রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ২৮তম সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১ ॥ ৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী ॥ ৪ অক্টোবর ২০২৪

॥ সৈয়দ খালিদ হোসেন ॥
বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন দেশের সাধারণ নাগরিকরা। তারা আর দেশে আওয়ামী লীগের বর্বর ও হিংস্র রাজনীতি দেখতে চান না। টেন্ডারবাজি, খুন, গুম, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অর্থ পাচার থেকে শুরু করে হেন কোনো অপরাধ নেই, যা আওয়ামী লীগ করেনি। পুলিশসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে দলটি। সরকারি দফতরে নিয়োগের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের লোক কিনা, তা নিশ্চিত হওয়ার পরই অর্থ-বাণিজ্য করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের দলীয় পদ না থাকা বা আওয়ামী পরিবারের না হওয়ায় অনেক মেধাবী বিসিএস পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগ পাননি। নির্বাচন ব্যবস্থা তছনছ করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। প্রায় শতভাগ নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয় বিচার বিভাগকে রাষ্ট্রের দফতরগুলো থেকে নির্দেশনা দেওয়া হতো রায় কীভাবে হবে? অর্থাৎ রাষ্ট্র, সব প্রতিষ্ঠানকে আওয়ামীকরণ করা হয়েছে। দলীয় বিবেচনায় পরিবর্তন করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক, সভাপতি, মসজিদ ও মাদরাসার ব্যবস্থাপনা কমিটিও। মানুষের কথা বলার স্বাধীনতাও হরণ করে নেওয়া হয়েছে। সরকারে সমালোচনা করা যেখানে সংবিধান অনুযায়ী স্বীকৃত, সেখানে সমালোচনার দায়ে নেওয়া হয়েছে রিমান্ডে-জেলে। ফলে সব মহল থেকে এ সরকারের পতন আন্দোলনে শরিক হন নাগরিকরা।
রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন সংলগ্ন ফুটপাতে সিদ্ধ ডিম বিক্রেতা কুমিল্লার বাসিন্দার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়, গল্পের ছলে তিনি জানান দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের দায়ে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার হওয়া জরুরি। এই দুর্নীতির সময়টাতে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে যারা রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করেছেন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন ও অর্থ পাচার করেছেন, তাদের প্রচলিত আইনে বিচার করা উচিত। জনগণ এ দুর্নীতিবাজ দলকে আর রাজনীতিতে দেখতে চান না।
ভোলা জেলার একটি মাদরাসার অধ্যক্ষের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের আলাপ হয়। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় সম্পদকে পরিবারের সম্পদ মনে করেছিল আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও তার পরিবার। তারা শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। এ টাকা পাচার করা হয়েছে বিদেশে। কিন্তু এদের বিচার হচ্ছে না। জনগণ এ দলটির দুর্নীতিবাজদের দ্রুত বিচার চান। ‘দ্রুত বিচার আইনে’ বিচার করতে আদালতে কোনো জটিলতা থাকলে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এ অপশক্তির বিচার হওয়ার উচিত বলে মনে করেন এ শিক্ষক। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কোথাও কোনো স্বাধীনতা ছিল না, আওয়ামী লীগের বাইরে কথা বলার অধিকার ছিল না। যা ইচ্ছা তাই করেছে দলটি। মানুষ এ দলটির প্রতি এতটাই অতিষ্ঠ যে, তারা আর কখনো দেশে আওয়ামী লীগের কোনো কার্যক্রম চান না। মানুষ মনে করেন, দলটির কোনো আদর্শ নেই, যা মানুষের জন্য অনুকরণীয়, ফলে আদর্শহীন কোনো পার্টি রাজনীতি করলে জনগণ তাদের কাছ থেকে কী আর পেতে পার। যারা সততার সঙ্গে রাজনীতি করেন, দলীয় আদর্শ রয়েছে, দেশের উন্নয়নে লুটপাট ছাড়া ভূমিকা  রাখবেন, তারাই রাজনীতি করুক- এমনটাই প্রত্যাশা এ শিক্ষকের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুশফিকুর রহমান মনে করেন, দেশের মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের দাঁড়ানোর আর কোনো সুযোগ নেই। তারা দেশ পরিচালনার নামে দেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। কোনো নাগরিক সন্ত্রাসের শিকার হলেও পুলিশের কাছে গিয়ে প্রতিকার পায়নি, ক্ষমতাসীনদের হামলার শিকার হওয়ার পর থানায় গিয়ে মামলা করতে পারেননি ভুক্তভোগী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ রামরাজত্ব কায়েম করেছিল। ক্যাম্পাসে অবস্থানের জন্য ছাত্রলীগের রাজনীতি ছিল অনেকটা বাধ্যতামূলক। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতে হলে ছাত্রলীগের রাজনীতি করা ছিল বাধ্যতামূলক। ফলে মতের বাইরে গিয়ে হলেও অনেকে বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগে মিশে গিয়েছিল। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে গণধর্ষণের ইতিহাস গড়েছিল ছাত্রলীগ, আর এ সংগঠনের সাংগঠনিক ও আধ্যাত্মিক নেত্রী হচ্ছে শেখ হাসিনা। ফলে জনগণ এ হাসিনার দলকে আর রাজনীতিতে দেখতে চান না।  
