আলোকে তিমিরে : গণবিপ্লব ২০২৪
১ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:৪৭
॥ মাহবুবুল হক ॥
মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষ মহাকালকে (সময়) দোষ দেয়, অথচ মহাকাল তো (সময়) আমিই।’ অর্থাৎ সময়কে দোষ দেয়া মানে সৃষ্টিকর্তা-পালনকর্তা মহান আল্লাহকে দোষারোপ করা। নাউযুবিল্লাহ।
আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল। সময় বহতা নদীর মতো। এর জোয়ার আছে, ভাটা আছে। এর উত্থান আছে। পতন আছে। তরঙ্গ আছে, প্লাবন আছে। মৃদু-মন্দ অবস্থা আছে, ঝড় আছে। তুফান আছে। প্রকৃতির সবকিছু মেনে নিতে হয়। সময়ও প্রকৃতি। মানুষ ও প্রকৃতির একটা অংশ। আর তোমরা তো জানোই প্রকৃতি স্বয়ম্ভরা নয়। মহান আল্লাহর সৃষ্টিসমূহ তার অনুগত দাস, তাকে সবকিছু মেনেই নিতে হয়।
যা হোক, ৫ আগস্টের এখন অনেক নাম। কোনো জনপ্রিয় মানুষের প্রথম ছেলে সন্তান হলে, সেই সোনার ছেলের অনেক ডাকনাম থাকে। নানা-নানি, দাদা-দাদি, খালা-মামা থেকে শুরু করে ফ্যামিলির ব্যক্তিগণ শিশুটিকে নানা নামে-উপনামে ডাকতে থাকে। ঠিক তেমনি ৫ আগস্টে যে বিশাল পরিবর্তন হলো, এ পরিবর্তনটি এত আকাক্সিক্ষত ছিল যে, এর জন্মের পর ডাকনাম নিয়ে মোটামুটি দেশময় হুলস্থুল পড়ে গিয়েছিল। কেউ নাম রেখেছেন স্বাধীনতা, কেউ দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্বাধীনতা, কেউ ঈদের আনন্দ, কেউ আবার বলছেন রোজার ঈদ, কেউবা কুরবানির ঈদ। কেউ বিপ্লব, কেউ অভ্যুত্থান, কেউ বলেছেন গণঅভ্যুত্থান। কেউ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। এই যে এত নামে ডাকা, এর সাধারণ অর্থ হলো বিষয়টি ছিল বহুকাক্সিক্ষত। প্রেমের ক্ষেত্রে অতল বিরোহীদের মতো। আকাশের চাঁদের মতো। জাতির ক্ষেত্রে সর্বজনীন চাওয়া ও পাওয়ার মতো।
কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের আবেগী এ শিশুটিকে নিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই নানা ধরনের বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গেল। আমাদের দেশের একটা বিশেষ ক্রাইটেরিয়া আছে। তা হলো আমরা সবাই যেমন ডা., সবাই তেমন বুদ্ধিজীবী, ঠিক তেমনই মুফতি এবং রাজনীতিবিদ। অন্য দেশের তুলনায় এটা ভালো কি মন্দ আমি সে আলোচনায় যাচ্ছি না। কারণ আমি কিছুটা চিন্তুক হলেও চিন্তাবিদ বা সমাজ বিশ্লেষক নই।
এ প্রসঙ্গে একটি গল্প বলি, ১৯৮০ সালে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ আনোয়ারুল হক খান মজলিসকে নিয়ে লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। বেড়াতে গিয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরেই এক ছাত্রকে প্রশ্ন করেছিলাম, তোমাদের দেশের রাজানীতি সম্পর্কে আমাদের কিছু জানাও। ছাত্রটি ত্বরিতবেগে জবাব দিয়েছিল, ‘দুঃখিত, আমি ইতিহাসের ছাত্র। আমি বর্তমান রাজনীতি সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। আমি এ বিষয়ে উৎসাহী নই।’
অথচ আমাদের দেশে গৃহকর্মীরা রাজনৈতিক বিতণ্ডায় পড়ে ভাত-তরকারির ডেকচি গুঁড়িয়ে দেখে। অথবা চুলাচুলি করে। সমাজ বিশ্লেষকরা হয়তো বলবেন, এটা রাজনৈতিক সচেতনতা। গরিব দেশ বলে সবাই নিজ নিজ অধিকার নিয়ে দারুণভাবে সচেতন।
