কিশোরগঞ্জ জেলায় কুরবানির জন্য প্রস্তুত ২ লক্ষাধিক পশু


২৯ মে ২০২৫ ১১:১২

আহসানুল হক জুয়েল, কিশোরগঞ্জ : আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে সারা দেশের মতো কিশোরগঞ্জ জেলার ১৩টি উপজেলায় খামারিরাও কুরবানির গরু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন শেষ মুহূর্তের পরিচর্যায়।
কিশোরগঞ্জ জেলার ১৩টি উপজেলায় খামারের কর্মচারী-মালিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ব্যস্ততাও বেড়েছে তাদের। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়া। এসব খামারে ছোট-বড় সব আকারের পশু প্রস্তুত করা হয়েছে।
খামারে দেশি জাতের গরু ছাড়াও রয়েছে ফ্রিজিয়ান, শাহী ওয়াল, ব্রাহামা, ইন্ডিয়ান বোল্ডারের মতো বড় জাতের গরু। এছাড়া মহিষ, বলদ ও গয়াল। প্রাকৃতিকভাবে ঘাস, খড়কুটা, ভুসি খাইয়ে বড় করায় খামারে এসব গরুর চাহিদাও অনেক। বাজারে দেশীয় গরুর ব্যাপক চাহিদা থাকায় ক্ষতিকর হরমোন কিংবা ইনজেকশনের ব্যবহার ছাড়াই দেশীয় পদ্ধতিতে গবাদিপশু পালন করা হয়েছে। ভারতীয় গরুর ওপর নির্ভর না করে নিজেদের দেশীয় গরুতেই কুরবানির চাহিদা মেটানো সম্ভব বলে মনে করছেন খামারিরা।
কিশোরগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার ১৩টি উপজেলায় পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে কুরবানিযোগ্য গবাদিপশুর সংখ্যা ২ লাখ ১৩ হাজার ৩৬৯টি। এর মধ্যে চাহিদা রয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৯১১টি, যা জেলার চাহিদা পূরণ করেও ৩২ হাজার ৪৫৮টি পশু দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চাহিদা পূরণ করতে পারবে। জেলায় ৭০ হাজার ৭১টি ষাঁড়, ৪ হাজার ৬টি বলদ, ১৮ হাজার ৫৫৯টি গাভি, ১ হাজার ২৮৮টি মহিষ, ১ লাখ ১৩ হাজার ৮৯৬টি ছাগল, ৫ হাজার ৫১৬টি ভেড়া ও অন্যান্য ৩৩টি কুরবানিযোগ্য গবাদিপশু রয়েছে।
আরো জানা গেছে, জেলার ১৩টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছোট বড় সব মিলিয়ে ১১৬টি গরুর খামার রয়েছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ সদরে ১২টি, করিমগঞ্জ ১২টি, তাড়াইল ৭টি, হোসেনপুর ৭টি, পাকুন্দিয়া ১০টি, কটিয়াদী ১০টি, কুলিয়ারচর ৭টি, ভৈরব ৮টি, বাজিতপুর ১২টি, নিকলী ৭টি, ইটনা ৯টি, মিঠামইন ৭টি, ও অষ্টগ্রাম ৮টি। এছাড়া কিশোরগঞ্জ জেলার গ্রামেগঞ্জে প্রায় কৃষকের বাড়িতেই ২-৪টি গরু পালন হচ্ছে। প্রতি বছর গরু পালন করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছে অনেকেই। শুধু কুরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে বিগত এক দশকে গরু লালন-পালন ও কেনা-বেচা করছেন হাজার হাজার মানুষ। খামারগুলোতেই প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কোনো প্রকার ক্ষতিকারক ওষুধ ছাড়াই গরু মোটাতাজা করা হয়ে থাকে। অল্প সময়ে গরু মোটাতাজা করতে যেন কোনো খামারি গরুকে বিভিন্ন প্রকার নিষিদ্ধ ওষুধ যেমনÑ হরমোন, ডেক্সামিথাজল, ডেকাসন, স্টোরেয়েড ইত্যাদি না খাওয়ায় তার জন্য জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের কর্মকর্তারা সর্বদাই সচেষ্ট রয়েছেন। খামারগুলোয় কর্মকর্তারা নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন।
আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে কুরবানির ঈদে সারা জেলায় পশুর চাহিদা মিটিয়েও খামারিরা জেলার বাইরেও বিক্রি করবে। এছাড়া জেলায় কুরবানির পশু বিক্রির জন্য মোট ৬৩টি গরুর হাট রয়েছে। এ ৬৩টি হাটে কিশোরগঞ্জ জেলা উপজেলার প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে ৪০টি ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম কাজ করছে। হাটগুলোয় কুরবানির পশু অসুস্থ বা স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা দেয়া হবে।