সাধারণ মানুষ মনে করেন, কর্তৃত্ববাদী শাসনের পর ছাত্র-জনতার উত্তাল আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট সরকারপ্রধানের পদ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। অনেকটা হুট করে ক্ষমতাচ্যুতির ঘটনায় তার দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে কার্যত চরম বিপর্যয় ও হতাশা নেমে এসেছে। দলটির ‘হতভম্ব’ নেতাকর্মীদের অনেকের মধ্যেই তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ এবং বিস্ময়। তাদের ‘লৌহমানবী নেতৃত্ব’ এমনভাবে পর্যুদস্ত হতে পারে, তার কোনো ধারণা দেশ ছেড়ে পালানোর একদিন আগেও তারা আঁচ করতে পারেননি। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে আতঙ্কে থাকা আওয়ামী লীগ এখন ‘আত্মগোপনে’ এবং কবে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কিংবা আদৌ পারবে কিনা, তা নিয়েও উদ্বিগ্ন অনেকে। দলটিকে টিকিয়ে রাখা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। সাধারণ মানুষও চান না দলটি আবার রাজনীতির মাঠে আসুক।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুরু মানে ফের ফ্যাসিবাদের উত্থানের পথ উন্মুক্ত করে দেওয়ার শামিল। কেননা ২০২৪-এর ফ্যাসিবাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের পুরোনো আকাক্সক্ষাই নতুন করে সামনে এনেছে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য ধর্ম-বর্ণ, সমতল-পাহাড় নির্বিশেষে সব জনগোষ্ঠীর সম্মিলনে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা। বিভাজনের রাজনৈতিক কাঠামো স্বৈরশাসন ও ফ্যাসিবাদকেই সহায়তা করে। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসান ঘটলেও স্বৈরাচার তৈরির ব্যবস্থা বহাল তবিয়তে। বিদ্যমান ব্যবস্থার বদল না হলে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা সফল হবে না। বিশেষত আমাদের সংবিধানেই নিহিত স্বৈরাচার তৈরির উপাদান। সুতরাং নতুনদের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েমে সংবিধান বাতিল বা পরিবর্তন জরুরি বিষয়। সংস্কার প্রয়োজন নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা, আমলা কাঠামো, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীতে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সে সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচনে যাবেÑ এটিই ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা। তা না হলে এ অভ্যুত্থান কাক্সিক্ষত সুফল বয়ে আনবে না। এখানে তরুণ প্রজন্মের বৃহত্তর অংশের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাদের আকাক্সক্ষার যেমন প্রতিফলন ঘটেছে, তেমনি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে তাদের স্বপ্নও দৃশ্যমান। একটি ছাত্র বিদ্রোহ কীভাবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হলো, তা বুঝতে হলে আমাদের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের উত্থান পর্বটি বোঝা জরুরি। আর এটি বুঝতে পারলে কেউ কখনোই আওয়ামী লীগের রাজনীতির কথা ভাবনায়ও আনবে না।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিরসহ সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেছেন, দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছর ধরে বিএনপির আন্দোলন দমন করতে গিয়ে হাসিনা সরকার হত্যা ও নৈরাজ্যের পথ বেছে নিয়েছিল। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের নামিয়ে দিয়ে সমগ্র দেশকে রণক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। কিন্তু ছাত্র জনতার দুর্বার প্রতিরোধের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালাতে বাধ্য হয়েছে। আওয়ামী লীগের দাম্ভিকতা, দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণেই তাদের পতন হয়েছে। আজকে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ গণধিক্কৃত দলে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ মনে করেন, আওয়ামী লীগ জনধিক্কৃত হয়েছে। তিনি মনে করেন, বর্তমান আওয়ামী লীগের যে পরিস্থিতি তাতে তারা ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে। যে হত্যা ও গণহত্যার দায়ভার আওয়ামী লীগের ওপর পড়বে, তাদের মানুষের মনের ভেতরে জায়গা করে নিতে আরও বহু বছর সময় লাগবে। তিনি নীতিগতভাবে মনে করেন, এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার নৈতিক অধিকার নেই।
শেখ হাসিনার পতনের মাত্র দুই মাস পার হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু কার্যক্রম চালানো শুরু করেছে দলটি। প্রকাশ্য কোনো কার্যক্রম দেখা না গেলেও দলটি তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজের মাধ্যমে দলীয় বিবৃতি প্রকাশ করছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে দলের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার সই করা এক বিবৃতিতে জানানো হয়, দেশের জনগণকে শক্তি ও সাহস নিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেছেন, ‘খুব দ্রুতই এ আঁধার কেটে যাবে।’ ওই বিবৃতিতে জানানো হয়, জন্মদিন পালন করায় দলীয় নেতাকর্মীসহ দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। পরে তার বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে সামরিক হেলিকপ্টারে করে প্রথমে ত্রিপুরার আগরতলা ও পরে সেখান থেকে বিশেষ বিমানে দিল্লি পৌঁছান। এর পরপরই ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়েন আন্দোলনকারীরা এবং ওইদিন বিকেলেই আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন ও জাদুঘর। হামলা হয় শেখ হাসিনার স্বামী মৃত ওয়াজেদ মিয়ার ধানমন্ডির বাসভবন সুধাসদনেও। এমনকি সারা দেশে দলটির বহু সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও নেতাদের বাড়িঘরেও হামলা হয়েছে। এসব ঘটনা ছিল বিক্ষুব্ধ জনতার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।