দেশের স্বার্থে জাতীয় ঐক্য গড়তে হবে
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:০০
বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা, তাজা জীবনদান ও রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ এখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে। ১৯৭১ সালের পর এবারই প্রথম একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকার হিসেবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বদরবারে ভূমিকা পালন শুরু করেছে। দেশের অভ্যন্তরেও রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন ও কাজ করছে। তাই একটি প্রতিবেশী দেশ ও তাদের এ দেশীয় দালালদের গাত্রাদাহ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতের রাজনীতিক, সাংবাদিক ও হিন্দুত্ববাদীরা বাংলাদেশ নিয়ে খুবই বিরূপ মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলাও করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য খুবই দুঃখজনক। মমতা বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠানোর প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে সমর্থন জানিয়ে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের সব অপচেষ্টা রুখে দিতে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন দেশের ৫০ জন বিশিষ্ট নাগরিক। জাতীয় ঐক্য গড়তে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছাত্রনেতৃবৃন্দসহ রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় নেতাদের সাথে পৃথক বৈঠক শুরু করেছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশ কঠিন সময় পার করছে উল্লেখ করে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ৪ ডিসেম্বর বুধবার ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ কমপ্লেক্সে ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স ২০২৪ এবং আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স ২০২৪-এর কোর্স সমাপনী অনুষ্ঠানে সার্টিফিকেট প্রদান শেষে এ কথা বলেন তিনি।
অপরদিকে ভারত বাংলাদেশের পতিত স্বৈরাচার খুনি হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে তার মাধ্যমে বিভিন্ন অপতৎপরতা চালাচ্ছে। কয়েক হাজার মানুষ হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া হাসিনাকে ভারত নিরাপদে আশ্রয় দিয়েছে। আর শেখ হাসিনা ভারতের বিজেপি সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে অবস্থান করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করছেন। এখানে এমন ভূমিকা ভারতকে বন্ধ ুরাষ্ট্র নয়, শত্রু রাষ্ট্রে পরিণত করছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান গত ২ ডিসেম্বর সোমবার তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি তার স্ট্যাটাসে বলেন, ‘ভারত নিজের দেশে তার প্রতিবেশী দেশের কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা দিতে যেখানে ব্যর্থ, সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলার কোনো অধিকার তাদের থাকতে পারে না। বাংলাদেশের জনগণ তাদের মাথার ওপর কারো দাদাগিরি একদম পছন্দ করে না। আমরা বাংলাদেশের জনগণকে সতর্ক থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। জাতীয় ঐক্যই তার কার্যকর ওষুধ।’
বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠানো নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার বক্তব্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
লন্ডনে অবস্থানরত মির্জা ফখরুল গত ২ ডিসেম্বর সোমবার রাতে টেলিফোনে গণমাধ্যমের কাছে দলের পক্ষ থেকে এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘সকালে কয়েকটি পত্রিকায় সংবাদ দেখলাম। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে উক্তি করেছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে সে বিষয়ে আমি বক্তব্য না রেখে পারছি না। তিনি (মমতা) যে উক্তি করেছেন, বাংলাদেশে শান্তি বাহিনী পাঠানোর, এটা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি একটা হুমকিস্বরূপ এবং আমরা মনে করি, এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাদের নেতৃবর্গের যে দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা হলেও প্রকাশিত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার এ বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করা উচিত। এ ধরনের কোনো চিন্তাও তাদের মধ্যে থাকা উচিত হবে না। কারণ বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে এবং সম্প্রতি একটা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তারা গণতন্ত্রকে ফিরে পেয়েছে। এদেশের মানুষ যেকোনো মূল্যে এ ধরনের চক্রান্তকে রুখে দাঁড়াবে’, গত ২ ডিসেম্বর সোমবার বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনে যোগ দিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ চান। তিনি বলেন, আমাদের প্রস্তাব, ভারত সরকার জাতিসংঘের কাছে বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী পাঠানোর আর্জি জানাক। তারা যাতে আমাদের লোকজনকে বাংলাদেশ থেকে উদ্ধার করতে পারে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ক্ষুণ্ন হওয়া বা বিপন্ন হওয়ার যে অলীক কাহিনী ভারতীয় মিডিয়াগুলোয় প্রচারিত ও প্রকাশিত হচ্ছে, তা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
