জোরালো হচ্ছে আ’লীগ নিষিদ্ধের দাবি


৮ মে ২০২৫ ১৪:০৯

॥ সৈয়দ খালিদ হোসেন ॥
জুলাই বিপ্লব নিয়ন্ত্রণ করতে নির্বিচারে পাখির মতো গুলি করে নাগরিকদের হত্যা করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। কিন্তু শতসহস্র মায়ের বুক খালি করেও বিপ্লবীদের ঠেকানো যায়নি। ফলে জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলটির অনেক সিনিয়র নেতা। এরপরই দলটি নিষিদ্ধের দাবি ওঠে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) মনে করে আওয়ামী লীগকে জনগণ গত ৫ আগস্টই লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছে। এখন কাজ হচ্ছে দলটি যেসব লোক খুন-গুম. দুর্নীতিসহ নানা অপরাধে জড়িত, তাদের দ্রুত বিচার করা এবং দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী মনে করে, রাজনীতি করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে আওয়ামী লীগ। ফ্যাসিবাদবিরোধী অন্য দলগুলোর মধ্যে কারো কারো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে ভিন্নমত থাকলেও অপরাধে জড়িতদের দ্রুত বিচারে সবাই একমত। তবে এনসিপি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও দলটির নেতাকর্মীদের অপরাধের বিচার হওয়ার আগে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের নির্মমতার শিকার হয়েছিল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। অরাজনৈতিক এ সংগঠনটি ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে সমাবেশ আহ্বান করলে ঢাকার প্রবেশপথগুলো বন্ধ করে দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু প্রতিবাদী জনতা সব বাধা উপেক্ষা করে সমাবেশস্থলে প্রবেশ করেন। বিশাল জনসমুদ্রে রূপ নেয় মতিঝিল ও আশপাশের এলাকাগুলো। পরে আগত নেতাকর্মীরা রাতে শাপলা চত্বরে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ওইসময়ের ফ্যাসিবাদী সরকার রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র আলেম সমাজের ওপর হামলা চালায়, সেখানে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারান। এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা আশরাফ মাহমুদ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি করেন। তিনি এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ড, ২০২১ সালে মোদির সফরকেন্দ্রিক চালানো হত্যাকাণ্ডসহ ফ্যাসিস্ট সরকারের চলা সকল হত্যাকাণ্ডের দোষে দোষী হওয়ায় সন্ত্রাসী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি আমরাও করছি।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান মনে করেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কোনো বিকল্প নেই। গত ৫ মে সোমবার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে থাকা লেবার পার্টির চেয়ারম্যানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ জুলাই বিপ্লবীদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে হেন কোনো অপরাধ নেই, যে অপরাধ করেনি আওয়ামী লীগ সরকার। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সবসময় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে। ফলে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা সম্মিলিত আন্দোলনে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন দলটির প্রধান শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে মানবতাবিরোধী নানা অপরাধে জড়িত অনেকেই দেশ ছেড়েছেন, যারা পালাতে পারেনি তারাও নানাভাবে চেষ্টা করছে। এ রাজনীতিক বলেন, পুরো দেশবাসীই দলটিকে নিষিদ্ধ চায়।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মনে করেন, কোনো দল নিষিদ্ধ কোনো সমাধান নয়। আওয়ামী লীগকে আদর্শিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে এবং সাংগঠনিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, দু-একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, নিষিদ্ধ করে দমন করা যায় না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উল্টো ফলাফলও আসে। তিনি বলেন, গত ১৬ বছর যারা গুম-খুনে জড়িত ছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। যারা অপরাধ করেছে সেসব ব্যক্তির বিচার হবে, দলের বিচারের প্রশ্নটিও আসছে। তবে দলের বিচারের ক্ষেত্রে খুবই জটিল, নতুন আইন করার প্রয়োজন হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে মানুষের মখোমুখি হওয়া জরুরি। সাইফুল হক বলেন, উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, আন্দোলন ঠেকাতে গণহত্যা চালালো, এত খুন-গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করল কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো ধরনের আত্মসমালোচনা নেই, অনুশোচনা নেই। উল্টো তারা নানা যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টা করছে।
