আমার জান্নাতি বাবার শেষ দিনগুলো
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:০২
॥ হাসান জামিল ॥
১৩ জুলাই ২০১০ তারিখের কথা। অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে সকালের নাশতা করছি। আব্বু হঠাৎ করে আমার কাছে এসে বললেন, আমাকে অফিসের কাছে উনি নামিয়ে দিয়ে কোর্টে চলে যাবেন। আমি যেন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে থাকি। আমি নাশতা শেষ করে দরজার কাছে গিয়ে লিফটের বোতাম টিপলাম। আমার মনে হলো আব্বু সারা বাসা ঘুরে বাইরে এসে আবার একবার বাসার দিকে তাকালেন। এরপর তিনি লিফটে উঠে পড়লেন। এরপর গাড়িতে আমাকে সাধারণ কিছু কথা বলে কামারুজ্জামান চাচার সাথে কথা বললেন। আমি অফিসের সামনে নেমে পড়লাম তেমন কোনো কিছু খেয়াল না করেই। আব্বু আমার অবস্থা দেখে সাবধানে রাস্তা পার হতে বলে চলে গেলেন। কে জানতো সেটাই হবে মুক্ত বাতাসে উনার সাথে আমার শেষ দেখা! কিছুক্ষণ পরে অফিসে বসে শুনি আব্বু ও কামারুজ্জামান চাচা গ্রেফতার হয়েছেন। এরপর আমাদের জীবনের আরেক দিক দেখা শুরু হলো। কোর্ট, ঢাকার জেল, কেরানীগঞ্জের কারাগার, থানা-পুলিশ, আইনজীবী ইত্যাদির সাথে আমাদের জীবন এক হয়ে গেঁথে গেল। জেলে কীভাবে আব্বুকে একটু শান্তি দেয়া যাবে, এই চিন্তাতেই চলছিল আমাদের প্রতিদিনের জীবন।
১০ ডিসেম্বর ২০১৩। এডভোকেট তাজুল ও ব্যারিস্টার মোমেনের চেম্বারে বসে আছি আমি, মাসুদ সাঈদী ভাই, সিনিয়র এডভোকেট মিজানুল ইসলাম ভাই, তাহকীক ভাই ও অন্যরা। সকাল ১০টার দিকে আব্বুর সাথে ব্যারিস্টার রাজ্জাক ও এডভোকেট তাজুল দেখা করে এসেছেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে। আইনজীবীদের সাথে কথা বললে আব্বুর মন সব সময়ই ভালো থাকে। তাই আমার মনও ভালো। আইনজীবীদের সাথে কথা বললে আব্বু মনে হয় খোলা জানালা দিয়ে বাইরের পৃথিবী দেখেন। মামলার ব্যাপারেও পূর্ণ ধারণা পান। যাই হোক, বেশ একটু ভালো মনেই নানা কাজ করেছি। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত। মাসুদ ভাইয়ের কাছে ফোন এলো এক ডেপুটি জেলারের থেকে। তিনি নাকি মগবাজার রেললাইনের কাছেই অপেক্ষা করছেন। আমাদের বাসা খুঁজে পাচ্ছেন না। মাসুদ ভাই আমাকে মোবাইল দিলেন তার সাথে কথা বলার জন্য। আমি ঐ ডেপুটি জেলারকে বাসার লোকেশন বলে দিলাম। ফোন কেটে দিয়ে আমি মাসুদ ভাইয়ের দিকে চেয়ে দেখলাম সবাই একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছেন। অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠলো। মনে পড়লো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে জেল কর্তৃপক্ষ লিখিত চিঠি দিয়ে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের শেষ দেখা করার জন্য খবর দেয়। ডেপুটি জেলার কি সেই চিঠিই নিয়ে এলো নাকি?
