রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ও ডকট্রিন অব নেসেসিটি


১ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:০৪

॥ হারুন ইবনে শাহাদাত ॥
কথায় আছে, ‘পিছনে জানের জ্যান্ত শত্রু রেখে সামনে পা বাড়ায় সেই বোকারা যাদের জন্ম হয়েছে অপঘাতে মরার জন্য।’ বার বার পরীক্ষিত নির্মম ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তারা ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে সংবিধান নয়, ‘আই এম দ্য স্টেটস এন্ড মাই ওয়ার্ড ইস দ্য ল’ ফ্রান্সের স্বৈরাচারী রাজা ষোড়শ লুইয়ের এ দর্শনে বিশ^াসী। তাদের তৈরি করা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে যারা অবৈধ ডামি সংসদের ফ্যাসিস্ট সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত অবৈধ রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে পদে রাখতে যারা কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন, তাদের প্রসঙ্গে এমন মন্তব্য করেছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগ বার বার পরীক্ষিত ফ্যাসিস্ট। কারণ তারা স্বাধীনতার পর থেকে যতবার ক্ষমতায় গেছে এবং বিরোধীদল হিসেবে রাজপথে আন্দোলন করেছে, সর্বত্র তাদের ফ্যাসিবাদী নগ্নরূপ জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, ‘আওয়ামী লীগের ডিএনএ-তে ফ্যাসিজম আছে।’ তারপরও তারা কেন ফ্যাসিজমের শক্তির উৎস বর্তমান সংবিধানের আলোকে শপথ রক্ষা এবং সংবিধান রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তা সত্যি রহস্যজনক। এ রহস্যের জট খুলে নতুন শপথে পথ চলা শুরু করতে ব্যর্থ হলে সীমান্তের ওপার থেকে যে ‘হুমকি-ধমকি’ আসছে, তা বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাই সাদাকে সাদা, কালোকে কালো মেনে নিয়ে বর্তমান অবৈধ রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিশ্চিত করতে হবে। ২০২৪-এর ৩৬ জুলাই বিপ্লবের চেতনা ধারণ করেন এমন একজন সৎ-যোগ্য সর্বজনশ্রদ্ধেয় তীক্ষè বুদ্ধির অধিকারী সাহসী ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের এ সর্বোচ্চ আসনে বসাতে হবে।
সাদাকে সাদা কালোকে কালো
শেখ হাসিনার সরকার দেশের সংবিধানকে কেটে-ছিঁড়ে নিজের ডায়েরি বইয়ে পরিণত করেছিলেন। আইন-আদালত চলতো তার আঙ্গুলির ইশারায়। এ কথা কারো অজানা নয়। তাই তার শাসনামলে সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলার সাহস খুব কম লোকেরই ছিল। যারা সাহস দেখাতেন, তাদের হয় ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হতো, নয়তো আয়নাঘরে বন্দি করে রাখা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন থেকে বাঁচতে অনেক সাহসী নেতৃত্ব পাড়ি দিয়েছিলেন দেশের বাইরে। এটাই বাস্তবতা। তাই তো রাষ্ট্রপতি পদ লাভজনক কি না, সংবিধানের এমন ব্যাখ্যা এবং হাজার হাজার পৃষ্ঠা খরচ করেছেন আওয়ামীপন্থী আইনজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা।
যে সংবিধান বাতিল না করলে ফ্যাসিবাদের শিকড় উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়, সেই সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা সম্পর্কে বলা রয়েছে। সেই অনুচ্ছেদ অনুসারে, ‘কোনো ব্যক্তি কেবল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী হইবার কারণে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হইবেন না।’ এ ধারার ব্যাখ্যায় সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক মনে করেন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য যে পদগুলোকে লাভজনক নয় বলা হয়েছে, তা শুধু সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রযোজ্য হয়। