ট্রেন চলবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশ হয়ে আসাম মেঘালয়ে
রেল করিডোর পাচ্ছে ভারত
॥ জামশেদ মেহ্দী॥
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর থেকেই ভারত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কাছ থেকে ট্রানজিটের নামে করিডোর চেয়ে আসছিল। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে তাদের সেই করিডোর দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ভারত একই আবদার জানিয়ে আসছিল। ২০০৯ সালের পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৩৮ বছর পর্যন্ত ভারতকে ঐ করিডোর দেওয়া হয়নি। কিন্তু ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার বিগত ১৫ বছরে ভারতকে স্থল ও নৌপথে করিডোর দিয়েছে। কিন্তু রেলপথে করিডোর দেয়নি। বিষয়টি একটু পরিষ্কার করা দরকার। আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর বাংলাদেশের এক স্থান থেকে রেলপথে ভারতে যাওয়া যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনেও ভারতের এক স্থান থেকে যথা কলকাতা থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রেনে ভারতের অপরাংশে যথা আগরতলা, মেঘালয় ইত্যাদি কোনো স্থানে যাওয়ার করিডোর দেওয়া হয়নি।
কিন্তু এবার অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর অবশেষে চলতি মাসে ভারতকে সেই রেল করিডোর দেওয়া হচ্ছে। ভারত থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের অপরাংশে যে ট্রেন যাতায়াত করবে। সেই ট্রেনে মালামাল পরিবহন ছাড়াও অস্ত্রশস্ত্রও পরিবহন করা হবে বলে ভারত ও বাংলাদেশের একশ্রেণির পত্রপত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগপন্থী স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য বিশিষ্ট শিল্পপতি এ কে আজাদের মালিকানাধীন দৈনিক সমকালের ১৯ জুনের অনলাইন সংস্করণের প্রথম পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে, আগামী ২১ জুন থেকে অর্থাৎ আজ থেকে ভারতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দুই দিনের সফরে যাচ্ছেন, ঐ সফরে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে যে ৩ দিন সরকারি ছুটি ছিল, ঐ তিন দিন বাংলাদেশে কোনো দৈনিক পত্রিকা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়নি। তাই সাধারণ পাঠকদের চোখে এ খবরটি আসেনি। কিন্তু ভারতের প্রায় সব প্রিন্ট মিডিয়ায় এ খবর এসেছে। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, টাইমস নাউ, ডেকান টাইমস, নিউ ইকনোমিক টাইমসসহ প্রিন্ট মিডিয়ায় যেমন খবরটি প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি এনডিটিভির মতো ভারতের সবচেয়ে নামকরা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়ও এ খবরটি সম্প্রচারিত হয়েছে। সম্ভবত ভারতীয় প্রিন্ট মিডিয়া থেকেই বাংলাদেশের দৈনিক সমকাল, দৈনিক ইনকিলাব, ইংরেজি ডেইলি স্টার এবং দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় খবরটি নেওয়া হয়েছে এবং অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। এই রেল ট্রানজিট বা করিডোর যে হতে যাচ্ছে, সেটি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ায় বোঝা গেছে। তিনি অত্যন্ত উৎফুল্ল গলায় বলেছেন, এ রেলওয়ে ট্রানজিট হলে সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত বিপুলভাবে উপকৃত হবে। ভারত এবং বাংলাদেশের প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া থেকে এসব খবর সংকলন করার পর যে সারমর্ম দাঁড়ায়, সেটি নিম্নরূপ-
ভারতের রেলওয়ে বোর্ড নতুন রেললাইন সম্প্রসারণের জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। এই নতুন রেললাইন ভারত থেকে বাংলাদেশ এবং নেপাল হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে সংযুক্ত হবে। এ সংযুক্তির ক্ষেত্রে চিকেন নেক নামে বহুল পরিচিত শিলিগুড়ি করিডোরকে এড়িয়ে যাওয়া হবে। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে তাদের ভূখণ্ডে ৫০০ কি.মি. নতুন রেলওয়ে লাইন নির্মাণের ‘আদেশ’ দিয়েছে। এর মধ্যে ৩৭৬ কি.মি. লাইন হবে ব্রডগেজ লাইন। টাইমস অব ইন্ডিয়ার ভাষায়, On the Bangladesh route, around 500 km of new railway lines have been ordered and gauge conversion will be performed for 367 km. On the Nepal route, over 200 km of new lines will be laid; while in the North East there will be another 212 km of lines being laid.