‘আমরা বার বার বলেছি, এখানে ভারতের সাংবাদিকরা এসেছিলেন তারাও দেখেছেন। পশ্চিম বাংলা ও ভারতের অনেক নামকরা সাংবাদিক এসেছিলেন। তারা দেখেছেন, বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি নেই। অথচ ভারতের মিডিয়া ও তাদের নেতৃবৃন্দ যেভাবে সম্পূর্ণ একটা মিথ্যাকে প্রচার করছেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি দিচ্ছেন, তা কোনোমতেই বাংলাদেশের মানুষ গ্রহণ করবে না’, যোগ করেন তিনি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশ সম্পর্কে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে যে কথাগুলো বলা হচ্ছে, অতি সম্প্রতি ইসকনকে নিয়ে যে এখানে নতুন করে চক্রান্ত শুরু হয়েছে, তা বাংলাদেশের মানুষ কখনোই গ্রহণ করবে না।’
‘এটা খুব পরিষ্কার যে, ইসকনের সাম্প্রতিক ভূমিকা অত্যন্ত সন্দেহজনক, রহস্যজনক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি, বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকিস্বরূপ’, বলেন তিনি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান গত ২ ডিসেম্বর সোমবার ঝালকাঠিতে ইউনিয়ন দায়িত্বশীল সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, দেশকে স্থিতিশীল রাখতে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা নানামুখী চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে উসকানি দিচ্ছে। এ ব্যাপারে দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। তারা যতই চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করুক, তাদের পাতানো ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। একটি উগ্রগোষ্ঠী বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চট্টগ্রাম আদালতের এক আইনজীবীকে হত্যা করেছে। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশকে উত্তপ্ত করতে। কিন্তু এদেশের শান্তিপ্রিয় মুসলমানরা তাদের সেই পাতানো ফাঁদে পা দেয়নি।
তিনি আরও বলেন, এদেশে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলে মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তিতে বসবাস করছে। আমরা এমন বাংলাদেশ চাইÑ যেখানে কোনো ধর্মীয় উপাসনালয় পাহারা দিতে হবে না। যেখানে কোর্ট কাচারী, অফিস আদালতে কোথাও গিয়ে আপনি লাঞ্ছিত হবেন না। কৃষক তার ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন। শ্রমিক পাবেন তার ঘামের মজুরি। জামায়াত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে কাউকে অধিকার ভিক্ষা করতে হবে না। সবাইকে তার অধিকার সম্মানের সাথে দেওয়া হবে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘের শান্তিবাহিনী পাঠানোর যে প্রস্তাব করেছেন, তার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভি বলেছে, ভারতের তাঁবেদার রেজিম উৎখাতের ফলে অনৈতিক স্বার্থ হাসিলে ছেদ পড়ায় সেখানকার রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা এখন বেসামাল হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশের জনগণ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে বিস্মিত ও হতভম্ব হয়েছে। এদেশের মানুষ তাকে একজন সেক্যুলার ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ হিসেবেই জানতো। কিন্তু এ বক্তব্যে প্রমাণিত হয়েছে কট্টর হিন্দুত্ববাদী ও মমতার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
গত ২ ডিসেম্বর বিকেলে নয়াপল্টনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। রিজভী বলেন, বাংলাদেশ ১৮ কোটি মানুষের দেশ। এদেশ কীভাবে চলবে, সেটি এদেশের জনগণ নির্ধারণ করবে। কোনো দেশের গভীর চক্রান্তের নীলনকশা কখনোই এখানে বাস্তবায়ন হবে না।
জাতীয় ঐক্যের ডাক ৫০ বিশিষ্ট নাগরিকের
