সংবিধান সংস্কার নয়, নতুন প্রণয়ন


১৫ মে ২০২৫ ১৫:৪২

॥ গাজী মুহাম্মদ শওকত আলী ॥
বাংলাদেশের সংবিধান : বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয় ১৯৭২ সালে। ১৯৭০ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ গণপরিষদ গঠিত হয়। বাংলাদেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করাই ছিল গণপরিষদের একমাত্র কাজ। গণপরিষদ আদেশ জারির মধ্য দিয়ে সংবিধান প্রণয়নের আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয়। আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি কমিটি শেখ মুজিবকে গণপরিষদের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত করে। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনেই স্পিকার নির্বাচিত হন শাহ আবদুল হামিদ আর ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন মোহাম্মদ উল্লাহ। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য ডক্টর কামাল হোসেনকে আহ্বায়ক করে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১১ অক্টোবরের মধ্যে কমিটি সংবিধানের খসড়া চূড়ান্ত করে। ১৯ অক্টোবর থেকে সংবিধান বিল সম্পর্কে গণপরিষদে সাধারণ আলোচনা শুরু হয় আর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান বিল গণপরিষদে পাস হয়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে সংবিধান কার্যকর হয়। ঐদিন গণপরিষদে সংবিধানের ওপর বক্তব্য রাখেন শেখ মুজিব। তিনি বলেন, এই “সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত” এ “সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার মূর্তপ্রতীক” হয়ে থাকবে। অতঃপর পর্যায়ক্রমে সংবিধানে ১৭টি সংশোধনী আনা হয়। কালের পরিবর্তনে “সংবিধান সংস্কার কমিশন” গঠন করা হয় ৬ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে। ৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিশনের প্রধান করা হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী রীয়াজকে।
প্রশ্নবিদ্ধ সংবিধান : প্রশ্ন হচ্ছে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হলো। পাকিস্তানের জাতীয় ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা কোন ক্ষমতা বলে বা কোন আইনে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করলো! এটা বোধগম্য নয়। সংবিধান দেশের জনগণের জন্য। সংবিধান প্রণয়ন করতে হলে জনগণের ম্যান্ডেট অবশ্যই লাগে। জনগণের ম্যান্ডেট নিতে হলে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী মেনোফেস্টোতে কীসের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয়। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে জনগণের ম্যান্ডেট ও রাজনৈতিক দলের মেনোফেস্টো দুটোই সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। অতএব এ সংবিধান অগ্রহণযোগ্য ও অবৈধ। যে সকল শহীদের রক্তে লিখিত! সংবিধান। সেই সংবিধান লিখিত হওয়ার ৫৩ বছরেও শহীদদের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়নি, শহীদদের বা শহীদ পরিবারকে কোনো প্রকার সম্মান প্রদর্শন বা সম্মানী দেওয়া হয়নি! এমনকি শহীদ পরিবারের লোকেরা কে কোথায় কেমন আছে, রাষ্ট্র সেই খোঁজখবর পর্যন্ত নেয়নি। এটা তো শহীদদের প্রতি সুস্পষ্ট অকৃতজ্ঞতা ও প্রতারণা।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারা সকলে একই দলের লোক ছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করার কথা যারা দাবি করছেন, তারা সংবিধান নয় মূলত (আওয়ামী লীগের) দলীয় গঠনতন্ত্রই তৈরি করেছেন। একই দলের লোকদের দ্বারা প্রণয়ন করা এ সংবিধানের সাথে জনসাধারণের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না আর এখনো নেই। অতএব এটা কোনো বৈধ সংবিধান হতে পারে না, এটা দলীয় গঠনতন্ত্র হতে পারে। সুতরাং বিতারিত ফ্যাসিস্টদের দলীয় গঠনতন্ত্র স্বাধীন দেশের সংবিধান হতে পারে না। অতএব জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন, কৃষ্টি সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুভূতির সাথে মিল রেখে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে।
