জিলহজ মাসের প্রথম দশকের আমল
২৯ মে ২০২৫ ১১:২০
॥ ওবায়েদ ইবনে গনি ॥
হিজরি সনের সর্বশেষ মাস জিলহজ; অর্থাৎ হজ ও কুরবানির মাস। ইসলামী শরিয়তে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ মাস এটি। কুরআনে কারীমের সূরা তাওবার ৩৬নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা যে চার মাসকে সম্মানিত বলে ঘোষণা করেছেন, মাহে জিলহজ তার অন্যতম। আল্লাহ তায়ালা কিছু মাস, দিন ও রাতকে ফজিলতপূর্ণ করেছেন। যেমন রমজান মাসকে অন্যসব মাসের ওপর মহিমান্বিত করেছেন। আরাফাতের দিন ও ঈদের দিনকে অন্যান্য দিনের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। কদরের রাতকে অন্যান্য রাতের চেয়ে মর্যাদামণ্ডিত করেছেন। চলতি জিলহজ মাস অনুরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মাস। যে মাসে হজ ও কুরবানি করা হয়ে থাকে। এ মাসের আমল ও ফজিলত সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও সহিহ হাদিসে বিস্তর আলোচনা এসেছে।
জিলহজের প্রথম দশকের গুরুত্ব : বরকতময় পবিত্র জিলহজ মাসের প্রথম দশকের আমলগুলো প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, আম বা সাধারণ ইবাদত। অর্থাৎ জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন বছরের অন্যান্য দিনের মতো সব নেক আমল করা। যেমন সালাত, সিয়াম (রোজা), দান-সাদাকাহ, তাসবীহ-তাহলীল, রাসূল (সা.)-এর প্রতি দরূদ পাঠ, পাপ থেকে তাওবা করা, কারো হক নষ্ট হলে তার কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়া ইত্যাদি; পাশাপাশি মুনকার বা মন্দ কাজ করা থেকে বিরত থাকা। দ্বিতীয়ত, খাস বা বিশেষ ইবাদত। জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের কিছু বিশেষ আমল রয়েছে। যেমন হজ পালন করা। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সামর্থ্যবান সব মুসলিমের ওপর হজ ফরজ।’ (সূরা আলে ইমরান : ৯৭)।
শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা এদিনগুলোর নামে শপথ করেছেন। তিনি বলেন, ‘শপথ ফজরের এবং ১০ রাতের।’ (সূরা ফজর : ১-২)। মুফাসসিরদের মতে, এখানে ফজর বলতে বিশেষভাবে জিলহজের ১০ তারিখের ফজর বোঝানো হয়েছে। আর যে ১০ রাতের শপথ করা হয়েছে, তা হলো জিলহজের প্রথম ১০ রাত। এ রাতগুলোর মর্যাদার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে জিলহজ মাসের প্রথম দশকের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই।’ (মুসনাদে আহমদ)।
জিলহজ মাসের প্রথম ৯ দিন রোজা রাখা উত্তম। নবী করিম (সা.) এদিনগুলোয় রোজা রাখতেন। (সুনানে আবু দাউদ)। ৯ দিন না পারলে এর মধ্যে যে কয়দিন সম্ভব হয় রোজা রাখলেও সওয়াব পাওয়া যাবে। বিশেষ করে ৯ তারিখ অর্থাৎ ঈদের আগের দিন অবশ্যই রোজা রাখার চেষ্টা করা। কেননা এ এক দিনের রোজার ফলে এক বছর আগের ও এক বছর পরের মোট দুই বছরের গুনাহ মাফ করে দেওয়ার কথা হাদিসে উল্লেখ আছে। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, ‘আমি আশা করি, আরাফাতের দিন অর্থাৎ জিলহজের ৯ তারিখের রোজার ফলে আল্লাহ তায়ালা এক বছর আগের ও এক বছর পরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। (সহিহ্ মুসলিম)।
জিলহজের প্রথম দশকে চুল-নখ না কাটা : জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার পর থেকে কুরবানির পশু জবাই করার আগ পর্যন্ত নখ, চুল, গোঁফ ও অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করা থেকে বিরত থাকা সওয়াবের কাজ। যাঁরা কুরবানি করবেন এবং যাঁরা সামর্থ্যরে অভাবে কুরবানি করবেন না, সবার জন্যই এ আমল করা উত্তম। তবে যে ব্যক্তি কুরবানি করবেন, তাঁর জন্য এ আমলটি তুলনামূলক অত্যধিক গুরুত্ব রাখে।
নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কুরবানি করার ইচ্ছে করবে, সে যেন জিলহজের নতুন চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানি করা পর্যন্ত তার চুল ও নখ না কাটে। (জামে তিরমিযী)। অন্য হাদিসে এসেছে- নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমাকে আজহার দিন (১০ জিলহজ) ঈদ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাকে আল্লাহ তায়ালা এ উম্মতের জন্য (ঈদ হিসেবে) নির্ধারণ করেছেন।’ এক ব্যক্তি তখন জানতে চাইলেন, ‘(যদি আমার কুরবানির পশু ক্রয়ের সামর্থ্য না থাকে), কিন্তু আমার কাছে এমন উট বা বকরি থাকে, যার দুধ পান করার জন্য বা মাল বহন করার জন্য তা প্রতিপালন করি- আমি কি তা কুরবানি করতে পারি?’ নবীজি বললেন, ‘না। বরং তুমি (ঈদের দিন) তোমার মাথার চুল, নখ ও গোঁফ কেটে ফেলো এবং নাভির নিচের চুল পরিষ্কার করো। এ-ই আল্লাহর নিকট তোমার কুরবানি।’ (সুনানে আবু দাউদ)। এমনকি সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈরাও এদিনগুলোয় শিশুদের চুল-নখ কাটা অপছন্দ করতেন। (মুসতাদরাকে হাকিম)।
বেশি বেশি তাকবির বলা: আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ও আবু হুরায়রা (রা.)-এর আমল ছিল- জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন তাঁরা তাকবির বলতে বলতে বাজারের দিকে যেতেন। তাঁদের এ আমল দেখে অন্যরাও তাকবির বলতেন। (সহিহ্ বুখারি)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা জিলহজের প্রথম দশকে অধিক পরিমাণে তাকবির (আল্লাহু আকবার), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এবং তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) পাঠ করো। (শুআবুল ইমান, তবারানি)।
তাকবিরে তাশরিক পাঠ : ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক বলা আবশ্যক। পুরুষ-নারী, মুকিম-মুসাফির সবার এ আমল করতে হবে। এমনকি ৯ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত কোনো নামাজ কাজা হয়ে গেলেÑ এ কাজা ওইদিনগুলোয় আদায় করলে সে কাজা নামাজের পরও তাকবিরে তাশরিক পড়বে। পুরুষরা তাকবির বলবে উচ্চৈঃস্বরে আর নারীরা নিম্নস্বরে। (ফাতাওয়া শামি)।
লেখক : সাংবাদিক।