মহাবিশ্বে জীবনের অস্তিত্ব ও অস্তিত্ববাদ
৮ নভেম্বর ২০২৪ ১১:১২
॥ মনসুর আহমদ ॥
সীমাহীন জ্ঞানের ক্ষুদ্র শাখা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা সীমাহীন, সীমা অপিরিসীম। কালের অগ্রগতিতে জ্ঞানের বিভিন্ন ধারা-উপধারা আজ জ্ঞান-বিজ্ঞান পরাবারের বিরাট মোহনায় মিলিত হয়ে অসীমের স্রোতে মিলিত হতে চলছে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় জড়বাদ ধীরে ধীরে ভাববাদে মিশ্রিত হয়ে জ্ঞানীদের সামনে তা বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞান ও ধর্ম পাশাপাশি এসে একে-অপরের ব্যাখ্যায় সহায়তা করছে। আজ তাই জ্ঞানের প্রতিটি শাখা সীমানায় রাসূল সা.-এর জ্ঞানের উপস্থিতির সন্ধান একটি স্বাভাবিক কার্যক্রম হিসেবে বিজ্ঞানীদের কাছে গৃহীত হতে চলছে।
রাসূল সা.-এর আবির্ভাবকালে প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান ছিল প্রাথমিক স্তরে। যে কারণে সে সময় রাসূলের জ্ঞানলোককে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করার সুযোগ ঘটেনি। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে সাথে তার জ্ঞানলোক সীমা আজ সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাসূলের জীবনের অন্যতম বিস্ময়কর ব্যাপার তো এই যে, রাসূল সা. কোনো একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়ার পরও তাঁর মুখনিঃসৃত হাদিস ও বিভিন্ন আলোচনা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে এমনভাবে স্পর্শ করেছে যে, এসব এখন এক উচ্চাঙ্গের জ্ঞানের কথা, যার মাঝে আধুনিককালের জ্ঞান-বিজ্ঞান একাকার হয়ে আছে।
আমরা রাসূলের বাণীতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের দু-একটি আলোচিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করব- যার দ্বারা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, রাসূল সা. কত নিখুঁতভাবে তার বাণীতে বৈজ্ঞানিক তথ্য ও তত্ত্ব পরিবেশন করেছেন, যে সম্পর্কে কুরআন অবতীর্ণকাল তো বটেই, বর্তমানকালের বিজ্ঞানও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম হয়নি।
বর্তমানকালের বিজ্ঞান মহাবিশ্ব সম্পর্কে বেশি করে ভাবছে। গ্রহ-নক্ষত্র সৃৃষ্টির রহস্য নিয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান চালাচ্ছে পৃথিবীর মতো অন্য কোনো গ্রহে নক্ষত্রের প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা, তা জানার জন্য। অনুসন্ধানের প্রথম ধাপ হিসেবে বিংশ শতাব্দীতে মানুষ পৃথিবীর নিকটতম প্রতিবেশী চাঁদে পা রেখেছ। দেখতে পেয়েছে ধূসর বালুময় চাঁদের বুকে নেই বাতাস, নেই আলো। সেখানে জীবনের অস্তিত্ব নেই। বিজ্ঞানীরা থেমে নেই। তারা দৃষ্টি ফিরায়ে নিচ্ছে সম্ভাব্য নিকটতম অন্যতম গ্রহ-মঙ্গলের দিকে। গত প্রায় কয়েক দশক ধরে মঙ্গল গ্রহ নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীরা বার বার আশার বাণী শোনাচ্ছে এখানে জীবনের অস্তিত্ব থাকতে পারে বলে।
মহাশূন্যে জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে রাসূলের বাণী আলোচনা করার আগে আমরা দেখি বর্তমান বিজ্ঞান এ ব্যাপারে কী ধারণা পোষণ করে। বিজ্ঞানের আধুনিক তথ্যের ওপর নির্ভর করে মহাশূন্যে জীবনের অস্তিত্ব ও সম্ভাবনা নিয়ে দুটি ধারায় আলোচনা করা যেতে পারে। একটি বুদ্ধিবৃত্তিক; দ্বিতীয়টি তত্ত্ব ও তথ্যনির্ভর।
