বোরো ধানের বাম্পার ফলন ন্যায্যমূল্যের আশা কৃষকদের


১ মে ২০২৫ ২২:৫৯

আহসানুল হক জুয়েল, কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলসহ সারা জেলায় বোরো ধান কাটার ধুম লেগেছে। কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাক্সিক্ষত সোনালি ফসল ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন হাওরাঞ্চলসহ জেলার কৃষান-কৃষানিরা হাওরাঞ্চলে মাইলের পর মাইল ক্ষেতের পর ক্ষেত সোনালি ধানে ভরে গেছে। হাওরের বাতাসে দুলছে ধানের সোনালি শিষ। এ যেন এক মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য। সপ্তাহখানেক আগে থেকে টুকটাক ধান কাটা শুরু হলেও বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পুরোদমে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে।
গত ২৪ এপ্রিল খাদ্য সচিব মাহমুদুল হাসান কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর এলাকা পরিদর্শন করেন এবং মিঠামইন উপজেলায় সরকারিভাবে ধান চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করেন।
সরেজমিন হাওর এলাকায় দেখা গেছে, অনেক জায়গায় মেশিন দিয়েও ধান কাটা হচ্ছে। হাওরের সর্বত্রই এখন শুধু ধান আর ধান। এসব কাজে এখন নারী-পুরুষ, ছোট-বড়সহ সবাই ব্যস্ত। তাছাড়া এবার ধানের বাম্পার ফলন পেয়ে কৃষকরাও খুশি। তবে ধানের যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সেই আশা কৃষকদের।
করিমগঞ্জের বড় হাওরে বুলবুল মিয়া তাঁর পাঁচ কানি জমিতে চাষ করা ব্রি২৮ ধান কাটার জন্য ২২ জন শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, একজন শ্রমিককে দৈনিক এক হাজার টাকা মজুরি দিয়ে এক হাজার টাকা মণের ধান কাটাতে হচ্ছে। ধানের দাম না বাড়লে কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
করিমগঞ্জের বড় হাওরে জমির ব্রি-২৮ জাতের ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন সেলিম ব্যাপারী। দুই একর জমিতে চাষ করা ধান তিনি পহেলা বৈশাখ থেকে কাটা শুরু করেছেন। ধানের ফলন ভালো হয়েছে উল্লেখ করে সেলিম ব্যাপারী বলেন, সেচ খরচ, সার খরচ আর ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায় শ্রমিকের মজুরি খরচ মিলিয়ে প্রতি মণ ধান উৎপাদনে খরচ পড়ে যায় প্রায় ৯০০ টাকা। অথচ বাজারে এখন প্রথম ধান বিক্রি করতে পারছেন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০ টাকায়। তাই কৃষকরা তাঁদের কষ্টার্জিত ফসলের দামটা যেন সঠিক পান, সেই দাবি করেন তিনি।
নিকলী উপজেলার মজলিশপুর এলাকার কৃষক সেলিম মিয়ার সঙ্গে কথা হয় নিকলীর বড় হাওরের মজলিশপুর এলাকায়। এ সময় তিনি বলেন, ধান কাটার মেশিন খরচসহ অন্যান্য খরচে মণপ্রতি ধান উৎপাদনে তাঁর খরচ পড়ছে ৮০০ থেকে সাড়ে ৮০০ টাকা। অন্তত ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে যদি তিনি ধান বিক্রি করতে পারতেন, তাহলে প্রকৃত সুফল পেতেন।
এ সময় পাশে থাকা সুরুজ মিয়া নামের আরেক কৃষক বলেন, ধান ও শ্রমিকের দাম যা-ই হোক, এবার তিনি ১০ কানি জমিতে ধান করেছেন। যে ফসল হয়েছে, অতীতে তেমনটি হয়নি। এবার ধানের বাম্পার ফলনে তিনি খুশি। ভালোয় ভালোয় যাতে আবহাওয়া অনুকূলে থাকতেই তিনি গোলায় ধান তুলতে পারেন, সেই আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় বোরো ধানা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে। সেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে। এর মাঝে শুধু হাওরেই ১ লাখ ৪ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। যেখান থেকে উৎপাদিত চালের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৯১২ মেট্রিক টন এবং ধানের উৎপাদন ধরা হয়েছে ১১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৬৮ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। গত বছর ধানের সরকারি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১২০০ টাকা প্রতি মণ, তবে এবার তা কৃষকদের জন্য বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৪৪০ টাকা প্রতিমণ, যা প্রতি কেজি ৩৬ টাকা। সরকার এ বছর কৃষকদের কাছ থেকে ৩৯ টাকা কেজি দরে ধান ও ৪৮ টাকা কেজি দরে চাল সংগ্রহ করবে বলে জানা গেছে।
জেলার হাওরাঞ্চলের কৃষকরা বলছেন, খরচ ও ঋণ মেটাতে অনেক চাষি ধান ঘরে না তুলেই বিক্রি করে দিচ্ছেন ৮২০ থেকে ৯০০ টাকা মণ দরে। যদিও এক মণ বোরো ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় সাড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত। ফলে কৃষকের মুখে হাসি মলিন হয়ে গেছে।
কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর উপজেলাগুলো হলো নিকলী, ইটনা মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা। এই চারটি উপজেলা ছাড়াও বাজিতপুর কুলিয়ারচর এবং করিমগঞ্জ উপজেলা কিছু অংশ নিয়ে জেলার হাওর অঞ্চল। ইতোমধ্যেই হাওরাঞ্চলের প্রায় ৬০ ভাগ বোরো ধান ইতোমধ্যেই কৃষকরা গড়ে তুলেছেন বলে একটা সূত্র দাবি করেছে। বাকি ৪০ ভাগ বোরো ধান আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই কৃষকের ঘরে তোলা সম্ভব হবে বলে জানা গেছে। যদি কোন প্রকার প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঝড়-শিলাবৃষ্টি এবং উজান হতে হঠাৎ কোনো পানি না আসে। উল্লেখ্য, হাওরাঞ্চলের মানুষের একমাত্র খাদ্য ফসল এ বোরো ধান। জমিগুলো সবই এক ফসলি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষতিগ্রস্ত হলে হাওরাঞ্চলের কৃষকদের মেরুদ- ভেঙে যাবে। কৃষকরা এ সংবাদদাতাকে জানান, মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি থাকলে এ বছর বোরো ফসল খুব সুন্দরভাবেই ঘরে তুলতে পারবেন।
কিশোরগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, আগাম পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় ফসলহানি রোধে এবার কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে উপজেলায় ২৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ১২৯টি ফসল রক্ষা বাঁধের নির্মাণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। নিকলী উপজেলার সবচেয়ে বড় হাওর জনশাইয় হাওরে কৃষক কিতাব আলীর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ২ একর বোরো ২৮ জাতের ধান কাটতেছি। ফলন ভালো হয়েছে। তবে ধান কাটার মৌসুমি কৃষি শ্রমিকের সংকট রয়েছে এলাকায়। তাই পরিবারে লোকজন ও এলাকার শ্রমিকদের নিয়ে ধান কাটছি। ধানের ন্যায্যমূল্য পেলে আমরা লাভবান হবো। জমি আবাদ করতে গিয়ে ঋণ করতে হয়েছে। তবে ভালোয় ভালোয় ধান তুলতে পারলে সব ঋণ শোধ করা যাবে। বর্তমানে হাওরাঞ্চলে ধান কাটার শ্রমিক মজুরি চলছে প্রতিদিন ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা করে। অনেক কৃষক নিরুপায় হয়ে উচ্চমূল্যের শ্রমিক এনে তাদের সোনালি ফসল ঘরে তুলছেন।
নিকলীর আলিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক বিল্লাল হোসেন বলেন, আমরা কৃষক মানুষ ঋণ করে বোরো ধান করেছি। ধানের ফলন ভালো হয়েছে এখন দাম ভালো পেলে লাভবান হবো। না হলে ঋণের বোঝ বইতে হবে।
হাওরের কৃষক পাপ্পু মিয়া বলেন, ‘আমাদের হাওরে হাইব্রিড ছক্কা, ফাইজং ও হাইব্রিড ২৯ ধানের ভালো ফলন হয়েছে। শুনেছি হাওরে বাঁধ হয়েছে। তাই বন্যা হাওয়ার শঙ্কা কম। কষ্টের ফসল নষ্ট হলে কি যে কষ্ট এইটা বইলা বোঝাইতাম পারতাম না। এখন হাওরের দিকে ছাইয়া ছাইয়া দুই হাত তুইলা মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করি, যে ধান জমিতে আছে সেই ধানের যাতে কোনো ক্ষতি না অয়।’ এই আকাক্সক্ষা শুধু আমার একার নয়, পুরো হাওরবাসীর।
নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর থেকে ১৬জনের একটি শ্রমিকের দল নিয়ে এসেছেন আমিন উদ্দিন নামের শ্রমিক দলনেতা। তিনি জানান, গত বছর শ্রমিকের মূল্য বেশি ছিল এবার কিছুটা কম। হাওরে এখন মেশিনের মাধ্যমে ধান কাটা হয়, তাই আমাদের মূল্য কম।
হার্ভেস্টার মেশিনের মালিক মাহবুবুর রহমান বলেন, শ্রমিক দিয়ে ধান কাটতে অনেক সময় লাগে। হার্ভেস্টার মেশিন দিয়ে ১ একর জমির ধান কাটতে মাত্র ১ ঘণ্টা লাগে। মেশিনে ধান কেটে কৃষক সহজেই বাড়ি নিয়ে যেতে পারে।
কিশোরগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামার বাড়ি) উপপরিচালক ড. মো. সাদিকুর রহমান জানান, খাদ্যে উদ্বৃত্ত কিশোরগঞ্জ জেলায় চলতি বছর ১ লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ লাখ ৮৮ হাজার ২১০ টন। আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ফলন ভালো হওয়ায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করবে। এ বছর সরকারিভাবে নির্বাচিত কৃষকদের কাছ থেকে ৩৯ টাকা কেজি দরে ধান ও ৪৮ টাকা কেজি দরে চাল সংগ্রহ করা হবে।
কৃষি শ্রমিক সংকট কাটাতে হাওরে ইতোমধ্যে ২২০টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার মেশিন ধান কাটার কাজ করছে। এছাড়া প্রতিদিনই বাহিরের জেলা থেকে হার্ভেস্টার মেশিন আসছে। পাশাপাশি কৃষি শ্রমিকরাও ধান কাটায় ব্যস্ত রয়েছে।