অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও রাসূল (সা.)


২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:৫৫

॥ মনসুর আহমদ ॥
‘ত্যাগনৈকেন অমৃতত্ত্ব মানশু’ : একমাত্র ত্যাগের দ্বারাই অমৃতত্ত্ব লাভ করা যায়Ñ এ মহাবাক্য ভারতবর্ষের সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের সকল মনীষীই গ্রহণ করেছিলেন তাদের জীবনে, প্রচার করেছিলেন মানবসমাজে। আমরা দেখি লুম্বিনী উদ্যানের গৌতম বুদ্ধকে রাজ্য, পিতা, নবজাত পুত্র ও সুন্দরী যুবতী স্ত্রীকে ত্যাগ করে সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করতে, রাম চন্দ্রকে দেখেছি অযোধ্যা রাজ্যের ন্যায্য অধিকার ছেড়ে বনবাস জীবন গ্রহণ করতে, চৈতন্য দেবকে দেখেছি ত্যাগের দোহাই দিয়ে এক দল নেড়ানেড়ী সৃষ্টি করতে। ত্যাগের মহত্ত কথা মুসলিম সমাজে বিকৃত রূপে প্রচলিত হয়ে আসছে ওদের মতো বহু যুগ ধরে। তাই তো দরিদ্রতার জীবনকে অনেকে গৌরবমণ্ডিত জীবন মনে করে থাকেন। এ চিন্তাধারা মুসলিম সমাজের কত যে গভীরে প্রবেশ করেছে, তা সহজেই অনুমেয় নজরুলের লেখা থেকে। দারিদ্র্যের জয়গান গেয়ে কবি লিখেছেন-
“হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান।
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিষ্টের সম্মান
কণ্টক- মুকুট শোভা!”
কবিরা কল্পনাজগতের সাত আসমান হাতড়িয়ে অনেক গ্রহ উপগ্রহের সন্ধান খুঁজে পান, যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। কবি দারিদ্র্যের মাঝে যে গৌরব খুঁজে পান, তা সাধারণ মানুষের সম্পদ নয়। হিন্দু-বৌদ্ধ দর্শনের ত্যাগবাদ মুসলিম জীবনের ভাগ্যাকাশে সংসারত্যাগী সুফিবাদের কুহেলিকা রূপে জুড়ে রয়েছে, ফলে মুসলিম সমাজ সম্পদ বৃদ্ধি ও ভোগের ব্যাপারে কিছুটা যেন অনীহা প্রদর্শন করছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, কেউ উপযোগবাদ আবার কেউ ভোগবাদের নামে পৃথিবীটাকে শোষণ করে চলছে আবার কেউ বা ত্যাগবাদের নামে সমাজ-সংস্কৃতি থেকে পালিয়ে দায়িত্বহীন সন্ন্যাসবাদের অন্তরালে জাতিকে ঠেলে দেবার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, যা একটি জাতির জন্য মরণ হুমকিস্বরূপ।
একটি চলিষ্ণু ও বর্ধিষ্ণু জাতির জন্য গতিশীল অর্থনীতি অতীব প্রয়োজনীয় উপাদান। জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে কার্ল মার্কসের মতে, একমাত্র অর্র্থনীতির শাসন নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। কথাটি আসলে সঠিক না হলেও একটি জাতির উন্নতির জন্য যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একটি মৌলিক বিষয়, তা অস্বীকার করা যায় না। একবিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক রেনেসাঁর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অতীত ইতিহাসের পানে তাকিয়ে দেখতে পাই যে, মানবসমাজের প্রয়োজনীয় কল্যাণমুখী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সার্থক রূপকার ছিলেন মরুর দুলাল হজরত মুহাম্মদ (সা.), তিনি ছিলেন মহাকালের শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ। রাসূলকে উদ্দেশ্য করে এরশাদ হচ্ছে, “… তিনি (রাসূল সা.) তাদেরকে নির্দেশ দেন সৎ কর্মের, বারণ করেন পাপ কাজ থেকে, তাদের জন্য যাবতীয় পাক জিনিস হালাল ঘোষণা করেন এবং নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তুসমূহ।” (আরাফ : ১৫৭)।
এ সংঘাতময় পৃথিবীতে একটি সুন্দর প্রজাতি হিসেবে টিকে থাকার জন্য মানুষের প্রয়োজন সম্পদকে কল্যাণময় খাতে বিনিয়োগ, সুন্দর পন্থায় ভোগ; বিনিয়োগ ও ভোগের অনুপ্রেরণা ব্যতীত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুযোগ থাকে না। ফলে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা হেতু একটি জাতি তার প্রাণরস নষ্ট করে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। পৃথিবীকে সরস উদ্যানে পরিণত করার প্রয়াসে মানুষকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে এ ধরণীর সম্পদ সুধা সুন্দর উপায়ে ভোগ, ত্যাগ ও বিনিয়োগর জন্য। এরশাদ হচ্ছে, “আল্লাহ যা দিয়েছেন, তা থেকে পরকালের ঘর খুঁজে নাও এবং দুনিয়ার হিসাবকে (নিজের সাংসারিক প্রয়োজন) ভুল না এবং আল্লাহ তোমাদের প্রতি যেরূপ অনুগ্রহ করেন তোমরাও অনুরূপ অনুগ্রহ প্রদর্শন কর।” ( কাসাস : ৭৭)।