মহাশূন্যে জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি ও নির্ভরশীল বিজ্ঞানের তথ্য ও উপাত্তের ওপর নির্ভর করছে বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞান বলছে, মহাবিশ্বে শত শত কোটি গ্রহ-নক্ষত্র ভেসে বেড়াচ্ছে, রয়েছে অগণিত গ্যালাক্সি। এই সীমাহীন গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে গঠিত পরিবারের মধ্যে পৃথিবী একটি ক্ষুদ্র গ্রহ মাত্র। এ সীমাহীন গ্রহ-নক্ষত্র সজ্জিত পরিবারের অন্যতম সদস্য পৃথিবীর বুকে বুদ্ধিমান মানুষ রয়েছে, রয়েছে তার উন্নত জীবনবিধান, রয়েছে ধ্বংস ও পুনরুত্থান, রয়েছে তাদের জন্য জান্নাত ও জাহান্নামের সংবাদ। শুধু পৃথিবী নামক গ্রহটিতে আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আর বাকি সব কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র, জীব-জীবন শূন্য, শুধু মরুময় বা গ্যাস প্রজ্জ্বলিত উত্তপ্ত অগ্নিকুণ্ডÑ এমন হওয়াটা বুদ্ধির কাছে যুক্তিহীন। আমরা যদি ক্ষণিকের জন্য আমাদের অস্তিত্বকে মহাবিশ্বের সীমানার বাইরে কল্পনা করে মহাশূন্যে ভাসমান সব গ্রহ-নক্ষত্রের দিকে তাকাই, তা হলে যদি একটি মাত্র গ্রহে প্রাণের স্পন্দন দেখতে পাই আর সব গ্রহ-নক্ষত্রকে জীবন শূন্য নীরব নিথর নিস্তব্ধ গ্যাস প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ড- দেখি তা হলে পৃথিবীর পাশাপাশি অন্যসব সৃষ্টিকে অসামঞ্জস্য ও অযৌক্তিক সৃষ্টি মনে হবে। তাই বুদ্ধিবৃত্তিক সিদ্ধান্ত তো এটাই হতে পারে যে, মহাবিশ্বের একটি ক্ষুদ্র গ্রহে জীবনের, বুদ্ধিমান প্রজাতির অস্তিত্ব থাকার পাশাপাশি মহাশূন্যের অনেক গ্রহ-নক্ষত্র সেখানকার পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যশীল জীবনের অস্তিত্ব রয়েছে।
বর্তমান বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি ও বিজ্ঞানের তথ্য মহাশূন্যে জীবন সম্পর্কে যা পেশ করেছে রাসূলের জবানিতে ও রাসূলের মারফৎ প্রাপ্ত পবিত্র কুরআনে দেড় হাজার বছর আগে তা মানবসমাজের কাছে পেশ করা হয়েছে। বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রে সেখানকার পরিবেশ সমর্থিত বুদ্ধিমান জীব ও জীবনের সম্ভাবনার ইঙ্গিত রয়েছে কুরআনে। কারণ এ বিশ্বচরাচর ধ্বংসের পরে মানুষ আবার যখন পুনরুত্থিত হবে, তখন তাদের অবয়বকে নতুন জগতের সাথে সামঞ্জস্যশীল করে তৈরি করা হবে বলে কুরআন ঘোষণা দিয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘সেদিন পরিবর্তিত করা হবে এ পৃথিবীকে অন্য পৃথিবীতে এবং পরিবর্তিত করা হবে মহাকাশসমূহকে’। [সূরা ইবরাহিম : ৪৮]।
বুদ্ধিবৃত্তিক দাবি অনুযায়ী মহাশূন্যের বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রে জীবনের অস্তিত্ব থাকা প্রয়োজন । প্রয়োজন অনুযায়ী অন্য কোথাও জীবনের সম্ভাব্যতার তথ্য প্রকাশ করেছে মহাগ্রন্থ আল কুরআন। এ ব্যাপারে গবেষণা করতে গিয়ে বিশ্ববিখ্যাত কুরআন গবেষক মরিস বুকাইলি লিখেছন, In this context, I think I may have found references in the Quran to the presence of the planets in the Universe that are similar to the earth , it must be added that many Scientists think this is a perfectly feasible fact, although modern data cannot provide any hint of certainity .