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রপতি পদে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অতীতে অনেকে সংসদ নির্বাচন করেছেন। সে কারণে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতার শর্তের ক্ষেত্রে সংবিধানে এ বিধান আনা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিকের মত হচ্ছে, সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতার প্রশ্নে সংবিধানের ওই বিধানে যখন বলা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি ও অন্য পদগুলো লাভজনক পদ বলে গণ্য হবে না, তখন এর অর্থ দাঁড়ায়, রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক পদ। কিন্তু তা সংসদ নির্বাচনে গণ্য হবে না বলে বলেছেন তিনি।’ কিন্তু তাতে কি দেশে আইনজীবীর অভাব নেই, মানে ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না, আর শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষে দাঁড়ালে শুধু কি ভাত আরো কত কী পাওয়া যায়, তা তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ‘আমার পিয়নের আছে চারশ’ কোটি টাকা।’ আর আদালতকে তার আমলে রসিকজনরা বলতেন, ‘কোর্ট কই পাবেন, সব তো এখন মুজিব কোটে পরিণত হয়েছে।’ সেই মুজিব কোট থেকে বৈধ বলে রায় দেয়। ১৫ মার্চ ২০২৩ সালে দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন বলা হয়, মো. সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন প্রক্রিয়া বৈধ বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে এ সংক্রান্ত দুটি রিটই খারিজ করেছেন আদালত। ১৫ মার্চ ২০২৩ বিচারপতি খসরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।’ এ রায় না দিলে তার পরিণত হতো প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এবং তারেক রহমানকে খালাস দেয়া বিচারপতি মোতাহার হোসেনের মতো- এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কারণ সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলা সেদিন ছিল অপরাধ। কারণ ফ্যাসিবাদের রানির কথাই ছিল সেদিন আইন।
তারপরও কেন দিন বদল হচ্ছে না
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, ফ্যাসিবাদের রানি পালিয়েছেন সত্য, তার দোসররা এখনো আছেন। শুধু আছেন বললে ভুল হবে, ক্ষমতার কেন্দ্রে আছেন। এমনকি বিরোধীদলেও আছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব খ্যাতনামা রাজনীতি বিশ্লেষক, লেখক ও সাংবাদিক মারুফ কামাল খান তার ভেরিফাইড ফেসবুকে এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, ‘রাজনীতি তো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসছি অনেককাল ধরেই। আমি কখনো বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল একজন আওয়ামী লীগারও দেখিনি। এখন আওয়ামী লীগের প্রতি পরম সহানুভূতিশীল বহু বিএনপি দেখতে পাচ্ছি চারদিকেই। এখন বুঝতে পারছি, টানা ষোলোটা বছর ধরে আমাদের কেন এতটা নির্যাতন ভোগ করতে হলো। বুঝতে পারছি, কেন বিএনপির সব আন্দোলনই শেষ অব্দি ব্যর্থ হতো। বুঝতে পারছি, কেন ওরা এত নির্বিঘ্নে ষোলোটা বছর ধরে রাজ্যপাট চালাতে পেরেছে। বুঝতে পারছি, কেবল পুলিশ, প্রশাসন ও সন্ত্রাসীরা নয়, ওদের ক্ষমতার আধার তো বিরোধী শিবিরেও ছিল।’
তাহলে প্রশ্ন হলোÑ এদের কারণেই কী সোনালি সূর্যোদয় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফ্যাসিবাদের অন্যতম শক্তিশালী পাওয়ার হাউস বঙ্গভবনে বসে নীলনকশা আঁকার সুযোগ পাচ্ছেন। সেই নীলনকশা বাস্তবায়নের স্বপ্নকাঠি নেড়ে ভারতের দিল্লি থেকে এপারের সন্ত্রাসীদের আদেশ দিচ্ছেন, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের হত্যা ও তাদের ঘরবাড়ি জ¦ালিয়ে দেয়ার ও গুপ্তহত্যার। দলীয় সন্ত্রাসী ও ক্যাডারদের নির্দেশ দিচ্ছে, ‘তাদের ঘরবাড়ি কি নেই…। সবকিছু কি প্রকাশ্যই করতে হবে…।’ এপার থেকে সায় দিচ্ছে ‘না আপা …।’
প্রেসিডেন্ট চুপ্পু শুধু অবৈধভাবে নির্বাচিতই নন। তিনি শপথও ভঙ্গ করেছেন। তার নেত্রীর পদত্যাগ সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছেন।
চুপ্পুর যত অপরাধ