বাসায় ফোন দিয়ে বললাম, সিকিউরিটিকে জানিয়ে দিতে যে জেলগেট থেকে লোক আসবে। এলেই যেন আমাদের ফ্ল্যাট ৮-এ তে পাঠিয়ে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ পরে বাসা থেকে আম্মু ফোন দিলেন। বললেন, একটা চিঠি এসেছে জেলগেট থেকে। তাতে লেখা, “রাত ৮টার মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কাদের মোল্লার সাথে দেখা করতে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনকে অনুরোধ করা হলো।”
মাসুদ ভাই ও আমার আশঙ্কা সত্যে পরিণত হলো। আম্মুকে বললাম, চিঠির অনুলিপিতে স্বাক্ষর করে ডেপুটি জেলারকে ফেরত দিতে। আম্মু তাই করলেন। আমি সাথে সাথে বাসায় থাকা মামাতো ভাইকে তাড়াতাড়ি চিঠি আইনজীবীদের অফিসে নিয়ে আসার জন্য বললাম। ইতোমধ্যে এডভোকেট তাজুল এলেন। আমাকে বললেন, চিঠি কই? বললাম ভাই, আসছে রাস্তায়। এই ফাঁকে আমরা মাগরিবের নামায পড়ে নিই। উনি বললেন, ঠিক আছে। নামায শেষ করে চা খাচ্ছি সবাই। এমন সময় মামাতো ভাই চলে এলো। চিঠির কয়েকটা ফটোকপি করা হলো। সবার হাতে হাতে চিঠি। মাসুদ ভাই বললেন, ঘটনা খারাপ। তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় যাও। সবাইকে নিয়ে দেখা কর।
আমি মামাতো ভাইকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে বাসায় চলে এলাম। সবাইকে বললাম, চলো তাড়াতাড়ি। সবাই তৈরি হয়ে গেল। দুই গাড়ি ও দুটি মোটরসাইকেলে করে সবাই রওনা হলাম। আমার এক বোন থাকে যাত্রাবাড়ীতে। ওকেও বলা হয়েছে। ভাই মওদুদ থাকে মালয়েশিয়ায়, তাই ওকে নেয়া গেল না। ফোনে বলা হলো, আমরা দেখা করতে যাচ্ছি। ছোট চাচাকেও আনা গেল না ফরিদপুর থেকে। অবরোধ চলছে, তাই রাস্তাঘাট ফাঁকা। ২০ মিনিটের মধ্যে জেলের গেটে পৌঁছে গেলাম। এর মধ্যে ফোন পেলাম মাসুদ ভাইয়ের। উনি জানালেন যে, রাত ৮টার আগেই যেন আমরা চিঠির কপি ও নামের তালিকা জমা দিই। এর মধ্যে এক ডেপুটি জেলার আমাদের কাছে এসে জানালেন যে, আমরা যেন নামের তালিকা তৈরি করে তাড়াতাড়ি জমা দিই। আমি জানলাম, আমরা রাত ৮টার আগে ঢুকবো। চারদিকে কয়েকশ’ সাংবাদিক। ক্যামেরার লাইটে চোখ অন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। সাংবাদিক ভাই-বোনদের নানা প্রশ্ন। বললাম, ভাই বের হয়ে উত্তর দেব। ৭-৪৫ মিনিটে ঐ ডেপুটি জেলার আবার এলে আমি চিঠি ও নামের তালিকা দিলাম। মোট ২৩ জন। আমি মনে মনে একটু শঙ্কিত যে, এত লোকজন দেখা করতে দেবে তো?
যাই হোক, জেল-কর্তৃপক্ষের লোকেরা আমাদের সবাইকে একে একে তল্লাশি করে জেলের দুটি গেট পার করে অভ্যন্তরে ঢুকতে দিলেন। দুই পাশে পুরুষ ও মহিলা গার্ড, মাঝে আমরা ২৩ জন। চারদিক চুপচাপ, সুনসান নীরবতা। সামান্য একটু হাঁটার পরে বামে একটা গেট। একটা বিশাল স্টোর রুমের মতো ঘরের পাশ দিয়ে অল্প হাঁটলেই রজনীগন্ধা সেল। ৮নং সেলে আব্বু অবস্থান করছেন। আমরা যখন পৌঁছালাম, তখন আব্বু খাচ্ছেন। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আরে তোমরা এসে পড়ছো। আমি তো অল্প কিছুক্ষণ আগে জানলাম যে তোমরা এসেছ। তারপর আব্বু আবার জেলের লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেন যে, তোমরা আমাকে কখন কী করবে। উত্তরে ওরা বললো, স্যার আমরা কিছু জানি না। আব্বু বললেন যে, রায়ের কপি তো আমি এখনো পাইনি। আব্বুর সেলটা ১২ ফিট বাই ১০ ফিটের মতো হবে। মাটিতে একটা কম্বল বিছানো, কম্বলের ওপর একটা সাদা চাদর, মাথার কাছে আরো একটা কম্বল বালিশ হিসেবে ব্যবহার করছেন তিনি। মাথার কাছে কুরআন শরীফ, হাদীস ও আরো কিছু বই রাখা। একটা মোড়ার ওপর এক ব্যান্ডের একটা রেডিও দেখতে পেলাম।