সংবিধানের মূলনীতি ও তার পরিবর্তন : ১৯৭২ সালে রাষ্ট্র পরিচালনায় কথিত সংবিধানে ৪টি মূলনীতির কথা বলা হয়। (১) জাতীয়তাবাদ, (২) সমাজতন্ত্র, (৩) গণতন্ত্র ও (৪) ধর্মনিরপেক্ষতা। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গৃহীত এ চার মূলনীতির সাথে ৯০% মুসলমানের ঈমান, আকিদা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পরিপন্থি। এসকল মূলনীতিতে জনগণের ম্যান্ডেট বা সম্পৃক্ততা নেই। অতএব সংবিধানে গৃহীত মুসলমানদের ঈমান-আকিদা পরিপন্থি মূলনীতিগুলো প্রত্যাহার যোগ্য। গণতন্ত্র হতে পারে সরকার গঠনের মাধ্যম। আর সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হতে হবেÑ (১) সালাত কায়েম, (২) যাকাত আদায়, (৩) সৎকাজের আদেশ এবং (৪) অসৎকাজে নিষেধ। আল্লাহ তায়ালা সূরা হজের ৪১ নম্বর আয়াতে এমনই ঘোষণা করেছেন।
পরিবর্তিত মূলনীতির ব্যাখ্যা : (১) সালাত কায়েমের মাধ্যমে সচ্চরিত্রবান জাতি গঠিত হবে। কারণ আল্লাহ বলেছেন সালাত মানুষকে সকল খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। (২) যাকাত হবে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। রাসূল (সা.) বলেছেন, যাকাত মানুষের সম্পদ পবিত্র ও বৃদ্ধি করে। যাকাতের মাধ্যমে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করে। সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা পায়। মুসলমান যাকাত দেবে আর অমুসলিরা জিযিয়া কর দেবে। যাকাত দেয়ার মাধ্যমে মুসলমান নাগরিকগণ রাষ্ট্রের যে সকল মৌলিক অধিকারগুলো ভোগ করবে অমুসলিমরাও জিযিয়া কর দেয়ার মাধ্যমে অনুরূপ সুযোগ-সুবিধা পাবে। (৩) সৎকাজের আদেশের মাধ্যমে দেশ ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। সমাজে ন্যায়বিচার ধনী-গরিব, মুসলিম-অমুসলিম সকলের জন্যই সমান কল্যাণ বয়ে আনবে। আর (৪) অসৎ কাজে নিষেধ করা হলে দেশ ও সমাজে অন্যায় অবিচার থাকবে না। এতে করে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই নিরাপত্তা পাবে।
সংবিধানে গৃহীত মৌলিক অধিকার : সংবিধানে মানুষের ৫টি মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে, (১) খাদ্য, (২) বস্ত্র, (৩) বাসস্থান, (৪) শিক্ষা ও (৫) চিকিৎসা। এই পাঁচ মৌলিক অধিকারের কথা বলা হলেও তা কখনোই মানা হয়নি। খাদ্যের অভাবে মা তার কোলের শিশুকে পানিতে ফেলে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। মা তার ক্ষুধার যন্ত্রণায় দুধের শিশুকে বিক্রি করে রুটি কিনে ক্ষুধা নিবারণ করার রেকর্ড আছে। বস্ত্রের অভাবে জেলেদের মাছ ধরার ছেঁড়া জাল দিয়ে লজ্জা নিবারণের ব্যর্থ প্রয়াস পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে। বাসস্থানের অভাবে বিভিন্ন স্থানে রেলস্টেশন, ফুটপাথ ও ফ্লাইওভারের নিচে শত শত বনি আদম তথা মানুষ ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও রাত্রিযাপন করছে। লাখ লাখ বনি আদম বাসস্থানের অভাবে শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত। ছিন্নমূল মানুষ আর্থিক সংকটের কারণে চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে রাষ্ট্রের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা কি কোথাও আছে? সংবিধানে বর্ণিত নাগরিকদের পাঁচটি মৌলিক অধিকার, কাজীর গরু খাতায় আছে কিন্তু গোয়ালে নেই এমন গল্পের মতই মনে হচ্ছে।
সংবিধানে গৃহিত মৌলিক অধিকারগুলোর সাথে সামাজিক নিরাপত্তা যুক্ত করতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো যাতে মানুষ ভোগ করতে পারে রাষ্ট্রকে তা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) শাসনামলকে আমলে নেয়া যেতে পারে।
