অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন মাস : সংস্কারের মাধ্যমে কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই গণপ্রত্যাশা


৮ নভেম্বর ২০২৪ ২০:৩১

॥ ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া ॥
বাংলাদেশের বয়স এখন আর কম বলা যাবে না। এটি এখন শিশুরাষ্ট্রও নয়, এক বছর দুই বছর, এক এক দশক করে পাঁচ দশক শেষ করে ছয় দশক অতিক্রম করছে। দেশটির বয়স ৫৪ বছর চলছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও অর্ধশতক বছর পরও আমাদের এদেশটি স্থিতিশীল হতে পারেনি। এ পাঁচ দশকে কোনো একটি দশকও দেখা গেল না, দেশে একটি স্থিতিশীল সরকার ছিল। যেই গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার নাম করে অজস্র জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা হলো, সেই গণতন্ত্র এদেশের সাধারণ মানুষ এখনো পায়নি। দেশটি জন্মের প্রথম দশক তথা ১৯৭০-এর দশকেই আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় শাসন কায়েম করে। তারপর খন্দকার মোশতাক আহমদ, জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশটাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে আরেক ভারতীয় দালাল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গণতন্ত্রকে হত্যা করে সামরিক শাসনে দেশকে অগণতান্ত্রিক নিগড়ে নিয়ে যায়। সাধারণ জনগণের ৯ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে দেশে আবার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু হয়। কিন্তু এ ব্যবস্থাও খুব বেশিদিন চালু ছিল না। ১৯৯০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু থাকলেও আওয়ামী লীগের কথিত আন্দোলন-সংগ্রামে দেশ স্থিতিশীলতা পায়নি। তারপর ২০০৯ সালে জাতির জীবনে আসে এক অমানিশার ঘোর অন্ধকার। ২০০৮ সালে বিশ্বাসঘাতক সেনা কর্মকর্তা মঈনউদ্দিন ও আমলা ফখরুদ্দিনরা এক কথিত নির্বাচনের মাধ্যমে দেশবিরোধী শক্তির পুতুল হিসেবে ফ্যাসিস্ট দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসায়। তার পরের ইতিহাস বড়ই করুণ।
বিগত ১৫ বছরে ফাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার নেতাকর্মীরা কী করেছে এবং কী হয়েছে, তার ইতিহাস বাঙালি জাতিসহ সারাবিশ্ব জেনেছে। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের অপকর্ম, অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড, হত্যা, খুন-গুম থেকে শুরু করে এহেন কোনো অনৈতিক কাজ নেই, তারা করেনি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট কর্মকাণ্ডের প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ করে আসছিল দেশের জনগণ। কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনা এসব প্রতিবাদকে কোনোরকম তোয়াক্কা না করেই খুন-হত্যা, গুম, রাহাজানি, লুটপাট করেই যাচ্ছিল। তবে জনগণের এ প্রতিবাদ গত জুলাই মাসে মহাবিস্ফোরণ ঘটে, সারা দেশের লাখকোটি মানুষ রাজপথে নেমে আসে। পতন ঘটে ফ্যাসিস্ট সরকারের, তার পরিণামে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মা স্বৈরাচারী হাসিনা। তারপর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের কথিত এমপি ও মন্ত্রীদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালায় আর বাকিরা দেশের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। অবশ্য লুকিয়ে থাকা ফ্যাসিস্টরা একের পর এক কট হচ্ছে সরকারের পাতা জালে।
ফ্যাসিস্টদের পতনের পর সর্বস্তরের জনগণের সমর্থন ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ৮ আগস্ট দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে। নোবেল বিজয়ী মানবতাবাদী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ২১ সদস্যের একটি উপদেষ্টা পরিষদ রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। বিভিন্ন বয়সী আমলা, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, এনজিও নেতৃত্ব, ছাত্র নেতৃত্বের সমন্বয়ে এ সরকার গঠন করা হয়েছে। গত ৭ নভেম্বর বৃহস্পতিবার এ অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকালের মেয়াদ তিন মাস পূর্তি হয়েছে। স্মরণকালের শান্ত ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছে।
এ তিন মাস বয়সী সরকারের কাছে সাধারণ জনগণের বড় কোনো প্রত্যাশা নেই। তবে নিত্যসঙ্গী কিছু বিষয়ে সরকারের নজর দেয়া দরকার। যেমন নিত্যপণ্যের দাম, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, শিল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা, দুর্নীতি দমন; বিশেষ করে সরকারি কার্যালয়গুলোয় ঘুষ লেনদেন, সাধারণ জনগণের নিত্যদিনের সেবাকে সহজলভ্য করা ইত্যাদি। তারপরও পুরো দেশের জনসমর্থিত এ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, শ্রমিক, ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক দলসমূহ, সিভিল সোসাইটি ও বুদ্ধিজীবীমহলসহ সকলের প্রত্যাশা অনেক বেশি। সর্বস্তরের মানুষ আশা করছেন, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ অতীতে সব জঞ্জাল পরিষ্কার করে সামনে এগিয়ে যাবে। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, বাকস্বাধীনতা পাবে, সুশাসন ফিরে আসবে, এককথায় সাধারণ জনগণ মুক্তি পাবে। অপরদিকে দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধ হবে, দেশের অর্থ পাচার আর হবে না, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খুন-গুম, হত্যা, অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ হবে, এককথায় দেশে ফ্যাসিবাদ আর স্বৈরাচার ফিরে আসবে না। জনসমর্থিত এ সরকারের কাছে জনগণের আকাশসম প্রত্যাশা। আর প্রত্যাশার যৌক্তিক কারণও আছে। কারণ এদেশের জনগণ তাদের মুক্তি ও কল্যাণের জন্য বার বার জীবন দিয়েছে, জানমালের ত্যাগ স্বীকার করেছে। কিন্তু জনগণের কাক্সিক্ষত মুক্তি মেলেনি। জনগণ বার বার প্রতারিত হয়েছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার, শেখ হাসিনা ও তার ফ্যাসিস্ট দল আওয়ামী লীগ কথিত এক চেতনার নামে দেশকে একটি কারাগারে পরিণত করেছিল। এবার জনগণ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুক্তির আকাক্সক্ষার প্রহর গুনছে। জনগণের প্রত্যাশা এবার বোধ হয় জনগণ একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ পাবে।
সুখী-সমৃদ্ধ একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে দশটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া এ দেশটিকে উদ্ধার করতে গত অক্টোবর মাসে সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, নির্বাচন ও পুলিশ বিভাগ সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারপর স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকার ও নারী বিষয়ক আরো চারটি কমিশন গঠন করা হয়েছে।
রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে যে ছয় কমিশন প্রধানদের সাথে গত ৩ নভেম্বর সোমবার বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সংস্কারের মাধ্যমে জাতি হিসেবে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতে চান। বৈঠকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী জানান, তার কমিশনের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সবার মতামত সংগ্রহ শুরু হয়েছে। কমিশনের সদস্যরা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সফর করে জনসাধারণের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন বলেও জানান তিনি।
মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন ক্যাডার প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময় শুরু হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন পেশ করার বিষয়ে তারা আশাবাদী।
আরেক বৈঠকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে অধ্যাপক ইউনূসকে জানান কমিশন প্রধান সফররাজ হোসেন। বৈঠকে সফর রাজ জানিয়েছেন, পুলিশ সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে ১০টি সভা করেছে। পাশাপাশি অংশীদারদের সঙ্গে চারটি বৈঠক করেছে। জনসাধারণের মতামত চেয়ে কমিশন একটি প্রশ্নমালা প্রস্তুত করছে, যা ইতোমধ্যে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
সফররাজ বলেছেন, কিছু আইন ও বিধি সংশোধনের প্রস্তাব এসেছে, যেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। এছাড়া কয়েকটি প্রক্রিয়া সহজ করে তোলার জন্য সুপারিশ করা হবে। মব নিয়ন্ত্রণে বলপ্রয়োগ পদ্ধতি পরিবর্তন করার প্রস্তাব নিয়েও কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান জানিয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধি-১৮৯৮-এর কয়েকটি ধারা পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং তা পরিবর্তন করা হবে কিনা, তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে।
এদিকে আরেক বৈঠকে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে জানান এ কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। বৈঠকে জানানো হয়, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অনুপস্থিত ভোটারদের জন্য পোস্টাল ব্যালট নিয়ে কাজ চলছে।
জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে ভোটার তালিকা সমন্বয় করা হচ্ছে জানিয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে জোর দিচ্ছে নির্বাচন সংস্কার কমিশন। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনপ্রধান শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনপ্রধান ইফতেখারুজ্জামান এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনপ্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ নিজেদের কমিশনের অগ্রগতি তুলে ধরেন। উল্লেখ্য, কমিশন গঠনের দিন থেকে ৯০ দিনের মধ্যে তাদের সরকারপ্রধানের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ জাতীয় সংসদ ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সংবিধান সংস্কারের সুপারিশ তৈরির জন্য অংশীজনদের মতামত ও প্রস্তাব নেবে সংবিধান সংস্কার কমিশন। আগামী সপ্তাহ থেকে রাজনৈতিক দল বাদে অন্য অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে তারা। তবে যেসব ব্যক্তি, সংগঠন, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক দল জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের সময় সক্রিয়ভাবে হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থেকেছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হত্যাকাণ্ড ও নিপীড়নকে সমর্থন করেছে, ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমকে বৈধতা দিতে সাহায্য করেছে, তাদের সংস্কার প্রস্তাবের সুপারিশ তৈরিতে যুক্ত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ কমিশন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলনের লক্ষ্যে সংবিধানের সামগ্রিক সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন, পুনর্বিন্যাস এবং পুনর্লিখনের বিষয় আসবে। এর মধ্য দিয়ে চিহ্নিত করা হবে কোন কোন জায়গায় সুনির্দিষ্টভাবে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন, পুনর্লিখন প্রয়োজন। পূর্বধারণা থেকে কমিশন কিছু করছে না। আলী রীয়াজ বলেন, তারা সব কটি বিষয় টেবিলে রাখছেন। তারা জানেন না, অংশীজনরা কী চান। অংশীজনদের কথা শোনার পর যা প্রয়োজন হবে, তা সুপারিশ করতে কমিশন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