গত ২ মে শুক্রবার আওয়ামী নিষিদ্ধ ও জুলাই গণহত্যার বিচার দাবিতে রাজধানীতে বিশাল সমাবেশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ওই সমাবেশ দলটির সব বক্তাই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে জোরালো দাবি জানান। একইদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। এ সময় তিনি বলেন, ৫ আগস্ট বাংলাদেশের জনগণ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি রায় দিয়েছে, যে তারা বাংলাদেশে আর কখনো রাজনীতি করতে পারবে না। আমরা যখন বলি জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে, তখন উপায় হচ্ছে একটি ভোটের মাধ্যমে, অন্যটি রাজপথে তাদের অবস্থান জানান দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। একটি গণঅভ্যুত্থান দেশে হয়েছে, সেখানে এদেশের জনগণ মুজিববাদ ও আওয়ামী লীগকে অস্বীকার করেছে। জনরোষে পড়ে আওয়ামী লীগের নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এরপর আওয়ামী লীগ এদেশে রাজনীতি করতে পারবে কিনাÑ এ আলোচনা আসতে পারে না। তারা রাজনীতির নৈতিক ভিত্তি হারিয়েছে। এখন তার আইনি বন্দোবস্ত কী হবে, কোন প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশর রাজনীতি থেকে দূর করতে পারি এবং একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে পারি, সেই পথ আমাদের উত্তরণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করে অতিদ্রুত তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে এবং বিচারের মাধ্যমে আমরা তাদের বিষয়ে একটি চূড়ান্ত ফয়সালা পাবো। এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ ইতোপূর্বে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্বোধন করে তার ফেসবুকে লেখেন, ‘ড. ইউনূস, আওয়ামী লীগ ৫ আগস্টেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। উত্তরপাড়া ও ভারতের প্রেসক্রিপশনে আওয়ামী লীগের চ্যাপ্টার ওপেন করার চেষ্টা করে লাভ নেই।’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান গত ২১ মার্চ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। ওই পোস্টে তিনি ‘আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন জনগণ মেনে নেবে না’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, এখন দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য পতিত ফ্যাসিবাদীরা দেশের ভেতরে-বাইরে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে মন্তব্য করেন শফিকুর রহমান। তিনি তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, বাংলাদেশের নির্যাতিত ১৮ কোটি মানুষের দাবি হলো, গণহত্যাকারীদের বিচার। চব্বিশের শহীদ পরিবারগুলোর পুনর্বাসন। আহত-পঙ্গু অসংখ্য ছাত্র-তরুণ-যুবক-মুক্তিকামী মানুষের সুচিকিৎসা। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সাড়ে ১৫ বছরের সৃষ্ট জঞ্জালগুলোর মৌলিক সংস্কার সাধন করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা। জামায়াতের আমীর লিখেছেন, এ সময় জনগণ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গণহত্যার বিচার দেখতে চায়। এর বাইরে অন্যকিছু ভাবার কোনো সুযোগ নেই। দেশবাসীর উদ্দেশে জামায়াতের আমীর তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, বাংলাদেশ ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক অতিক্রম করছে। দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের পর ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই একটি নতুন বাংলাদেশ মহান আল্লাহর মেহেরবানিতে উপহার হিসেবে পেয়েছে জাতি। এজন্য মহান রবের দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া। একইসঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতিতে সর্বস্তরের জনগণকে সংযত, সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ থেকে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানিয়েছেন শফিকুর রহমান।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনন্সিটিউশন মিলনায়তনে ‘লগি-বৈঠার তাণ্ডবে নিহতদের প্রতিবাদে আলোচনা সভা’ অনুষ্ঠানে জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘মানুষ হত্যার পর যারা (আওয়ামী লীগ) পেট্রোল দিয়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলে, তাদের রাজনীতি ও নির্বাচন করার নৈতিক অধিকার নেই’। তিনি বলেন, “১৯৯৬ সালে তাদের (আওয়ামী লীগ) দলীয় প্রধান বলেছিলেন, কেউ যদি তাদের দলের একটা লাশ ফেলে, তাহলে তারা ১০টা লাশ ফেলবেন। এবার বলেননি কিন্তু, করেছেন। জাতির ওপর রাগ মেটাতে নিরীহ মানুষকে হত্যার পর তাদের লাশ পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছেন। ‘তারা নাকি আবার এদেশে রাজনীতি ও নির্বাচন করতে চায়। যারা জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তারা নির্বাচনে ভোট চাইবে কার কাছে? তাদের কোনো নৈতিক অধিকার নেই।’ গত ২ মে এনসিপি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে একটি সমাবেশ করে। ওই সমাবেশে মূল্য লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি তোলা। বিষয়টি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়েরের দৃষ্টিতে এনে এ বিষয়ে দলের অবস্থান জানতে চাওয়া হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আওয়ামী লীগের বিষয়ে জামায়াতের অবস্থান পরিবর্তন হয়নি। আগের অবস্থানেই রয়েছে জামায়াত। তিনি বলেন, দলের আমীর এবং সেক্রেটারি জেনারেল এ বিষয়ে আগে কথা বলেছেন এবং সেই অবস্থানেই রয়েছি আমরা।