ইসলাম এসেছে মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ সাধন করে তাকে পূর্ণতার চরম শীর্ষে পৌঁছে দিতে। মানবের মানবিক গুণাবলির পূর্ণতা ও শ্রেষ্ঠত্ব আসতে পারে মানব সমাজে জিন্দেগি কাটানের মধ্য দিয়ে। সমাজে বসবাস করতে হলে প্রয়োজন হয় পরস্পরের প্রতি পরস্পরের নির্ভরতা। এ নির্ভরতার বিভিন্ন উপাদানের মধে অর্থনৈতিক সম্পর্ক একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জীবনের কল্যাণ সাধন সমাজের মঙ্গল সৃষ্টিই ইসলামী অর্থনীতির মূল কথা। নিজের জীবনের কল্যাণ সাধনের জন্য চাই সাধারণভাবে মানুষের কল্যাণ সাধন। তাই অর্থনৈতিক উন্নতি ও তার সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের কল্যাণ সাধনের পরামর্শ দিয়ে থাকে ইসলাম। ‘উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম’Ñ রাসূলের এ কথাটির মধ্যে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা অর্জন ও মানুষের কল্যাণে তা প্রয়োগের শিক্ষা আমরা খুঁজে পাই।
ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ৫টি স্তম্ভের মধ্যে ২টি স্তম্ভ হজ ও জাকাত সরাসরি মুসলিম সমাজকে আর্থিক সচ্ছলতা অর্জন ও ধনের প্রবৃদ্ধির উৎসাহ প্রদান করে। ইসলামে ইবাদতের অধিকাংশই অর্থনীতিকে ঘিরে সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন হজ, জাকাত, সদকা, জিহাদ, কর্জে হাসানা, সৎ ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ সামাজিক কল্যাণ সাধন করে নিজের ঐহিক উন্নতির সাথে সাথে অর্জন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি। এসব পুণ্যের বিধান ইঙ্গিত দেয় মুসলিমে জীবনে অর্থনৈতিক সচ্ছলতার প্রয়োজনীয়তার।
পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় একটি কথা আছে ঈড়হংঁসবৎ রং ঃযব শরহম. ভোগই অর্থনীতির রাজত্ব শাসন করে। অর্থাৎ ভোগ থেকে আসে চাহিদা, আর চাহিদা থেকে আসে উৎপাদনের উদ্যোগ। এ ব্যবস্থায় ত্যাগের কোনো কথা নেই। কিন্তু ইসলামের অর্থব্যবস্থায় নিজের ভোগের সাথে অন্যকেও ভোগের সুযোগ প্রদানের জন্য ত্যাগের অনুপ্রেরণা জোগায়। এ ত্যাগ ও ভোগের ইচ্ছাই আর্থিক উন্নতির অনুপ্রেরণা দিয়ে মুসলিম সমাজকে কঠোর প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হতে বলে। কুরআনের ঘোষণা- “লাইসা লিল ইনসানে ইল্লা মাসায়া”-মানুষ তার প্রচেষ্টা অনুযায়ী ফল পাবে। অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে, “ইন্নাল্লাহা লা ইউগাইয়েরু মাবি কমিন হাত্তা ইউগাইয়েরু মাবি আনফুসিহীম”Ñ আল্লাহ কখনোই কোনো জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ তারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা পরিবর্তন না করে। এভাবে শ্রম, প্রয়াস ও উদ্যোগের উৎসাহ প্রদান করে ইসলাম একটি কর্মতৎপর জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এর বিপরীতে যারা মনে করেন দারিদ্র্য মুসলিম জীবনের অলংকার তারা ইসলামের জীবন দর্শন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী নন। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামদের জিন্দেগির দিকে ইঙ্গিত করে যারা প্রচার করেন দারিদ্র্যই মুসলিম সমাজের সৌন্দর্য কাম্য তারা হয়তো ভুলে যান ইসলামী আন্দোলনের গোড়ার ইতিহাস। ইসলামকে জীবনবিধান হিসেবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাদের হিজরত করতে হয়েছে, দিতে হয়েছে প্রচুর জান ও মালের কুরবানি। ইসলামী আন্দোলনের এ ব্যস্ততম লগ্নে কারও পক্ষে ব্যক্তি জীবনে অর্থনৈতিক উন্নতি স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টির সুযোগ ঘটেনি। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে যে রাষ্ট্র সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে দারিদ্র্য ঘুচে সম্পদের প্রাচুর্য এসেছিল। দুনিয়া ঐ সমাজের দিকে তাকিয়ে ছিল আগ্রহ ভরে ইতিহাস তার সাক্ষী। শুধু সে কালেই নয়, এ কালেও যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জীবনকে বাজি রেখে ছুটে চলেছেন তাদের বা সময় কই ব্যক্তি জীবনে আর্থিক সচ্ছলতা সৃষ্টির। তাই বলে মুসলিম জীবনে অর্র্থনৈতিক সচ্ছলতার প্রয়োজন নেই এ ভাবনা ত্রুটিপূর্ণ। এ ধরনের ত্রুটিপূর্র্ণ চিন্তাধারা একটি জাতিকে কর্মবিমুখ করে ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে।
ধ্বংস নয়, বরং সৃষ্টির উল্লাসে যোগ দিতে আহ্বান জানায় ইসলাম। রাসূল (সা.)-এর পবিত্র জীবনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই তিনি একটি কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি আর্থিক সচ্ছল জাতির কামনা করতেন। রাসূল (সা.) অর্থ ব্যবস্থাকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করে জীবন থেকে দারিদ্র্যের মূলোৎপাটনের শিক্ষা দিয়েছেন তাঁর প্রিয় অনুসারীদের। এ কথার প্রমাণ মেলে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিভিন্ন প্রার্থনার মধ্যে। তিনি রবের দরবারে প্রার্থনা করতেন, “আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল কাস্ওয়াতে, ওয়াল গাফ্লাতে অজ্জিল্লাতে ওয়াল মাস্কানাতেÑ হে আল্লাহ! আমি আপনার দরবারে অন্তরের পাষণ্ডতা, গাফিলতি অবমাননা ও অভাব অভিযোগ হতে, আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” এ দোয়ার মাধ্যমে রাসূল বলে দিচ্ছেন, মুসলিম সমাজ হওয়া উচিত অভাবমুক্ত সচ্ছল সমাজ।
সঞ্চয় বাড়ানো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম উপাদান। এজন্য প্রয়োজন সমাজ থেকে দুষ্কর্ম, অপব্যয় ও অদক্ষতা কমান। দক্ষতা, সচেতনতা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করা সম্ভব। অক্ষমতা, অলসতা ব্যক্তি জীবনকে যেমন করে পরনির্ভরশীল পরমুখাপেক্ষী, তেমনি একটি জাতিকে করে দেয় পঙ্গু। জাতির পঙ্গুত্ব ঘোচাতে পথের সন্ধান দিয়েছেন রাসূল (সা.) বিশ্বের মানুষকে তার দোয়ার মাধ্যমে। তিনি আল্লাহর কাছে মোনাজাতে বলতেন, “হে আল্লাহ! আমি চিন্তা ও উদ্বেগ, অক্ষমতা ও অলসতা, কৃপণতা ও ভীরুতা, ঋণের গুরুভার ও পরাজয়ের গ্লানি হতে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।”
একটি জাতির সচেতনতা ফিরিয়ে আনতে এ মোনাজাতের প্রতি লক্ষ প্রদান যথেষ্ট। জাতির কল্যাণ ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা যেভাবে কাজ করছে, তার মূল সূত্র ইসলামী অর্থনৈতিক দর্শনে গোড়ার দিক ধেকে বিদ্যমান ছিল। ঋণ দান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পদ্ধতিতে বর্তমান ইসলামী ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। এসব কাজের মাধ্যমে জাতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে থাকে। এগুলো সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) বেশ উৎসাহব্যঞ্জক কথা শুনিয়েছেন পৃথিবীর মানুষকে। আল্লাহ ঋণ প্রদান সম্পর্কে বেশ উৎসাহব্যঞ্জক কথা শুনাচ্ছেন মানুষকে। এরশাদ হচ্ছে, “কে আছে যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেবে? তাহলে তিনি তাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেবেন এবং এ কারণে তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার।”
