আমাদের স্বপ্ন


২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:১৫

॥ ওবায়েদ ইবনে গনি ॥
রাজনীতিতে পক্ষ-বিপক্ষ, সরকারি দল-বিরোধীদল, দেশ পরিচালনায় সরকারের কাজের ভূমিকা নিয়ে বিরোধীদলের গঠনমূলক সমালোচনা, সরকারি দল জাতীয় প্রয়োজনে বিরোধীদলকে একসাথে নিয়ে কাজ করার আহ্বান করবে আবার বিরোধীদল তার ডাকে সাড়া দিয়ে দেশ গঠনে সহায়তা করবেÑ এটা যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশেরও রাজনৈতিক দল আছে, পক্ষ-বিপক্ষ আছে, তাদের মাঝে তর্কবিতর্ক আছে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে জনমত গঠনের জন্য যে তথ্য প্রচার করছেন, তা থেকে আমরা সঠিক তথ্য পাচ্ছি না। বরং আরো বিভ্রান্ত হচ্ছি, যা আমাদের বিশ্বাসের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
২০০৮ সালে একটি পরিকল্পিত কারচুপির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দখল করে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় দেশপ্রেমিক সেনা অফিসার হত্যা করে আ’লীগ সরকার। পরিকল্পিত সেনা হত্যাযজ্ঞ করে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করা হয়। এটা কোনো অঘটন ছিল না, বিষয়টি পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞÑ যেখান থেকেই আধুনিক ফ্যাসিজমের গোড়াপত্তন। ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের নামে প্রহসন, যেখানে ১৫৩ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যায়। তখন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ভোটাধিকার হরণ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে কালো আইন করে কণ্ঠরোধ করা। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতাদের প্রহসনের বিচারের নামে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা। ২০১৮ ও ২০২৪-এর দুটি প্রহসনের নির্বাচন, যা পাকিস্তান আমলের ইতিহাসকেও হার মানায়। ভিন্নমত পোষণ করায় সহস্রাধিক মানুষকে খুন, ৮০০-এর অধিক মানুষকে গুম ও ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, নির্বাসনসহ অমানবিক নিপীড়ন।
২০২৪ সালের ৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল করে রায় দিলে দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। ১৬ জুলাই আন্দোলন প্রাণঘাতী রূপ নেয়। ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে কোটা সংস্কারের পক্ষে রায় দিলেও আন্দোলনে প্রাণহানিকে ‘জুলাই গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে ৯ দফা দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত থাকে। আন্দোলনকারীরা ‘দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত জুলাই মাস গণনা করার’ কথা জানান; এভাবে তারা ১ আগস্ট থেকে ৩৬ জুলাই হিসেবে গণ্য করতে থাকেন। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৪ আগস্ট (৩৫ জুলাই) থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ৫ আগস্ট (৩৬ জুলাই) ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। আন্দোলনের সফলতাকে আন্দোলনকারীরা ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ এবং এদিনটিকে ‘৩৬ জুলাই’ হিসেবে অভিহিত করেন।
জুলাই পেরিয়ে আগস্ট। আন্দোলন-সংঘর্ষ-রাজনৈতিক পালাবদলে উত্তাল দেশ। তীব্র আন্দোলনের মুখে দাঁড়িয়ে পতন হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের। ৫ আগস্ট তীব্র জল্পনা শুরু হয়, সেনাপ্রধানের কথায় স্পষ্ট হয় শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের কথা। তারপরই দেশের ছাত্র-জনতা ফেটে পড়ে খুশিতে-উচ্ছ্বাসে। সামাজিকমাধ্যমে লেখা হতে থাকে, ‘স্বাধীনতার দিন; ৩৬ জুলাই।’ জুলাইজুড়ে আন্দোলন চলেছে, আন্দোলনের মাঝে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে প্রাণ গিয়েছে বহু শিক্ষার্থীর। সেই কারণেই আগস্ট শুরু হলেও নিজেদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আগস্ট মাসের দিনগুলোকেও জুলাই হিসাবে গণনা করছিলেন বিক্ষোভকারীরা। তাদের বক্তব্য ছিল, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত শেষ হবে না জুলাই। সেদিক থেকে ৫ আগস্ট হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের পর ওই দিনটিকে ৩৬ জুলাই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উল্লেখ করছেন আন্দোলনকারীরা। এ ৩৬ জুলাই হয়ে রইল বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিন।
একটি ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ছাত্র-জনতা হাসিনার দুঃশাসনের কবল থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে ভূমিকা পালন করেছে। ২ হাজারের অধিক ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছে। ২৫ হাজারের অধিক আহত হয়েছে, কেউ কেউ চিরজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেছে, অন্ধত্ববরণ করেছে। প্রতিটি সংগ্রাম-পরবর্তী ইতিহাসকে কুক্ষিগত করা হয়েছে।
বিতর্কের শেষ নেই। আমরা কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা বলে বিবেচনা করব? জাতির সামনে এ ধরনের তথ্য উপস্থাপন করেছে স্বার্থান্বেষী মহল এতে কি নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হচ্ছে না? বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা ইতিহাস পড়েছে এবং ইতিহাস তৈরি করতে ভূমিকাও রেখেছে। এবার তারা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রচর্চার মাধ্যমে প্রকৃত স্বাধীনতা উপভোগ করতে চায়। তাই ফ্যাসিস্ট মানবতা বিরোধী আ’লীগের বিচারের পর এবার একটি অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ও স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থা কায়েম হোক। আর নতুন স্বপ্ন নিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের মাধ্যমে দ্বিতীয় স্বাধীনতা রক্ষা করাই হোক গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী এ সময়ের দৃঢ় অঙ্গীকার।
লেখক : সাংবাদিক।