দুর্নীতিবাজ আমলাদের যোগসাজশে প্রশাসনকে ম্যানেজ

আ’লীগ নেতাদের জমজমাট ব্যবসা


২৪ অক্টোবর ২০২৫ ০৯:৩৮

॥ সাইদুর রহমান রুমী ॥
দেশের সরকারি সেক্টরের বড় বড় দরপত্রসহ শীর্ষ ব্যবসা এখনো আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে। দুর্নীতিবাজ আমলাদের সাথে যোগসাজশে তারা আবার পূর্বের স্বরূপে ফিরে আসছে। সড়ক ও জনপথ, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের কোটি কোটি টাকার কাজ এখনো তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে। পলাতক আওয়ামী লীগ নেতারা বিভিন্নভাবে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা তাদের বিশ্বস্তদের মাধ্যমে আড়াল থেকে এখনো সবকিছু কব্জায় রেখেছে বলে অভিযোগ আসছে।
শত শত কোটি টাকার সেতুর টোল এখনো আওয়ামী নিয়ন্ত্রণে
রাজস্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস সড়ক-সেতুর শত শত কোটি টাকার টোল হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী-নেতাদের এক লোভনীয় খাত। আধুনিক টোল ব্যবস্থাপনার নামে বিগত ১৫ বছর বিরাট রাজস্বের এ খাতের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তারা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক পাটমন্ত্রী মির্জা আজম, গুম-খুনে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানসহ বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতা এ সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করতেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী হাসিনা পালিয়ে গেলেও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে আওয়ামী লীগ নেতারা এসব কোম্পানি দোর্দণ্ড প্রভাবে এখনো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
এখনো দেশের বেশিরভাগ সেতু তাদের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব কোম্পানির মাঝে ইউডিসি, সিএনএস, শামীম এন্টারপ্রাইজ, সেল ভান, রেগনাম, এটিটি, পেন্টা গ্লোবাল টোল আদায় নিয়ন্ত্রণ করছে।
আনিসুল হক
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কোম্পানি কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস) দলীয় প্রভাব খাটিয়ে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়ে ২৪ শতাংশ রেশিউতে টেন্ডার ছাড়াই যমুনা সেতুর টোল লুটপাট করে বছরের পর বছর। যমুনা সেতুতে শুরুতে মাত্র ৬ মাসের জন্য কাজ নিয়েছিল তারা। পরে বিভিন্ন কৌশলে ৮ বছর টোল ব্যবস্থাপনার নামে লুটপাট করে তার কোম্পানি। আনিসুল হকের এ কোম্পানিটি অন্তর্বর্তী সরকারের এ সময়কালেও ভৈরব সেতু, ঘোড়াশাল সেতু, লেবুখালি সেতুর টোল নিয়ন্ত্রণ করছে। যার সাথে জড়িত রয়েছে যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।
মেঘনা-গোমতী সেতুতে টোল আদায়ে দুর্নীতি
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সাল থেকে আনিসুল হকের ছোট ভাই আরিফুল হক সিএনএসের চেয়ারম্যান ছিলেন। পরবর্তীতে তার মৃত্যুর পর ২০১৭ সাল থেকে আনিসুল হকই সিএনএসের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। সম্প্রতি মেঘনা-গোমতী সেতুতে টোল আদায়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সিএনএসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। দুদকের এ মামলায় বলা হয়, মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায়ের চুক্তিতে অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সরকারের ৩০৯ কোটি টাকার ক্ষতি সাধনের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক ছয় মন্ত্রী ও সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এতে অভিযোগে বলা হয়, ২০১৬ সালে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেড (সিএনএস)-কে একক উৎসভিত্তিক দরপত্রের মাধ্যমে টোল আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটি ৪৮৯ কোটি টাকার বেশি বিল গ্রহণ করে।