গণহত্যার বিচার ও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের বিষয়ে সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখানে তিনি বলেন, ‘বিএনপি গত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেছে। যারা দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। তবে আমরা এ কথা বলে আসছি যে, কোন পার্টি নিষিদ্ধ হবে, কোন পার্টি কাজ করবে, কোন পার্টি কাজ করবে না, সেসব বিষয়ে জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে। জনগণের কাছ থেকে এ সিদ্ধান্ত আসতে হবে।’ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ মনে করেন, এদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার অধিকার নেই। সে কারণে আইনি প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। গত ২৫ এপ্রিল গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের মাঝে আর্থিক সহায়তা প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এমন মন্তব্য করেন। অন্যদিকে গত ২১ মার্চ রাজধানীর উত্তরার দক্ষিণখানে ফায়দাবাদ মধ্যপাড়া হাজী শুকুর আলী মাদরাসা সংলগ্ন মাঠে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বিচার দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে কথা হচ্ছে, কিন্তু বিচার নিয়ে কথা হচ্ছে না। বিচারের পর আওয়ামী লীগের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। আর জনগণ ক্ষমা করলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। জুলাই আন্দোলনে যারা গণহত্যায় জড়িত তাদের বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের যারা অপরাধী তাদের বিচার নিশ্চিত হওয়ার পর জনগণ রাজনীতি করার সুযোগ দিলে আমাদের কিছু বলার নেই। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে বিএনপির বর্তমান অবস্থান জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি গত ৫ মে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, বিএনপির মুখপাত্র আমি নই, এ বিষয়ে দলের মহাসচিব ও মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী আহমেদের বক্তব্যই দলের বক্তব্য।
জার্মানির ডয়চে ভেলে একাডেমি ও বন রাইন-জিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক যোগাযোগবিষয়ক শিক্ষক ড. সাইমুম পারভেজ মনে করেন, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্বিচার রাজনৈতিক সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদী হামলা ও সামাজিক দাঙ্গার মধ্যে নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এ বছরের মধ্য জুলাই ও আগস্টের প্রথম ভাগে। আর্মার্ড কারের ওপর যুবকের লাশ, রিকশার পাদানিতে মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তরুণের আকুতিময় চোখ, হেলিকপ্টার থেকে বাছ-বিচারহীন গুলিতে শিশুর মৃত্যু…মানুষের জীবন যেন মূল্যহীন, জীবন নেওয়া যেন ভিডিও গেমসের মতো খেলা! সে সময়ের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান শেখ হাসিনা এবং সরকারের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ ও জোরালো নির্দেশ ছাড়া হাজারো মানুষকে হত্যা ও গুরুতর আহত করার সম্ভাবনা কম। তাই শেখ হাসিনা, তাঁর সরকার এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সুষ্ঠু বিচার জরুরি। এই বিচারে গাফিলতি বা ঢালাও হত্যা মামলা দেওয়া হবে, এ ঘটনাকে হালকা করে ফেলার শামিল। গত ১৫ বছরে সুষ্ঠু ভোট না হওয়া, জুলাই হত্যাকাণ্ড এবং অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পলায়নের পর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের আচরণ ও বক্তব্যে এ নিয়ে অনুশোচনা লক্ষ করা যায় না। তাই যদি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে কোটি মানুষের পরিণতি এর সঙ্গে জড়িত। তাই এ বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত হঠকারিতা নয়, বরং কার্যকর আলোচনা ও চিন্তার মাধ্যমেই হওয়া উচিত।
এ বিশ্লেষক আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করতে আমরা কয়েকটি সম্ভাব্য বিকল্প দৃশ্যপটের কথা চিন্তা করতে পারি। প্রথম দৃশ্যপট, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা। স্বল্পসময়ের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে পারে। এ সিদ্ধান্ত আসতে পারে তিনটি প্রক্রিয়ার যেকোনো একটির মাধ্যমে, আদালতের নির্দেশে, গণভোট অথবা নির্বাহী আদেশে। আদালতের নির্দেশে নিষিদ্ধ করার আবেদন করলে প্রমাণ করতে হবে যে, দল হিসেবে গণহত্যায় আওয়ামী লীগ জড়িত ছিল কিনা, দলীয় সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী ছিল, দলের প্রধানের জড়িত থাকার প্রমাণ আছে কিনা। সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যে কাজের সীমানাগত পার্থক্য, তা-ও এখানে দেখতে হবে। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় শুধু অপরাধের বিচার নয়, বরং এর সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় জড়িত। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি তার সাংস্কৃতিক মূলধন। বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের অনেক মহারথী ও মতামত প্রভাবক আওয়ামী লীগের শক্তি। তাই দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়া দলটিকে নিষিদ্ধ করলে তা কার্যকরী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আওয়ামী লীগকে স্বল্পমেয়াদি নিষিদ্ধ করলে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হবে।