অন্তর্র্বর্তী সরকারকে সমর্থন জানিয়ে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের সব অপচেষ্টা রুখে দিতে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন দেশের ৫০ বিশিষ্ট নাগরিক। গত ৩০ নভেম্বর শনিবার এক যৌথ বিবৃতিতে তারা এ আহ্বান জানান।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে বিবৃতিটি শেয়ার করেন। এতে বলা হয়, গত ৫ আগস্ট ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটে এবং শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যান। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এক নতুন সূচনার সাক্ষী হয়। এরপর অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তী প্রশাসন সমাজের সর্বস্তরের ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। দেশের সামনে এখন জরুরি কাজ হলো রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস পুনঃস্থাপন, অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং একটি গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ তৈরিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন।
বিবৃতিতে বলা হয়, এ প্রেক্ষাপটে পতিত শাসনের শক্তিগুলো তাদের বিদেশি পৃষ্ঠপোষকদের প্রকাশ্য এবং গোপন সমর্থনে দেশে বিভাজন সৃষ্টিতে সক্রিয় রয়েছে। তারা মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচার ছড়াচ্ছে এবং সহিংসতা উসকে দিচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচারের অতিরঞ্জিত, বানোয়াট এবং ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা প্রতিবেদন প্রচারের মাধ্যমে একটি সম্মিলিত প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এ প্রোপাগান্ডার ফলে ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামে সাইফুল ইসলাম নামে একজন সরকারি কৌঁসুলিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এতে বলা হয়, আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাই এবং দ্রুত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করি। এ শোকাবহ পরিস্থিতি এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে। যেকোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াবে। তবে বাংলাদেশের জনগণ সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন করেছে এবং সহিংসতা বৃদ্ধির যেকোনো চেষ্টাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করেছে। হত্যাকারীরা কোনো সম্প্রদায়, ধর্ম বা গোষ্ঠীর প্রতিনিধি নয়। বরং তারা শেখ হাসিনা ও তার পৃষ্ঠপোষকদের এজেন্ট হতে পারে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, যদি তদন্তে এটি প্রমাণিত হয়, তবে এটি নিশ্চিত করবে যে, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি। এ পরিস্থিতিতে সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শন করতে হবে, যখন আমরা বাংলাদেশের পুনর্গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছি।
বিবৃতিতে তারা বলেন, যেকোনো উত্তেজনাপূর্ণ আহ্বান বা কার্যকলাপ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করতে পারে এবং পতিত স্বৈরাচারীকে সুবিধা দিতে পারে। এছাড়া হাসিনা শাসনের রেখে যাওয়া বিশাল অর্থনৈতিক গহ্বর থেকে আমরা এখনো বেরিয়ে আসতে পারিনি। সাম্প্রদায়িক বা রাজনৈতিক সহিংসতা আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো খারাপ করবে এবং এ মুহূর্তে অতি প্রয়োজনীয় দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকে ভীতি প্রদর্শন করবে। এতে বলা হয়, আমরা সব বাংলাদেশিকে ধর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শ, আদর্শ, লিঙ্গ, বয়স বা যেকোনো বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে এ হুমকির মুখে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানাই। আমরা বাংলাদেশের ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বরের প্রতি আমাদের সংহতি প্রকাশ করছি।
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ গবেষণা বিশ্লেষণ ও তথ্য নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ড. রুমি আহমেদ খান, ডায়াস্পোরা অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্র্যাসির প্রতিষ্ঠাতা ড. শামারুহ মির্জা, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট ডা. শফিকুর রহমান, আইনজীবী এহতেশামুল হক, অর্থনীতিবিদ ও লেখক মো. জ্যোতি রহমান, বিজ্ঞানী ও অ্যাক্টিভিস্ট ড. ফাহাম আবদুস সালাম, প্রকৌশলী নুসরাত খান মজলিশ, বিজ্ঞানী মো. নুসরাত হোমায়রা, ড. সৈয়দ রউফ (পাবলিক সার্ভিস, কানাডা), অর্থনীতিবিদ ও সামাজিক উদ্যোক্তা নাজিয়া আহমেদ, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট মেজর (অব.) শাফায়াত আহমদ, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী আহমদ হাবিবুর রহমান, শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার কর্মী সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া, সিডনি পলিসি