মহাবিশ্বে জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কে কুরআনের ইঙ্গিত প্রচুর গবেষণার দাবি রাখে। কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘যা কিছু আসমান জমিনে রয়েছে তাদের ছাড়া যা কিছু আল্লাহ তায়ালা বাঁচাতে চাইবেন সবই ভীত বিহ্বল হয়ে পড়বে এবং সবাই তার কাছে আসবে বিনীত অবস্থায়।’ [আন নামল : ৮৭]।
এ আয়াতে জমিন ও আসমানে এমন সব সত্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত রয়েছে যারা প্রলয় দিবসে ভীতসন্ত্রস্ত হবে। জমিনের মানুষ সেদিন যেমন ভীতসন্ত্রস্ত হবে আকাশজগতের অধিবাসীরাও ভীতসন্ত্রস্ত হবে। ভীতু হবার পেছনে থাকে উদ্বেগ, বুদ্ধির উপস্থিতি ও দায়িত্বানুভূতি। আসমানের এমন অধিবাসী বলতে ফেরেশতা হবে এমন ইঙ্গিত কুরআনে প্রদান করেনি। আয়াতের ভাষণ থেকে অনুমান করা চলে যে ওসব অধিবাসীরা দায়িত্বানুভূতির ব্যাপারে মানব সদৃশ কোনো জীব হবে। প্রকৃত ব্যাপার আল্লাহই ভালো জানেন।
মহাবিশ্বে জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কে কুরআন যে ইঙ্গিত দিয়েছে, তা আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারে অনেকটা স্পষ্ট। সম্প্রতি ‘দ্য প্রসেডিংস অব ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে, মহাশূন্যের নক্ষত্র মণ্ডলের অর্গানিক কম্পাউন্ড বা জৈব উপাদান থেকে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়ে থাকতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়া নাসার গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক লুইস আলা ম্যানডোলা এক বিবৃতিতে বলেন, বিজ্ঞনীদের ধারণা কোষের ঝিল্লি গঠনের প্রয়োজনীয় উপাদান তথা প্রাণের উৎস রয়েছে মহাশূন্যের মধ্যে। এ আবিষ্কারের তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি স্থানে জীবনের অস্তিত্ব থাকতে পারে। [ওয়াশিংটন, ৩১ জানুয়ারি, রয়টার্স]।
সম্প্রতি পৃথিবী থেকে ৩৫ লাখ আলোকবর্ষ দূরে নক্ষত্র রাজির কাছাকাছি এমন দুটি নয়া নক্ষত্র আবিষ্কার হয়েছেÑ যাতে পানি ও জীবন ধারণের অন্যান্য উপাদান বিদ্যমান। এ গ্রহ আবিষ্কারের ফলে পৃথিবীর বাইরে জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কে বহু শতাব্দীর প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে আশা করা যায়। সান ফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং বার্কলেস্থ ইউনিভার্সিটি আব ক্যালিফোর্নিয়ার ভিজিটিং প্রফেসর জিওফ্রেমারসি বলেন, ‘কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ জটিল রাসয়নিক সামগ্রী বিদ্যমান থাকার মত যথেষ্ট শীতল ঐ গ্রহ। তাতে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।’
জিওফ্রে মারসির সহযোগী মি. বাটলার বলেন, ভূপৃষ্ঠের বায়ুমণ্ডলের নিচে এমন একটি এলাকা রয়েছে, যেখানের তাপমাত্রা পানির তাপমাত্রার সাথে সঙ্গতি পূর্ণ। মি. মারসি আরো বলেন, গ্রহদ্বয়ের পৃথিবীর মতোই চন্দ্ররাজি রয়েছে। আর তাতে প্রাণের সম্ভাবনাই উজ্জ্বল।
