রমাদানে প্রতিদিনের কাজ


৬ মার্চ ২০২৫ ১২:১৯

॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
মহান আল্লাহ তায়ালা ১২ মাসের মধ্যে উত্তম মাস হিসেবে রমাদানকে উল্লেখ করেছেন। এ মাসের মধ্যে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চাইতেও উত্তম। এ মাসে শয়তানকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। মুমিনদের জন্য প্রতিদানের পরিমাণ ১০ গুণ থেকে সাতশত গুণ আবার আল্লাহ বলেছেন, রোজা তাঁর জন্য, তাই এর বিনিময় তিনিই দেবেন। তাই হিসাবের বিষয়ে ভাবার কী প্রয়োজন? এ মাসেই আল-কুরআন নাজিল হয়েছে।
রমাদান মাস শুরু হয়ে গেছে। আরবি মাসের হিসাব শুরু হয় মাগরিব থেকে। মাগরিব অর্থাৎ সূর্য ডোবা থেকে শুরু করে পরের দিন সূর্য ডোবা পর্যন্ত একদিন। এবারে শনিবার সূর্য ডোবা থেকেই রমাদানের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। সূর্য ডোবার থেকে আমরা পুরো রমাদানের প্যাকেজ থেকে সাওয়াবের ভাগ পেতে শুরু করেছি।
আমরা আলোচনা করব রোজাদারের প্রতিদিনের কাজ কী? যদিও এ বিষয়গুলো পুরনো। আমরা অনেকেই জানি এবং আমল করি। পাঠক সমাজের প্রতিদিনের কাজগুলো আবার মনে করানোর জন্যই এ লেখা।
আমি আগেই বলেছি, আরবি মাস শুরু হয় মাগরিব থেকে। অতএব মাগরিবের নামায আমরা জামাতের সাথে মসজিদে পড়ার চেষ্টা করব। যেহেতু রমাদানে সুন্নতের মর্যাদা ফরজের সমান আবার ফরজের মূল্য ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ, আবার সীমাহীন মূল্য আল্লাহ আমাদের দেবেন। তাই রমাদানের শুরু থেকেই আমরা ফরজ, সুন্নত, নফল সবটাই যত্নের সাথে আদায় করব। নিজে, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সবাই আমরা এ রমাদানের হক আদায় করে চলব।
মাগরিব মসজিদে পড়েই আবার এশার নামায আদায়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। আপনি কাজে থাকলে কখন কোথায় এশার নামায আদায় করবেন, তা পূর্বেই চিন্তা করে রাখতে হবে। কারণ এশার পরই তারাবি পড়তে হবে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ মসজিদেই ২০ রাকাত তারাবির নামায পড়া হয়। কোথাও সূরা তারাবি আবার কোথায় কুরআন খতম দেয়ার জন্য হাফেজ সাহেব ২৬ বা ২৭ রোজার রাতের মধ্যে পুরো কুরআনের ৩০ পারা নামাযে পড়ে থাকেন। তারাবিতে কুরআন পড়া তারতিলের সাথে তিলাওয়াত করতে হবেÑ যাতে করে মুসল্লিরা মনোযোগ সহকারে কুরআন শুনতে পায়। তারাবি পড়ার পর জামাতের সাথে ৩ রাকাত বেতর পড়া হয়। অনেকে শেষ রাতে যারা তাহাজ্জুদ পড়েন, তারা তাহাজ্জুদের পর ৩ রাকাত বেতরের নামায আদায় করেন। উল্লেখ থাকে যে, কাবা ও মসজিদে নববীতে ২০ রাকাত নামায আদায় করেছি। তাহাজ্জুদ নামাযের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সূরা মুজ্জামিলে বর্ণনা দিয়েছেন। তাই অন্য সময়ে না পারলেও রোজার সময় যেহেতু আমরা শেষ রাতে সাহরি খেতে উঠি, তাই একটু আগে উঠে ভালো করে অজু করে ২ রাকাত করে ৮ রাকাত বা তার কমবেশি পড়ে তারপর ৩ রাকাত বেতের পড়তে পারি। কারণ এ সাওয়াবের মৌসুমে কোনো কাজেই অবহেলা করা যাবে না। প্রতিটি সময় আমাদের কাজে লাগাতে হবে। সাহরির শেষ সময়ে খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে যেহেতু হাতে ঘড়ি আছে, মোবাইল ফোন আছে তাই সময় নির্ধারণ কোনো সমস্যা নেই।