নতুন রেল করিডোর নির্মাণের যে রুট দেওয়া হয়েছে, সেটাও ভারতীয় প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ২৫০ কি.মি. নতুন রেললাইন বসানো হবে। এটি হবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মেঘালয় ভায়া বাংলাদেশ। রুটটি হবে বালুরঘাট-হিলি-গাইবান্ধা-মহেন্দ্রগঞ্জ-তুরা-মেন্দিপাথর। পশ্চিমবঙ্গেও লাইন হবে দুটি। একটি হবে ৮০ কি.মি.। আরেকটি হবে ৬০ কি.মি.।
অপর রুটটি হবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসাম ভায়া বামনহাট। রুটটি হবে বালুরঘাট-হিলি-পার্বতিপূর-কাউনিয়া-লালমনিরহাট-মোগলহাট-গিতালদহ। যেসব রেললাইন ব্রডগেজে কনভার্ট করা হবে, সেগুলো হলো পশ্চিমবঙ্গ থেকে ত্রিপুরা ভায়া বাংলাদেশ। রুটটি হলো গেদে-দর্শনা-আখাউড়া-আগরতলা-পেট্রাপোল-বেনাপোল-নাভারন-যশোর-রূপদিয়া-পদ্মাবিলা-লোহাগড়া-কাশিয়ানি-শিবচর-মাওয়া-নিমতলা-গেণ্ডারিয়া-ঢাকা-টঙ্গী-ভৈরব বাজার-আখাউড়া-আগরতলা। এই বিশাল রুটে যথাক্রমে ১০০ কি.মি. ও ১২০ কি.মি. লাইন ব্রডগেজে কনভার্ট করা হবে। নেপালের দিকে স্থাপন করা হবে ১৯০ কি.মি. রেললাইন। রুটটি হবে বিরাটনগর-নিউ মল। আরেকটি হবে ১২ দশমিক ৫ কি.মি.। রুটটি হবে গলগলিয়া-ভদ্রপুর-কাজালি বাজার।
ভারতীয় রেলওয়ে সূত্র উল্লেখ করে, হিন্দুস্তান টাইমস এবং টাইমস নাউ পত্রিকাসমূহে বলা হয়েছে, এর ফলে একদিকে যেমন ভ্রমণের সময় অনেক কমে যাবে; অন্যদিকে তেমনি কৌশলগতভাবেও ভারত লাভবান হবে। কারণ চিকেন নেকটি মাত্র ২২ কি.মি. লম্বা। এর এক প্রান্ত রয়েছে নেপালে, আরেক প্রান্ত রয়েছে বাংলাদেশে। ভুটানের দোকলাম নামক কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ডটি নিয়ে ভারত এবং চীনের মধ্যে যখন যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয় তখন এ চিকেন নেক নিয়ে ভারত অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়ে। তখন থেকেই ভারত চিন্তা করতে থাকে যে সামরিকভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এ চিকেন নেক যদি শত্রুর হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল পূর্বাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। পর্যবেক্ষক মহল বলেন, এমন একটি অবস্থায় ভারত দুটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে পরিণত হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি করিডোর হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের মনিপুর বা নাগাল্যান্ডে যেতে সময় লাগে ৩২ ঘণ্টা। হিন্দুস্তান টাইমস দাবি করেছে যে, যদি কলকাতা থেকে বাংলাদেশ হয়ে মেঘালয়, মনিপুর বা নাগাল্যান্ডে যেতে হয়, তাহলে বিরতিহীন দ্রুত গতির মালগাড়ির সময় লাগবে মাত্র ৪ ঘণ্টা। অর্থাৎ ভারতের সময় বাঁচবে ২৮ ঘণ্টা। বিবিসি এবং আল-জাজিরায় বলা হয়েছে যে, এসব রুটে যে মালগাড়ি চলবে, সেগুলোয় শুধুমাত্র নিত্যব্যবহার্য পণ্যই পরিবহন করা হবে না, সমরাস্ত্রও পরিবহন করা হবে। ভারতীয় ইংরেজি পত্রপত্রিকায়ও সমরাস্ত্র শব্দটি সরাসরি না বলে বলা হয়েছে Goods having strategic importance.
