স্নাতক পাস কোর্স

ক্লাসে অংশ নিচ্ছে না শিক্ষার্থীরা


১ মে ২০২৫ ১৭:৪৮

॥ সৈয়দ খালিদ হোসেন ॥
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেশে যত ডিগ্রি কলেজ রয়েছে, সেখানে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে অংশ নেয় না বললেই চলে। যেসব কলেছে অনার্স এবং মাস্টার্স কোর্স রয়েছে, সেসব কলেজে ডিগ্রি পাস কোর্স থাকলেও পাস কোর্সের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে মোটেও অংশ নেয় না। আর যেসব কলেজে অনার্স বা মাস্টার্স নেই, সেখানে কিছু শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশ নেয়। যারা ক্লাসে অংশ নেয়, তারাও নিয়মিত নয়। তাছাড়া এদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে খুবই কম। অনেক শিক্ষার্থী কলেজ কর্তৃক নেওয়া পরীক্ষাগুলোয়ও অংশ নেয় না। কিন্তু যখন চূড়ান্ত পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় আসে, তখন এ ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা ঠিকই পরীক্ষায় অংশ নেয়। পাস করার হারও খারাপ নয়। এ শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হলেও মানুষের মনে পাস করা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। ক্লাসে অংশ না নিয়ে পরীক্ষা দেওয়া এবং কৃতকার্য হওয়া এ শিক্ষার্থীরা ভালো কর্মসংস্থানে যাচ্ছে না। শিক্ষকতা বা শিক্ষা খাতেও এরা ভালো কোনো অবদান রাখছে না। ডিগ্রি পর্যায়ের এ শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরাতে কিছু কিছু কলেজ কর্তৃপক্ষ সাধ্যানুযায়ী প্রচেষ্টা চালালেও অধিকাংশই উদ্যোগী নয়। তাছাড়া দেশের এ কলেজগুলোর পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ‘জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়’ এ বিষয়ে কঠোর ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর ক্লাসে অংশ নিচ্ছে না ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা।
ক্লাস বর্জনের সংস্কৃতি
ঢাকার তেজগাঁও সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন, ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতিটাই হয়ে গেছে ক্লাস না করার। প্রথমে ভর্তি হওয়ার পর কিছুদিন ক্লাস হয়। এরপর যেন সব শেষ। অসংখ্য শিক্ষার্থী আছে যারা একদিনও ক্লাস না করে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। শিক্ষকরা ক্লাস নেন না বিষয়টি এমন নয়, বরং শিক্ষার্থীরাই ক্লাস করে না। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই ক্লাসে যায় না। সরকারি আযিযুল হক কলেজের শিক্ষার্থী মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, আমরা যারা ডিগ্রিতে (পাস) বিজ্ঞানে ভর্তি হই, আমাদের মতো অসহায় যেন আর কেউ নেই। আমরা পড়তে আসছি নামকাওয়াস্তে। পড়ে যে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে তাও না। তারপরও আমাদের বিজ্ঞানের বিষয়গুলো আয়ত্ত করতে হয়। পড়তে হয় প্রাইভেট। সাধারণত কোনোরকম এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থীরা আসে ডিগ্রিতে। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে লাভটা কী? এ বিষয় নিয়ে পড়ে চাকরিতে কোনো সুবিধা পাবো তাও তো না। তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ সময় প্র্যাকটিক্যাল বিষয়গুলোর ন্যূনতম ধারণাও থাকে না। আমরা মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী আর টাকা দিয়ে প্র্যাকটিক্যাল পাস করা শিক্ষার্থী। অপর এক শিক্ষার্থী বলছেন, আমরা যে কলেজের শিক্ষার্থী এটা হয়তো মনেই থাকে না। আমাদের যোগাযোগ শুধুমাত্র পরীক্ষার সময়কেন্দ্রিক। ডিগ্রি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র একটা সার্টিফিকেট প্রয়োজন, তাই পড়তে আসে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে হৃদ্যতা, বন্ধুত্ব, পরিবেশ এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমাদের কাছে মুখ্য নয়। কারণ আমরা তিন বছরের জন্য আসি একটা সার্টিফিকেট নিতে। তিনি আরও বলেন, এই ডিগ্রি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কেউ চাকরিকে গুরুত্ব দেয় না। আমরা সকল বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা নিয়ে পাস করছি। এমনভাবে এ সিলেবাস সাজানো যে, শুধু আমরা প্রাথমিক ধারণা পাচ্ছি। টিউশনিতেও আমাদের ভ্যালু থাকে না। কারণ অভিভাবকরা চান বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানে অভিজ্ঞ লোক।
অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক বিমল সরকারের ভাষ্য, দেশের কলেজগুলোয় শিক্ষার্থীদের ক্লাস না করার প্রবণতা দিন দিন যে কী মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, তা অল্প কথায় সহজে বলে শেষ করা যাবে না। বিষয়টি একেবারে ভাবনারও অতীত এবং সবার জন্যই গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার। এছাড়া গোটা জাতির জন্যই সমূহ দুর্গতিরও আলামত বলে মনে করি। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে যেমন-তেমন, এর ওপরের স্তরগুলোর হাল-হকিকত একেবারেই নাজুক। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস; এমনকি অনেকের কাছেই অবিশ^াস্য বলে মনে হলেও কথাটি সত্য যে, বছরের কোনোদিনই একটি ক্লাসেও উপস্থিত না থেকে কিংবা নামকাওয়াস্তে দু-চার দিন উপস্থিত থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ডিগ্রি পাস কোর্সের মতো পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। অনিয়মিত নয়, ক্লাসে উপস্থিত না হওয়াদের নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবেই বছরের পর বছর এ সুযোগটি করে দিয়ে চলেছে কর্তৃপক্ষ। আর অতি সহজেই সুযোগ পেতে পেতে শিক্ষার্থীদের মাঝে এরূপ ক্লাস না করার প্রবণতা দিন দিন কেবল বেড়েই চলেছে। পরিস্থিতি যে কী ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা শিক্ষার সঙ্গে যারা সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নন, তাদের বোধকরি সহজে বিশ্বাসই করানো যাবে না। তবু রক্ষাÑ নিয়ম অনুযায়ী আজকাল এক কলেজের পরীক্ষার্থীকে অন্য কলেজে বসে পরীক্ষা দিতে হয়। তা না করে আগের মতো নিজেদের কলেজেই বসে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে পরীক্ষার হলে এমন অসংখ্য পরীক্ষার্থীর দেখা পাওয়া যেতÑ যাদের ক্লাসে তো দূরের কথা, শিক্ষকরা ক্যাম্পাসেই কখনো দেখেননি।
জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে থাকার ভোলা সরকারি কলেজে অনার্স এবং মাস্টার্স কোর্সে অধ্যয়নের ব্যবস্থা আছে। ওই কলেজটিকে ডিগ্রি পাস কোর্সও চালু রয়েছে। বছরের পর বছর এ কলেজে ডিগ্রি পাস কোর্সের শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে দেখা যায়নি। ভোলার নাজিউর রহমান ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী মো. শাখাওয়াত হোসেন সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে শিক্ষার্থীরা স্থানীয় পর্যায়ে নানা কাজে নিয়োজিত হয়ে পরে। চাকরি করার কারণে তারা ক্লাস করার সুযোগ পাচ্ছে না।
কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ডিগ্রিতে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে অংশ না নেওয়ার একাধিক কারণ রয়েছে। তার দৃষ্টিতে অনেক কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে, ডিগ্রি পাস কোর্সে ভর্তি হয় অপেক্ষকৃত দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের পরিবারের সন্তানরা। এরা ভর্তি হওয়ার পর পোশাক কারখানা, এনজিও বা অন্য কোনো চাকরিতে যোগদান করে, ফলে ক্লাস করার সুযোগ থাকে না। মেয়ে শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিয়ে হয়ে যায়, ফলে তারা সংসার করে, ক্লাস করে না। কিন্তু পরীক্ষার সময় এসে ঠিকই পরীক্ষা দিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও কঠোর হচ্ছে না। জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় কঠোর নির্দেশনা দিলে শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়েই ক্লাসে অংশ নেবে। প্রায় এক বছর আগে গত ১৯ মে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘শুধু কাগুজে সনদ অর্জন নয়, নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে যথার্থ জ্ঞান অর্জন করে একজন শিক্ষার্থীকে পড়াশোনা শেষ করতে হবে। ক্লাসে উপস্থিত না হয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ এবং উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে’। কিন্তু বিশ^বিদ্যালয় সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেই। মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম জানান, তার কলেজে ডিগ্রি পাস কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে ২ শতাধিক, কিন্তু ক্লাসে পাঁচ ভাগের এক ভাগও অংশ নিচ্ছে না। তার ভাষ্য, ডিগ্রিতে ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন। এরাও নিয়মিত নন। কখনো ক্লাসে আসেন আবার কখনো আসে না।
শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরাতে অসহায় কর্তৃপক্ষ
অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান দায়িত্বে থাকাকালে দেশের একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে বলেন, অনুপস্থিতির বিষয়ে বললে সব বিশ্ববিদ্যালয়েই কিছু শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যে হলে থেকেও হয়তো আড্ডা দিয়ে সময় পার করছে। ক্লাস করছে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি হওয়ায় আমাদের বিষয়টি আলোচনায় বেশি আসে। কিন্তু এটি চিন্তা করা হয় না যে, একজন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে। যেমন অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আর্থিক অবস্থা এক্ষেত্রে কিছুটা প্রভাব ফেলে। আমাদের অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা পার্ট টাইম চাকরির পাশাপাশি এখানে পড়ালেখা করে। তাদের অনেকের পক্ষেই ইচ্ছে থাকলেও নিয়মিত ক্লাস করা সম্ভব হয় না। কারণ সে চাকরিটা ছেড়ে দিলে হয়তো তার পরিবার সংকটে পড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ৭০ শতাংশ উপস্থিতি না থাকলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করার বিধান রয়েছে। এখন শিক্ষকরা যদি এ নিয়মে কঠোর হন, তাহলে কিন্তু যে শিক্ষার্থী চাকরির পাশাপাশি পড়ালেখা করছে, তার আর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থাকবে না।
জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এস এম আমানুল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে তার মোবাইল ফোনে একাধিকার চেষ্টা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফলে এ প্রসঙ্গে তার মন্তব্য ও পরিকল্পনা জানা যায়নি।