বিজ্ঞানের এসব আধুনিক তথ্য বহু পূর্বে কুরআনের ঘোষণাকে সমর্থন জানাচ্ছে। মহাবিশ্বে জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কে কুরআনের ঘোষণা, ‘তাঁর এক নিদর্শন নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টি এবং তদুভয়ের মধ্যে তিনি যেসব জীবজন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন; তিনি যখন ইচ্ছা এ গুলিকে একত্রিত করতে সক্ষম।’ [সূরা : ২৯]। এ আয়াত থেকে স্পষ্টরূপে জানা যায়, এ পৃথিবীর ন্যায় মহাবিশ্বে অন্য কোথাও জীবনের অস্তিত্ব রয়েছে।
মহাবিশ্বে জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কে রাসূল সা.-এর বাণী আরও চমকপ্রদ। কুরআন পাকে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ সপ্ত আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং পৃথিবীও সেই পরিমাণে। এ সবের মধ্যে তাঁর আদেশ অবতীর্ণ হয়, যাতে তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং সবকিছু তাঁর গোচরীভূত।’ [তালাক : ১২]।
এ আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে আধুনিক তাফসির কারকগণ বলেন, মহাবিশ্বে আল্লাহ তায়ালা আরও অনেক জগৎ সৃষ্টি করে রেখেছেন এবং সেখানকার পরিবেশ উপযুক্ত জীবনসম্পন্ন সত্তাও বিদ্যমান। আকাশলোকের কোটি তারা-নক্ষত্র জীবনশূন্য নয় এবং সেখানেও জীবনের অস্তিত্ব ও তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহ প্রদত্ত জীবনবিধান।
এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস রা. যে হাদিস বর্ণনা করেছেন, তা বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে বিস্ময়ে নিপতিত করে। হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদিস, ‘অন্যান্য পৃথিবীতেও তোমাদের মতো নবী আছেন। আদমের মতো আদম , নূহের মতো নূহ, ইবরাহিমের মতো ইবরাহিম ও ঈসার মতো ঈসা রয়েছেন।’ যদিও ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়েত মুতাওয়াতির রেওয়াতের মর্যাদার লাভ করেনি, তবুও সে রেওয়ায়েতকে উপেক্ষা করা চলে না। ইবনে হাজার তার ‘ফতহুল বারী’ গ্রন্থে এবং ইবনে কাসীর তার তাফসির গ্রন্থে এ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। আল্লামা আলুসী তাঁর তাফসির গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘ইহাকে ছহিহ মনে করিয়া লওয়ার পথে না কোনো বিবেক-বুদ্ধিগত কোনো বাধা আছে, না শরিয়তের দিক দিয়া কোন কারণ। ইহার অর্থ হইল, প্রত্যেকটি পৃথিবীতে একটি সৃষ্টি রহিয়াছে যাহা উহার মূল উৎসের সহিত সম্পর্কিত, যেমন আমাদের এ পৃথিবীতে সব বনী আদম ও মানুষ হযরত আদমের বংশোদ্ভূত এবং প্রত্যেকটি পৃথিবীতে এমন সব ব্যক্তিও রহিয়াছেন, যাহারা নিজের মধ্যে অন্যদের তুলনায় বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী, যেমন আমাদের এখানে নূহ ও ইবরাহিম [আ.] প্রমুখ বিশিষ্ট মর্যাদাবান। এর পর আল্লামা আলুসী আরও লিখেছেন, সম্ভত পৃথিবী সাতটিরও বেশি হইবে এবং অনুরূপভাবে আকাশমণ্ডলও কেবল সাতটি নাও হইতে পারে। ‘সাত’ একটি পূর্ণ সংখ্যা। এই সংখ্যাটির স্পষ্ট উল্লেখে এ কথা অনিবার্য হইয়া পড়ে নাই যে, পৃথিবী এ সংখ্যার বেশি হইতে পারিবে না। [তাফহীমুল কুরআন, সূরা তালাক টিকা : ২৩]।
