৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস
৮ নভেম্বর ২০২৪ ০০:৫৮
॥ গাজী মো. শওকত আলী ॥
ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। এই দিনে দেশপ্রেমিক সিপাহি-জনতার ঐক্য ও সংহতির কারণে ভারতীয় চর খালেদ মোশাররফ ও তার অনুসারীদের প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছিল। ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে কতিপয় সৈনিক প্রথমে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দি করে। খালেদ মোশাররফ স্বঘোষিত সেনাপ্রধান হয় ও মেজর জেনারেল আর সেনাপ্রধানের র্যাঙ্ক ব্যাজ ধারণ করে। ৬ নভেম্বর বঙ্গভবনে যায় ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে বন্দি করে। মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেয়, জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে। ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রথমে মেজর জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে ও খালেদ মোশাররফ ও তার সঙ্গী-সাথীদের প্রতিহত করে। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালের এদিনটি ছিল শুক্রবার এমনিতেই দিনটি মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদ আনন্দ, রহমত, বরকত, মাগফিরাত, সম্মেলন বা সমাবেশ ও সংহতির দিন। ঐ একই দিনে ভারতীয় আধিপত্যবিরোধী সিপাহি-জনতার ঐক্য, সংহতির ও বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা পায় ও ভারতীয় আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করা হয়। এটা আমাদের জন্য আনন্দের।
১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানের পূর্বাংশ তথা পূর্ব পাকিস্তান ‘বাংলাদেশ’ নামে স্বাধীন হওয়া একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠিত হয়। যার বীজ বপন করা হয়েছিল ১৯৬৫ সালে, আগরতলা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। যার স্বীকারোক্তি করেছিলেন ৭ম জাতীয় সংসদের স্পিকারের আসনে বসে কর্নেল শওকত। তিনি আরো বলেছিলেন যে, তিনিও শেখ মুজিবের সাথে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন। প্রকাশ থাকে যেÑ দেশ বিভাগের জন্য ১৯৬৫ সালে আগরতলায় বসে ভারতের সাথে এমন একটি গোপন চুক্তি করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সেই চুক্তির ভিত্তিতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রাম সংঘটিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম কালীন বা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিব চেয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে। তিনি কখনো পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ হোক বা আলাদা করে বাংলাদেশ স্বাধীন হোক তা চাননি। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাদ আজাদের লিখিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ২৫ মার্চের আগে বার বার অনুরোধ করা সত্যেও শেখ মুজিব স্বাক্ষর করেননি। যার আরো প্রমাণ মিলে তাজউদ্দীন কন্যার রচিত ‘পিতা ও নেতা’ পুস্তকে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শেখ মুজিব পাকিস্তানি জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে তার পরিবারের নিরাপত্তার শর্তে আত্মসমরর্পণ করে নিরাপদে পাকিস্তানে চলে যান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে টিক্কা খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানিরা রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সসহ বাংলাদেশের বেশকিছু স্থানে আচমকা আক্রমণ চালায়। অতি দ্রুত সংবাদ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এমতাবস্তায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জীবনবাজি রেখে তৎকালীন মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মেজর জিয়ার আহ্বানে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে এদেশের ছাত্র-জনতা মেহনতি মানুষ অনেক রক্ত জীবন আর ত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করে। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের রাতে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকৃতি দেয়। ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনী পাকবাহিনীর পরিত্যক্ত অস্ত্র গোলাবারুদ লুট করে ভারতে নিয়ে যায়। ভারত যে কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করছে, তা হচ্ছে পাকিস্তানের মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করে মুসলমানদের শক্তিকে দুর্বল করা।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে শেখ মুজিব লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরে সিরাজুল আলম খানের কাছে দেশের অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, দেশ তো স্বাধীন হয়ে গেছে। শেখ মুজিব আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করেন, এটা কী বলছ! দেশ কি ভাগ করে ফেলেছ! দেশে ফিরে এসে ১৯৭২ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও পরে রাষ্ট্রপতি হন ভারতের অনুগত দাস শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ পরিচালনার জন্য ভারতের পরামর্শে শেখ মুজিব গঠন করে রক্ষীবাহিনী। একদলীয় শাসন কায়েম করে দলীয় বিবেচনায় অল্পসংখ্যক পত্রিকা রেখে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়। শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে ইসলাম ও নৈতিকতা মুছে দেয়।
দেশ শাসনের নামে চলে নির্যাতন, নিপীড়ন, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, লুটপাট, গুম, খুন, ব্যাংক লুট ইত্যাদি। যে কারণে দেশের মানুষ অল্পসময়ের মধ্যেই অতিষ্ঠ্য হয়ে ওঠে। দেশের মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যায়। অভাব-অনাটনে ক্ষুধার্ত মানুষ ডাস্টবিনে রাস্তার কুকুরের সাথে লড়াই করে পরিত্যক্ত ও পচা খাবার ভক্ষণ করতে দেখা যায়। নারীদের তাদের ইজ্জত-আব্রু ঢাকার জন্য মাছ ধরার ছেঁড়া জাল গায়ে জড়াতে দেখা যায়।