সংবিধান সংশোধন ও রাজনীতিকরণ : বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের নিকট প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ দায়বদ্ধ। বাংলাদেশের সংবিধানে মোট ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে। সর্বশেষ ১৭ নম্বর সংশোধনী ৮ জুলাই ২০১৮ সালে আনা হয়েছে। মানুষের রচিত সংবিধান রাজনৈতিক কারণে সংশোধন করা হয়। যেমনÑ দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির সব ক্ষমতা কেড়ে নেয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে আর এ কারণেই দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম হয়েছিল। মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি মানুষের উপযোগী যে সংবিধান আল কুরআন দিয়েছেন তা কিয়ামত পর্যন্ত সংশোধনের প্রয়োজন হবে না। অতএব ৯০% মুসলমানের দেশে আল কুরআনকে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করাই ঈমান ও সময়ের দাবি। আমরা মুসলমান হিসেবে, সালাত (নামাজ) সাওম, হজ ও যাকাতের বিষয়ে সচেতন থাকলেও আল্লাহর অন্যান্য আইন বা বিধিবিধানের ব্যাপারে উদাসীন। আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণ রূপে আল্লাহর দীনে দাখিল হও। (সূরা বাকারা : ২০৮)। দীন আরবি শব্দ যার অর্থ হচ্ছে জীবন বিধান। সালাত, সাওম, হজ, যাকাত এগুলো হচ্ছে দীনের অংশ বিশেষ। সালাত, সাওম, হজ, যাকাত যেমন ফরজ, তেমনি আল্লাহর দেয়া আইনকানুন বা বিধিবিধানগুলো মানাও ফরজ। চোরের বিচার হাত কাটা, জেনার বিচার পাথর মেরে হত্যা করা ইত্যাদি। তবে এ বিচারের জন্য অবশ্যই কিছু শর্ত আছে। রাষ্ট্র যদি নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে পারে তবেই শরিয়তের আইন প্রয়োগ হতে পারে।
সংবিধানের ত্রুটিসমূহ : সংবিধানের প্রায় অধিকাংশ সংশোধনীতে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ প্রধান্য পেয়েছে। যার কারণে এ সংবিধান ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতন্ত্র সৃষ্টিকারী বলে আখ্যায়িত হয়েছে। এ সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকারের চেয়ে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ প্রাধান্য পেয়েছে। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিগুলো আদালত কর্তৃক স্বীকৃত ও বলবৎযোগ্য নয়। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলো নানাবিধ শর্তযুক্ত হওয়ায়, এগুলোর ফাঁকফোকর গলে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো সরকার অহরহ লঙ্ঘন করছে। মানুষের মৌলিক অধিকার বিষয়ক বিধানগুলোর ফাঁকফোকর গলে ১৮৬০ সালের ব্রিটিশ দণ্ডবিধি ও ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির মতো দমনমূলক ব্রিটিশ আইনগুলো এখনো বলবৎ রাখা হয়েছে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন ও ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো জনবিরোধী আইনগুলোর মাধ্যমে সরকার নাগরিক অধিকার আরো বেশি সংকুচিত করেছ্।ে
সংবিধানের চতুর্থ ভাগ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভায় নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণের কোনো বিধান সংবিধানে না থাকার কারণে ও ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ দ্বারা সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা খর্ব করার কারণে প্রধানমন্ত্রীর হাতে নির্বাহী ক্ষমতা নিরঙ্কুশভাবে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। যার জন্য বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থাকে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র বলা হয়ে থাকে। জনগণের সীমিত নাগরিক অধিকার ও প্রধানমন্ত্রীর অবারিত ক্ষমতার পরিধি বিবেচনা করে এ সংবিধানকে চিরস্থায়ী জরুরি অবস্থার সংবিধান বলা যেতে পারে। সংবিধান হতে হবে জনগণের জন্য। সংবিধান জনগণের কথা বলবে, শাসকের নয়।
নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখতে সংবিধানের ব্যর্থতার দরুন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাতে জীবন দিতে হয়েছে ২ হাজার ৬৯৯ জনকে। গুম হয়েছে ৬৭৭ জন। কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছে ১ হাজার ৪৮ জন। বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ পঞ্চদশ সংশোধনীর ৭ম অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করে সংবিধানের প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগসহ আরো কিছু অনুচ্ছেদকে সংশোধন অযোগ্য বা চিরকালীন বলে ঘোষণা করেছে। এসবই করা হয়েছে রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার জন্য। আল কুরআন ব্যতীত পৃথিবীতে আর কোনো কিছুই সংশোধন অযোগ্য হতে পারে না।
সংবিধান সংস্কার না নতুন আইন প্রণয়ন : ২৪ এর জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান বা গণবিপ্লব সংবিধান মেনে হয়নি। গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব সংবিধান পরিপন্থি। সুতরাং বিপ্লবের পর সংবিধান অকার্যকর বা পরিত্যাজ্য। সংবিধান মানলে বিপ্লবীদের ফাঁসি হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও সংবিধানে নেই। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মূলত বিপ্লবী সরকার। যে বা যারা সংবিধান মানে, তারা মূলত বিপ্লবকে অস্বীকার করে। বিপ্লবোত্তর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করেছেন। যার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী রীয়াজ। জনাব রীয়াজ বলেছেন, “১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান মূলত একটা দলীয় গঠনতন্ত্র।” ৭২-এর সংবিধান যারা প্রণয়ন করেছেন, তারা মূলত সকলেই একটি মাত্র দলের লোক ছিলেন। সংবিধানের ৪টি মূলনীতির অধিকাংশই সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের ঈমান ও আকিদা পরিপন্থি। সংবিধানতো ৫ আগস্টই বিপ্লবের মাধ্যমে বাতিল হয়ে গেছে, এটা সংস্কারের প্রশ্ন কেন। প্রয়োজন নতুন সংবিধান প্রণয়ন। অতএব দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ঈমান, আকিদা, সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে মিল রেখে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে সুচিন্তিতভাবে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। প্রয়োজনে গণভোটও হতে পারে। সংবিধান সংস্কার কমিশনে দেশের বিজ্ঞ অভিজ্ঞ আলেমেদের যুক্ত করতে হবে।
কেমন সংবিধান চাই : প্রচলিত অর্থে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে সকল মূলনীতি আইনকানুন বা বিধিবিধান প্রয়োজন হয়, তার একটা সংক্ষিপ্ত রূপ বা সারমর্ম হচ্ছে ‘সংবিধান’। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন সূরা আলে ইমরানের ১৯ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমার নিকট একমাত্র দীন হচ্ছে ইসলাম।’ দীন আরবি শব্দ যার অর্থ হচ্ছে, ‘জীবনব্যবস্থা বা জীবনবিধান। জীবন বিধান বলতে বোঝায়, মানুষ তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কীভাবে জীবন পরিচালনা করবে তথা কী খাবে আর কী খাবে না, কী করবে আর কী করবে না সবই আল কুরআনে উল্লেখ আছে। সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন, “কুরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের হিদায়াত ও সঠিক পথের সুস্পষ্ট নির্দেশ আর হক-বাতিলের পার্থক্যকারী রূপে।” সূরা আলে ইমরানের ৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো জীবনবিধান বা আইনকানুন গ্রহণ করতে চাইবে, তার থেকে তা গ্রহণ করা হবে না।’ সূরা আ’রাফের ৫৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, “সৃষ্টি যার (আল্লাহ) আইন চলবে তাঁর।” অতএব সৃষ্টি যেহেতু আল্লাহর সেহেতু আইন বা নির্দেশও চলবে আল্লাহর।” অতএব রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আল্লাহর দেয়া বিধিবিধান তথা আল কুরআনের আলোকেই সংবিধান প্রণয়ন করা উচিত।