কুরআন-হাদিসের এসব আলোচনা থেকে আমরা বিস্ময়াভূত হই, কীভাবে দেড় হাজার বছর পূর্বে যখন মহাজগৎ সম্পর্কে টলেমীর চিন্তার আবর্তে মানুষ ঘুরপাক খাচ্ছিল, তখনই কুরআন হাদিসে মহাশূন্যে জগতে প্রাণের অস্তিত্বের ইঙ্গিত প্রদান করা হলো। এমন তথ্যের সন্ধান এল যে- রাসূলের মাধ্যমে, তাঁর জ্ঞানলোকে বিচরণ করে তাঁর অনুসারীদের উচিত মহাশূন্যের রহস্য উদ্ঘাটন করা। যে জাতির রাসূল মহাশূন্য পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেলেন নূরের জগতে, যিনি শুনালেন মহাশূন্য জগতে প্রাণের স্পন্দনের কথা, সেই রাসূলের অনুসারীর যখন বিধর্মীদের মহাশূন্যে স্পুটনিক, খেয়াযান, নভোচারী পাঠাতে দেখে নির্লজ্জভাবে প্রশান্তির সাথে গম্ভীর ভাবে উক্তি করে’ আরে আমাদের কাছে ওসব নতুন কিছু নয়, অমন বহু চীজের ইঙ্গিত-ইশারা আমাদের কিতাব পাকে আগে থেকেই করে গেছে’ তখন অমুসলিম বিজ্ঞানীরা হাসে। যে জাতির সভ্যতার বিপ্লবী বিচরণ মধ্যযুগে ঘুমন্ত ইউরোপকে নব জীবনের স্বপ্ন সাধনা নিয়ে জাগিয়ে তুলে ছিল তাদেরকে আজ বিশ্বনেতৃত্ব লাভের জন্য বসে বসে নির্লজ্জভাবে প্রশান্তি লাভের কোনো সুযোগ নেই।
মহাবিশ্বে জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কে রাসূল সা.-এর জ্ঞান যেমনি মহাকাশ বিজ্ঞানীদের অমূল্য সম্পদ, তেমনি সমাজে মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কিত দর্শন ‘অস্তিত্ববাদ’ দার্শনিক মতবাদও মানুষের অস্তিত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কিত রাসূলের পেশকৃত মতবাদকে অনুসরণ করছে।
অতীতের তত্ত্বঘেঁষা বিমূর্ত দর্শনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর মানব মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বিশেষভাবে ভাবিত দর্শন অস্তিত্ববাদ। বুদ্ধিবাদী ও ভাববাদী দার্শনিকদের কাছে পরমসত্তা ছিল অভীষ্ট লক্ষ্য। তাদের বিমূর্ত ধ্যান অনুধ্যানের সঙ্গে মানুষের বাস্তব সমস্যাবলীর কোনো যোগ ছিল না। যে কারণে তাদের বিমূর্ত অনুধ্যানসর্বস্ব ভাববাদী ও বুদ্ধিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে জন্ম নিয়েছিল অস্তি¡ত্ববাদ। তত্ত্বকেন্দ্রিক ভাববাদী দর্শনের বিরুদ্ধে ও প্রতিক্রিয়ায় যে অস্তিত্ববাদ জন্ম গ্রহণ করে, তার মূলে ছিলেন কিয়ার্কেগার্ড। কিয়ার্কেগার্ডই প্রথম অস্তিত্ববাদ কথাটিকে আধুনিক অর্থে ব্যবহার করেন। অস্তিত্ববাদী দার্শনিক কিয়ার্কেগার্ড, মার্টন হাইডেগার, কার্ল জেসপার্স অস্তিত্ববাদ ও মানব মর্যাদা সম্পর্কে যে ধারণা পেশ করেছেন, তার অনেকটা মিল দেখা যায় রাসূল সা. উপস্থাপিত জীবনদর্শনে।