আলী রীয়াজ বলেন, সাধারণ নাগরিকদের মতামত ও প্রস্তাব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সংগ্রহ করবে। আগামী ১২ নভেম্বর মঙ্গলবার থেকে ওয়েবসাইট কার্যকর হবে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ওয়েবসাইটের ঠিকানা জানিয়ে দেওয়া হবে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, গণঅভ্যুত্থানের জনআকাক্সক্ষা সম্পৃক্ত করেই তারা প্রস্তাব তৈরি করবেন। এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি, এ বিষয়গুলো বিভিন্ন আলোচনায় এসেছে। তবে এসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়ে গেছে, তা বলা যাবে না।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বর্তমান সরকার বাস্তবায়ন করবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য মাহফুজ আলম বলেন, তিনি এখানে (সংবাদ সম্মেলনে) প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে আসেননি। এটি একেবারেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে তাকে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ধরা হলে তিনি বলতে পারেন, অবশ্যই এ সরকারই বাস্তবায়ন করবে। তবে কোন প্রক্রিয়ায় সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হবে, তা খোলাসা করেননি তিনি।
মাহফুজ আলম বলেন, সংবিধান বিষয়ে যে প্রশ্নটা সেটা এক দফা ঘোষণার দিনই বাতিল হয়েছে। কারণ সেখানে বলা হয়েছিল, ‘পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আমরা খারিজ করছি, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চাই।’ নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত মানেই নতুন সংবিধান।
আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, সাতটি উদ্দেশ্য সামনে রেখেই সাংবিধানিক সংস্কার করা হবে। সেগুলো হলোÑ ১. দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিশ্রুত উদ্দেশ্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এবং ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আলোকে বৈষম্যহীন জনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। ২. ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো। ৩. রাজনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বস্তরে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ। ৪. ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার উত্থান রোধ। ৫. রাষ্ট্রের তিনটি অন্তনির্বাহী বিভাগ, আইনসভা এবং বিচার বিভাগের পৃথককরণ ও ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। ৬. রাষ্ট্রক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যাপ্ত ক্ষমতায়ন। ৭. রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক এবং আইন দ্বারা সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা।
সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা, অন্তর্বর্তী সরকার একটি সুখী-সমৃদ্ধ জনকল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজের পাশাপাশি দেশের চলমান সংকটগুলোর দিকেও জোরালোভাবে নজর দেবে। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের দাম ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি সাধারণ জনগণের রুজি রোজগার একেবারেই তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছিল। তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। তাই নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু এ দাম বৃদ্ধির একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রা আছে। উন্নত রাষ্ট্রগুলোয়ও নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে, তবে সেটা হচ্ছে শতকরা এক ভাগ থেকে তিন ভাগ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা পাঁচ ভাগ পযন্ত পৌঁছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জাপানে ২০২২ সালে মূল্যস্ফীতি ছিল দুই দশমিক ৫ শতাংশ আর ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয় তিন দশমিক ২৭ শতাংশ। মে মাসে জার্মানিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল মাত্র ২ দশমিক ৪ আর এপ্রিলে ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি সাধারণত ৫ শতাংশের মধ্যে থাকলে সাধারণ জনগণ কিছুটা সহ্য করতে পারে। কিন্তু দুই অংকের তথা ১০ শতাংশ বৃদ্ধি কোনোভাবেই জনগণের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হবে না।
গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ চিত্রে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ হয়েছে। গত আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। জুলাইয়ে দেশে মূল্যস্ফীতি হয় ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা ছিল গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে আশার বিষয় হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে টানা দুই মাস মূল্যস্ফীতি কমল। অবশ্য বিবিএসের পরিসংখ্যান নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের আস্থার অভাব রয়েছে। বিশেষ করে দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে পরিকল্পনামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত পরিবর্তন করে তাদের ইচ্ছামতো বসিয়ে দিতেন, যেটা সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হতো। অভিযোগ রয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকার নিত্যপণ্যের দামের বেলায় পরিসংখ্যান হেরফের করে কমিয়ে দিত আর জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বাড়িয়ে প্রকাশ করতে বিবিএসকে বাধ্য করত। যার কারণে অর্থনীতির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মধ্যে সমন্বয় করতো না। জনগণ আশা করে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তথ্যের এ ধরনের গোঁজামিল দেবে না।
তারপর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজটি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে প্রধানত দায়িত্ব হচ্ছে পুলিশ বিভাগের। বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগ যদি ইচ্ছে করে তাহলে তারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি একটি কাক্সিক্ষত মানে নিয়ে আসতে পারবে। তবে এজন্য প্রয়োজন পুলিশ বাহিনীর নৈতিক মানের উন্নয়ন ও পেশাগত ইথিকস ও মোরালিটি লালন করা। এককথায় পুলিশ বাহিনী দুষ্টের দমন করবে এবং শিষ্টের লালন করবে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
দুর্নীতি হচ্ছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা। তাই সরকারকে দুর্নীতি দমনে আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স তিন মাস হয়েছে। নির্বাহী বিভাগ তথা প্রশাসনের মাধ্যমেই সরকার রাষ্ট্রটি পরিচালনা করে থাকে। দেশের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় কমিশনার অফিস, সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সবই পরিচালিত হয়ে থাকে রাষ্ট্রের স্থায়ী কর্মকর্তা তথা প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তাদের দিয়ে। সরকারের সব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে প্রশাসনের এসব কর্মকর্তার মাধ্যমে। তাদের যদি নৈতিক দিক থেকে উন্নতমানে নেয়া যায়, তাহলে রাষ্ট্রে কোনো দুর্নীতি থাকতে পারে না। বিগত ৫৪ বছরের বাংলাদেশে দুর্নীতি না কমে বরং বেড়েছে, বিশেষ করে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলের এ দুর্নীতি আরো ফুলে ফেপে ষোলোকলায় পূর্ণ হয়েছিল। এ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে জনগণ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নেয়া কোনো কর্মসূচিরই সুফল পাবে না। দুর্র্নীতি; বিশেষ করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যালয়ে যে ঘুষ লেনদেন হয়, তার কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই সাংবাাদিকরা গণমাধ্যমে এ ঘুষ লেনদেন নিয়ে প্রমাণিত কোনো নিউজ বা প্রতিবেদন লিখতে পারে না, তাই ছাপতে পারে না। এসব ঘুষ লেনদেনের বিষয়গুলো রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সদস্যরাই অপেক্ষাকৃত ভালো করে জানেন। তবে বিভিন্নভাবে জানা গেছে যে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেবা খাতের কার্যালয়গুলোসহ অধিকাংশ অফিসে এখনো আগের মতো ঘুষ লেনদেন চলছে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে এ ব্যাপারে তীক্ষè দৃষ্টি দেয়ার পাশাপাশি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এককথায় সরকারকে দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্স হতে হবে এবং কথায় নয়, বাস্তবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও দমনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতির দেশ। দুইশত দেশের মধ্যে ৩৫তম অর্থনীতির দেশ অবশ্যই এটা অনেক বড় অর্জন। বিশ্ব অর্থনীতিতে অনেক খাতেই বাংলাদেশ তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে রয়েছে। যেমন গামেন্টস খাতে রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। সরকার যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও গ্যাসসহ জ¦ালানি খাতে সহায়তা দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরো দ্রুত এগিয়ে যাবে বলেই অর্থনীতিবিদদের প্রত্যাশা।
বিগত তিন মাসে দেশের রাজনৈতিক ময়দানের ছোটখোটো কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ছাড়া সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ময়দান থেকে বিতাড়িত, অবশ্য তার দোসর জাতীয় পার্টি কিছু রাজনৈতিক অপতৎরতা চালানোর অপচেষ্টা করেছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার প্রতিরোধে এসব অপতৎপরতা হালে পানি পায়নি। একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে সংস্কার কমিশনগুলো যেভাবে কাজ করছে, আশা করা যায় তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি কল্যাণরাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের কাজটি শুরু হবে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসও বলেছেন, সংস্কারের মাধ্যমে জাতি হিসেবে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতে চান। গড়ে তুলতে চান এদেশের ছাত্র-জনতারও প্রত্যাশা সুখী-সমৃদ্ধ নতুন বাংলাদেশ।