এই ঋণ হলো সুদবিহীন ঋণ, সুদবিহীন ঋণের মাধ্যমে দরিদ্র অভাবী লোকদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে দারিদ্র্যের বোঝা হলকা করা সম্ভব। দুর্দশাগ্রস্তদের লেনদেনের ব্যাপারে অবকাশ প্রদানকে উন্নতমানের কাজ বলে আখ্যায়িত করে রাসূল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি দুর্দশাগ্রস্তকে অবকাশ দিল অথবা তার নিজের অধিকার ও দাবি প্রত্যাহার করলো, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন কঠিন অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি দেবেন।” (মুসলিম)।
প্রত্যেক জাতির অর্থনেতিক উন্নতির জন্য মূল উপাদান ব্যবসা। ব্যবসাকে উৎসাহিত করে কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, “আল্লাহ ব্যবসা বাণিজ্যকে করেছেন হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম।”
একটি জাতির উন্নতির জন্য প্রয়োজন একটি সৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। সৎপন্থী ব্যবসায়ীদের মর্যাদা তুলে ধরতে রাসূল (সা.) ফরমান, “সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীরা হাশরের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদগণের সাথে অবস্থান করবে।” একটি জাতির উন্নতির জন্য এর চেয়ে বড় আশাব্যঞ্জক বাণী আর কোন যুগে কোন মনীষী শুনিয়েছেন বলে জানা নেই।
বিনিয়োগের ব্যাপারে মানুষকে প্রচুর তাগিদ প্রদান করেছে ইসলাম। অর্থ গচ্ছিতকরণকে ইসলাম অপছন্দ করে। জনগণের কল্যাণে বিনিয়োগকে ইসলাম উৎসাহিত করে। আল্লাহ বলেন, “যারা স্বর্ণ-রৌপ্য মজুদ রাখে এবং আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে না, তাদেরকে কঠোর আজাবের খবর দিন।” (তাওবা : ৩৪)। আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার কথার মধ্যে জনগণের কল্যাণমূলক সব ধরনের কাজই বোঝায়। এভাবে খাদ্যদ্রব্য মজুদকারীকে রাসূল (সা.) কঠোর ভাষায় নিরুৎসাহিত করেছেন। অধিক মূল্যে বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে খাদ্যদ্রব্য আটক রাখতে রাসূল (সা.) নিষেধ করেছেন।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের জন্য দরিদ্র জীবন সম্পূর্ণরূপে অনভিপ্রেত। গোটা বিশ্বের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা মানুষের কল্যাণের নিমিত্তে, তাই মানুষের সম্পদ বঞ্চিত থাকা অযৌক্তিক। রাসূল (সা.) মানুষকে শুধু পারলৌকিক কল্যাণ কামনার দোয়াই শিক্ষা দেননি, বরং পারলৌকিক কল্যাণ এবং ইহলৌকিক কল্যাণ ও বস্তুগত উন্নতির গুরুত্ব প্রদানের শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেছেন, “আল্লাহুম্মা ইন্নি আসয়ালুকা মিন ফাদলিকা ওয়া রাহমাতিকা ফা ইন্নাহু লা ইয়ামলিকুহুমা ইল্লা আন্তাÑ হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার কল্যাণ ও রহমতের প্রার্থনা করছি। কেননা তুমি কল্যাণ ও রহমতের মালিক।”
আধ্যাত্মিক ও আখিরাতের নিয়ামত ‘রহমত’ এবং দুনিয়াবী জিন্দেগির নিয়ামত ‘ফজল’ এ দুটির কামনাই নৈতিক জীবনের উন্নতি ও পার্থিব জীবনের সচ্ছলতার জন্য প্রয়োজন। সম্পদের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব ও অর্জনের তাগিদ অন্তরে অনুভব করি রাসূলের পবিত্র দোয়ার মাঝে। আল্লাহ পবিত্রতম সত্তা নিজেই মানুষকে প্রদান করেছেন দুনিয়াবী ও জাগতিক নিয়ামত অনুসন্ধানের পরামর্শ। যেন মানুষ ইহলৌকিক ও পারলৌকিক নিয়ামত অর্জনে ভারসাম্য সংস্থাপন করে একটি সুন্দর জীবনের অধিকারী হতে পারে। পবিত্র কালামে পাকে এরশাদ হচ্ছে, “যখন তোমাদের নামাজ শেষ হয়ে যায় তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর”। আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করার বিধানটি একটি স্বাভাবিক বিধান ।