অস্তিত্ববাদীরা বিশ্বাস করে, জন্মের আগে সে সচেতন ছিল না এবং মৃত্যুর পরেও সে সচেতন থাকবে না এবং জীবন ও সত্তা পরিবেষ্টিত একটা ক্ষণস্থায়ী জীবন। অস্তিÍত্ববাদীদের জীবনের অনিত্যতা, অর্থাৎ আমি একদিন থাকব না এই না থাকার প্রীতিতি বা শূন্যতাবোধই নৈকিতকতার ভিত্তি। শূন্যতাবোধ ব্যক্তির মনে জাগিয়ে তোলে ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের কথা। যে কারণে সে সুযোগ পায়- সামান্য। যে কতদিন সে বেঁচে থাকবে, সে সময়টাকে সার্থক ও পরিপূর্ণ অস্তিত্বের অর্জনের লক্ষ্যে সদ্ব্যবহার করবে। কিয়ার্কেগার্ডের মতে, গভীর নিষ্ঠা মিশ্রিত প্রচেষ্টায় ব্যক্তির পক্ষে ঈশ্বরপ্রাপ্তি সম্ভব। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ঈশ্বরপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ঐশী সত্তায় বিলীন হয়ে যাবে। স্রষ্টা ও তার সৃষ্টব্যক্তির মিলন সম্ভব; কিন্তু এ মিলন সত্ত্বেও ব্যক্তি বজায় রাখতে পারে তার ব্যক্তিত্ব আর স্রষ্টা থেকে যান স্বতন্ত্র।
কিয়ার্কেগার্ডের নৈতিকতার মূল ভিত্তি মানুষের শূন্যতাবোধ তথা মৃত্যু, যা রাসূল সা. কর্তৃক নৈতিকতার ভিত্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মানুষের মনে মৃত্যুচিন্তা জাগরিত থাকলে সে খারাপ কাজ থেকে সহজেই বিরত থাকে। পরকালীন জীবনের চিন্তা মানুষের সৎ গুণাবলী অর্জনের উত্তম মাধ্যম- এ ধারণা আধুনিক অস্তিত্ববাদীদের বহু পূর্বে প্রদান করেছেন রাসূল সা.। আবু সায়ীদ খুদরী বলেছেন, “নামাযের জন্য একদিন রাসূল সা. মসজিদে তাশরিফ আনলেন। তিনি দেখলেন কিছু লোক খিল খিল করে হাসছে। রাসূল সা. তাঁদেরকে বলছেন, তোমরা যদি সকল আস্বাদনকে নিঃশেষ করে দেয়ার মতো জিনিস অর্থাৎ মৃত্যুকে যদি স্মরণ করতে তাহলে তা হাসিকে রুখে দিত। মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ কর। মৃত্যু সকল হাসি তামাসাকে নিঃশেষ করে দেয়। [তিরমিযী]।
কিয়ার্কেগার্ড ঈশ্বরপ্রাপ্তি সম্পর্কে যে ধারণা পেশ করেন, তা ইসলামের খোদাপ্রাপ্তি ধারণার বেশ কাছাকাছি। ইসলামের আবির্ভাবকালে দুনিয়ার অধিকাংশ জাতি ছিল ঈশ্বরবাদ ও অবতারবাদের দাস। কিন্তু আল্লাহর ধারণাকে ইসলাম উন্নততর ও বিশুদ্ধতমভাবে পেশ করেছে। স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির একাত্মতা সম্ভব হয় তাঁর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। ইসলাম বলে যে, সব সৃষ্টিই আল্লাহর অভিব্যক্তি। কিন্তু মানব ধারণাক্ষম আল্লাহর আকার নেই, তার সৃষ্ট কোনো বস্তুর মাধ্যমে তার প্রতিকৃতি কল্পনা করা ইসলামে নিষেধ। তাই দেখা যায়, অস্তীত্ববাদীরা আল্লাহর রাসূলের প্রদত্ত ধারণাকেই দার্শনিক মতবাদ হিসেবে তাদের অজান্তে পেশ করেছেন।
