আলোকে তিমিরে

ওভার্টলি নাইস কভার্টলি আগলি


৯ অক্টোবর ২০২৫ ১৪:১৭

॥ মাহবুবুল হক ॥
দুনিয়ার যেকোনো দেশ সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে জানতে হলে আপনাকে একাকী বা অন্তত একজন বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে হবে। বিদেশে আত্মীয় হোক, বন্ধু হোক, কেউ আপনাকে আলাদা করে সময় দিতে পারবে না। সবার নিজের নিজের কাজ আছে। কাজ না থাকলে কাজ খোঁজাও তো একটা বড় কাজ। কাজ পেলেই যে আপনি করতে পারবেন, সেই পরিবেশও সবসময় থাকে না। থাকার জায়গা আর কাজের জায়গা যদি কাছাকাছি না হয় বা পরিবহনের অসুবিধা থাকে, তাহলে তো অনেক সমস্যা, মোদ্দাকথা হলো, যারা আপনাকে সময় দেবে, তারা নিজেদের ক্ষতি করে হয়তো আপনাকে একটু সময় দেবে। তারও তো একটা সীমা থাকবে।
আমি প্রথমবার যে সিনিয়র বন্ধুর কাছে গিয়ে উঠেছিলাম। তিনি এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরের দিন সকালে তিনি আমাকে বললেন, এখন তোমার মতো কাজকর্ম তুমি করতে থাকো, প্রতিদিন রাতে আমাদের দেখা হবে।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। বিষয়টিকে সাথে সাথে খুব নিষ্ঠুর ও নির্দয় আচরণ বলে বিবেচনা করেছিলাম। তবে কোনো প্রতিবাদ বা আবদার করিনি। ক্ল্যাপহেম রেলওয়ে জংশনে এসে ইংরেজি ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব ভালোভাবে না জানার কারণে স্যালফোর্ডের জায়গায় শ্যালফোর্ড বলেছিলাম। যাবো দক্ষিণের প্রায় সাউথ এ্যান্ডে, গিয়ে পড়লাম নর্থের একটা শহরে। আবার নতুন করে টিকিট কেটে নর্থ থেকে সাউথে যাওয়া, বুঝতেই পারছেন কত বিপত্তিতে পড়েছিলাম। একটা ট্রেনিং প্রোগ্রামে যুক্ত ছিলাম। দেরি হওয়ায় ট্রেইনার একজন লেবানিজ ছেলের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, আজকের লেশন (পাঠ) তুমি এই বন্ধুর কাছ থেকে শিখে নেবে এবং ফেরার পথে ওকে ভিক্টোরিয়া রেলওয়ে স্টেশনে নামিয়ে দেবে। লাঞ্চের সময় মাত্র আধাঘণ্টা। এর মধ্যে রেজিস্ট্রেশন, সালাত এবং লাঞ্চ। লেবানিজ সালাত আদায় করবে না। আমি সার্ভিস বয়ের কাছ থেকে একটা মোটা কাগজের সিট চেয়ে নিয়ে একটু কোণায় গিয়ে একা একা জোহরের সালাত আদায় করলাম। নাম রেজিস্ট্রেশন করালাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ট্রেনিং গ্রহণকারীরা খাওয়া-দাওয়া করছে। একটা টেবিলে একজনের খাবার সাজানো ছিল। খুলেই চামচ আর কাঁটা চামচ সবেমাত্র ধরেছি, সার্ভিস বয় হন্তদন্ত হয়ে বলছে, ‘দিস ইজ নট ফর ইউ। ইউ আর এ মুসলিম।’ বলেই সে মেইন খাবারের প্লেটটা তুলে নিলো। আমি মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। ভাগ্যিস ছেলেটা আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছে। সে হাসতে হাসতে বলছে, দিস ইজ ফরবিডেন নিষিদ্ধ। জাস্ট ওয়েট, আই এম রিপ্লেসিং (বদলাচ্ছি)। আমার কেন যেন বমি বমি আসছিল। আমি আর জিজ্ঞেস করলাম না খাবারে হারাম খাদ্য কী ছিল। সে স্বল্প সময়ে ল্যামের (ভেড়ার) গোশতের খাবার নিয়ে এসেছিল। আমি তাকে থ্যাংকস জানালাম এবং স্যরিও জানালাম। বললাম আমার কাছে ড্রাই খাবার আছে।
ট্রেনিং পিরিয়ডের শেষে লেবানিজ বন্ধুর কাছ থেকে সকালের লেশনটা (পাঠ) নিচ্ছি, সে আমাকে বলল, ‘তুমি কি আজ রাতে আমাকে একটু শেল্টার (জায়গা) দিতে পারবে? আমি এখনো থাকার জায়গা ঠিক করতে পারিনি। দুদিন তো বন্ধ আছে। এর মধ্যে ঠিক করে নেব। প্লিজ হেল্প মি।’ ভাবলাম, এটাই আমার কপাল। সাত-পাঁচ না ভেবেই আল্লাহর ওপর ভরসা করে রাজি হয়ে গেলাম। আমার জন্য মসজিদের মেহমানখানার দুই সিটের একটি সিট বরাদ্দ করা হয়েছিল। বাকি সিটটা খালি ছিল। কেয়ারটেকার প্রথমে সিঁট ভাড়া দিতে রাজি হয়েছিল, কিন্তু পরে যখন জানল সে সালাত আদায় করে না, তখন সে রাজি হচ্ছিল না, বলছিল মেহমানখানা জবরদস্ত মুসলিমের জন্য। নামকাওয়াস্তে মুসলিমের জন্য নয়। আমি বললাম, তাহলে আমাকে যে দিলেন? বললেন, আরে ভাই আপনি তো ডাইরেক্টর সাহেবের মেহমান। বাটারসি রোডের এই ইসলামিক এডুকেশন ও কালচারাল সেন্টারের সবাই বাংলাদেশি এবং নোয়াখালীয়ান (নোয়াখালী জেলার অধিবাসী)।
যাহোক, কেয়ারটেকার চাচা নোয়াখালীর মানুষ। তাঁকে কোনোরকমে সামলানো হয়েছিল। তাঁর তখন বয়স ছিল পঁচাত্তরের উপরে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, চাচিসহ গোটা সংসারকে ফেলে রেখে আপনি কেন এখানে থাকেন? সোজাসুজি বলেছিলেন, ইংরেজরা ২০০ বছর ধরে আমাদের দেশের ধন-সম্পদ লুটপাট করেছে। আমি নিজে পঞ্চাশ বছরের উপর, আমার ছেলে, ভাতিজা এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন মিলে এখানে বসবাস করে কিছু তো উদ্ধার করতে পেরেছি।
তাঁর জবাবে আমরা তো লা-জবাব। পরবর্তীতে এ ধরনের জবাব বহু বাংলাদেশিদের মুখ থেকে পেয়েছি।
পূর্বে, পরে বা এখন যারাই প্রথম লন্ডনে আসেন, তারা প্রাথমিকভাবে হতাশ হন। এয়ারপোর্ট থেকে নেমে তারা যখন শহরের দিকে যান, তখন রাস্তার পাশের ঘরবাড়ি দেখে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। সব বাড়িঘর পুরনো, রংচটা, বেঁটে, লম্বা বা উঁচু নয়, বৃষ্টিভেজা, শ্যাওলায় ভরা। এখনো অবশ্য কিছু হাই রাইজ বিল্ডিং হয়েছে। প্রায় সময় বৃষ্টি। সামারে একটু কম। উইন্টারে যেমন শীত, তেমন বৃষ্টি ও বরফ। বাংলাদেশের মতো রাস্তাঘাট ডুবে যায়। পানি সরে গেলে রাস্তাঘাট প্রায় সময়ই স্যাঁতসেঁতে