অভিযুক্তদের মূলে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, তৎকালীন সচিব এম এ এন ছিদ্দিক, অতিরিক্ত সচিব ফারুক জলিল, উপসচিব মোহাম্মদ শফিকুল করিম, প্রকৌশলী ফিরোজ ইকবাল, ইবনে আলম হাসান, আফতাব হোসেন খান, আব্দুস সালাম এবং সিএনএস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনীর উজ জামান চৌধুরী, পরিচালক সেলিনা চৌধুরী ও ইকরাম ইকবাল।
সিএনএস’র তিন সেতুর টোল আদায়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা নেই
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে দুদক আনিসুল হকের এ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করলেও সিএনএস বর্তমানে আরো তিনটি সেতুর টোল আদায় কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত এক যুগে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) অন্তত পাঁচ ধরনের কাজ বাগিয়ে নেয় সিএনএস। যার পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা হবে বলে জানা যায়। আর এসব কাজে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব লুটপাট করার অভিযোগ রয়েছে।
মির্জা আজম লালন শাহ সেতুর টোল আদায় করছে
একইভাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী জামালপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মির্জা আজমের নিয়ন্ত্রণাধীন ইউডিসি কনস্ট্র্রাকশন বর্তমানে মেঘনা গোমতী সেতুর টোল নিয়ন্ত্রণ করছে। এ কোম্পানিটি লালন শাহ সেতুসহ দেশের আরো কয়েকটি সেতুর টোলেরও দায়িত্বে রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিগত আওয়ামী লীগের সময় একচেটিয়াভুক্ত দলীয় কোম্পানিগুলো বর্তমানেও প্রশাসনকে উৎকোচ ও সুবিধা দিয়ে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দরপত্রগুলো এমনভাবে প্রণয়ন করা হচ্ছেÑ যেন অন্য নতুন কোনো কোম্পানি অংশগ্রহণ করতে না পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরনো আওয়ামী নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানিগুলো আরএফকিউ (রিকোয়েস্ট ফর কোটেশন) পদ্ধতির সুযোগ নিয়ে ঘুরেফিরে তারাই টোল আদায় ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। নতুন করে দরপত্রের পূর্বে কাউকে না দিয়ে প্রকারান্তরে তারাই এসব টোলের কাজ চালাচ্ছে।
ভারতীয় পার্টনারের মাধ্যমে টোলের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
মির্জা আজমের আশীর্বাদপুষ্ট এ কোম্পানি ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লি. দলীয় ক্ষমতা বলে রূপসা সেতু, লালন শাহ সেতু, হাতি কামরুল সেতু, কর্ণফুলী সেতু টোল এক টানা ১৭ বছর নিয়ন্ত্রণ করে। প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের ছদ্মাবরণে এসব কোম্পানির এত ক্ষমতা ছিল যে, তাদের বিষয়গুলো ডিপার্টমেন্টালি বিগত সময় সঠিকভাবে অডিট করা হতো না। তারা টোল কালেকশন করে ৫০% জমা দিতো আর ৫০% লুটপাট করতো। ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে তাদের ভারতীয় পার্টনার ভ্যান ইনফ্রা এসব টোলপ্লাজায় প্রতি দিনের ৫০ শতাংশ গাড়ি তাদের ভ্যান সফটওয়্যার থেকে বাদ দিয়ে দিত বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে নানা কৌশলে খুবই সূক্ষ্মভাবে টোলের টাকা আত্মসাৎ করা হতো। আরো ভয়াবহ আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে চব্বিশের অভ্যুত্থানের পরও এসব কোম্পানিগুলো অদৃশ্য শক্তির ইশারায় বহাল তবিয়তে এসব টোলপ্লাজা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দৃশ্যপটে এখনো রয়েছে শামিম এন্টারপ্রাইজ। এর মালিক শামিম ময়মনশিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। আওয়ামী লীগের বিগত টানা ১৭ বছর তিনি এফবিসিসিআই’র পরিচালক ছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তিনি আস্থাভাজন হিসেবে বহু বার বিদেশ সফর করেন। তারই আপন ছোট ভাই টিটু ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের আওয়ামী লীগের বিগত দুবারের মেয়র ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতা শামিম ও মির্জা আজমের ইউডিসি কোম্পানি এখনো মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল নিয়ন্ত্রণ করছে।