আব্বু লোহার মোটা গ্রিল ধরে বলতে শুরু করলেন, “তোমরা সবাই জানো কেন ওরা আমাকে ফাঁসি দিতে চায়। শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার জন্য আজকে আমার এ অবস্থা। তবে আমি ফাঁসির ভয় পাই না। যদি আমাকে আল্লাহ কবুল করেন, তবে তা হবে শহীদের মৃত্যু। আল্লাহ সবাইকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন না। আমার জীবনের বিনিময়ে যদি ইসলামী আন্দোলন বিজয়ী হয়, তাহলে আমার চেয়ে খুশি কেউ হবে না। আর আমার ফাঁসির দ্বারা এ জালিম সরকারের পতন আরো দ্রুত হবে, ইনশাআল্লাহ। আমার প্রতি ফোঁটা রক্তের বিনিময়ে এ দেশে ইসলামী আন্দোলন আরো বেগবান হবে। আমি কোনো অন্যায় করিনি। আর আল্লাহ তায়ালা যা ঠিক করে দেন, ঠিক তাই হয়। আল্লাহ যা ভালো ও মঙ্গলজনক মনে করেন, তাই করেন। সুতরাং আমি যদি সাইয়েদ কুতুব হাসানুল বান্নাদের কাতারে জায়গা পাই, তবে তা হবে আমার জন্য গর্বের। তোমরা কোনো চিন্তা করবা না।”
তারপর আব্বু আমাদের চাচাতো ভাই, মামাতো ভাই, ফুপাতো ভাইদের উদ্দেশে বললেন, “আমি তোমাদের সবার অভিভাবক ছিলাম। চেষ্টা করছি সবসময় ভালো কিছু করার। কিন্তু এখন যদি আল্লাহ আমাকে কবুল করেন, তবে আল্লাহই তোমাদের অভিভাবক হবেন। আল্লাহই সবচেয়ে উত্তম অভিভাবক। সুতরাং তোমাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।”
তারপর আব্বু জেলের লোকদের বললেন, আমি বাচ্চাদের একটু ঘাড়ে, কোলে নিতে চাই। এ প্রসঙ্গে উনি একটা গল্পও ওদের ও আমাদের শোনালেন, ইমাম হাসানের গল্প। গল্প শুনেই হোক আর কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়েই হোক, ওরা আব্বুকে মোটা লোহার গেট খুলে কক্ষের সামনে খালি জায়গায় বের করে আনলো।
আব্বু প্রথমে মেয়েদের আদর করলেন। আমার বোনরা তো আব্বুকে ছাড়তেই চায় না। আব্বু বললেন, “তোমরা সবসময় সত্যের ওপরে থাকবে। শরিয়তের ব্যাপারে কঠোর থাকবে।” আব্বু বাচ্চাদের কাঁধে-ঘাড়ের ওপরে নিলেন। পারভীনের ছেলে আফনান আব্বুর খুব প্রিয় ছিল সবসময়। আব্বু ওকে কোলে নেয়ার সময় একটু আবেগাপ্লুত হলেন। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন। বললেন, বাচ্চাদের সৎ ও ঈমানদার মানুষ হিসেবে তৈরি করার দায়িত্ব আমাদের।
একে একে আমরা ভাই-বোন সবাই আব্বুর সাথে কোলাকুলি করলাম। তারপর আব্বু আম্মুকে বললেন, পেয়ারী আমি তো তোমার হক আদায় করতে পারিনি, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। এ দেশের মানুষের জন্য আন্দোলন করার কারণে সময় দিতে পারিনি। ছেলেমেয়ে ও তোমার অনেক ইচ্ছে পূরণ করতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করো।
আম্মু বললেন, তুমি যে কি বলো। আমিই মাঝে মাঝে তোমাকে এটা-সেটা চেয়ে বিরক্ত করেছি। তারপর আব্বু বললেন, আমাকে যে কারণে ওরা ফাঁসি দিতে চায়, তা তো তোমরা বুঝ। সুতরাং সেভাবে তোমরা নিজেকে গড়ে তুলবে। তোমরা সবাই ধৈর্যধারণ করবে। এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া সম্ভব। আম্মুকে বললেন, “অবিবাহিত ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে পারিবারিক দায়িত্ব পালন করবে। আমি তো পারলাম না। সময় পেলাম না। ইনশাল্লাহ জান্নাতের সিঁড়িতে তোমাদের সাথে আমার দেখা হবে। ফরিদপুরে আমাকে কবর দেবে আমার আব্বা-আম্মার পায়ের তলে। দাফনে ওমরাহ এর কাপড় দেবে। কবরের ওপর কোনো স্তম্ভ নির্মাণ করবে না। ঘটা করে কোনো অনুষ্ঠান করবে না। এতিম মাদরাসাতে দান করবে। গরিব-দুস্থদের খাওয়াবে। সবাইকে সালাম দেবে ও দোয়া করতে বলবে। এখন তোমরা চলে যাও আমি তোমাদের যাওয়া দেখি।”