তো বিশ্লেষণ শুরু হলো। হঠাৎ করে এটা কেমন করে হলো! এ যেন এক বিনামেঘে বজ্রপাত! হঠাৎ করে আগ্নেয়গিরির লাভা, সুনামি, অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার দাবানল। শুরুটা হলো কোটা আন্দোলন নিয়ে। যেটা ২০১৮ সালে একবার স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে ছিল। তখনকার সরকার দাবির জবাবে শুধু আশাবাদ ব্যক্ত করেনি, বলেছিল এটা তো আমাদেরই দাবিÑ সর্বজনীন দাবি। এটা না করার কি আছে। একটু সময় দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে। ছাত্ররা সেই সরকারকে বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি বা কোনো ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অর্ধযুগ পর হঠৎ করে সেই বিষয়টি সামনে এলো। প্রথমে বিশ্লেষকদের মধ্যে কেউ কেউ বলছিলেন, জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী হওয়া, এটা পরোক্ষভাবে সরকারেরই একটা খেলা। সেই সাথে যুক্ত হয়েছিল পাঠক্রম। বিশেষ করে এ দুটি বিষয় নিয়ে দেশব্যাপী ক্ষোভ-বিক্ষোভ ধূমায়িত হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল দেশের কোথাও না কোথাও একটা বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটবে। সেই দিক থেকে দেশবাসীকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য এটা একটা ‘চাণক্য খেল’। কিন্তু দেখা গেল এসব আন্দাজ, অনুমান ও বিশ্লেষণ ভেস্তে যেতে লাগল।
সরকারের পক্ষ থেকে আর এ সংগ্রামের সঠিক মূল্যায়ন হলো না। তারা বিষয়টিকে যৌক্তিক বা সংবেদনশীল হয়ে ভাবার বা চিন্তা করার কোনো সুযোগ পেল না। ধীরে ধীরে দেশব্যাপী সরকারের জুলুম, নির্যাতন ও অত্যাচার যখন বাড়তে লাগলো, তখন একদিকে সরকারি দলের সকল অঙ্গ সংগঠন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী (বিশেষ করে পুলিশ) যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিল। শুরু হলো একের পর এক দেশব্যপী পরিকল্পিত গণহত্যা, বোঝাই গেল এটা প্রতিবেশী দেশের বড় ধরনের ইন্ধন। বিষয়টি সূর্যের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। সেই মুহূর্তে জনতা আর বসে থাকলো না। এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হতে শুরু করলো ছাত্রশিবির, জামায়াতসহ ইসলামপন্থি দলসমূহের সংগঠন ও অঙ্গ সংগঠন, দ্বিধান্বিত বিএনপি, বুনিয়াদি চীনপন্থি বাম সংগঠন। রুশপন্থি বামেরা তো দূরেই থাকলো। দলহীন ডানপন্থিরা এগিয়ে আসলেও বিভিন্ন পর্যায়ের ওলামারা সেভাবে এলো না। এ সময় গণহত্যাকারী সরকারের প্রধান এ সম্মিলিত জনশক্তিকে বিভিন্নভাবে দালাল, পাকিস্তানি ও রাজাকার বলে বিদ্বেষ ছড়াতে লাগলো। সম্মিলিত জনগোষ্ঠী বলে উঠলো,
‘তুমি কে, আমি কে?
রাজাকার! বাজাকার!
কে বলেছে, কে বলেছে?
স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’।
আর যায় কোথায়? মহা এক গণবিস্ফোরণ ঘটে গেল! ১৯৭১-এর ৭ মার্চের সঙ্গে এর তুলনা করা অসঙ্গত হবে না। দল-মত-নির্বিশেষে বাংলাদেশের ভারতবিরোধী জনতা অর্থাৎ লাখো লাখো পরিবার রাস্তায় নেমে এলো। সুযোগ বুঝে একটা গ্রুপ এ মহা-আন্দোলনের নাম দিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। যার প্রমাণ ফেসবুকে অনেকের প্রোফাইল পিকচারে লাল ব্যাকগ্রাউন্ড। কিন্তু আল্লাহর কী ইচ্ছা! ডানপন্ধিরা সবাই এ নামকরণকে পরম আনন্দে ও আন্তরিকায় গ্রহণ করে নিল। শুরু হলো ৩য় ধাপের ঢাল-তলোয়ারহীন শুধু লাঠি-সোঁটার গণযুদ্ধ। বোঝা গেল তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা জিততে শুরু করেছে। এবার আর কমিউনিস্টদের তথাকথিত বৈষম্য স্থির থাকতে পারলো না। ভারতবিরোধী জনতার চাপে পুরো আন্দোলনের সব দাবিকে পাশে রেখে ছাত্র-জনতার দাবি উচ্চকিত ও সমুজ্জ্বল হলো একদফা, একদাবিতে। ‘খুনি সরকারের পতন চাই’ ‘ঝঃবঢ় ফড়হি ঐধংরহধ’ ইত্যাদি।