এ সামরিক গুরুত্বের কারণেই ভারতীয় পত্রপত্রিকাগুলোয় বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ হয়ে যে নতুন রেল ট্রানজিট স্থাপন করা হবে, সেই রুটগুলো শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেকে নির্মিত রেললাইনকে পাশ কাটিয়ে চলবে। এর ফলে চিকেন নেকের ওপর তেমন কোনো চাপ আর থাকবে না। ভারতের রেলওয়ে বোর্ড যেসব রুটকে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে, দি হিন্দু পত্রিকার বিজনেস লাইনে তার দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ১২৭৫ দশমিক ৫০ কি.মি.। নিচের লাইনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে ইংরেজিতে বলা হয়েছে, FLS for 14 new railway connectivity routes connecting Bangladesh, Nepal, and alternate routes towards the North-East have been sanctioned, an official in the Railway Ministry stated. অর্থাৎ ভারতীয় রেল মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে এসব নতুন রেল পথের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
আরেকটি রুট হবে বিলোনিয়া-ফেনী-চট্টগ্রাম। এই রুটের দৈর্ঘ্য হবে ৩৮ কি.মি.। বিহারের পূর্ণিয়া থেকে বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত ১৭০ কি.মি. নতুন লাইন স্থাপন করা হবে। ২০১৭ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে বিদ্যমান দোকলাম অচলাবস্থার কারণে সামরিক বাহিনী এবং বেসামরিক পরিবহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রেললাইনটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সংকীর্ণ করিডোরটি বিবাদ অঞ্চলের কাছে পড়ছে। আন্তর্জাতিক রেল সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে ১৪টি রুট সমীক্ষা রিপোর্টে চূড়ান্ত সিলমোহর দিয়েছে ভারতীয় রেল বোর্ড। ইতোমধ্যে সেবক থেকে রংপো পর্যন্ত ট্রেন নিয়ে যাওয়ার কাজ চলছে। নাথুলা পর্যন্ত ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে। ১,২৭৫.৫ কিলোমিটার রেললাইনের যে অনুমোদন দিয়েছে রেল বোর্ড, তার মধ্যে বাংলাদেশের ৮৬১ এবং নেপালের ২৯২.৫ কিলোমিটার রয়েছে। বাকিটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের।
এই খবরের পর যা ঘটবার তাই ঘটেছে। যখন বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন এবং ১৯৯৬ সালে যখন তিনি বিরোধীদলের আসনে বসেন, তখন এ উভয় সময়ে তিনি বলেছিলেন, বুকের রক্ত দিয়ে হলেও তিনি ভারতের এ করিডোর রুখবেন। বেগম জিয়া অনেক দিন হলো ক্ষমতায় নাই। এই সুযোগে বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ ভারতের যত চাহিদা ছিল সব পূরণ করেছে। সর্বশেষ এ সর্বনাশা রেল করিডোর দিতে যাচ্ছে। তাই প্রত্যাশিতভাবেই বিএনপি এর তীব্র বিরোধিতা করেছে। গত ১৯ জুন বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, রেল ট্রনজিটের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো ভারতের সমরাস্ত্র এবং বেসামরিক পণ্য পরিবহনের জন্যই করা হয়েছে। আর এগুলো অবশ্যই করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে যে, গণতন্ত্র মঞ্চ, এবি পার্টি, মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বাধীন ১২ দলসহ অন্যান্য দল ঈদের রেশ কেটে যাওয়ার পর এ সম্পর্কে সভা-সমাবেশ ও সিম্পোজিয়াম করার চিন্তাভাবনা করছে। যদি বিএনপি এ ব্যাপারে সম্মতি দেয়, তাহলে তাদের মিছিল মিটিং করারও চিন্তা ভাবনা রয়েছে।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদি শীর্ষ বৈঠক দিল্লিতে
- বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসুন : অধ্যাপক মুজিবুর রহমান
- দাওয়াই পাচ্ছে না সরকার
- বিএনপিতে কেন নন্দলাল বিতর্ক
- বড় বন্যার আশঙ্কা
- আওয়ামী লীগে অস্বস্তি-দ্বন্দ্ব
- অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার
- পলাশী ট্র্যাজেডি দিবস ২৩ জুন
- সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও মিডিয়ার ওপর জুলুম-নিপীড়ন বন্ধ করুন : মিয়া গোলাম পরওয়ার
- জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এদেশে কুরআনের সমাজ বিনির্মাণ : রফিকুল ইসলাম খান