আব্বু মোটা লোহার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন আর আমরা সবাই একে একে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে আবার সেই লাইন ধরে হাঁটা মূল গেটের দিকে। মূল গেট থেকে বের হয়ে দেখলাম ক্যামেরার লাইটে চারদিক দিনের মতোই উজ্জ্বল। সবাইকে গাড়িতে বসালাম। বড় মামা বললেন, মিডিয়ার সাথে কথা না বলার জন্য। কিন্তু আমি ভাবলাম এ সুযোগে কিছু কথা না বললে হবে না। কারণ সবাই লাইভ টেলিকাস্ট করছে। গাড়ির জানালা খুলে বললাম, আব্বু বলেছেন যে, শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার কারণেই আজকে উনাকে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। অন্য রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকলে আজকে উনার এ অবস্থা হতো না। উনি গাড়ি-বাড়ি করে ভালো থাকতে পারতেন। আজকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে এ অবস্থা। উনি আইনজীবীদের সাথে কথা বলতে চান, উনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।
তারপর আমরা গাড়ি ছুটালাম বাসার উদ্দেশে। আমি মাঝে নেমে মোটরসাইকেলে করে আইনজীবীদের অফিসে গেলাম। আব্বুর সাথে কী কথা হয়েছে, তা জানালাম। এর মধ্যে শুনলাম যে, সরকারের কতিপয় মন্ত্রী নাকি বলেছেন, রাত ১২-০১ মিনিটে ফাঁসি হবে। কোনো শক্তি নাকি তা ঠেকাতে পারবে না। আরও জানতে পারলাম যে, আমাদের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রাজ্জাক ও এডভোকেট খন্দকার মাহবুব, এডভোকেট তাজুল ইসলামরা নাকি চেম্বার বিচারপতির কাছে গেছেন আদেশটি স্টে করার জন্য। অপেক্ষা করছেন চেম্বার বিচারপতির আদেশের জন্য। এশার নামাজ পড়া হয়নি। অজু করার জন্য বাথরুমে ঢুকলাম। এমন সময় ফোন এলো যে, চেম্বার বিচারপতি আগামীকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত স্টে দিয়েছেন। মানে মৃত্যু পরোয়ানা আগামীকাল ১০টা পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। আল্লাহু আকবর বলে চিৎকার করলাম। সাথে সাথে বাসায় ফোন দিলাম বড় মামার মোবাইলে। বড় মামা শুনে কতবার আল্লাহু আকবর বললেন, তা গুনতে পারিনি। সবার সাথে কোলাকুলি করে বাসায় রাত ১১টায় ঢুকলাম। বাসায় ঢুকে দেখি সবাই খুশিতে বাক্যহারা। অবাক করা ব্যাপার এই যে, এই ভালো সুসংবাদ শোনার পাঁচ মিনিট আগে এক মহিলা সাংবাদিককে আমি বলছিলাম যে, আব্বু শহীদি মৃত্যু প্রত্যাশী। আব্বু তার কবর ফরিদপুরে চান। সাংবাদিক বললেন, আপনারা কখন যাবেন ফরিদপুর। আমি বললাম, আপা, আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহর রহমত প্রত্যাশী। এখনো ঠিক করিনি কখন যাবো ফরিদপুর। তবে এটা জানবেন যে, মৃত্যুর ফয়সালা আকাশে হয়, মাটিতে নয়। উত্তর শুনে উনি বললেন, ঠিক আছে ভাই। পরে কথা বলব।
আল্লাহর অশেষ রহমত। আল্লাহ সামান্য রহমতের পরশ দিয়ে তাঁর প্রিয় বান্দাকে রক্ষা করলেন। সবাইকে বললাম, বেশি বেশি কুরআন পড়ার জন্য, রোজা রাখার জন্য, তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে বেশি বেশি দোয়া করার জন্য। সারা দিন এমন দৌড়াদৌড়ি করেছি যে, মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে ঘুমাবো। এর মধ্যে মওদুদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করলাম। ও ভোরে মালয়েশিয়া থেকে আসবে। আমার বাচ্চা মেয়ে নুহা মনি আমাকে ছাড়া ওর আম্মুকে অনেক বিরক্ত করে। সামান্য কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য শুয়ে পড়লাম। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। কিন্তু ঘুমের দেখা নেই। আব্বুসহ ইসলামী আন্দোলনের অন্য ভাইদের কথা ভাবছি। আব্বু কি রকম ঠাণ্ডা জায়গায় থাকেন! ঢাকা শহরের থেকে পুরো জায়গাটা আলাদা মনে হয়। আব্বুর গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটা চোখে ভাসছিল। একদম হঠাৎ করেই ঘুমিয়ে গেলাম।
