‘মার্চ ফর গাজা’ : প্রমাণ হলো ঐক্যই শক্তি


১৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:৩৪

॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
গত ১২ এপ্রিল শনিবার সকাল ৯টায় যাচ্ছিলাম সাপ্তাহিক সোনার বাংলা অফিসে, শাহবাগ হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশ দিয়ে। তখনই দেখছিলাম মানুষের মিছিল ‘মার্চ ফর গাজা’ ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বাস-ট্রেন, নদীপথে মানুষের মিছিল মানবতাবিরোধী ইসরাইলের বিরুদ্ধে স্লোগানে স্লোগানে আকাশ-বাতাস কাঁপানো আওয়াজ ইসরাইলের ধ্বংস কামনা করে। এ যেন আবার ৫ আগস্টের মতো আরেক মহাবিপ্লবের ডাক। বেলা ১১টার পরপরই মগবাজার থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রওনা দিলাম কেন্দ্রের ফরহাদ ভাইকে নিয়ে। এখানেও মিছিল আর মিছিল। ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সবাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে। সবার মুখে- ধ্বংস হোক, নিপাত যাক, ইসরাইল, নেতানিয়াহু। গলায় জুতার মালা। অপূর্ব দৃশ্য। চোখের পানিও দেখা গেছে অনেকের চোখে। গাজার প্রান্তরে ছোট শিশু ও নারীর আর্তনাদের চিত্র মনে করে তাদের জন্য দোয়া করছিল মহান আল্লাহর কাছে।
আর্তনাদ করছিল দুনিয়ার ২০০ কোটি মুসলমান থাকতে ছোট দেশ ইসরাইলের মানবতাবিরোধী কাজে আমরা কেন বাধা দিতে পারছি না। ৫৭টি মুসলিম দেশের সংগঠন ওআইসি কেন জোরালো ভূমিকা নিতে পারছে না? জবাব ছাড়াই মিছিলে মিছিলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মানুষের মহাঢল। যেদিকেই তাকাই না কেন, মানুষ আর মানুষ। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল না।
মাইকে আওয়াজ আসছিল আজকে কোনো বক্তা বক্তৃতা দেবে না। শুধুমাত্র ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে আর বায়তুল মোকারমের খতিব আবদুল মালেক সাহেব লাখো জনতাকে নিয়ে মহান রবের কাছে হাত তুলে মোনাজাত করবেন। হে আল্লাহ! এ ইসরাইল রাষ্ট্রকে তুমি ধুলায় পরিণত করে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দাও। ফিলিস্তিনের আজাদী নিশ্চিত কর। শিশু ও নারী, পঙ্গু-আহত লোকদের গাজায় তুমি রহমত নাজিল কর। গোটা দুনিয়ার মানুষকে তুমি হেদায়েত দাও। মুসলিম উম্মাহর শাসকদের তুমি রুখে দাঁড়ানোর তাওফিক দাও। হে আল্লাহ! তুমিই আমাদের অভিভাবক। তুমিই আমাদের সাহায্যকারী। তাই তোমার শক্তির কাছে সব জালিম শক্তির পরাজয় হবেই। তুমি আমাদের গুনাহ মাফ করে দাও। আমাদের জালিমের জুলুম থেকে বাঁচার তাওফিক দাও। জালিমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি দাও। আমাদের দোয়া কবুল ও মঞ্জুর কর।
‘মার্চ ফর গাজা’ জনসমুদ্রে যোগ দিয়েছিল আগস্ট বিপ্লবের আহত-পঙ্গু ছাত্র-জনতা হুইলচেয়ারে বসে। আরো যোগ দিয়েছে শিশুদের রক্তমাখা কাপড়ে মোড়ানো প্রতীকী লাশ নিয়ে মায়েরা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশ কেন একখণ্ড ফিলিস্তিন উদ্ধারের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববিবেকের কাছে আর্তনাদ জানানো হয়েছে অনতিবিলম্বে অসম যুদ্ধ বন্ধ করে ফিলিস্তিন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করার দাবি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নেতানিয়াহুর বিচার করতে হবে। তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে গাজায় হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে। জাতিসংঘকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। দুনিয়ার সব মানবতাবাদী দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। গাজার এ নৃশংস ঘটনা মিডিয়ায় প্রচার করতে হবে। প্রকৃত ঘটনা জনসম্মুখে তুলে ধরে এর বিচারের আওতায় আনতে হবে।