জানা যায়, সাবেক যোগাযোগ সচিব নজরুল ইসলাম টেন্ডারের অনেক বড় ধরনের অনিয়ম দেখে টেন্ডার বাতিল করে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে সাবেক সচিব নজরুল ইসলাম অবসরে যাওয়ার পর মির্জা আজম, ওবায়েদুল কবির ও নতুন সাবেক সচিব নুরিকে ম্যানেজ করে ঐ বাতিল টেন্ডার পুনরায় আবার রিভিউ করে টেন্ডার পাস করিয়ে টোলপ্লাজার দায়িত্ব নেয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মন্ত্রণালয়ের সার্ভার ও বিআরটিএ’র সার্ভার অডিট করলে সব দুর্নীতি বেরিয়ে আসবে।
মির্জা আজম ইউডিসি কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করছে
শামীম এন্টারপ্রাইজ এবং মির্জা আজমের ইউডিসি কনস্ট্রাকশন বড় বড় টোল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মগবাজার উড়ালসড়ক, ঢাকা বাইপাস সড়ক নির্মাণ, বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাসের বিশেষ লেন (বিআরটি) নির্মাণসহ অসংখ্য প্রকল্প করায়ত্ত করে।
আরেক কোম্পানি এসিয়ান ট্রাফিক টেকনোলজি (এটিটি) বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক বড় বড় টোল চালাতো। সে ছিল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ওবাদুল কাদেরের অন্যতম সহযোগী। শেরপুর সেতু ও ফেঞ্চুগঞ্জ সেতুর টোল পরিচালনায় তারা ছিলো। দীর্ঘসময় ধরে সড়ক ও জনপথ দপ্তরের আওতাধীন এই দুই টোলপ্লাজায় কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করে এ কোম্পানি। সাম্প্রতিক এক অডিটে তাদের বড় ধরনের দুর্নীতি ধরা পড়ে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গুম-খুনে জড়িত কুখ্যাত জিয়াউল আহসানের কোম্পানি পেন্টা গ্লোবাল বিগত সময়ে বিভিন্ন টোলের সাথে জড়িত ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর আবারো তারা বিভিন্ন সেতুর দরপত্রে অংশগ্রহণ করছে।
ওবায়দুল কাদেরের আশীর্বাদপুষ্ট রেগনাম রিসোর্স এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে চরসিন্ধুর টোল ব্যবসা।
সড়কে আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-এমপিদের হাজার কোটি টাকা লুটপাট
বিগত সাড়ে ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে যারা মন্ত্রী-এমপিদের পরিবারের লোকজনদের পার্টনার বানিয়ে একক আধিপত্য বিস্তার করে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেয় আওয়ামী ঘরানার ব্যবসায়ীরা। কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সরকারি বরাদ্দের শত শত কোটি টাকা লুপাট করা হয়। ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে তাদের মলিকানাধীন অনেক কোম্পানি এখনো বহাল তবিয়তে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
সড়ক ও জনপথে লুটপাট কোম্পানির নাম হচ্ছে এনডিই। আওয়ামী লীগের চিফ হুইপ লিটন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হবার সুবাদে সরকারের সব মন্ত্রণালয়ে বড় বড় কাজ নিত এ কোম্পানি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে এ কোম্পানি সব মিলিয়ে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার কাজ করেছে বলে জানা যায়। রানা বিল্ডার্স লি., হাসান টেকনো মাসুদ হাইটেক একই পরিবারের ৩টি প্রতিষ্ঠান। সাবেক এম.পি বাহার, সাবেক এম.পি নিজাম হাজারী, সাবেক এম.