রাষ্ট্রপতি চুপ্পুর বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক লুটের সাথে জড়িয়ে আছে তার নাম। তাছাড়া তিনি বার্বাডোজের নাগরিক। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে ১,৫০,০০০ রিংগিত বিনিয়োগ এবং দুবাইয়ের কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত ও ওয়ারাদ জেনারেল ট্রেডিং এলএলসি নামের দুবাইয়ে নিবন্ধিত একটি প্রতিষ্ঠানে ব্যবসায়িক বিনিয়োগের বিনিময়ে রেসিডেন্স ভিসা পাওয়ার প্রমাণস্বরূপ বিভিন্ন কাগজপত্র তাদের হাতে আছে বলে জানিয়েছে বাংলা আউটলুক নামের একটি পত্রিকা।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেছেন, ‘একমাত্র বাংলাদেশেই এমন অদ্ভুত বিষয় দেখা যায়। অন্য দেশের নাগরিক হয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হওয়া যায়। এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এর জন্য তার শাস্তি হওয়া উচিত। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু যেকোনো সময় পদত্যাগ করবেন। তার পদত্যাগ করা উচিত। তার রাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্যতা নেই। তিনি আপাদমস্তক একটা দুর্নীতিবাজ লোক। আমরা শুনেছি, তিনি বার্বাডোজের নাগরিক হয়েছেন। এটা মনে হয় শুধু বাংলাদেশেই হয়- অন্য দেশের নাগরিক রাষ্ট্রপতি। চুপ্পু সাহেব দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাকে কেন বানানো হয়েছিল, কারণ পদ্মা সেতুতে একটা বড় দুর্নীতি হয়েছে। এটা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক মনে করে, আমরাও মনে করি। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যখন তদন্তে আসে, এটা জেনেই শেখ হাসিনা চুপ্পুকে ওখানে বসিয়ে দিলেন। এরপর সেই মেয়াদ শেষ হলে ওনাকে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান করলেন। আশ্চর্য উনিই হলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।’
সংবিধান লঙ্ঘন করে যাকে রাষ্ট্রপতি করা হয়েছে, তাকে রক্ষা করতে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসছে- যারা এ কথা বলেছেন, সেই উপদেষ্টাদের সাংবিধানিক ভিত্তি কী?
উপদেষ্টাদের জবাবদিহি ও ডকট্রিন অব নেসেসিটি
সংবিধানের ৫৫ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘মন্ত্রিসভা সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকিবে’। এখন যেহেতু সংসদ নেই ডকট্রিন অব নেসেসিটি হিসেবে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর উপদেষ্টারা শপথ নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। নেসেটিটি এটাকে লিগ্যাল করে। তাই তাদের দায়বদ্ধতা সংসদ নয়, ছাত্র-জনতার প্রতিনিধিদের কাছে। তাদের কাছে অবশ্যই তারা জবাবদিহি করতে বাধ্য। তাই তাদের চাওয়াকে মূল্য দিয়ে ডকট্রিন অব নেসেসিটির ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এতে সাংবিধানিক শূন্যতার প্রশ্ন অবান্তর। শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নয়, এর আগের সরকারগুলোর উপদেষ্টাদের নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। যেমন: ২০১৪-এর ১১ ফেব্রুয়ারিতে একবার এ প্রশ্ন উঠেছিল। উপদেষ্টাদের মন্ত্রিসভার বৈঠকে অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন আওয়ামী লীগের মরহুম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল। তখন সবাই বলেছিলেন, সংবিধানে উপদেষ্টা পদটি এসেছিল কেবল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষেত্রে। তারপরও প্রতিটি সরকারের আমলেই সংসদ সদস্যদের বাইরে থেকে উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে এবং তারা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পর্যন্ত পাচ্ছেন। আর তা হচ্ছে সরকারের নির্বাহী আদেশের ভিত্তিতে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার মরহুম রফিক-উল হক বলেছিলেন, উপদেষ্টারা (রাজনৈতিক সরকারের) কোথাও কোনো শপথ নিচ্ছেন না। তারা রুলস অব বিজনেস অনুসারে নিয়োগ পাওয়া। শপথ না নিয়েই তারা মন্ত্রিসভায় বসছেন, বিভিন্ন কাজে হস্তক্ষেপ করছেন। এটা একটা বিস্ময়।’ অবশ্য সেই প্রেক্ষাপট আর বর্তমান প্রেক্ষাপট এক নয়। রাজনৈতিক সরকারের উপদেষ্টারা শপথ ছাড়া দায়িত্ব পালন করলেও এখন যারা আছেন (অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা) তারা এর ব্যতিক্রম। তাই তাদের কাজের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।
