ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-জনতা ষড়যন্ত্রের সব কালো হাত গুঁড়িয়ে দেবে


৮ নভেম্বর ২০২৪ ২০:৩৩

॥ জামশেদ মেহ্দী॥
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে বহুমুখী ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এ সরকারের আয়ু হয়েছে মাত্র ৩ মাস। অথচ ৩ মাসে এ সরকারকে উৎখাত করার জন্য সংবিধানবিরোধী একাধিক তৎপরতা চলেছে। গত ৩ মাসে সরকারবিরোধী কী কী ষড়যন্ত্র হয়েছে সেগুলো একটু পরেই আমরা বলব। কিন্তু এর মধ্যে ষড়যন্ত্র একটি নতুন ডাইমেনশন পেয়েছে। এ ডাইমেনশন হলো ভারতের বিজেপির প্যারেন্ট সংগঠন আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ), মোদি সরকার, ভারতে আশ্রয় নেওয়া পলাতক হাসিনা এবং ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য এবং ক্যাডার। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে ইসকন নামক একটি এনজিও, যারা নিজেদের সনাতন ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করে। তাদের সাথে আরো যুক্ত হয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নামক একটি চরম সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। যাদের নাম ওপরে বলা হলো, এরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে আলাদাভাবে নাশকতামূলক তৎপরতা চালাচ্ছে। আবার অন্য সময় সকলের মধ্যে একটি অলিখিত আন্ডারস্ট্যান্ডিং রয়েছে। ইসকনের পুরো নাম হলো ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস। বাংলায় কৃষ্ণের চেতনার আন্তর্জাতিক সোসাইটি। আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের দানবীয় শাসনে এ ইসকন এবং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বিরুদ্ধে কলম ধরা যেত না। ধরলেই খোদ আওয়ামী লীগ সরকার সাম্প্রদায়িক, জঙ্গি এবং মৌলবাদী বলে বদনাম দিত এবং অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে গ্রেফতার করে বেআইনি শাস্তি দিত। এদের সম্পর্কে আমরা একটু পরে বলছি।
একাধিক পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, রংপুর এবং ঢাকায় জাতীয় পার্টি হঠাৎ করে মাথা তুলেছিল এবং ছাত্র অধিকার পরিষদের একটি ক্ষুদ্র মিছিলে হামলা করে তাদের পেটায়। যারা হামলা করে এবং পেটায়, তারা আগে থেকেই জাতীয় পার্টির অফিসে মজুদ ছিল। এদের ৮০ শতাংশই ছাত্রলীগ এবং যুবলীগ বলে জানা যায়। স্বনামে বের হলে গণধোলাই হবে, সেই আশঙ্কায় তারা জাতীয় পার্টির সাইনবোর্ড ব্যবহার করে। ছাত্র অধিকার পরিষদের ছেলেদের গায়ে হাত তোলার সংবাদ পেয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা ছুটে আসেন। তাদের আসার খবর পেয়ে জাতীয় পার্টির সদস্যবৃন্দ এবং জাতীয় পার্টির নামধরে আসা আওয়ামী ক্যাডাররা চম্পট দেন। অফিসে এসে কাউকে না পেয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা জাতীয় পার্টির অফিস জ্বালিয়ে দেয়। এ অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটত না। কিন্তু এর উৎস হলো রংপুর জাতীয় পার্টি। হাসিনা সরকারের মদদে জনৈক মোস্তাফা রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। সপ্তাহখানেক আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দুই নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমের রংপুর সফরের কথা ছিল। সিটি করপোরেশন নেতা মোস্তাফা এ দুই নেতাকে রংপুরে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। তারপরও সারজিস রংপুর সফর করেন এবং যথারীতি তার সফরসূচি অনুযায়ী কাজ করেন। সারজিস আলম রংপুরে থাকা অবস্থায় মোস্তাফার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি তার বিরুদ্ধে মিছিল করে এবং তাকে ঢাকা ফিরে যাওয়ার স্লোগান দেয়।
রংপুরে জাতীয় পার্টির এ ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ উসকানিমূলক। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন রাজনৈতিক প্রতিবাদের মধ্যেই তাদের কর্মসূচি সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু ঢাকায় ছাত্রদের গায়ে হাত তোলার ফলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন পাল্টা আঘাত করে।
