্রী ও শিশুপুত্রের গভীর আত্মবিশ্বাস, অতলান্তিক ঈমানী প্রেরণা, আল্লাহর প্রতি নিশ্চিন্ত নির্ভরতা ও অবশেষে আল্লাহকে খুশি করার জন্য তাঁর হুকুম বাস্তবায়নে জীবনের সর্বাধিক প্রিয় একমাত্র সন্তানকে নিজ হাতে জবেহ করার মতো কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তরণÑ এসবই ছিল আল্লাহর প্রতি অটুট আনুগত্য এবং আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ নজরানা পেশ করা।
ইব্রাহীম (আ.) তাঁর প্রিয়পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে কুরবানি করে এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেনÑ যাতে অনাগত ভবিষ্যতের অগণিত মানুষ আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণের বাস্তব শিক্ষা লাভ করতে পারে। এজন্যই প্রতি বছর জিলহজ মাসে মুসলিম জাতি পশু কুরবানির মাধ্যমে ইব্রাহীম (আ.)-এর স্মৃতি স্মরণ করে এবং পশু কুরবানির সাথে সাথে নিজেদের পশুবৃত্তিকে কুরবানি দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে।
ইসমাঈল (আ.) নবীন বয়সেই বিশ্ববাসীকে আত্মসমর্পণের এক বাস্তব ও জ্বলন্ত শিক্ষা প্রদান করেছেন। মূলত বিনা শর্তে আল্লাহর রাহে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার নামই হলো আত্মসমর্পণ।
মাতা পিতা-পুত্র আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের যে অনুপম আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, তা যেমন অতুলনীয়, তেমনি চির অনুকরণীয়। আজকে ইব্রাহীমী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পশু কুরবানির সাথে সাথে আমাদের দৃপ্ত শপথ নিতে হবে যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জান, মালসহ যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা সর্বদা প্রস্তুত আছি। আর এটিই হলো কুরবানির শিক্ষা। এ স্বর্ণোজ্জ্বল আদর্শ যুগে যুগে বিশ্ববাসীকে বার বার এ পরম সত্যটিকেই হৃদয়ঙ্গম করাতে চেয়েছে যে, আল্লাহই একমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক, তাঁর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনই প্রকৃত মুমিনের কাজ এবং তাতেই নিহিত রয়েছে মুমিন জীবনের অশেষ কল্যাণ ও প্রকৃত সফলতা। ইব্রাহীম (আ.) সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছিলেন, হয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ ঘোষিত মানবজাতির ইমাম। তিনি মানবজাতির আদর্শ। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যারা আল্লাহ ও পরকালের ভয় কর তাদের জন্য ইব্রাহীম ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা মুমতাহিনা : ৪-৬)।
মুসলিম পরিবারের আদর্শ
মুসলিম পরিবারের প্রতিটি মানুষেরই একমাত্র আদর্শ হবে আল্লাহর হুকুমের কাছে মাথা নত করা অর্থাৎ পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করাই হবে প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য।
মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহীম (আ.) এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন তাঁর সন্তানদের ও পরিবারকে। সুতরাং ইব্রাহীমী ঈমান, মা হাজেরার কুরবানি ও আনুগত্য এবং ইসমাঈলি আত্মত্যাগের উত্থান যদি আবারো আমাদের মাঝে জাগ্রত হয়, তবে আধুনিক জাহেলিয়াতের গাঢ় অমানিশা ভেদ করে পুনরায় মানবতার বিজয় নিশান উড্ডীন হবে। পরিবার সমাজ তথা রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে আসবে। তাই আমাদের কুরবানির পশুর গলায় ছুরি দেওয়ার পূর্বে নিজেদের মধ্যে লুকায়িত পশুত্বের গলায় ছুরি দিতে হবে। মহান আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণকারী ও আত্মত্যাগী হতে হবে। তাকওয়া ও আল্লাহভীতি অর্জনের মাধ্যমে প্রকৃত মুমিন বা মুত্তাকি হওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
মহান রবের কাছে তাঁর শেখানো ভাষায় দোয়া করছি, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে আর আমার পিতা-মাতাকে যে নিয়ামত দান করেছ তজ্জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার শক্তি আমাকে দান কর, আর আমাকে এমন সৎকর্ম করার সামর্থ্য দাও- যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও। আমার সন্তানদের সৎকর্মপরায়ণ করে আমার প্রতি অনুগ্রহ কর, আমি অনুশোচনাভরে তোমার দিকে মুখ ফিরালাম এবং আমি অনুগত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা আহকাফ : ১৫)।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- কুরবানির ইতিহাস ও তাৎপর্য
- আরাফাতের দিনের গুরুত্ব ও ফজিলত
- জায়নবাদ এবং তার সখা
- নতজানু
- বখতে নসরের চোখ
- আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন-এর দুটি কবিতা
- চাঁদের জোসনা
- আলম শামস-এর একগুচ্ছ
- বিদ্রোহী কবি সম্রাট
- সাফা মারওয়া
- ঈদের নামায
- কুরবানি ঈদের পূর্বপ্রস্তুতি
- কুরবানি ঈদের রান্না
- সংসার
- হজ মহাসম্মেলন
- বিদায় হজের ভাষণ
- নূহা রাহির মিশুবিষয়ক সুসমাচার
- ঈদ ভাবনায় আঁকা জীবন
- কুরবানির শিক্ষা