যদি কোনো পশু ট্রাকে ওঠানামা করতে রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ে সেখানেও ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম পৌঁছে যাবে, প্রতিটা হাটে। জেলা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে করে পশুর মালিকরা পশু বিক্রি করে নিরাপদভাবে তাদের বিক্রিয়কৃত টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন।
একজন খামারি এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার খামারে কুরবানি উপযোগী ৬০টি গরু রয়েছে। সর্বনিম্ন ৮০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের গরু আছে। কুরবানি উপলক্ষে যে গরুগুলো লালন-পালন করেছি, সেগুলো ৮-৯ মাস ধরে লালন-পালন করা হচ্ছে। যেগুলো গোশত উৎপাদনের জন্য লালন-পালন করা হয়, সেগুলো ৩-৪ মাস। কুরবানির জন্য প্রস্তুতকৃত গরুপ্রতি প্রতিদিন আকারভেদে ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা খরচ হয়। প্রতিদিন দেশীয় জাতের এ গরুগুলোর খাবারের খাদ্য তালিকায় রয়েছে খৈল, ভুসি, খড়, সবুজ ঘাস, ভুট্টা গাছের সাইলেন্সার, ছোলা ও ঝাউয়ের মতো প্রাকৃতিক খাবার। প্রাকৃতিক উপায়ে সম্পূর্ণ স্টেরয়েড ও ইনজেকশনমুক্ত বিশুদ্ধ গো-খাদ্যের মাধ্যমে গরু বড় করে আমরা বিক্রি করে আসছি। আশা করছি প্রতিবেশী দেশ থেকে কোনো গরু আনা না হলে আমরা সকল খামারিরাই লাভবান হবো। আমি মনে করি, আমাদের দেশীয় গরুর মাধ্যমে চাহিদা মেটানো সম্ভব। খামার থেকেই গরুগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপারি ও সাধারণ মানুষ ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে।
করিমগঞ্জ উপজেলার সিদলারপাড় গ্রামের ইয়াসিন এগ্রো ফার্মের মালিক সুমন মিয়া জানান, আমরা পারিবারিকভাবেই গরু লালন-পালন করি। কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার করি না। সকাল-বিকাল নিয়ম করে খাবার দিই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি। গরু ভালোভাবে বেড়ে ওঠে। এখন ঈদের বাজারে তুলব, ভালো দাম পেলে পরের বছর আরেকটু বড় খামার করার চিন্তা করছি। তবে গো-খাদ্যের দাম ও কাজের লোকের হাজিরা, সব মিলে একটি গরুর পেছনে যে ব্যয় হয়, তা পুষিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হয়। আমার খামারে ১ লাখ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা মূল্যের গরু রয়েছে।
কিশোরগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সুভাষ চন্দ্র পণ্ডিত জানান, জেলায় মোট ৬৩টি গরুর হাট রয়েছে। এসব হাটে ক্রেতাদের নিরাপদ পশু ক্রয়ের ক্ষেত্রে ৪০টি ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম কাজ করবে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ সদরে ৪টি, করিমগঞ্জ ৪টি, তাড়াইল ৩টি, হোসেনপুর ৩টি, পাকুন্দিয়া ২টি, কটিয়াদী ৬, কুলিয়ারচর ২, ভৈরব ৩, বাজিতপুর ৩, নিকলি ২, ইটনা ২, মিঠামইনে ৪, অষ্টগ্রামে ২টি টিম কাজ করবে।
ডা. সুভাষ চন্দ্র আরও জানান, ‘প্রাকৃতিক উপায়ে খড়, ঘাস, খৈল, চালের কুঁড়া ও ভুসি খাইয়ে গরু মোটাতাজা করছেন খামারিরা। প্রস্তুত করা প্রাণী সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন, জেলার প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীগণ। ওষুধের অপব্যবহার, রাসায়নিক খাবার বর্জনের ব্যাপারে খামারিদের নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে আসছেন তারা। পাশাপাশি রোগাক্রান্ত প্রাণী কিংবা কুরবানির অনুপযোগী প্রাণী কেনাবেচা না করার পরামর্শ দিচ্ছেন। এ বিষয়ে উপজেলাভিত্তিক একটি করে ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রত্যেক উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।