খোদার এ বাণীর সাথে রাসূল (সা.)-এর দোয়া আমাদের এ শিক্ষা দেয় যে, মানুষ মসজিদে প্রবেশ করবে মূলত প্রত্যক্ষভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ‘রহমত’ লাভের জন্য আর সালতান্তে সে জমিনে ছড়িয়ে পড়বে উন্নত ও কল্যাণময় জীবনের প্রয়োজনীয় উপাদান ‘ফজল’ অর্জনের নিয়তে। আমরা মসজিদে প্রবেশকালীন সময় দোয়া করি, হে আল্লাহ! আমাদের জন্য তোমার রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে দাও বলে, আর সালাত শেষে জমিনের বুকে পা রাখতে বলিÑ হে আলাহ! আমরা তোমার কাছে ফজল চাই। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দোয়া আমাদের কল্যাণময় জীবনের জন্য আল্লাহর রহমত ও পার্থিবজগতের প্রাচুর্য অর্জনে উৎসাহিত করে। এছাড়া রাসূলের প্রাত্যহিক দোয়া “রব্বানা আতেনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাওঁ ওয়া ফিল আখিরাতে হাসানা”- আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে হাসানা অর্জনে উৎসাহিত করে। শরয়ী পরিভাষায় যাবতীয় আত্মিক, দৈহিক ও পরিবেশগত নিয়ামত, যা মানুষকে আনন্দ দান করে তাকেই ‘হাসানা’ বলা হয়। দুনিয়ার আনন্দের একটি সাধারণ উপাদান অর্থনৈতিক প্রাচুর্য। তাই অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন প্রকারান্তরে রাসূলের শিক্ষার প্রতি শৈথিল্য প্রদর্শন ব্যতীত কিছু নয়।
এ আলোচনার থেকে মনে করার কোন সুযোগ নেই যে, মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক অর্জনই হবে তার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য অথবা যথেচ্ছাচারী হিসেবে ভোগবাদী জীবনযাপন করবে। ইসলামের অর্থনীতি ভোগ ও ত্যাগের মধ্যে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠার শিক্ষা প্রদান করে। আল্লাহ নির্দেশ, দিয়েছেন “খাও পান কর কিন্তু সীমালঙ্ঘন কর না নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।”
সীমাতিরিক্ত ভোগ ইসলামের দৃষ্টিতে দূষণীয়। একজন মুসলমানের ভোগের চাহিদা কেমন হওয়া উচিত, তা আল্লাহ স্বয়ং আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন -“যারা খরচ করলে বেহুদা পথে খরচ করে না, না কার্পণ্য করে, বরং দুই চরম সীমার মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান আঁকড়ে ধরে।”
বর্তমান বিশ্বের হাহাকারময় অবস্থার জন্য দায়ী যে পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী অর্থ ব্যবস্থা, তার মোকাবিলায় ইসলামী অর্থনীতির ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা যে কত কল্যাণময় তার চিন্তা জাগরিত হচ্ছে আজ বিভিন্ন অর্থনীতিবিদদের হৃদয় কন্দরে।
এ আলোচনায় অর্থনৈতিক উন্নতির গুরুত্বের ব্যাপারে রাসূল করীম (সা.)-এর শিক্ষা সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হল। রাসূলের শিক্ষা দরিদ্র জীবন গ্রহণ নয়, বরং চাই কল্যাণময় অর্থনৈতিক প্রাচুর্য যা মানুষের ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতে সুখ আনয়নে সাহায্য করে। যারা ইসলামকে বৈরাগ্যবাদের আদলে মানুষের সামনে পেশ করে দরিদ্র জীবন গ্রহণের উৎসাহ জোগায় তারা প্রকৃতপক্ষে রাসূলের শিক্ষার ভুল ব্যাখা করে মুসলিম সমাজের প্রচুর ক্ষতিসাধন করে যাচ্ছে।
মুসলিম জাতির আবির্ভাব হয়েছে সব জাতির উপরে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে টিকে থাকার জন্য। তাই মুসলিম জাতির সম্মানিত সভ্য হিসেবে প্রতিটি মুসলমানের উচিত জ্ঞান ও নৈতিকজগতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সাথে সাথে অর্থনৈতিকজগতে নিজদের উপযুক্ত ও শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করা। সব জাতির ওপরে নেতৃত্ব করার যোগ্যতা হিসেবে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন মুসলমানের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। পলায়নপর দায়িত্বহীন জীবন মুসলমানের জীবন নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র জীবন দর্শন মুসলমানদের দরিদ্রের জীবন নয়, বরং কল্যাণময় অর্থনেতিক প্রাচুর্যের জীবন গঠনের অনুপ্রেরণা যোগায়। ভোগ ও ত্যাগের ভারসাম্যপূর্ণ সুখের জীবনই প্রকৃত পক্ষে মুসলিম জীবন।