১১ ডিসেম্বর। সকালে ফজরের নামাজের অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলো। নামাজ পড়ে মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলাম, আল্লাহ তোমার কাছে আমি জীবনে কিছু চাইনি। চাওয়ার যোগ্য আমি নই। আমি আমার পিতার জীবন ভিক্ষা তোমার কাছে চাই না। ইসলামী আন্দোলনের নেতা হিসেবে যদি আব্বুর ভবিষ্যতে ভূমিকা রাখার জন্য তুমি তাকে সম্মানের সাথে মুক্ত করো, তবে সারা জীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। আর যদি তুমি তাকে কবুল করো, তবেও আমার কিছু বলার নাই। আমার আব্বু জানামতে কোনো অন্যায় করেছেন, এমন কোনো কিছু দেখি নাই, শুনি নাই। কেউ কোথাও বলছে, তাও জানি না। তারপরও যদি কোনো অন্যায় করে থাকেন, তবে তুমি তাকে মাফ করো। তুমি তাকে কবরের আজাব থেকে মুক্তি দাও। ইসলামী আন্দোলনের শহীদের জন্য তুমি তোমার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখাও। আল্লাহ তুমি তাকে মাফ করো, মাফ করো।
নামায শেষে আবার ঘুমিয়ে ৯টার সময় উঠলাম। এরপর বের হলাম আইনজীবীদের অফিসের উদ্দেশে। এর মধ্যে অসংখ্য ফোন এসেছে। গতকাল যারা আল্লাহর এ কুদরত দেখেছেন, শুনেছেন, সবাই জানতে চান কীভাবে কী হলো। আমি সবাইকে বললাম, ভাই, সবাই দোয়া করেন। আল্লাহ যেন আব্বুকে সসম্মানে মুক্তির ব্যবস্থা করেন। আর যদি শহীদ হিসেবে কবুল করেন, তবে তার ব্যবস্থাও আল্লাহ যেন করেন অশেষ সম্মানের সাথে।
আইনজীবীদের অফিসে পৌঁছে জানলাম হেয়ারিং শুরু হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপক্ষের হেয়ারিং চলছে, পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে হেয়ারিং চলছে। যে বেঞ্চ আব্বুর ফাঁসির রায় দিয়েছে, সেই বেঞ্চই এই হেয়ারিং করছে। ১১টার দিকে শুনলাম আধাঘণ্টার জন্য হেয়ারিং মুলতবি করা হয়েছে। মনে মনে দোয়া করতে থাকলাম। আরও ভাবতে থাকলাম আব্বুর মনের অবস্থা। আব্বুর সেলে একটা পুরনো রেডিও দেখেছি। আল্লাহই জানেন ওটা চলে কিনা। চললে আব্বু নিশ্চয়ই মিনিটে মিনিটে আপডেট পাচ্ছেন। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন। বিভিন্ন সাংবাদিকদের প্রশ্ন-উত্তর, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি করতে করতে ১২-৩০ থেকে ১টার মাঝামাঝি হঠাৎ ফোন এলো মাসুদ ভাইয়ের মোবাইলে। জানলাম, হেয়ারিং আগামীকাল আবার চলবে। এ সংবাদ শুনে আল্লাহ পাকের দরবারে আবার শুকরিয়া আদায় করলাম। বাসায় ফোন করে জানালাম। সবাইকে শুকরিয়া নামায আদায় করার জন্য বললাম। দুপুরের খাওয়া ও নামায শেষ করে বাসায় ফিরে সবাইকে বিস্তারিত জানালাম। রাত ১১টা পর্যন্ত নানা কাজে ব্যস্ত থেকে খাওয়া-দাওয়া, নামায শেষ করে আবারও আব্বুর মামলা সম্পর্কিত নানা কাজে মগ্ন হলাম। অনেক রাতে কাজ শেষ করে শুয়ে পড়লাম।