পদত্যাগ ও শপথবাক্য
ডকট্রিন অব নেসেসিটি উপেক্ষা করে যারা প্রশ্ন তুলছেন, রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন? কে শপথ বাক্যপাঠ করাবেন। তাদের প্রশ্নের উত্তর মেলে গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক শহীদুল্লাহ ফরায়জী লেখা সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত মন্তব্য প্রতিবেদনে। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বের অধিকাংশ দেশে রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্টকে শপথবাক্য পাঠ করান সেই দেশের প্রধান বিচারপতি। সংসদীয় সরকার পদ্ধতি বা রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতির দেশেও রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণ করেন প্রধান বিচারপতির নিকট। এটা বিশ্বব্যাপী সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত রেওয়াজ। কিন্তু বাংলাদেশে এর ব্যত্যয় দেখা যাচ্ছে।… বাংলাদেশে দুটি পদকে সংবিধান প্রজাতান্ত্রিক মর্যাদা দিয়েছে। পদ দুটি হলোÑ ১. রাষ্ট্রপতি এবং ২. প্রধান বিচারপতি। (এই দুজনের পদ এবং পদবির সাথে প্রজাতন্ত্রের নাম জড়িত রয়েছে) সংবিধানের ৪৮(১)-এ বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকিবেন। যিনি আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হইবেন। রাষ্ট্রপ্রধান রূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন।’ সংবিধানের ৯৪ (২)-এ বলা হয়েছে, “প্রধান বিচারপতি, যিনি ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’ নামে অভিহিত হইবেন।” ‘বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি’ এবং ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’ সংবিধানে উল্লেখ করায় পদ দুটিতে প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়েছে। সুতরাং এ দুটি পদ পরস্পরের দ্বারা পরিচালিত শপথে রাষ্ট্রের প্রতি অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবেনÑ এটাই প্রজাতন্ত্রের জন্য ন্যায়সঙ্গত। প্রধান বিচারপতিকে ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’ হিসেবে অভিহিত করার মাঝে প্রজাতন্ত্রের সুমহান উদ্দেশ্য ও অভিসন্ধি রয়েছে, যা অনেকেই গভীরভাবে খতিয়ে দেখেন না বা যুক্তির কষ্টিপাথরে পরীক্ষা করতে পারেন না। রাষ্ট্রপতির শপথ প্রধান বিচারপতি কর্তৃক পরিচালিত হবে, এ আইন বিশ্বব্যাপী অনুসৃত নীতি। একে লঙ্ঘন করে একদিকে বিচার বিভাগের ক্ষমতার অবনমন করা হয়েছে; অন্যদিকে বিচার বিভাগের সক্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।’
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, জাতীয় এ সংকট সমাধানে বিভিন্ন অংশীজনের সাথে সংলাপ আয়োজনের মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্রপতি মনোনয়নের জন্য প্রধান বিচারপতি একটি কমিটি গঠন করে দিতে পারেন। বাছাইকৃত ব্যক্তির নাম ঘোষণার আগে বর্তমান রাষ্ট্রপতি পদত্যাগপত্র প্রধান বিচারপতির কাছে জমা দেবেন। প্রধান বিচারপতি তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ এবং তারপর ৩৬ জুলাই বিপ্লবের চেতনা বাস্তবায়নের প্রত্যয় দীপ্ত শপথবাক্য নতুন রাষ্ট্রপতিকে পাঠ করাবেন। সংস্কার এবং নির্বাচনের পর নতুন সংবিধানের আলোকে আলোকিত সমৃদ্ধির পথে যাত্রা শুরু করবে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ।