মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে বাংলাদেশ

সঠিক পথে পররাষ্ট্রনীতি


৬ মার্চ ২০২৫ ১১:২৭

॥ জামশেদ মেহ্দী ॥
৮ মার্চ শনিবার, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের ৭ মাস পূর্ণ হবে। এ ৭ মাসে সরকারের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন নীতি নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি কী, সেটি অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ড. ইউনূস এ পর্যন্ত খোলামেলা কোনো কথা বলেননি। তার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন কয়েকবার বিদেশ সফর করতে গিয়ে যেসব কথা বলেছেন, সেখান থেকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে কিছুটা আঁচ পাওয়া গেলেও বিষয়টি সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, অনেক শিক্ষিত-সচেতন মানুষের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ভারত সম্পর্কে এ সরকারের নীতি অনেকটা স্পষ্ট। সে সম্পর্কে পরে আসছি।
বিদেশনীতি সম্পর্কে ড. ইউনূসের ধ্যান-ধারণা বা চিন্তাধারা ধোঁয়াশার মধ্যে থাকলেও বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে প্যারিসে অবস্থানকালে তার একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে বিমানে ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তে সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, ভারত সরকার বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিতাড়ন নিয়ে নাখোশ বলেই মনে হয়। অনেকে আশঙ্কা করছেন যে, ভারত নতুন সরকারকে ডিস্ট্যাবিলাইজ করবে বলে মনে হচ্ছে। উত্তরে তিনি বলেন যে, যদি বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চেষ্টা করা হয়, তাহলে উত্তর-পূর্ব ভারতেও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হবে। তার পরিণতিতে সেই অশান্তি প্রতিবেশী মিয়ানমারেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এরপর এ সম্পর্কে আর কোনো কথা হয়নি।
ড. ইউনূস মূলত একজন অর্থনীতিবিদ। সারা জীবন তিনি অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেছেন। ১২-১৪ বছর আগে আমার সংরক্ষিত পেপার কাটিং ফাইল ঘেঁটে দেখলাম, তিনি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা তথা সার্কের একজন ভোকাল প্রবক্তা। বিগত ৭ মাসে তিনি ২-৩ বার বলেছেন যে, সার্ককে শক্তিশালী করা দরকার। এ ব্যাপারে তাকে বলা হয় যে, সার্ক তো উঠে দাঁড়াতে পারেনি ভারতের কারণে। সার্ক মুখ থুবড়ে পড়েছে। তারও কারণ হলো- পাকিস্তান ও ভারতের চিরবৈরিতা। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এ ব্যাপারে বলেন যে, তিনি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবেন। তিনি কতদূর চেষ্টা করেছেন এবং সে চেষ্টা কতদূর ফলবতি হয়েছে, সেটি আমরা জানি না। তবে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ভারত কোনোদিন চায়নি যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হোক। আর ভারতের এ ইচ্ছা পূরণ করার জন্য হাসিনা তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব করেছেন। বস্তুত বিগত ১৫ বছরে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের নামকাওয়াস্তে সম্পর্ক থাকলেও দুটি দেশ বিগত ১৫ বছরে ভারতের ইচ্ছা অনুযায়ী মুখ দেখাদেখিও বন্ধ করে দেয়।
সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ড. ইউনূসের সাথে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেছেন। এ বৈঠক হয়েছে অত্যন্ত হৃদ্যতামূলক পরিবেশে। পাকিস্তানের সাথে সীমিত পরিমাণে হলেও আমদানি-রপ্তানি শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসেছে। বাংলাদেশের একটি সামরিক প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সফর করেছে। তুরস্ক ও পাকিস্তান থেকে যুদ্ধাস্ত্র ক্রয় করার আলাপ-আলোচনা চলছে। বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে অনেকগুলোর মধ্যে এটিও একটি টার্নিং পয়েন্ট। তবে সার্কের ব্যাপারে ইঞ্চি পরিমাণ অগ্রগতিও হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে হবে বলেও মনে হয় না।