ভারতের গোলামিই কি আ’লীগের নিয়তি


৯ অক্টোবর ২০২৫ ১৪:১৩

॥ সরদার আবদুর রহমান ॥
ভারতের গোলামি করা কিংবা তাঁবেদারি করাই কি আওয়ামী লীগের নিয়তি। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মানুষ স্বভাবগতভাবেই স্বাধীনচেতা হওয়ার কথা। কিন্তু এর একমাত্র ব্যতিক্রম মনে হয় আওয়ামী লীগ নামক দলটি। বিশেষত ক্ষমতা নিশ্চিত করতে এবং ভারতের একতরফা স্বার্থ পূরণ করতে এ দলটি সর্বদা উদগ্রীব থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে এযাবত তারা তাদের অসংখ্য কর্মকাণ্ড দিয়ে সে কথাই প্রমাণ করে চলেছে। এতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে হলেও তাতে আপত্তি নেই। এমনটাই ঘটে চলছিল ১৯৭২ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত অর্ধশতাব্দীর বেশি অতিক্রান্ত হওয়া সময়কালে।
সেই যে শুরু
বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনচেতা মন ও মনন পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে স্বাধীনতার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু এ কথাও মহাসত্য যে, ভারত তার স্বার্থ পূরণের জন্য এ লড়াইকে জয়ী হতে সাহায্য করে। ভারতের ছিল বহুমুখী স্বার্থের সমাহার।
এক. ভারতের বহু দিনের স্বপ্ন ছিল পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়ে দুর্বল করে দেয়া,
দুই. বাংলাদেশকে ভারতের করদরাজ্যে পরিণত করে শোষণ-লুণ্ঠন করা,
তিন. সীমান্ত রক্ষার এক বিরাট চাপ থেকে মুক্ত হওয়া এবং
চার. বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে সেভেন সিস্টার্সের অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা।
এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে ভারত তার দাবার ঘুঁটি চালাতে থাকে। আর এ ঘুঁটি হিসেবে পেয়ে যায় আওয়ামী লীগ নামের একটি সন্ত্রাসনির্ভর রাজনৈতিক চক্রকে। আর আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে পেয়ে যায় বামপন্থি কিছু দলকে।
ভারতের মূল এজেন্ডা ছিল পাকিস্তান থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। ২০০৭ সালের ১৫ এপ্রিল উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনী প্রচারকালে ইন্দিরা গান্ধীর নাতি এবং সেখানকার পার্লামেন্টের সদস্য ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, ‘আমার পরিবার একবার কিছু সিদ্ধান্ত নিলে, তা আর ফিরে যায় না। সেটা ভারতের স্বাধীনতার বিষয়ে হোক। পাকিস্তানকে ভাগ করার বিষয়ে হোক বা ভারতকে একবিংশ শতাব্দীতে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে হোক।’ তার এই মন্তব্যে ভারত ও পাকিস্তানজুড়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেলেও বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে বা ভারতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের কার্যালয় থেকে কোনো প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়নি। তাঁর এ বক্তব্যের স্পষ্ট দাবি, ১৯৭১-এ পূর্ব বাংলার বিচ্ছিন্ন হওয়া ভারতের গান্ধী পরিবারের ইচ্ছার ফল। বাংলাদেশের অনেক নীতিনির্ধারকও যে সেরকমই মনে করেন, তার প্রমাণ মেলে খোদ দেশটির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর প্রকাশ্য ভাষণে। তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, ‘ভারত যদি আমাদের সহযোগিতা না করতো আর ইন্দিরা গান্ধী না থাকতো, তাহলে আমরা ৯ মাস তো দূরের কথা, ৯ বছরেও স্বাধীন হতে পারতাম না। আর সেই কৃতজ্ঞতার কারণেই ভারত আমাদের বন্ধু।’ এছাড়া আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও নেতারা কথায় কথায় প্রবল ভারতপ্রীতির কথা এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সরাসরি আহ্বান জানাতেন। এমনকি দুই দেশের সম্পর্ককে ‘স্বামী-স্ত্রীর মতো’ বলে নির্লজ্জভাবে উল্লেখ করেছেন।
মুজিব বাহিনীর কাজ