১২ ডিসেম্বর। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, দেখি ৯টা বাজে। ফজরের নামায পড়া হয়নি। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে অজু করে কাজা নামায আদায় করে, নাশতা খেয়ে আইনজীবীদের অফিসের উদ্দেশে বের হলাম। অফিসে পৌঁছে শুনলাম হেয়ারিং চলছে। তবে বিচারপতিদের অঃঃরঃঁঃব নাকি ভালো নয়। কিছুক্ষণ পরে জানানো হলো, হেয়ারিং মুলতবি করা হয়েছে আধাঘণ্টার জন্য।
আবার শুনানি শুরু হলো। কিছুক্ষণ পরে জানলাম, প্রধান বিচারপতি হঠাৎ নাকি হেয়ারিং বন্ধ করে দিয়েছেন। বন্ধ করে দিয়ে বলেছেন, ১০ মি. পরে অর্ডার দেয়া হবে। মহান আল্লাহর কাছে অনবরত দোয়া করতে থাকলাম। বাসার সবাইকে বললাম, বিশেষভাবে দোয়া চালিয়ে যেতে। মোবাইলে নানা ফোন আসছে। সবাই একযোগে জানতে চাচ্ছে কোনো খবর আছে কিনা। যাই হোক, অবশেষে প্রায় ২০ মিনিট পরে জানা গেল যে, জরাবি গধরহঃধৎনষব না বলে অর্ডার দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি।
শুনে সবাই বললেন যে, আজকেই হয়তো রায় কার্যকর করবে সরকার। ল’ ইয়ারদের সাথে কথা বলে সাক্ষাতের জন্য একটা দরখাস্ত জেলগেটে পাঠালাম। দরখাস্ত জমা দিয়ে জানতে পারলাম, দরখাস্ত গ্রহণ করা হয়েছে ও জেল-কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে যত দ্রুত সম্ভব জেলগেটে উপস্থিত হওয়ার জন্য বলেছে। শুনে আম্মুকে ও অন্যদের বললাম দ্রুত রেডি হওয়ার জন্য। মাগরিবের নামায পড়ে আমরা বের হলাম।
জেলগেটে যথারীতি অনেক পুলিশ। সাংবাদিক, অনেক আলো। একজন ডেপুটি জেলার এলেন। সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। লাইন ধরে প্রথম গেট পার হলাম। চেক করা হলো সবাইকে। গতবার চশমা খুলে রাখা হয়নি। আজকে চমশা খুলে রাখা হলো। জেলের লোকজন বাদে আজকে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সাদা পোশাকধারী লোকজনও অনেক উপস্থিত। ফরমালিটি কমপ্লিট করে আবার দুই পাশে জেলের গার্ডদের নিয়ে আব্বুর সেল রজনীগন্ধাতে গিয়ে দেখি আব্বু বসে বসে চা খাচ্ছেন।
আমাদের দেখে বললেন, তোমরা এসে গেছো। আম্মু বললেন, মওদুদ এসেছে তোমাকে দেখতে। আব্বু বললেন মওদুদ, কই তুমি সামনে আসো। মওদুদের পড়াশোনার খবর নিলেন। শরীর-স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানলেন। তারপর বললেন, “তোমরা এতক্ষণে নিশ্চয় জানো যে, আমার জরাবি গধরহঃধৎনষব না বলে বিচারপতিরা রায় দিয়েছেন। তোমরা সবাই জানো আওয়ামীবিরোধী ও ইসলামী আন্দোলন করার কারণে আমার ব্যাপারে ওরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিচারপতিরা সরকারের নির্দেশে এ রায় দিয়েছে। যে রায়ই দিক, আমি পরোয়া করি না। আমি জানি, আমি কোনো দোষ করি নাই। সৎ পথে থাকার জন্য যদি আল্লাহ আমাকে কবুল করেন, তবে তা হবে সার্থক মৃত্যু। এই মৃত্যু আমি গ্রহণ করবো সন্তুষ্টচিত্তে। তোমরা কোনো প্রকার দুশ্চিন্তা করবে না। তোমাদের সাথে আমার জান্নাতের সিঁড়িতে দেখা হবে, ইনশাআল্লাহ।”
তিনি আরও বললেন যে, “তোমরা কখনো হারাম পথে রোজগার করবা না। হালাল পথে আয় করলে আল্লাহ কখনো না খেয়ে মারবেন না। আর হারাম পথে রোজগারের গাড়ি-বাড়ি দেখে কখনো আফসোস করবে না। এটা আল্লাহর খুবই অপছন্দ।”
আব্বু বলতে থাকলেন, “তোমরা ব্যক্তিগতভাবে (যদি আল্লাহ আমাকে কবুল করেন ও তারা ফাঁসি দেয় তবে) আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করবা না। আল্লাহর দীন এদেশে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠা হওয়ার মাধ্যমে আমার ফাঁসি ও আমার প্রতি যে অন্যায় হয়েছে তার প্রতিশোধ হবে। আল্লাহ পথের কর্মীরা ইসলামী আন্দোলনকে বিজয়ী করার মাধ্যমে আমার প্রতি ফোঁটা রক্তের প্রতিশোধ নেবে। এটা সবাইকে বলে দেবে।”