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক বা কৌশলগত কারণে। দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে কানেক্টিং পয়েন্ট হলো বাংলাদেশ। ড. ইউনূসের সরকার এখন চেষ্টা করছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা। মালয়েশিয়ার সাথে সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে। পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইন্দোনেশিয়াও বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করায় আগ্রহী। সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডও এখন বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়।
বাংলাদেশের অভিন্ন সীমান্তবর্তী দেশ হলো মিয়ানমার। বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছেন। তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নাই। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ বা প্রদেশ যাই বলুন না কেন, সেটি হলো সাবেক আরাকান এবং বর্তমানের রাখাইন প্রদেশ। গৃহযুদ্ধরত মিয়ানমারে আরাকান আর্মি প্রায় গোটা রাখাইন প্রদেশটি দখল করেছে। রাজধানী সিত্তের দখল নিয়ে এখন লড়াই চলছে। এ রাখাইন প্রদেশ বাংলাদেশের ফরেন এবং স্ট্র্যাটেজিক পলিসি নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বের দাবিদার। কারণ রাখাইন প্রদেশের বাসিন্দাদের সাথে আমাদের চট্টগ্রামের মানুষের বহু দিক দিয়ে মিল আছে। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমার আসার পথ ঐ রাখাইন। প্রায় দেড় বছর আগে বাংলাদেশের কয়েকজন বুদ্ধিজীবী তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল যে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সাথে বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলুক, তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তাই বলে রাখাইন বা আরাকান প্রদেশকেও অবহেলা করা যাবে না। আরাকান আর্মির সাথে গোপনে সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে।
হাসিনার সরকার বুদ্ধিজীবীদের এ পরামর্শে কর্ণপাত করেনি। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে এ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। ড. ইউনূসের একজন উপদেষ্ট বলেছেন যে, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবসময় সব কথা বলা যায় না। কিছু কথা বলা যায় আর কিছু কথা পর্দার অন্তরালে বলতে হয়। এসব কথা বাইরে বলা যায় না। ঐ উপদেষ্টা বলেছেন, আমরাও আরাকান আর্মির সাথে সঙ্গোপনে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছি। শুধু এতটুকুই আপনাদের কাছে প্রকাশ করছি। বিস্তারিত বলা যাবে না। শিক্ষিত-সচেতন সমাজ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। যাক আরাকান আর্মির সাথে গোপনে হলেও তো কথা চলছে। আরাকান যদি স্বাধীন হয়, তাহলে এ গোপন কথা কাজে লাগবে। আমরা এখানে শুধু এটুকু বলতে পারি যে, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম যেমন ভারত সংলগ্ন, তেমনি আরাকান বা রাখাইনও ভারত সংলগ্ন। বাংলাদেশ বিশেষভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন। অনুরূপভাবে আরাকানও উত্তর-পূর্ব ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন। বিষয়টিকে একত্র করলে এই দাঁড়ায় যে, উত্তর-পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ এবং রাখাইন বা আরাকান সকলেই একে অপরের সন্নিহিত অঞ্চল। এ পটভূমিতে ড. ইউনূস যখন বলেন, বাংলাদেশকে ডিস্ট্যাবিলাইজ করলে অন্যান্য অঞ্চলও ডিস্ট্যাবিলাইজড হবে, তখন উত্তর-পূর্ব ভারত এবং আরাকান তার উক্তির মধ্যে উহ্য থাকে।
এবার আসছি বড় তিনটি শক্তির সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে। এ বড় তিনটি দেশ হলোÑ আমেরিকা, চীন এবং ভারত। রাশিয়ার নাম এখানে নিলাম না। কারণ রাশিয়া বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে। আর তাছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া রাশিয়ার সাথে আর কোনো রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক নাই। শেখ মুজিব যে সাড়ে তিন বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন রাশিয়ার নিকট থেকে এক স্কোয়াড্রন অর্থাৎ ১২টি মিগ-২৯ জঙ্গিবিমান কিনেছিলেন। এরপর রাশিয়ার সাথে আর কোনো সামরিক দেনদরবারের কথা শোনা যায়নি। তবে ঐ ১২টি মিগ-২৯ জঙ্গিবিমান এখন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বলে জানা যায়।