ঐদিকে আশুলিয়ায় একটি গার্মেন্টস কারখানায় দুই শ্রমিকের ঝগড়া-ঝাঁটি ও বাদানুবাদকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তার ফলে ঐ গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকরা তাদের কারখানা বন্ধ করে দেয়। তাদের দেখাদেখি আরো ৬টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ৭টি কারখানার শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করে। তাদের জমায়েতের মধ্যে সুকৌশলে ঢুকে পড়ে আওয়ামী লীগের উসকানিদাতা দালালরা (Agent provocateurs)। তারা সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে গাড়িটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। তারা ভেবেছিল, সেনাবাহিনীর গাড়ি পোড়ানোর প্রতিবাদে সেনাবাহিনী র‌্যান্ডম ফায়ার করবে। ফলে ঢাকা তথা দেশব্যাপী স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হবে। তবে প্রশাসন মাথা ঠাণ্ডা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে।
ঢাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়ে কুচক্রীরা চট্টগ্রামে ইসকন নামক হিন্দুদের একটি সংস্থায় অনুপ্রবেশ করে। সনাতন ধর্মের সাইনবোর্ড লাগিয়ে ইসকনের সাথে মিলে যায় আওয়ামী ঘরানার কয়েক হাজার কর্মী। ফলে তারা চট্টগ্রামে একটি বড় শোডাউন করে। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নামক আরেকটি উগ্র হিন্দু সম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। তারা হুমকি দিয়েছে, হিন্দুদের দাবি না মানলে তারা শিগগিরই ঢাকা ঘেরাও করবে। তাদের এ ঘোষণা শুনে তাদের কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাজার হাজার কর্মী প্রস্তুতি নিয়েছে। অতীতে এ স্বল্পমেয়াদি সরকারকে উৎখাত করার জন্য যেসব চক্রান্ত করা হয়েছিল, সেসব চক্রান্ত যেমন ব্যর্থ হয়েছে, ইসকনের এবারের চক্রান্তও তেমনি ব্যর্থ হবে।
এ ব্যাপারে ইনকিলাব মঞ্চ নামক একটি সংগঠনের মুখপাত্র শরিফুল ওসমান বিন হাদি গত ৪ নভেম্বর টিএসসিতে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ইসকনের মুখোশ উন্মোচিত করেছেন। ইসকনের দেওয়া ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানের বিরোধিতা করে শরিফুল ওসমান বলেন, বাংলাদেশের কোনো মন্দির-উপাসনালয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান শুনিনি। বাংলাদেশের হিন্দুরা ‘হরে কৃষ্ণ, হরে রাম’ বলেন। এ ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে গত ১০-১৫ বছরে ভারতে বিজেপি অসংখ্য মুসলমানকে হত্যা করেছে। এ স্লোগান ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’র মতো, যা দিয়ে সব অপরাধের বৈধতা দেওয়া হয়।
শরিফুল ওসমান বলেন, বাংলাদেশে একটি বয়ান তৈরি হয়েছে যে ইসকনের বিরুদ্ধে কথা বললেই হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়। ইসকন কোনোভাবেই বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীর প্রতিনিধি নয়। বরং তাদের হাতে বাংলাদেশের অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তারা গত কয়েক বছরে অনেক মন্দির দখল করেছে। ‘ইসকন বাংলাদেশে দাঙ্গা লাগাতে চায়। তারা বহির্বিশ্বে দেখাতে চায়, বাংলাদেশে দাঙ্গা লেগেছে। গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনার আমলে হিন্দুদের জমি দখল হয়েছে, তার বিরুদ্ধে ইসকন কোনো বিবৃতিও দেয়নি।’
বাংলাদেশে বিদ্যমান নীতি অনুযায়ী, এসব এনজিও প্রতিষ্ঠান কেবল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে। কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম করতে পারবে না। অথচ ইসকন যেসব কর্মকাণ্ড করছে, সবই রাজনৈতিক। তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করতে চেয়েছে। ইসকনের পরিচয় পরিষ্কার করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ইসকন কি ধর্মীয় সংগঠন নাকি রাজনৈতিক, তা পরিষ্কার করতে হবে। তারা রাজনৈতিক সংগঠনের মতো সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে কোন আইনে তারা নিবন্ধন পেয়েছে, তা প্রকাশ করতে হবে। গত ১০-১৫ বছরে তারা যে অনুদান পেয়েছে, তার সঠিক হিসাব এনজিও ব্যুরোর কাছে দেওয়া হয়েছে কিনা, তা জানাতে হবে।