আব্বু আরও বললেন, “আমার মৃত্যুর পরে ঘটা করে কোনো অনুষ্ঠান, দোয়া মাহফিল করবে না। আব্বু আমাদের বলেন, বিয়ের সময় নিজেকে নিলামে তুলবা না। সত্যকে এমনভাবে ঘুরিয়ে বলবা নাÑ যেন মানুষ অন্য অর্থ করতে পারে। সবসময় সত্যের ওপর থাকবা। বাচ্চাদের ইসলামী আদর্শে মানুষ করার চেষ্টা করবা। ওরা সৎ ও ঈমানদার মানুষ হলে আমার প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে তার বদলা হবে।”
তারপর আব্বু হঠাৎ তাড়াহুড়া করতে লাগলেন। বলতে থাকলেন, “তোমরা এখন চলে যাও। কারণ আমার হৃদয় এখন শুধুমাত্র আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ভালোবাসায় পূর্ণ থাকতে হবে। কিন্তু তোমরা থাকলে তোমাদের প্রতি ভালোবাসায় আমার মন ভরে থাকবে। তাই তোমরা চলে যাও। আল্লাহ তোমাদের সহায় থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।”
এ কথাগুলো বলে আব্বু সেলে ঢুকে যাচ্ছিলেন। শেষ স্পর্শ নেয়ার জন্য আমি, মওদুদ, পারভীন, লারজীন ও অন্যরা আব্বুর হাত ধরলাম। আমি শেষবারের মতো আব্বুর সেলের দিকে তাকালাম। গার্ডরা আমাদের আস্তে আস্তে সরিয়ে দিল। আব্বু সেলের ভেতরে ঢুকে গেলেন।
আমরা বের হয়ে লাইন ধরে আবার হাঁটতে থাকলাম মূল গেটের উদ্দেশে। মনে হচ্ছিল সারা জীবন যদি হাঁটতে পারতাম। যদি রাস্তা শেষ না হতো। কিন্তু লোহার গেটের বিকট শব্দ বাস্তবে ফিরিয়ে আনল আমাকে।
চশমা, ঘড়ি, মানিব্যাগসহ যে যার জিনিস ফেরত নিয়ে বাইরে বের হলাম। বাইরে শত শত লোক দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে ওঠার পর গাড়ি একটু এগোলো। কিন্তু সাংবাদিকরা নাছোড়বান্দা। জানালা খুলে শরীরের অর্ধেক বের করে বললাম, আব্বু বলেছেন, সাত দিন সময় তিনি পাবেন। এরপর তিনি তার সিদ্ধান্ত জানাবেন। তিনি ল’ ইয়ারের সাথে দেখা করতে চান। এ কথাগুলো বলতে আমার গলা ব্যথা হয়ে গেল। কারণ অনেক জোরে চিৎকার করে বলতে হচ্ছিল। চারদিকে বিকট আওয়াজ ও চিৎকার। এর মধ্যে জেল ও পুলিশের লোক এসে আমাকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে বললেন। আমি আবার গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লাম। শত শত সাংবাদিকের ভিড় ঠেলে আমাদের গাড়ি এগোতে লাগলো, অবশেষে আমরা খালি রাস্তা পেয়ে গেলাম। চারদিকে লোকশূন্য, দোকানপাট সব বন্ধ। মনে হয় কারফিউ চলছে। রাস্তার মাঝে আমি নেমে আইনজীবীদের অফিসে গেলাম। সেখানে আকন্দ ভাইসহ অন্যরা অপেক্ষা করছিলেন। আমি সবকিছু খুলে বললাম। সবাই আমার কথা শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন। আবেগ সামলে নিয়ে সবাই আমাকে দ্রুত বাসার উদ্দেশে চলে যেতে বললেন।
আমি বাসায় এসে দেখি অনেক লোকজন। বিশেষ করে বহু মহিলা এসেছেন আমাদের বাসায়। আত্মীয়-স্বজনরাও এসেছেন সবাই। বাসায় আসার পর বড় মামা, ভাই-বোন, আম্মু আমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনসহ আমরা বসলাম। আলোচনা হলো এ ব্যাপারে যে, ফাঁসি তো হয়ে যাচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছায়। এখন আমরা কে কে গ্রামের বাড়িতে যাবো। আমি মেয়েদের যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধ করলাম। কিন্তু আমার বোনদের এককথা। বিপদ-আপদ যাই হোক না কেন, তারা গ্রামের বাড়িতে যাবে। ছোট বাচ্চাদের নিয়েই যাবে, যা হয় হবে। শেষে সিদ্ধান্ত হলো যে, আমরা সবাই যাব। আম্মু বোনরাসহ অন্য মেয়েরা বিভিন্ন গাড়িতে যাবে। এই সিদ্ধান্ত হওয়ার পরে সবাইকে তৈরি হওয়ার জন্য বলা হলো। মেয়েরা, ছেলেরা সবাই তৈরি হতে লাগলো। তখন সাড়ে ৯টা বাজে। আমাদের সবার চোখ টিভি পর্দার দিকে। আমি ফোন রিসিভ করতে করতে ক্লান্ত।