অ্যানালাইসিস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক ড. মোবাশার হাসান, অস্ট্রেলিয়ার পাবলিক সার্ভেন্ট ইফাত তাবাসসুম, অধ্যাপক ড. সাইফুল খোন্দকার, ডেটা ইঞ্জিনিয়ার ও মানবাধিকার কর্মী রূপম রাজ্জাক (যুক্তরাজ্য), ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট ও ফিন্যান্স প্রফেশনাল ড. মোহাম্মদ মিয়া প্রমুখ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিভিউলুশানারি যুদ্ধে জন ডিকেনসন ১৯৬৮ সালে একটি বিপ্লবী গান গেয়েছিলেন যাকে লিবার্টি সং হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। গানটির গুরুত্বপুর্ণ একটা কলি ছিল এমন, ‘ঞযবহ লড়রহ যধহফ রহ যধহফ, নৎধাব অসবৎরপধহং ধষষ, ইু ঁহরঃরহম বি ংঃধহফ, নু ফরারফরহম বি ভধষষ.’ অর্থাৎ তাহলে এসো হাতে হাত মেলাই, আমরা সব সাহসী আমেরিকান! ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা দাঁড়াই, বিভক্ত হলে আমাদের পতন হবে।
আমেরিকানরা নিজেদের মধ্যে কোনো কোনো ব্যাপারে দ্বিমত থাকলেও জাতি হিসেবে ৫০টি রাজ্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে বিগত আড়াইশত বছর যাবত। তাই আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর একক পরাশক্তি।
ঐক্যবদ্ধতার ব্যাপারে দৈনিক নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন তার ঘৃণায় ঈর্ষায় আবৃত সময় গ্রন্থে ‘বিজয় দিবসের কিছু ভাবনা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘যে জনগোষ্ঠী সতর্ক এবং ঐক্যবদ্ধ, যারা তাদের সত্যিকারের স্বার্থের খবর রাখে, তারাই নিজেদের সুন্দর সুস্থ নিরাপদ জীবনকে অক্ষুণ্ন রাখছে। বাংলাদেশকে এদের অনুসরণ করতে হবে।’
জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে যেমন সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগেও আল্লাহ কুরআনুল হাকিমে ও তার রাসূল হযরত মুহাম্মদ সা. গুরুত্ব দিয়ে মুসলিমদের আহ্বান জানিয়েছেন। আল্লাহ আল কুরআনে বলেছেন ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রশি আঁকড়ে ধরো এবং বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)।
রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর সাহায্য ঐক্যবদ্ধতার সঙ্গে। যে ব্যক্তি মুসলিম ঐক্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, সে জাহান্নামের দিকে অগ্রসর হলো’। (তিরমিযী : ২১৬৭)। হযরত আবুজর গিফারী (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলিম ঐক্য থেকে এক বিঘত বিচ্ছিন্ন হলো, সে তার গর্দান থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলল’। (আবু দাউদ : ৪৭৫৮)। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আনুগত্য থেকে বের হয়ে যায় এবং ঐক্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সে জাহেলি যুগের মৃত্যুবরণ করবে। অর্থাৎ কবিরা গুনাহ নিয়ে মরবে।’ (মুসলিম : ১৮৪৮)। রাজনীতি বিশ্লেষকরাও বলছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৈৗমত্ব রক্ষা ও দেশকে এগিয়ে নিতে হলে ফ্যাসিবাদি রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, জনতার সাথে রাষ্ট্রের সব অঙ্গ ও বিভাগের ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
ইতোমধ্যে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী শীর্ষনেতারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতীয় ঐক্য গড়তে গত ৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্রনেতাদের সাথে বৈঠক করেছেন এবং ৪ ডিসেম্বর বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক করেছেন। ছাত্রনেতাদের সাথে বৈঠক শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা যে বৈঠক করছেন, তার উদ্দেশ্য হলো জাতীয় ঐক্য।
ঐক্যবদ্ধ হওয়া মুসলিমদের জন্য জরুরি এবং ঐক্য বিনষ্ট করা মহাপাপ। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন জাতির নেতারা তাদের কওমকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন। যে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে সে জাতিকে বিশ্বের অন্য কোনো জাতি পরাজিত বা পদানত করতে পারেনি।
যুগে যুগে ইতিহাস ও সাহিত্যের পাতায় পাতায় ঐক্য ও একতার ওপর অনেক কাহিনী ও গল্প আছে। সর্বোপরি বাংলাদেশের মুসলিমদের আল কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আর পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে প্রতিবেশী দেশের ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি যত হুঙ্কার দিক, তাতে বাংলাাদেশের জনগণকে পদানত করতে পারবে না। তাই বাংলাদেশের মুসলিমরা যদি একক নেতৃত্বের অধীনে ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়তে পারে, তাহলে এদেশ শুধুই সামনে এগিয়ে যাবে। কেউ বাংলাদেশিদের রুখতে পারবে না।