কাউন্সিলর পারভীনের রুদ্ধশ্বাস ৩৬ ঘণ্টা!

মুহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিক, গাজীপুর : গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মহিলা কাউন্সিলর পারভীন আক্তারের বাবা মুক্তিযোদ্ধা চাঁন মিয়া জমিসংক্রান্ত বিরোধে ২০১১ সালে খুন হন। সেই খুনের আসামিরাই তাকে অপহরণ করে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল বলে গত ১৩ জুলাই রোববার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন পারভীন আক্তার।   

কাউন্সিলর পারভীন আক্তারকে শনিবার রাতে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার আউসপাড়া এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে তাকে রাতেই গাজীপুরে আনা হয়। রোববার সকালে গাজীপুর সদর হাসপাতালে চিকিৎসার পর দুপুরে তাকে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে গাজীপুরের পুলিশ সুপার আবদুল বাতেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায়, গোলাম আজাদ খান, জয়দেবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম কামরুজ্জামান এবং গাজীপুর গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমির হোসেন ও পরিদর্শক আলম চাঁদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে পারভীন আক্তার জানান, ১০ জুলাই রাতে এক নারী তাদের দাম্পত্য কলহ মেটানোর জন্য সহযোগিতা চেয়ে কাউন্সিলর পারভীনের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল করেন। ওই নারী পারভীন আক্তারকে জিরানী বাজার এলাকায় রহিম আফরোজ ব্যাটারি কারখানার পাশে যেতে অনুরোধ করেন।

পরদিন শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে তিনি সেখানে যাওয়ার পর ওই নারীর সঙ্গে দেখা হয়। এ সময় ওই নারী বলেন, তার কাছে কিছু স্বর্ণালঙ্কার আছে। সেগুলো রেখে তাকে ১০-১৫ হাজার টাকা দিতে বলেন। পারভীন রাজি হলে ওই নারী তাকে নিয়ে জিরানী বাজার এলাকায় যান। জিরানী বাজারে যাওয়ার পর স্বর্ণালঙ্কার হস্তান্তরের জন্য পারভীনকে মাইক্রোবাসে উঠতে বলেন।

মাইক্রোবাসে উঠতে গিয়ে পারভীন মাইক্রোবাসের ভেতরে তার বাবার খুনের মামলার আসামি দুলাল হাজী, জুয়েল ও সোহেলসহ অজ্ঞাতনামা পাঁচ-ছয়জনকে বসে থাকতে দেখেন। তাদের দেখে পারভীন ফিরে যেতে চাইলে তাকে জাপটে ধরে তুলে নেয়া হয় মাইক্রোবাসে। এরপর সেটি সাভারের দিকে চলতে শুরু করে। এই সময় দুলাল হাজিসহ অন্যরা তাঁর নাকে-মুখে রুমাল চেপে ধরেন। এতে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন।

পারভীন আক্তার আরো জানান, ওই দিন (শুক্রবার) রাত ৯টার দিকে তার জ্ঞান ফিরলে তিনি দেখেন একটি ঘরের মধ্যে বন্দী রয়েছেন। এ সময় ওই নারীসহ অজ্ঞাত আরো দু’ তিনজন যুবক তাকে পাহারা দিচ্ছিল। একপর্যায়ে ওই নারী তাকে মারধর করে এবং পিতার হত্যার মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। এতেও কোনো সাড়া না পেয়ে তারা একইভাবে আবার তাকে সংজ্ঞাহীন করে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে ঢাকা-সিলেট সড়কের দিকে রওনা দেয়।

পথে শনিবার বিকেলের দিকে পারভীনের জ্ঞান ফিরে আসে। এ সময় অপহরণকারীরা দূর থেকে পথে পুলিশের একটি চেকপোস্ট দেখতে পায়। পরে তারা গতিপথ পরিবর্তন করে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের দিকে রওনা দেয়। এরপর রাত ঘনিয়ে আসে। তারা (শনিবার) রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার হাত পা বেঁধে ঢাকা-হবিগঞ্জ মহাসড়কের পাশে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়।

এ সময় এক অটোরিকশা চালকের সহায়তায় তিনি স্থানীয় একটি বাজারে পৌঁছান। সেখান থেকে এক ব্যক্তির মুঠোফোন দিয়ে তিনি তার স্বামী মিনহাজ উদ্দিনকে অবস্থান জানিয়ে ফোন করেন। পরে তার স্বামী পুলিশকে জানালে পুলিশ তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। খবর পেয়ে রাতেই গাজীপুরের পুলিশ তাকে গাজীপুর নিয়ে আসে।

পারভীন আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, উদ্ধার হলেও বর্তমানে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাকে যেকোনো মুহূর্তে তার বাবার খুনিরা মেরে ফেলতে পারে।

তিনি আরো বলেন, ‘জমিজমা নিয়ে বিরোধে ২০১১ সালে দুলাল হাজি, জুয়েল ও সোহেল তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা চাঁন মিয়াকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তিনি সেই মামলার বাদী। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে তারা তাকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দিয়ে আসছিল। হুমকির বিষয়ে জয়দেবপুর থানায় একাধিক জিডি রয়েছে।’

সংবাদ সম্মেলনে গাজীপুর পুলিশ সুপার আবদুল বাতেন সাংবাদিকদের বলেন, কাউন্সিলর পারভীনের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের প্রথম কাজ ছিল ভিকটিমকে উদ্ধার করা। এখন কাজ হচ্ছে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করা। তাদের গ্রেফতার করতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু হয়েছে।’

জয়দেবপুর থানার পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আলম চাঁদ জানান, সংবাদ সম্মেলন শেষে পারভীন আক্তারের গাজীপুর আদালতে জবানবন্দী নেয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, এ ব্যাপারে রোববার তার স্বামী মিনহাজ উদ্দিন জয়দেবপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।