পি ইকরাম হোসেন, ওবায়দুল কাদেরের ভাই এদেরকে পার্টনার বানিয়ে রানা বিল্ডার্স লি. ২৫ হাজার কোটি টাকা, হাসান টেকনো ২২ হাজার কোটি টাকা, মাসুদ হাইটেক ১২ হাজার কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেয়। মোজাহার এন্টার প্রাইজ লি. খুলনার সাবেক মেয়র আমিন আহমদ এর ভাই। সাবেক মেয়র আমিন ছিল খুলনার আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। তারা শেখ পরিবারের একক আধিপত্য দেখিয়ে খুলনা বিভাগে সড়কের ২০ হাজার কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেয়। শেখ পরিবারের প্রভাবে এই মোজাহার এন্টারপ্রাইজ নর্থ বেঙ্গলে ৫ হাজার কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেয়। সব মিলিয়ে মোজাহার এন্টারপ্রাইজ সারা বাংলাদেশে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেয়। আবেদ মনসুর, মাসুদ হাইটেক ও রিলায়বল বিল্ডার্স লি. আওয়ামী লীগ নেতাদের কোম্পানি হবার কারণে সারা দেশে ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেয়। যার প্রধান পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন সাবেক এমপি শামীম ওসমান ও ঢাকা জোনের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান। যিনি ছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর ডান হাত। এই অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ওবায়দুল কাদেরের এতটা কাছের লোক ছিলেন যাকে ঐ চেয়ার থেকে বিগত ১৫ বছরে সরানোর ক্ষমতা কারো ছিলো না। কাকে কোথায় পোস্টিং দেওয়া লাগবে সবই তার কথায় চলতো। মাহফুজ খান প্রা. লি. বরিশাল বিভাগের ডন আবুল হাসনাত আব্দুল্লার পার্টনার ও মাহফুজ খান প্রা. লি. কোম্পানির চেয়ারম্যান হওয়ায় বরিশাল বিভাগের ১০ হাজার কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেয়। এ মাফুজখান বরিশাল সিটি করপোরেশনে সব কাজ তার কোম্পানিকে দেওয়া হতো। সেখানে আবুল হাসনাত আব্দুল্লার বড় ছেলে বরিশালের মেয়র সাদেক একক আধিপত্য। সবকাজ মাহফুজ খান কে আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ ও মেয়রের আরেকটি আস্থাভাজন ফার্ম ছিলো রিলায়বল বিল্ডার্স ৮ হাজার কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেয়। তমা কনস্ট্রাকশন কো. লি.-এর মালিক মো. আতাউর রহমান মানিক নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লি.-এর মালিক আলমগীর ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রথম যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী আবুল হোসেনের সরাসরি পার্টনার হওয়ায় এই দুই কোম্পানি রেল মন্ত্রণালয় থেকে তমা কনস্ট্রাকশন কো. লি. ২৫ হাজার কোটি টাকা, ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লি. ৩০ হাজার কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেয়। সাবেক যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী এতটা প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন তার একক ক্ষমতায় এই দুই কোম্পানির বাইরে কোনো ঠিকাদার কে টেন্ডার দিতে দিত না। কেউ টেন্ডার দিলে সেই কোম্পানি ব্ল্যাক লিস্ট করে দিতো। এদের ভয়ে রেলে কেউ টেন্ডার দিত না। এ দুই ঠিকাদার অনেক হাই রেটে কাজ নিত। এছাড়া তমা কনস্ট্রাকশন কো. লি. গণপূর্ত বিভাগের একক আধিপত্য ছিলো। সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয়ে তার আধিপত্য ছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ সব মন্ত্রণালয় মিলে তমা কনস্ট্রাকশন কো. লি. ৭০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লি. চট্টগ্রাম সিডিএ এর উড়াল সেতু যার দৈর্ঘ্য হবে ২০ কি. মি.। চট্টগ্রাম শহর থেকে চট্টগ্রাম এয়াপোর্ট পর্যন্ত উড়াল সেতু কাজ করে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লি. ও ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ৬০ হাজার কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেয়। মাঈন উদ্দিন বাশী শেখ পরিবারের লোক হওয়াতে ভুয়া ও ফেইক সার্টিফিকেট দিয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেয়। একইভাবে ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন লি. ফ্যাসিস্ট সরকারের যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। শেখ হেলালের ব্যবসায়িক পার্টনার, শেখ হেলালের মাধ্যমে সে সড়ক ও জনপথ, ঢাকা মাওয়ার ৪ লেনসহ বিগত সময়ে সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেয়।
সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে এ কোম্পানিগুলোর বকেয়া পাওনা এখনো অন্তর্বর্তী সরকার পেমেন্ট করছে এবং নতুন দরপত্রগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হচ্ছে যেখানে তাদেরই অভিজ্ঞ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স লি.-এর মালিক ছিলেন আরেক আওয়ামী লীগের বড় ডোনার। সে ছিলো মাহাবুবুল হানিফ ও সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ব্যবসায়িক পার্টনার। ফ্যাসিস্ট সরকারে ১৬ বছরে সে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের রামপাল পাওয়ার প্লান্ট এর মাটি ভরাট ১ হাজার কোটি টাকার কাজ উচ্চমূল্যে বাগিয়ে নেয়। পায়রায় কুল পাওয়ার প্লান্ট, আরটিজিসিএল মুন্সীগঞ্জ পাওয়ার প্লান্ট এর যত মাটি ভরাট কাজ ছিলো সবই পেতো এই বশির। তিনি সবসময় উচ্চমূল্যে এই কাজগুলো বাগিয়ে নিতো। সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে ম্যানেজ করে ৫ হাজার কোটি টাকার ড্রেজিং এর কাজ হাতিয়ে নেয় সে। পানি মন্ত্রণালয় থেকেও এই বশির ১০ হাজার কোটি টাকার কাজ বেশিরভাগ না করে বিল উঠিয়ে নেয়। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পূর্বাচলের ২ হাজার কোটি টাকার কাজ নিয়ে নেয়।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাবেক মন্ত্রী বা রাজনীতিকদের প্রভাবে এ ধরনের দুর্নীতি স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছিল। এর পেছনে আমলাদের জোরালো যোগসাজশ না থাকলে হয়তো এতটা সম্ভব হতো না। তাই রাজনীতিকের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট আমলাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও এমপি মির্জা আজমের নিয়ন্ত্রণাধীন ইউডিসি কন্সট্রাকশন লি.-এর পরিচালক কামাল আহমেদের সাথে মোবাইলে মেসেজ এবং ফোন দিলেও তাতে তিনি কোনো সাড়া দেননি।
ওবায়দুল কাদেরের আশীর্বাদপুষ্ট রেগনাম রিসোর্স লি.-এর পরিচালক মোহাম্মদ জনি বলেন, আমরা রাজনৈতিক কোনো ছত্রছায়ায় বিগত সময়ে ব্যবসা করিনি। তিনি সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাথে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমরা এখন চর সিন্ধুর সেতুর টোলের দায়িত্ব পালন করছি। মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পরও নতুন কাউকে দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত আমরাই কাজ করছি। টোল আদায়ে দুর্নীতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুদক আমাদের ডেকেছিল, আমরা আমাদের উত্তর সেখানে দিয়েছি।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, বিগত সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় টোল আদায়ে কোম্পানিগুলো নিয়োগ দেয়ায় এতে ব্যাপক দুর্নীতির সৃষ্টি হয়। এছাড়া এসব কোম্পানিগুলো মেয়াদ শেষের পরও অনেক বছর বিভিন্ন ছুঁতায় বছরের পর বছর অবৈধভাবে টোল আদায় করেছে। এর ফলে সরকার ব্যাপক রাজস্ব হারিয়েছে। তিনি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় দরপত্র এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনার সাথে সাথে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পরিহার করার আহ্বান জানান।