অবস্থায় থাকে। মেঘ, বৃষ্টি, বরফ। সবসময় কাঁদুনে অবস্থা। বিরহ বিরহ ভাব। গোটা প্রকৃতি যেন বিষণ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আনন্দের লেশমাত্র নেই। প্রতি এলাকায় প্রায় একই রকম সব বাড়িঘর। প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টে ছোট একটি টয়লেট এবং একটি বাথরুম। ৫০ বছর আগে তো নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ রাস্তার পাশে পাবলিক টয়লেট ও বাথরুমে যেত। সে অবস্থার এখন উন্নতি হয়েছে। কিন্তু টয়লেট আর বাথরুম খুব একটা বাড়েনি; বিশেষ করে সরকারি কোয়ার্টারে। দেশে বসে যারা ব্রিটেনের অবস্থা শুনতো আর এখানে এসে এদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখত, তখন অনেকেই আর এদেশে থাকতে চাইতো না। তখনো দেখেছি, এখনো দেখছি, কাউকে দাওয়াত দিলে বা মেহমান হতে বললে, প্রথমেই সরাসরি জিজ্ঞেস করত আপনাদের বাসায় কয়টা বাথরুম-টয়লেট আছে? যখন শুনতো মাত্র একটা বাথরুম ও একটা টয়লেট, তখন অনেকেই আর দাওয়াতের বিষয়ে উৎসাহবোধ করত না। টয়লেট ও বাথরুমের প্রাদুর্ভাব বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত রেস্টুরেন্টেই মেহমানদারি করত। এখনো করে।
আমাদের দেশে ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, বাসা বা বাড়ি যাই হোক না কেন, বাথরুম অন্যান্য রুমের তুলনায় অনেক বেশি সুন্দর ও সাজানো। পাকিস্তান আমলে সরকারি বাসাগুলোয় একটি টয়লেট ও একটি বাথরুম থাকতো, অন্তত মধ্যম মানের চাকরিজীবীদের জন্য। এখন তো আর সে অবস্থা কোথাও নেই। তিন বেডরুমের বাসায় অন্তত গড়ে তিনটে বাথরুম তো রয়েছে। ওরা বলে মুসলিম ও বাংলাদেশিরা লেভিস (আয়েশী)। বাংলাদেশিরা গড়ে বলে ব্রিটিশরা নোংরা। ওরা পানি খুব কম খরচ করে। টিস্যু পেপার দিয়েই সবকিছু ওরা সেরে ফেলে। ওদের বাড়িঘর দুয়ারে টিস্যু পেপারের কোনো কমতি নেই। আমাদের উচ্চবিত্ত পরিবারে যত ধরনের টিস্যু থাকে, সেই সব ধরনের টিস্যু থাকে এখানকার মধ্যবিত্ত পরিবারে। আমি এখানে শুধু ব্রিটিশদের কথা বলছি না, সব ধরনের অধিবাসীদের কথাই বলছি। টিস্যুর ব্যবহার সাধারণভাবে অতিরিক্ত। এ বিষয়ে দারুণ অপচয় রয়েছে। কিন্তু উপায় তো নেই। টয়লেট, বাথরুম ও বেসিনের স্বল্পতার কারণে স্বাভাবিকভাবেই টিস্যুর ব্যবহার বহুগুণ বেড়ে গেছে। সাধারণভাবে মুসলিম এবং বাংলাদেশিরা যারা এখন নতুন বাড়ি ঘর বানাচ্ছেন, তাদের বাড়িঘরে টয়লেট-বাথরুম বেড়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের মতো অতটা বাড়েনি।