এবার দেশবাসী যেন একটা পথ পেয়ে গেল। একটা গন্তব্য (উবংঃরহধঃরড়হ) ও একটা লক্ষ্য (এড়ধষ) পেয়ে গেল। তাই তো জনগণ ভাবলো এ ফ্যাসিস্ট সরকার এর পতন হলে ইনশাআল্লাহ দেশ ও দশের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সহস্রাধিক নিরপরাধ ছাত্র-জনতার শাহাদাতবরণের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রধান দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিল। সরকার গঠনে দুদিন দেরি হওয়া সঠিক ছিল না। কিন্তু জানা গেল আন্দোলনকারী ছাত্রজনতা যাকে সরকারপ্রধান করবেন তিনি নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিদেশে একটু অসুস্থ ছিলেন। ফিরে আশার পর সেনাবহিনীসহ আন্দোলনকারী সকল শ্রেণির মানুষের সহযোগিতায় ৮ আগস্টে সরকার গঠন হলো। জনপ্রিয় সরকার হলো, কিন্তু বিপ্লবী বা অভ্যুত্থানকারী সরকার হলো না।
এই সরকারকে পুলিশ, আনসার প্রকাশ্যরূপে সহযোগিতা করলো না। একই সাথে প্রতিবেশী দেশের অবিবেচক ও প্রতিহংসাপরায়ণ গোষ্ঠী ইতিহাসে স্থান করার মতো একটি মানবসৃষ্ট বন্যা ঘটালো। দেশের পূর্বাঞ্চলে। একই সময়ে তাদের গুপ্ত দোসরদের ষড়যন্ত্রে ঘটে গেল সচিবালয়ে আনসার বিদ্রোহ। আল্লাহর অশেষ রহমতে সদ্য বিপ্লব ভূলুণ্ঠিত হয়নি। বন্যা মোকাবিলায় দেশের ইসলামী দলগুলো, আলেম সমাজ ও ছাত্রজনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তৎপরতা চালানোয় মহান আল্লাহ এ যাত্রায় আমাদের বাঁচিয়ে দিলেন।
ঠিক এরই কয়েকদিন পরেই ইতিহাস গড়ে সবচেয়ে বড় আসরের দেশব্যাপী দুর্গাপূজা অচিন্তনীয় ও অভূতপূর্বভাবে সম্পন্ন হয়ে গেল।
সরকারকে সর্বান্তকরণে সহযাগিতা করলো আর্মি ও বিজিবি। জানা যায়, বিএনপির পরামর্শে বিল্পবী সরকার হয়নি। হলে এখন যে সংবিধান, প্রেসিডেন্ট, গণতান্ত্রিক আইন-কানুনের যে ধোঁয়া উঠেছে, তা উত্থাপিত হওয়ার কোনো সুযোগ থাকতো না। রাতারাতি সব পরিবর্তন করার সুযোগ ছিল। কমিউনিস্টদের হাতে আন্দোলনের নেতৃত্ব থাকলে অবশ্যই তারা তা করতো। কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যেই বড় দ্বিধা ছিল। ইসলামপন্থি জনগোষ্ঠী এগিয়ে গেলে ইসলামী বিপ্লব হওয়ার সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল হয়ে উঠবে। তাই তারাও বিএনপির পরামর্শের সামনে স্থির থাকতে পরলো না, ইসলামিস্টরা দ্বিধান্বিত ছিল।
অত বড় দায়িত্ব নেওয়ার মতো দর্শন ও মতবাদ এবং লক্ষ্য তাদের সামনে স্থিরকৃত ছিল না। তারা সকল দল, মত ও আদর্শিক গোষ্ঠীর সাথে স্বমন্বয় করে অগ্রসর, হতে চেয়ছিল, তাদের দিক থেকে এটা অসমীচীন হয়েছে সেটা বলা যাবে না। কারণ তারা বিধ্বস্ত ছিল। তাদের পরিকল্পনার ক্যানভাসটা অত বিশাল ও বিস্তৃত ছিল না। তাদের নিজস্ব শক্তি ও অবস্থান সম্পর্কে তারা দৃঢ়চিত্ত ছিল। সকলের কল্যাণ ও মঙ্গল ছিল তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য। হিংসা নয়, বিদ্বেষ নয়, ক্ষমা, ভালোবাসা এবং মমতার আদলে তারা বিন্যাসিত ছিল। এখনো সেই অবস্থানেই তারা আছে।
এদিকে সরকার, প্রশাসন, ব্যবসায়ী মহল, বিচার বিভাগে পতিত সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ওপর-কাঠামোর জনশক্তি এবং সেক্যুলার দল মিলে এক বড় ঐক্যের সেক্যুলারদের পাঁয়তারা চলছে। একদিকে ইসলাম এবং অপরদিকে সেক্যুলারিজম। এ টানাপড়েনের মধ্যে দেশ ও দশ হামাগুড়ি খাচ্ছে। তবে আশার কথা হলো মহান আল্লাহর ইচ্ছায় যেহেতু এ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, সেখানে দেশের জনগণ যদি মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকেন এবং তার দিকে ফিরে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তাহলে আশা করা যায় মহান আল্লাহর সাহায্য এদেশের জনগণ পাবে, ইনশাআল্লাহ্।