সকলে বলেন, আমেরিকার সাথে ড. ইউনূসের নাকি সম্পর্ক ভালো। কথাটি আংশিক সত্য। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন এবং তার পত্নী সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টনের সাথে ড. ইউনূসের রীতিমতো পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। সেই সুবাদে তাদের উত্তরসূরি বারাক ওবামা এবং জো বাইডেনের প্রশাসনের সাথেও ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প বা রিপাবলিকান পার্টির সাথে ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠতার কোনো খবর পাওয়া যায়নি। পত্রপত্রিকায় বলা হয়েছিল যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে নাকি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত দোস্তি রয়েছে। ভারতের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া বড় আশা করেছিল যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে ট্রাম্প-মোদির দোস্তির সুবাদে বাংলাদেশকে শায়েস্তা করা হবে।
ট্রাম্প তো প্রেসিডেন্ট হলেন। ভারতীয় গণমাধ্যমও খুব বগল বাজালো। যথারীতি ট্রাম্প ও মোদির বৈঠকও হলো। কিন্তু ফলাফল? বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। তাদের মিটিংয়ের আগে ঢক্কানিনাদে প্রচার করা হয়েছিল যে, জো বাইডেনের সরকার নাকি মার্কিন ডিপ স্টেটের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারকে ফেলে দিয়েছে। তাকে সহযোগিতা করেছে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী আইএসআই। ইউনূস এসে বাংলাদেশকে ইসলামী জঙ্গি রাষ্ট্র বানিয়েছেন। এবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউনূসের সরকারকে ফেলে দেবেন। সত্যি কথা বলতে কী, যারা রাজনীতি কিছুটা বোঝেন, যারা মার্কিন রাজনীতির ইতিহাস পড়েছেন, তারা এ আওয়ামী এবং ভারতীয় উল্লাসে মোটেই কর্ণপাত করেননি। দিন শেষে দেখা গেল, ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে অনেকটা সেই, ‘ভিক্ষা চাই না, কুত্তা সামলাও’ এর মতো। বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত তার উদ্বেগের কথা মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জানান। আর এক সাংবাদিক বলেন, মার্কিন ডিপ স্টেট শেখ হাসিনাকে ফেলে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দৃঢ়ভাবে সেই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি আরো বলেন, এসব ব্যাপারে ভারতের রয়েছে পুরনো অভিজ্ঞতা। ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারত এসব করে আসছে। তিনি (ট্রাম্প) ভারতের এ ইতিহাস পড়া শুরু করেছেন মাত্র। মোটকথা হলো, ড. ইউনূসের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো, বাংলাদেশের ওপর থেকে ভারতীয় প্রভুত্বের জগদ্দল পাথর অপসারণ।
এবার আসছি চীনের কথায়। অনেকে ড. ইউনূসকে প্রো-আমেরিকান বললেও তার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা কিন্তু অফিসিয়ালি সর্বপ্রথম সফর করেছেন চীন। চীনও বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সাহায্য দেওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া। কিন্তু ড. ইউনূস চায়নার উদার সাহায্যের ঝাঁপিতে ঝাঁপিয়ে পড়েননি। তিনি বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন। আপাতত তিনি আমেরিকা ও চীনের মধ্যে সমদূরত্ব বা Equidistance বজায় রাখছেন।
ভারতের কথা আর কী বলব? ড. ইউনূসের ৭ মাসের কূটনীতি ভারতকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, শুধুমাত্র বাংলাদেশেরই যে ভারতকে দরকার তাই নয়, ভারতেরও দরকার বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ ছাড়া তাদের হাসপাতাল ল্যাংড়া, হোটেল ব্যবসায় লালবাতি, পর্যটন পর্যুদস্ত। শেখ হাসিনা ভারতকেই বাংলাদেশের আমদানির একমাত্র উৎস করেছিলেন। কিন্তু এ সরকার সেই আমদানির উৎসকে উরাবৎংরভু করেছেন বা একাধিক উৎস আবিষ্কার করেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সঠিক পথেই চলছে।