ব্রিটিশরা ছোট প্রাকৃতিক প্রয়োজনে পানি ব্যবহার করে না, বড় প্রয়োজনেও সামান্য ব্যবহার করে। ওরা মুসলিমদের মতো বা বাংলাদেশিদের মতো প্রতিদিন সাওয়ার করে না, গোসল করে না। এসব কারণে পূর্বেও শুনেছি, এখনো শুনছি, ব্রিটিশরা ‘ওভার্টলি ক্লিন বাট কভার্টলি ভেরি আগলি’ পূর্বে অক্সফোর্ড স্ট্রিটের মতো রাস্তার পাশের টয়লেটে ঢুকলেও এ ধরনের মন্তব্য অবশ্যই দেখা যেত। শুধু টয়লেটে বা বাথরুমে কেন? রাস্তার পাশের দেয়ালে দেয়ালেও এ ধরনের চিকা মারা আমি প্রত্যক্ষ করেছি।
এই আগলিনেস (নোংরামি) ওদের সবখানে।
বেশ মনে পড়ছে, একবার আমি ট্রেনে সাউথ লন্ডনের দিকে যাচ্ছি। আমার সরাসরি সামনে ২০-২২ বছরের একজন তরুণী দিব্যি নিজের থুতু দিয়ে ঠোঁট মুখ নাক পরিষ্কার করছে। দেখেই আমার বমি আসছিল। আমি উঠে টয়লেটের দিকে চলে গিয়েছিলাম। ট্রেনের ভেতরটা আয়নায় মোড়া। সবার চোখে পড়ার কথা। কিন্তু লক্ষ করলাম, কেউ বিব্রতবোধ করছে না। এরা বিভিন্ন রকম পোশাক-আশাক, সেন্ট এবং প্রসাধনীতে অনেক টাকা খরচ করে। এর কারণও আছে অনেক। বাড়িভাড়াও এদের অনেক বেশি।
একবার এক সকালে ব্যাচেলর কোয়ার্টারে গিয়েছিলাম। দেখলাম কর্মজীবী ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ ক্যাডসসহ ঘুমাচ্ছে। কেউ কেউ জুতাসহ ঘুম থেকে উঠছে। আবার তাড়াতাড়ি করে টয়লেট বা বাথরুম না করেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুটছে। হায়রে জীবন! পড়াশোনা করতে এখন রাজ্যের পাউন্ড লাগে। ব্যারিস্টার হতে হলে আগে লাগতো ৫০-৫৫ লাখ টাকা। এখন লাগে দ্বিগুণেরও বেশি। বাংলাদেশিরা এত টাকা কোথায় পাবে? পাবে। যারা গত কয়েক বছর হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন, তারাই পারবেন তাদের ছেলেমেয়েকে ব্রিটেনে পড়াতে। পূর্বে সবার জন্য নানারকম বৃত্তির ব্যবস্থা ছিল, এখন প্রায় সব উঠে গেছে। চাকরি-বাকরি করে পড়াশোনার সুযোগ আগে ছিল। এখন নিয়মকানুনের বেড়াজালে তাও কমে আসছে। এটাও এক ধরনের আগলি ইমেজ।
ব্রিটেনের ছেলেমেয়েরা তো আমাদের দেশের মতো সবাই গ্র্যাজুয়েট বা মাস্টার্স করে না। তারা বড় জোর ইন্টারমিডিয়েট বা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যন্তই বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। যারা জীবনে উন্নতি করতে চায়। বড় মানুষ হতে চায়। গবেষণায় অবদান রাখতে চায়, তারাই শুধু কষ্ট করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে।
দুটি বিষয় এখানে ভালো ছিল, লেখাপড়া ও চাকরি। এখন ধীরে ধীরে সব ব্যবসার মধ্যে চলে গেছে। ব্রিটিশরা যখন পড়াশোনা করছে না, বহির্বিশ্বের শিক্ষার্থীরাই যখন ব্রিটেনে এসে লেখাপড়া করছে, তখন দাম বাড়াতে বা খরচ বাড়াতে ক্ষতি কি? এখানেও আগলিনেস, ডিভাইড অ্যান্ড রুলস চাপাতে অসুবিধা কোথায়?