অস্তিত্ববাদী দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার মানুষের যে পরিচয় তুলে ধরেছেন, তাও রাসূলের মানব অস্তিত্ব ধারণার সম্পর্কে অনেকটা কাছাকাছি। মানুষের পরিচয় সম্পর্কে হাইডেগার ব্যক্তি মানুষকে তার নিজের সঙ্গে পরিবেশের সঙ্গে এবং অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত অবস্থায় বিশ্লেষণ করেন। তিনি মানুষের অস্তিত্বশীল হওয়া সম্পর্কে মনে করেন যে, অস্তিত্বশীল হওয়া বা যথার্থ সত্তা হিসেবে থাকার অর্থই হচ্ছে নিজের সম্পর্কে চিন্তা করা এবং নিজের সম্পর্কে জড়িত হওয়া। প্রমাণিক সত্তা মানেই আত্মসত্তা; আর এ সত্তার অর্থ শুধু চেতনাসম্পন্ন হওয়াই নয়, বরং দায়িত্বশীল হিসেবে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত হওয়া। ব্যক্তি কখন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন সত্তা নয়। মানব জীবন মানে জগৎস্থ সত্তা (Being in the world)। এখানে আত্মসত্তার সঙ্গে অন্যান্য সত্তার অর্থাৎ অন্যান্য ব্যক্তি ও বস্তুর সম্পর্ক রয়েছে। হাইডেগার মানুষের আত্ম অতিক্রমণের (Self transcendence) কথা স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ মানুষ প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করবে জগৎ সম্পর্কে ব্যক্তির ঘনিষ্ঠতা এবং সর্বোপরি মৃত্যুর ভয় তাতে আত্ম অতিক্রমণের শেষ ধাপকাল অতিক্রমণ করে অস্তিত্বের বর্তমান মুহূর্ত থেকে ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যায়। হাইডেগার মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে যে ধারণা পেশ করেছেন, তা রাসূলের মানব দায়িত্ব সম্পর্কিত দার্শনিক ব্যাখ্যা মাত্র। হাইডেগার নৈতিক বিধানকে বিবেচনা করেছেন চলমান ও গতিশীল হিসেবে। তিনি মনে করেন, মানব মন ও সমাজের পরিবর্তনশীল নতুন অবস্থার দিকে লক্ষ রেখে সময়োপযোগী দিশা প্রদানই নৈতিক অনুশাসনের মূল লক্ষ্য। নীতি বিদ্যায় যাকে বলা হয় সৃজনী নৈতিকতা ইসলাম সমর্থিত।
মানুষ সম্পর্কিত এসব ধারণা রাসূলের উপস্থাপিত ধারণার অনুরূপ। সামাজিকতাকে পরিপূর্ণভাবে স্বীকার করে সমাজের সব অংশে নিজের অস্তিত্ব বিস্তীর্ণ করে দেয়াই ইসলামের অস্তিত্ববাদের মূল কথা। মহানবী সা. বলেছেন, ‘যে মুসলমান মানুষের সাথে মিলে মিশে একত্র ও একাত্ম হয়ে বসবাস করে এবং তাদের অসদ্ভাব ও যন্ত্রণায় ধৈর্য ধারণ করে, সে ঐ মানুষের চেয়ে উত্তম যে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করে না এবং তাদের অমিতাচারও সহ্য করে না।’
অতি ক্ষুদ্র এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে অস্তিত্ববাদ নামি দর্শনে কিয়ার্কে গার্ড ও হাইডেগার যা ব্যক্ত করেছেন, তা মানুষের মর্যাদা ও তার অস্তিত্ব ও দায়িত্ব সম্পর্কে রাসূল সা.-এর দেয়া ধারণার একটি ক্ষুদ্রায়িত রূপ মাত্র।
মহাবিশ্বে জীবনের অস্তিত্ব ও সমাজে মানব অস্তিত্ব সম্পর্কে আজ হতে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে রাসূল সা. কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য রাসূলকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী হিসেবে প্রমাণ করে। শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানীর আনীত জীবনবিধান যে মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ, তা আজ ধীরে ধীরে মানুষ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
লেখক : তড়িৎ প্রকৌশলী।