সাহরি খেয়েই আজান হলে দুই রাকাত ফজরের সুন্নত বাড়িতে পড়ে নিলে ভালো। তারপর কাছাকাছি মসজিদে ছেলে-নাতিদের নিয়ে যান। চেষ্টা করবেন একটু আগে গিয়ে প্রথম কাতারে শামিল হতে। সময় থাকলে মসজিদে গিয়ে না বসে দুই রাকাত নামায পড়ার ব্যাপারে আমাদের নবী মুহাম্মদ সা. উৎসাহিত করেছেন। ফজরের নামায মসজিদে আদায় করে বাড়িতে এসে কুরআন তিলাওয়াত করবেন অর্থসহ। উল্লেখ থাকে যে, বাড়িতে এসেই খবর নেবেন বাড়িতে অবস্থানরত মহিলারা ফজরের নামায আদায় করেছেন কিনা? সূর্য ওঠার পর দুই রাকাত নামায পড়া অনেক মূল্যবান। নবী সা. বলেছেন, দুই রাকাত এ সময়ে নামায আদায় করলে আমাদের শরীরের ৩৬০টি হাড়ের জোড়ার সাদাকাহ আদায় হয়ে যায়।
জোহরের নামায আদায়ের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। মসজিদের অভাব নেই। একটু খেয়াল রাখলেই আপনি আপনার কর্মস্থল থেকে মসজিদে গিয়ে জোহরের নামায আদায় করে নিতে পারেন। রোজার সময় যেহেতু একটু আগেই ছুটি হয়ে যায়, তাই আসরের নামায হয় কর্মস্থলে অথবা বাসার কাছাকাছি মসজিদে পড়ে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে আসর থেকে মাগরিব সময়টা খুবই মূল্যবান। এ সময়ের ইবাদত আল্লাহর কাছে মর্যাদাকর। অতএব রোজার সময় আসর থেকে মাগরিব কুরআন পড়া, ইসলামী আলোচনা করা, রোজার ফজিলত প্রতিবেশীর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে। সুবহানাল্লাহ, আলহামদুল্লিাহ, আল্লাহ আকবার সবসময়ই পড়তে থাকতে হবে।
মাগরিবের পূর্বেই আমাদের ইফতারির প্রস্তুতি নিতে হবে। মনে রাখতে হবে ইফতার মজা করে খেতে গিয়ে যেন মাগরিবের জামাত ছুটে না যায়। প্রয়োজনে খেজুর আর পানি দিয়ে ইফতার করে মাগরিবের নামায আদায় করে এসে ইফতারের বাকি খাবার খেতে হবে। ইফতার বাড়ির সবাইকে নিয়ে স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে-বউ, নাতি-নাতনি ও বাড়ির কাজের লোকদের ইফতারিতে শামিল করতে হবে। মাঝেমধ্যে প্রতিবেশীদেরও ইফতারিতে দাওয়াত দিতে হবে। আত্মীয়-স্বজনকেও ইফতারিতে দাওয়াত দেয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে মাগরিবের নামাযে যেন ব্যাঘাত না হয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার এশার নামাযের আজান হবে। মাগরিবের পর একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলে ভালো হয়। সবাইকে নিয়েই পার্শ্ববর্তী মসজিদে এশা পড়ে তারাবির নামাযও আদায় করে নিত হবে। যাদের শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছে তারা শেষ রাতে সাহরির পূর্বে বা পরে তাহাজ্জুদ পড়ে ৩ রাকাত বেতের নামায আদায় করে নেবেন। সাহরি খাওয়ার সময় অনেক বেশি না খাওয়া ভালো। এ ব্যাপারে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ঘুম থেকে উঠে অজু করার পূর্বেই এক গ্লাস একটু গরম পানি পান করলে খুবই ভালো।
এশার ও তারাবি পড়ে বাড়িতে ফিরেই রাতের খাবার সেরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘুমাতে যেতে হবে। মোবাইল ও টিভি দেখে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ঘুমালে শেষ রাতে ওঠা সহজ হয়। মনে রাখতে হবে কাজের ছেলেমেয়ে বা বাড়ির কর্ত্রীকেও ভালো খাবার তৈরির জন্য বেশি সময় নেয়া যাবে না। সকলে মিলেই রমাদানের সময় কাজে লাগাতে হবে।