দণ্ডবিধির পরিবর্তন : ১৮৬০ সালের ব্রিটিশ দণ্ডবিধি ও ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির মতো দমনমূলক ব্রিটিশ আইনগুলো আমরা এখনো মেনে চলছি। এসকল আইন দ্বারা সাংবিধানিকভাবে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। অথচ আল্লাহ কুরআনে কত সুন্দর সুন্দর আইনের কথা বলেছেন। আল্লাহর দেয়া দণ্ডবিধিÑ যেমন হত্যার শাস্তি সম্পর্কে সূরা আল মায়েদার ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে হত্যার বদলে হত্যা (জীবন)। চোরের শাস্তি সম্পর্কে সূরা আল মায়েদার ৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে। সন্ত্রাসের শাস্তি সম্পর্কে সূরা আল মায়েদার ৩৩ আয়াতে বলা হয়েছে। জেনা, অবৈধ যৌনকর্ম, ব্যভিচার, ব্যভিচারের অপবাদের শাস্তি সম্পর্কে সূরা আর নেসার ১৫ ও ১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে। ইসলামের বিধিবিধানের মধ্যে সালাত সিয়াম হজ যাকাতের মতো চোরের বিচার হাত কাট আর জেনার বিচার অবিবাহিতদের বেত্রাঘাত ও বিবাহিতদের পাথর মারা শুরু হলে শতভাগ এসকল অপরাধ কমে যাবে, ইনশাআল্লাহ।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিধান : এ সম্পর্কে আল কুরআনের সূরা বাকারার ১৮০-১৮২, ২৪০, সূরা আন নিসার ৭-৮, ১১-১২, ৩৩, ১৭৬, সূরা আল মায়েদার ১০৬-১০৮ আয়াতে, সূরা আনফালে আয়াতে বলা হয়েছে। ক্রয়-বিক্রয়ের বিধিবিধান সম্পর্কে সূরা বাকারা ১৯৮, ২৭৫, ২৮২-২৮৩, সূরা আন নিসার ২৯, সূরা আন নূর ৩৭, সূরা জুমা ১০, সূরা আল মুযাম্মেল ২০ নম্বর আয়াতে নির্দেশনা দেয়া আছে। সুদ সম্পর্কে বলা হয়েছে সূরা বাকারার ২৭৫, ২৭৮-২৮০, সূরা আন নেসার ১৬১ নম্বর আয়াতে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব বিধান চালু হলে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ আল্লাহ তায়ালা সূরা আল মায়েদার ৬৬ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছেন, যারা আল্লাহর আইন মেনে চলবে, তাদের রিজিকের জন্য আসমান ও জমিনের দরজা খুলে দেবেন। উদাহরণস্বরূপ আমরা আফগানিস্তনকে সামনে রাখতে পারি।
নারী নীতি : নারীরা জন্মের পর থেকে বিয়ের বয়স হওয়া পর্যন্ত পিতার তত্ত্বাবধানে থাকবে। বিয়েতে পুরুষের (যে বিয়ে করবে তার) পক্ষ থেকে সম্মানজনক মোহরানা পাবে। বিয়ের পর স্বামী তাকে সম্মানজনক ভরণ-পোষণ দিতে বাধ্য। নারীর (স্ত্রীর) ইজ্জত-আব্রু রক্ষায় পুরুষ (স্বামী) প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা করতে বাধ্য। নারীর (স্ত্রীর) অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পুরুষের (স্বামীর) ওপর বর্তায়। নারীর (স্ত্রীর) কাজ হবে পুরুষের (স্বামীর) ঘর-সংসার রক্ষণাবেক্ষণ করা, সন্তান ধারণ করা, লালন-পালন করা। স্বামীর অনুগত থাকা। স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রী সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা পাবে বিনিময়ে স্ত্রী স্বামীর ঘর-সংসারের জিম্মাদার হবে। ইসলামী শরিয়াহ মতে, এটাই নারী-পুরুষের ন্যায্য অধিকার।
সহজ-সরল সংবিধান : ৯০% মুসলমানের দেশে জনগণ প্রতিদিন কমপক্ষে ৩৩ বার আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে বলি, ‘আমাদেরকে সহজ-সরল পথ দান করো।’ সূরা আলে ইমরানের ৫১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ‘নিশ্চই আল্লাহ আমাদের মালিক অতএব আমাদের উচিত আল্লাহর হুকুমগুলো মেনে চলা, আর এটাই সহজ ও সরল পথ।’ অতএব সংবিধান সংস্কার বা সংশোধন নয়, বরং কুরআন-সুন্নাহর আলোকে নতুন করে সহজ-সরল সংবিধান প্রণয়ন করা বাঞ্ছনীয়।