একদিকে যখন মুক্তিবাহিনী সীমান্তে লড়াই করছে, তখন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ‘মুজিব বাহিনী’ নামে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলে। নিজেদের অনুগত এ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে থাকে। বাহিনী হিসেবে এর নামকরণ হয় ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-বিএলএফ। এ বিষয়ে একটি তথ্যে উল্লেখ করা হয়, “….জুন মাস থেকে দেখা গেল, বিভিন্ন শিবির থেকে প্রশিক্ষণের জন্য অপেক্ষারত তরুণরা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। এ যুবকদের গোপনে অন্য ধরনের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা এতই সুপরিকল্পিত ও বিস্তৃত ছিল যে, বিশেষ বিমানে কঠোর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার মাধ্যমে সেটা হতো। ফলে ভাবতে বাধ্য হলাম, আমাদের বিশ্বাস করা হচ্ছে না। সেক্টর কমান্ডাররা সবাই এতে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। জানিয়ে দেয়া হলো, ‘এ ব্যাপারে নাক গলাবেন না।’ পরে জানা যায় যে ‘র’-ই ছিল এর মূল উদ্যোক্তা।…রাজনৈতিক দিক থেকে এটা ছিল এক সর্বনাশা সিদ্ধান্ত। এ ধরনের গোপন পরিকল্পনার কারণে যুদ্ধের সময়ই মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। জানা যায়, কিছু সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক বিবেচনাতেই এ পরিকল্পনাটি গ্রহণ করা হয়েছিল। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ সরকারের কোনো অনুমতি ছিল না। তাদের যেসব মিশনে পাঠানো হতো তার কিছুই মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারেনি। শুধু শেখ মণি ও ভারত সরকারের অল্প কিছু লোক এসব জানতেন।”
মৈত্রী চুক্তি না গোলামি চুক্তি
ভারত কেবল বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সহযোগিতা করেনি। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির নামে ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ২৫ বছর মেয়াদি একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফরের সময় এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল, দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো পক্ষ অন্য কোনো দেশের সঙ্গে এমন কোনো সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবে না, যা চুক্তি স্বাক্ষরকারী কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাতে পারবে না এবং অন্য পক্ষের সামরিক ক্ষতি হতে পারে কিংবা নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারেÑ এমন কোনো কাজে নিজ দেশের ভূমি ব্যবহারের জন্য তৃতীয় কোনো পক্ষকে অনুমতি দিতে পারবে না; চুক্তি স্বাক্ষরকারী কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে যদি তৃতীয় কোনো দেশ সামরিক আগ্রাসন চালায়, তাহলে চুক্তি স্বাক্ষরকারী কোনো পক্ষ ঐ তৃতীয় দেশটিকে সমর্থন করতে পারবে না, বরং স্বাক্ষরকারী উভয় পক্ষ দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করে সেই হুমকি মোকাবিলার ব্যাপারে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং নিজ নিজ দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। চুক্তি স্বাক্ষরকারী প্রত্যেক পক্ষ তৃতীয় কোনো পক্ষের সঙ্গে গোপনে বা প্রকাশ্যে এমন কোনো চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে না, যা বর্তমান চুক্তির স্বার্থকে বিঘ্নিত করে। বলাবাহুল্য ২৫ বছর মেয়াদি এ চুক্তির ফলে প্রধানত সামরিকভাবে বাংলাদেশ ভারতের স্বার্থের ক্রীড়নকে পরিণত হয়।
এরও আগে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একটি ৭ দফার ‘গোপন চুক্তি’ হয় বলে জানা যায়। এ চুক্তি স্বাক্ষর ছাড়া ভারত সরকার বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনী পাঠাতে রাজি ছিল না। স্বাধীন দেশে ভারতের পুতুল সরকার হয়ে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন এ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে। চুক্তির দফাগুলো ছিল নিম্নরূপ:
১. ভারতীয় সেনা বিশেষজ্ঞদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে একটি প্যারা মিলিটারি ফোর্স বা আধাসামরিক বাহিনী গঠন করতে হবে।