রমাদানের সময়েই যেহেতু ফিতরা দিতে হয়। ঈদের দিনেও যদি কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করে, তারও ফিতরা দিতে হবে। রমাদানে গোটা মাসে অনেক ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে, তাই এ ফিতরা দিলে তা সংশোধন হয়ে যায়। ফিতরার পরিমাণ এক সা পরিমাণ প্রতিজনের। আমাদের দেশের ৩ কেজি চালের দামের সমপরিমাণ দিলে আর কোনো সন্দেহ থাকে না। ফিতরা চাল, ডাল, খেজুর, কিশমিশ দিয়ে দেয়া যায়। আবার টাকা দিয়ে দিলেও ফিতরা আদায় হয়ে যাবে।
রমাদানের শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করা বড় কাজ। ঘর সংসার রেখে শুধুমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য ২০ তারিখ আসর পড়ে মাগরিবের পূর্বেই স্থানীয় মসজিদে প্রয়োজনীয় বিছানাপত্র নিয়ে হাজির হতে হবে। এখন প্রায় মসজিদেই ইতেকাফের জন্য মসজিদের তরফ থেকে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ১০ দিনের বাজার খরচের জন্য কিছু টাকা দিতে হয়। ফলে বাসা থেকে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার হয় না। উল্লেখ্য যে, রমাদান সামনে রেখে সালামের প্রচার করতে হবে। ছোট-বড়, ধনি-গবির সবাইকেই সালাম দিতে হবে। আগে সালাম দিলে সাওয়াবের ৯০ ভাগ সালামদানকারীর ভাগে লেখা হবে।
আমরা যাকাতও এ রমাদানে দিতে পারি। যেহেতু সাওয়াব বেশি, তাই এ সময়ে হিসাব করে যাকাত দিতে হবে। যাকাত দিতে হবে যার কাছে নগদ একশত টাকা বছরের খরচ বাদে থাকবে, তার শতকরা আড়াই টাকা যাকাত দিতে হবে। যাকাত ৮ খাতে দেয়া যেতে পারে। গরিব-মিসকিনদেরই হক বেশি। আবার আত্মীয়-স্বজনরা যদি এ ক্যাটাগরিতে পরে তবে তাদের আগে দিতে হবে। যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি বলে কিছু নেই। যাকাত গোপনে হকদারদের কাছে পৌঁছানো ভালো। লোকদেখানোর জন্য বাড়িতে সারিবদ্ধভাবে লোক দাঁড় করে যাকাত বিলি করা মাননসই নয়। যাকাত এমনভাবে দিলে ভালো হয়, যাতে যাকাতগ্রহীতা আগামী বছর যাকাত দিতে পারে। অর্থাৎ কাউকে গরু-ছাগল, মুরগি বা ছোট-খাটো দোকান করে দিলে ভালো হয়।
২৯/৩০ দিন রোজা রাখার পর আসে ঈদুল ফিতরের ঈদের নামায। আমরা ঈদুল ফিতরের নামায খোলা মাঠে পড়ার চেষ্টা করব। ঝড়-বৃষ্টি হলে মসজিদেও ঈদের নামায আদায় করা যাবে। ঈদের নামাযে স্ত্রী, মেয়ে, বউ-বাচ্চাদের নিয়ে জামাতে যেতে হবে। মেয়েদের নামাযের জায়গা পৃথক করে দিতে হবে। তারাবিতেও মেয়েদের নামাযের ব্যবস্থা রাখতে হবে। খুতবা শোনা সবার জন্য ওয়াজিব। ইমামের সাথে দ্ইু রাকাত ৬ তাকবিরের সাথে পড়তে হবে। অবশ্য ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.), ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) এবং মালিকী, শাফিঈ, হাম্বলী মাযহাব ও ্আহলে হাদীসের অনুসারীরা ১২ তাকবীরে ঈদের সালাত আদায় করে থাকেন। (রাদ্দুল মুহতার, পৃ. ৬৬৪)। ঈদের দিন সকাল থেকেই নামাযের প্রস্তুতি, নামায সেরে কুশল বিনিময় করে এসে আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় যেতে হবে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেয়ার জন্য। ঈদের মাঠে যাওয়ার পূর্বেই কিছু হলেও মিষ্টিমুখ করে যেতে হবে। খেজুর খেলেও চলবে।ঈদের সময় নতুন জামাকাপড় কেনার জন্য বাড়তি খরচ না করে গরিবদের জামাকাপড় কিনে দেয়া যেতে পারে। নতুন হোক বা পুরনো হোক, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে ঈদের জামাতে শরিক হতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে রমাদানের পুরো হক আদায় করে রোজা পালনের তাওফিক দান করুন।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।