শুরুতেই বলছিলাম ঐক্যই শক্তির উৎস। দীর্ঘদিন পর লাখ লাখ লোক ঢাকায় একত্রিত হলো কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়া। কোনো ধাক্কাধাক্কি নেই। আগে যাওয়ার প্রবণতা ছাড়াই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশ লোকে ভরপুর হয়ে গিয়েছিল। জাতীয় নেতৃবৃন্দ, আলেম সমাজ, মিডিয়া নেতৃবৃন্দ সবাই এককাতারে উঠেছিল এই ‘মার্চ ফর গাজা’ মঞ্চে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত আন্দোলন, হেফাজতে ইসলাম, এনসিপি, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ দেশের রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক ধর্মীয় দল, ক্রীড়া সংগঠনসহ আপামর জনতার এক মিলনমেলা ও প্রতিবাদ মেলা। অনুষ্ঠানটির আয়োজনে ছিল ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ নামে একটি অরাজনৈতিক মানবিক প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে। দল-মত নির্বিশেষে সব মতের লোকদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো এই ‘মার্চ ফর গার্জা’ অনুষ্ঠানটি। বাংলাদেশের মানুষ আগস্ট বিপ্লবের পর আবার প্রমাণ করল দেশের যেকোনো আপদ-বিপদে তা প্রতিহত করার জন্য জনতা এককাতারে দাঁড়িয়ে তা প্রতিহত করতে পারবে, ইনশাআল্লাহ। আমাদের ২০ কোটি মানুষের ৪০ কোটি হাত দেশের শত্রুদের জন্য একসাথে গর্জে উঠবে। কোনো গোষ্ঠী বা দেশ আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের দিকে বাঁকা চোখে তাকাতে সাহস করবে না। আমরা ঐক্যবদ্ধ জাতি। ছিটেফোঁটা কিছু লোক ছাড়া।
মানুষ মানুষর জন্য। ‘মার্চ ফর গাজা’ অনুষ্ঠানে আবারো প্রমাণ হলো। ১০ জায়গায় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য ক্যাম্প স্থাপন করে আহত রোগীদের জরুরি সেবা দিয়েছে ১০টি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। যেমনÑ ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) ব্যবস্থাপনায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল কমিউনিটি, মেডিকেল দাওয়াহ সোসাইটি, রিদম, ডক্টরস ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস, ইবনে সিনা হাসপাতাল, আকিজ- মনোয়ারা ট্রাস্টের সহযোগিতায় পরিচালিত হয় ১০টি মেডিকেল বুথ এবং ১০টি এম্বুলেন্স সার্ভিস।
সড়কে সড়কে পানি, শরবত সরবরাহ করেছে স্বেচ্ছাসেবী ভাই-বোনরা। এ এক অপূর্ব দৃশ্য। বাংলাদেশের মানুষ অতিথিপরায়ণ, তা এ অনুষ্ঠানে বাস্তবে প্রমাণ হলো। মহান আল্লাহ আমাদের এ ছোট দেশটিকে জনকল্যাণ ও ইসলামের আলোকে সুখী-সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার শক্তি দান করুন।
পুরানা পল্টন, প্রেস ক্লাব, মগবাজার, শান্তিনগর, কাকরাইল, এলিফ্যান্ট রোড, পুরান ঢাকা, আজিমপুর ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্ক চত্বর সব জায়গায় সাহায্যকারীরা ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে-গলায় পরে ছাত্র-জনতাকে গাইড করে সভাস্থলে আসার দিকনির্দেশনা দিয়ে অভূতপূর্ব কাজ করেছে। কয়েক কিলোমিটারব্যাপী জনতার ঢল, কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলার আলামত লক্ষ করা যায়নি। আমি যেহেতু দীর্ঘদিনের মাঠের কর্মী। তাই আমার পদচারণা প্রায় সব জায়গায়ই চোখে পড়েছে। এ এক অপূর্ব দৃশ্য।
জোহর, আসর নামাজ পাশের মসজিদ ও যত্রতত্র জায়গায় পড়ার সুযোগ ছিল। এখানেও এক অনন্য দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে। খাবার পানি ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় ছোট-খাটো নাশতার দোকান ছিল। তাদের প্রয়োজনে এ দোকানগুলো ভালো সার্ভিস দিয়েছে। চা-কফির সরবরাহ কম ছিল না।
সব মিলিয়ে ‘মার্চ ফর গাজা’ আয়োজনে প্রমাণ হয়েছে গাজাবাসীর জন্য বাংলাদেশিদের দরদ, ভালোবাসা আসলে লোকদেখানো নয়। মনের তাগাদা থেকেই মহান আল্লাহর রহমতে বাংলাদেশের মানুষের মানবিক দিক ফুটে উঠেছে। এ থেকে প্রমাণ হয়, আমরা পারব আমাদের দেশটিকে আদর্শ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে। দেশের মানুষ ঐক্য চায়। ভালো লোকের বসবাস চায়। সকল প্রকার চাঁদাবাজ, দুর্নীতিমুক্ত জনদরদিদের সমন্বয়ে ভালো দেশ উপহার দিতে চায়। জবাবদিহিমূলক নেতার নেতৃত্বে দেশ চালাতে পারলে বাংলাদেশকে পৃথিবীর মধ্যে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র বানাতে আমরাই পারব, ইনশাআল্লাহ।