২. ভারতীয় সেনা বিশেষজ্ঞদের অধীনে যাবতীয় সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করতে হবে। সমস্ত সামরিক যান ও যন্ত্রপাতি ভারতের কাছ থেকেই কিনতে হবে।
৩. ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ও তত্ত্বাবধানে স্বাধীন বাংলাদেশের যাবতীয় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে।
৪. ভারতীয় পরিকল্পনাবিদগণই বাংলাদেশের উন্নয়নের ফর্মুলা ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন।
৫. বাংলাদেশের সমস্ত বৈদেশিক ও কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড ভারতের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত হবে এবং তা কোনোভাবেই ভারতের জাতীয় স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করতে পারবে না।
৬. ভারতের অনুমোদন ছাড়া বাংলাদেশ কারো সাথে কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারবে না।
৭. এ চুক্তিটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার চলমান যুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের আগে স্বাক্ষরিত হলো এবং চুক্তি অনুযায়ী ভারতীয় সৈন্য যেকোনো সময় বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাদের প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতে পারবে।
আওয়ামী লীগ নেতারাই ৭ দফা চুক্তির মাধ্যমে এসব ব্যাপার নির্ধারিত করে দিয়েছিলেন। ওই ৭ দফা চুক্তি অনুযায়ীই ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের সর্বত্র চেয়ার দখল করে বসে। আর এজন্য ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশ সরকারের সদস্যদের ১৬ ডিসেম্বরের পরপরই কলকাতা থেকে বাংলাদেশে আসতে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ও অন্য কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেয়া হয় ২২ ডিসেম্বর। বিজয়ের পরপরই ভারতীয় বাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরে স্তূপীকৃত হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য, বিপুল পরিমাণ অটো মোবাইল, লোকোমোটিভ, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী, অলংকারপত্র, ৯৩ হাজার পাকিস্তানির অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ বর্তমান বাজার মূল্যে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সামগ্রী লুটে নিয়ে যায়।
হাসিনার প্রথম নিরাপদ আশ্রয়
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব নিহত হলে জার্মানিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় প্রদান করে। এটি ছিল হাসিনার প্রথম নিরাপদ আশ্রয়। সেখানে প্রায় পাঁচ বছর অবস্থান করে রাজনৈতিক পাঠ গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কল্যাণে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এর মাত্র দুই সপ্তাহ পরই প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করা হয়। ফলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়।
হাসিনার দ্বিতীয় নিরাপদ আশ্রয়
এবার দ্বিতীয় দফায় ভারত শেখ হাসিনার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হলো। চব্বিশের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে পলায়ন করে সেখানে তিনি আশ্রয় নিলেন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভারত তার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হওয়ার পেছনে কী বিরাট স্বার্থ নিহিত রয়েছে, তা চিন্তা করা কঠিন। বিশ্লেষকরা বলছেন, তার মানে ভারত সরকার সবই জানে এবং জেনেশুনেই হাসিনা ও তাঁর অনুগামীদের ভারতে অবস্থান এবং কার্যকলাপে অনুমতি দিয়েছে। যত দূর জানা যায়, হাসিনা রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আশ্রয় পেয়েছেন। তার মানে খানাপিনা, টেলিফোন বিল ও নিরাপত্তার জন্য খাই-খরচা সবই ভারত সরকারের। কোনো কোনো ভারতীয় রাজনীতিক প্রশ্ন তোলা শুরু করেছেন, এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা জেনেও ভারত ঠিক কোন কারণে হাসিনাকে ‘বধূর আদরে’ থাকতে দিচ্ছে। এ কথা অনেকেই বলেছেন, ক্ষমতা থেকে