গত ৩ নভেম্বর ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ঐ ভিডিওতে দেখা যায় যে, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের একজন নেত্রী অনর্গল বলতে থাকেন যে, সমগ্র বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর চরম নির্যাতন হচ্ছে। হিন্দুদের হত্যা করা হচ্ছে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের এ ন্যারেটিভ খুব জোরেশোরে প্রচার শুরু হয় খোদ নরেন্দ্র মোদির কণ্ঠ দিয়ে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও তার হাওয়া লেগেছিল। নির্বাচনে হিন্দু ভোট টানার আশায় সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমানে কমলা হ্যারিসের প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন যে, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর বর্বর অত্যাচার হচ্ছে। তিনি টুইট বার্তায় বলেন, বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর ‘বর্বর’ সহিংসতা চালানো হচ্ছে এবং তারা হামলা ও লুটপাটের শিকার হচ্ছেন। এসবের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ একটি সম্পূর্ণ ‘বিশৃঙ্খল’ অবস্থার মাঝে রয়েছে।
সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো এই যে, ‘জয় শ্রীরাম’ হলো বিজেপির পলিটিক্যাল স্লোগান। এটি সনাতন ধর্ম অর্থাৎ হিন্দু ধর্মের অফিসিয়াল ধর্মীয় স্লোগান নয়। কিন্তু ইসকন বাংলাদেশের অনেক মন্দিরে জয় শ্রীরাম স্লোগান দিচ্ছে। ইসকনের রেজিস্ট্রেশনে বলা হয়েছে যে, তারা অরাজনৈতিক একটি সংস্থা। কিন্তু বাস্তবে তারা আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ) এবং বিজেপির পলিটিক্যাল উইং হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছে।
বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ঢালাও প্রচারণা বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। তারা ঐ নেত্রীকে বলেন যে, হিন্দু হিসেবে বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের ওপর আক্রমণ চালানো হয়নি। শেখ হাসিনা যেমন জনরোষে ভারতে পালাতে বাধ্য হয়েছে তেমনি তার পলায়নের পর বাংলাদেশের অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী জনরোষের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে কিছু হিন্দুও আছে। কিন্তু তাদের হিন্দু হিসেবে ধরা হয়নি। তারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী হিসেবে জনরোষের শিকার হয়েছেন। তারা বলেন, আপনাদের সংগঠনের নামটিই তো সাম্প্রদায়িক। আপনাদের সংগঠনের নাম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কেন? মুসলমানদের নাম কোথায় গেল? অথচ মুসলমানরা এ দেশে মোট জনসংখ্যার ৯২ শতাংশ। তাদের বাদ দিয়ে ৮ শতাংশের জন্য একটি সংগঠন আপনারা বানিয়েছেন। এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা ও কর্মীরা দিতে পারেননি। তারা তাড়াতাড়ি ঐ স্থান ছেড়ে চলে যান।
ভারতের মদদপুষ্ট লোকাল এজেন্টরা ৬ আগস্ট রাতে নিরাপত্তা বাহিনীতে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করে। কিন্তু অন্যরা সেটি ব্যর্থ করে দেয়। তারপর জুডিশিয়াল ক্যুর ষড়যন্ত্র। সেটিও হাজার হাজার বিপ্লবী ছাত্র-জনতা সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও করে ব্যর্থ করে দেয়। এরপর একে একে আনসার বিদ্রোহ, শাহবাগে লাগাতার কয়েকদিন সনাতনী ধর্মের লোকজনের অবরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করে। এসব ষড়যন্ত্র জনগণ বানচাল করে দিয়েছেন। ভবিষ্যতেও তারা ব্যর্থ হবেন।
কারণ এটি ২০২৪ সাল। এটি ১৯৭১ সাল নয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের যে জনগণ ভারতের পক্ষে ছিলেন, আজ সেই একই জনগণ ভারতীয় আধিপত্যকে এদেশ থেকে বিতাড়িত করতে চান। তৎসত্ত্বেও মানুষের হুঁশিয়ার থাকা দরকার। কারণ শেখ হাসিনা আগামী ডিসেম্বরে খুব বড় ধরনের গোলযোগ সৃষ্টি করার জন্য তার নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের দিন শেষ। কিন্তু তাদের পেছনের মদদদাতা ভারতকে অত হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। তবে সব জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকলে ভারত বাংলাদেশের প্রতি তার কালো হাত বাড়াতে সাহস করবে না। ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-জনতা ষড়যন্ত্রের সব কালো হাত গুঁড়িয়ে দেবে।
Email: [email protected]