বর্তমানে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন পূর্বে প্রায় ৫০টি দেশের ইনভেস্টররা এসে দেখে গেছে, এদেশে টাকা বিনিয়োগের পরিবেশ আছে। জনগণের স্বত্বঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশে দেশে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব। জায়গা-জমিন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, পানি সরবরাহসহ সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য প্রাপ্তি। চাই শুধু দুর্নীতিমুক্ত নেতার সমন্বয়। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির ইতোমধ্যেই দেশে ও বিদেশে সৎ লোকের সমন্বয় রেখে নাসা থেকে শুরু করে দেশে দেশে তারা সততার সাথে কাজ করে দেশের মান-ইজ্জত সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছে। আমরা দেশে গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে শহর-বন্দর, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদরাসা, এতিমখানা, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক-বীমা কোম্পানি করে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে, আমরা সততা ও দক্ষতার সাথে কাজ করে দেশদরদির এক প্রতিচ্ছবি গড়ে তুলতে সক্ষম।
আগামীতেও দেশ গঠনের সব ক্ষেত্রে আমাদের সৎ, যোগ্য, দায়িত্বশীল লোক পারবে উন্নত দেশ গঠন করতে। আমরা শুধু জনগণের কাছেই জবাবদিহির ভয় পাই না। কাল কিয়ামতে আল্লাহর কাছেও জবাবদিহির ভয় আমাদের মধ্যে কাজ করে। জবাবদিহিমূলক লোক তৈরি করতে পারলে তারা ব্যাংক ডাকাতি, ফাঁকিবাজি, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করবে না। দেশের মাটি-মানুষের জন্য তারা নিবেদিতভাবে কাজ করবে। দেশ উন্নতির শিখরে নেয়ার পরিকল্পনা আমাদের আছে। আমরা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র গঠনে সততার নজির স্থাপন করে দেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।
ইতোমধ্যেই বিদেশি মিডিয়ায় ‘মার্চ ফর গাজা’ ঢাকার খবর প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন বার্তা সংস্থা এপিতে প্রকাশিত হয়েছে, ঢাকায় ইসরাইলবিরোধী হাজার হাজার লোক মিলিত হয়ে নেতানিয়াহুর গলায় জুতা ঝুলিয়ে মিছিল করেছে। ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট ইউকে বাংলাদেশের রাজধানীতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে লাখো মানুষের বিক্ষোভ। সৌদি আরবের ‘আরব নিউজে’ ১০ লাখ লোকের সমাবেশে ইসরাইলের প্রতি ঘৃণা ও তাদের পণ্য বর্জনের ঘোষণা বড় করে প্রচার করে। ওয়াশিংটন পোস্টে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিক্ষোভের খবর প্রচার করে এবং লাখো লোক মিছিল করে এবং প্যালেস্টাইনের পক্ষে স্লোগান দেয়।
‘মার্চ ফর গাজার’ ঘোষণাপত্র পড়ে শোনান দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
প্রথম দাবি ছিল, গাজায় প্রতিদিনের গণহত্যার বিচার, জাতিসংঘের ব্যর্থতা এবং এর প্রতিকার।
দ্বিতীয়ত, মুসলিম নেতাদের প্রতি দাবি অবৈধ ইসরাইলের বিরুদ্ধে বাস্তব পদক্ষেপের এবং মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল আকসাকে মুক্ত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশের পাসপোর্টে ‘except Israel’ শব্দ পুনঃলিখন। (ইতোমধ্যে এ দাবি সরকার মেনে নিয়েছে)।
চতুর্থত, ইসরাইলের দোসর মোদি সরকারের ইসলামবিরোধী ওয়াকফ সম্পত্তি আইন বাতিলের বিরুদ্ধে ওআইসিকে যথাযথ ভূমিকা নেয়া।
পঞ্চমত, ইসরাইল ও তাদের দোসরদের পণ্য সর্বাত্মক বর্জন করার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
সব শেষে গাজার লোকদের সাহস জোগানোর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা এবং ইসরাইল ও তাদের ইসলামবিরোধী সকল ষড়যন্ত্র রুখে দেয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য চেয়ে সভা সমাপ্ত হয়।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল : [email protected]