হাসিনার পতন ভারতের জন্য একটা বড় ধরনের কূটনৈতিক বিপর্যয়। প্রধানমন্ত্রী মোদি শেখ হাসিনাকে নিজের লোক মনে করে তাঁর পেছনে বিস্তর বিনিয়োগ করেছেন। সে বিনিয়োগের সুফলও পেয়েছেন। ‘ভারতের নিজের স্বার্থেই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে হবে’, যা তাদের কাছে একটা অবশ্যকর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি একা নন, আরো হাজার দুয়েক আওয়ামী নেতা-কর্মী নাকি রয়েছেন, যাঁরা বেশ আরামেই ভারতীয় আতিথ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ জিমে যাচ্ছেন, কেউ মাথায় নকল চুল বসাচ্ছেন, কেউ অনলাইন বৈঠকে যুক্ত হচ্ছেন।
ভারসাম্যহীন সম্পর্ক
‘আমরা ভারতকে যা দিয়েছি, ভারত আজীবন তা মনে রাখবে’- শেখ হাসিনার এ বক্তব্য বহুল আলোচিত। নিঃসন্দেহে এটি ভারসাম্যহীন সম্পর্ককেই নির্দেশ করে। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখলেও দেয়া-নেয়ার ভারসাম্যে এক ধরনের অসামঞ্জস্য সর্বদা বিরাজমান রয়ে গেছে। ১৯৭২ সালের মৈত্রী চুক্তি দিয়ে সম্পর্কের সূচনা হলেও দীর্ঘ ৫৪ বছরে বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার, বিদ্যুৎ আমদানির সুযোগ, জলপথ, সড়ক ও রেলপথ ব্যবহারের সুবিধা দিয়েছে। বাংলাদেশ দিয়েছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগের সুবিধা। ডিজেল পাইপলাইন, উপকূলীয় জাহাজ চলাচল, বিদ্যুৎ রপ্তানি, লাইন অব ক্রেডিট, সীমান্তহাট, বাণিজ্য চুক্তি- সবকিছুতেই ভারত পেয়েছে বাস্তব সুবিধা। আওয়ামী সরকার বরাবরই একচেটিয়া সুবিধা দিয়ে গেছে ভারতকে।
বিপরীতে বাংলাদেশ কী পেয়েছে? কিছু আর্থিক সহায়তা, সীমিত পণ্য প্রবেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং কিছু অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। তবে প্রতীক্ষিত তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি আজো হয়নি। ট্রানজিট থেকেও পায়নি তেমন আর্থিক সুবিধা। ঋণ সহায়তা দিলেও ভারতীয় পণ্য কেনা ও ভারতীয় ঠিকাদারদের কাজ দেয়ার শর্ত প্রকল্পের মান ও উপযোগিতা নিয়েও ছিল নানা প্রশ্ন। আর সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ককে অনেকটাই নাজুক করেছে। মোটাদাগে বলা যায়, ৫৪ বছরে ভারত কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভবান হয়েছে, আর বাংলাদেশ অপেক্ষা করছে প্রতিশ্রুত প্রতিদান ও ন্যায্য সুযোগের।
প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা?
এবার শেখ হাসিনার গদিচ্যুত হওয়ার ঘটনাকে যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না ভারত। তারা অনেকটাই ‘প্রতিশোধমূলক’ ব্যবস্থা অবলম্বনের পথ বেছে নিয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এরকম চোখে পড়ার মতো বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। যেমন- গত এপ্রিলে বন্দর ব্যবহার করে অন্য দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশকে দেয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। মে মাসে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও প্লাস্টিকসামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্যের স্থলবন্দর দিয়ে আমদানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয়ে ব্যাপক অপপ্রচার অব্য্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ‘ব্যর্থ’ বলে দেখানোর চেষ্টা করে চলেছে।
প্রভু ও দাসের সম্পর্কের অবসান জরুরি
বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা মনে করেন, দুটি দেশের সম্পর্ক হওয়া উচিত পরস্পরকে সম্মান করে সহযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারত চেয়েছে প্রভু এবং দাসের মতো সম্পর্ক। আর এজন্য পথ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। নিজেদের দলীয় স্বার্থে এবং আজীবন ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে তারা ভারতের কাছে মাথা বন্ধক রেখে নতজানু হয়ে থেকেছে। বর্তমান পরিবেশে এখন জাতি আশা করে এ মনোবৃত্তির অবসান হবে এবং বাংলাদেশ তার হারানো মর্যাদা ফিরে পাবে।