দেশের এমন ক্রান্তিকালে বিদেশিরা প্রচুর খাদ্যসামগ্রী ও বস্ত্র দান করেছিল। বিদেশি সংস্থা সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য আট কোটি কম্বল দান করেছিল। ঐ সময় শেখ মুজিবুর রহমান প্রকাশ্যে জনসভায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘সাড়ে ৭ কোটি মানুষ ৮ কোটি কম্বল, তাহলে আমার কম্বল গেল কোথায়?’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমি ভিক্ষা করে আমার দেশের গরিব মানুষের জন্য যা আনি, চাটার দল তা খেয়ে ফেলে।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘মানুষ পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ এটাই আওয়ামী লীগের বৈশিষ্ট্য।
দেশের এহেন অবস্থায় সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক মেধাবী, সাহসী, দেশপ্রেমিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার শেখ মুজিবের কাছে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান চান ও পরামর্শ দেন। কিন্তু শেখ মুজিব তাতে কর্ণপাত করেননি। অবস্থার প্রেক্ষিতে মনে হয় যেন তাদের কাছে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে তাদের কানে কানে আল কুরআনের সেই বাণী ভেসে আসছিলÑ যাতে বলা হয়েছে, “আর তোমাদের কি হলো যে, তোমরা আল্লাহর পথে লড়াই করছ না সেই সব দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে; যারা ফরিয়াদ করছে এই বলে যে, “হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদিগকে এ জনপদ থেকে বের করে নিয়ে যাও, যার অধিবাসিরা অত্যাচারী! আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একজন অভিভাবক নির্ধারণ করে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একজন সাহায্যকারী পাঠাও।” (সূরা আন নিসা : ৭৫)।
জালেম শাসক শেখ মুজিবের ওপর দেশের মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে। শেখ মুজিবের মৃত্যুর খবর শুনে অনেকেই ইন্না লিল্লাহ বলার পরিবর্তে আলহামদুলিল্লাহ বলেছেন। আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল মালেক উকিল শেখ মুজিবের মৃত্যুর খবর শুনে আলহামদুলিল্লাহ বলেছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন ফেরাউনের বিদায় হয়েছে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের ঐ দিনটি ছিল শুক্রবার, শেখ মুজিবের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ঐ দিন সারা দেশে কোথাও কোনো মিষ্টির দোকানে কোনো মিষ্টি অবশিষ্ট ছিল না। শুক্রবার হওয়ার কারণে মসজিদে মসজিদে শোকরানা আদায় করা হয়; এমনকি ফজরের সময় যারা শেখ মুজিবের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ রোজা বা সিয়াম পালনেরও নিয়ত করেছিলেন। শেখ মুজিবের প্রতি মানুষের ঘৃণা ও ক্ষোভের কারণে তার জানাযায়ও কেউ অংশগ্রহণ করেনি। প্রকাশ থাকে যে, শেখ মুজিবকে যখন হত্যা করা হয় তখন সেনাপ্রধান ছিলেন কাজী মো. সফিউল্লাহ। আর রক্ষীবাহিনীর প্রধান ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। তারা তার কোনো কাজে আসেনি।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ভারতের দালাল ‘র’-এর এজেন্ট ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে তার অনুসারী ‘র’-এর আরো কিছু এজেন্টদের নিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করে। অতঃপর নিজে স্বঘোষিত সেনাপ্রধানের পদ দখল করে ও মেজর জেনারেলের র্যাঙ্ক ব্যাজ ধারণ করে। ৬ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে যায়, খন্দকার মোশতাক আহ দেকে বন্দি করে, মন্ত্রিসভা বাতিল ও জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে। ঐ দিনই খালেদ মোশাররফ তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সা’দাত মো. আবু সায়েমকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে।
খালেদ মোশাররফের এহেন অপতৎপরতায় বিভিন্ন সেনানিবাসে সিপাহিরা ক্ষিপ্ত ও সংগঠিত হতে থাকে। এরই মধ্যে গভীর রাত পর্যন্ত সিপাহিদের সাথে ছাত্র-জনতা যুক্ত হতে থাকে। ৭ নভেম্বর প্রত্যুষে সিপাহি-জনতা একাকার হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। প্রথমেই সিপাহি-জনতা মেজর জেনারেল জিয়াকে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে। সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান ঠেকাতে এসে ভারতীয় চর খালেদ মোশাররফসহ তার অনুসারীরা স্বশস্ত্র অবস্থান নেয়। শেষ পর্যন্ত তারা সিপাহি-জনতার হাতে প্রাণ হারায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহচর ও সহযোদ্ধা তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের লোকদের নিয়ে একটি নতুন সরকার গঠন করা হয়। খন্দকার মোশতাকের ৮৩ দিনের শাসনামলে শেখ মুজিবের শাসনামলের অনেক কিছুই পরিবর্তন করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল জয় বাংলা স্লোগান বাদ দেয়া। “জয় বাংলার স্থলে নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” ইত্যাদি সংযোজন করেছিলেন।
ভারত তার সেবাদাস শেখ মুজিবের মৃত্যুতে শোকাহত হয়। আর তখন থেকেই কৌশল আঁটতে থাকে বাংলাদেশকে তাদের অধীনস্থ করে রাখার জন্য। তারই অংশ হিসেবে ৩ নভেম্বর ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর এজেন্ট তৎকালীন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফকে দিয়ে একটি অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। যার পরিসমাপ্তি ঘটে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে সিপাহি-জনতার সংহতি ও বিপ্লবের মাধ্যমে।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কলামিস্ট।