রাত ১০টা। টিভিতে ব্রেকিং নিউজ আসতে থাকলো যে, কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। পাঁচ-দশ মিনিট পর আমি আমাদের নানা সূত্র থেকে নিশ্চিত হলাম যে, ফাঁসি সত্যি সত্যিই কার্যকর করা হয়েছে। যাই হোক, আমি সবাইকে বললাম যে, ছেলেরা আগে নেমে নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন গাড়িতে বসে যাক। তারপর মেয়েরা গাড়িতে উঠবে। আমাদের ছেলেরা প্রায় সবাই নিচে নেমে গেল। ২-৩ মিনিট পরে হঠাৎ শুনি নিচে অনেক চিৎকার-চেঁচামেচি। জানলাম, স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা মিছিল করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাসার নিচে আমাদের ছেলেদের আক্রমণ করেছে। কিন্তু খালি হাতেই আমাদের ছেলেরা তাদের প্রতিরোধ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। কিন্তু হঠাৎ করে পুলিশ এসে অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগের কর্মীদের আটক না করে বরং আমার ভাই, মামাতো ভাইসহ অন্য ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের বাসার নিচের তলায় পার্কিং লটে মারাত্মকভাবে লাঠিচার্জ করা শুরু করল। শুধু তাই নয়, পুলিশের পিকআপে করে তাদের আটক করে নিয়ে যাওয়া হলো রমনা থানায়। থানায় নিয়েও তাদের নির্মমভবে পেটানো হয়। মাথা ফেটে রক্ত বের হয় কয়েকজনের। কিছুক্ষণ পরে আমার বড় মামা ও বোন থানায় যোগাযোগ করলে পুলিশ জানায়, তারা নাকি জানতই না এটা শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার বাসা ও আটকরা আবদুল কাদের মোল্লার আত্মীয়-স্বজন! আটকরা নাকি আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছিল। তারা বড় মামাকে আরো বললো যে, আপনি এসে এদের নিয়ে যান। পরে আমার বড় মামা ও বোন গিয়ে আটক আমার ছোট ভাই ও অন্যদের ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। এদের ছাড়িয়ে আনার পর দেখি অনেকের শরীর ফেটে গেছে, কারো মাথা ফেটে গেছে, মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। সে এক ভয়ানক রক্তাক্ত দৃশ্য। যাই হোক, প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পরে সবাই একটু শান্ত হয়ে বসলাম। তখন বাজে রাত ১২-৩০-এর মতো। সবাই বললো যে, ছেলেরা যে রকম আহত হয়েছে আর মেয়েদের যে মানসিক অবস্থা, তাতে ফরিদপুর যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভবপর হবে না। আর আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ না করেই সরকারের লাশবাহী গাড়িও এতক্ষণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটের কাছে পৌঁছে গেছে। আর গ্রামের বাড়ি থেকেও খবর পাচ্ছিলাম যে, চতুর্দিকে পুলিশ কর্ডন করে রেখেছে। গাড়ি তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষও আমাদের গ্রামের বাড়ির ১ কিলোমিটারের আশপাশে যেতে পারছে না। পুলিশ বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সবাইকে বাসার ভেতরে অবস্থান করার জন্য বলছে। সুতরাং সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমরা সদরপুরে যাবো না। আমি ফোন করে চাচাকে জানালাম যে, আমরা আসছি না। তিনি যেন আব্বুর পবিত্র লাশ পুলিশের কাছ থেকে বুঝে নেন ও দাফনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। এর মধ্যে অবশ্য স্থানীয় পুলিশের ওসি ও সদরপুরের টিএনও আমার চাচার সাথে যোগাযোগ করেছে। আমাদের ফরিদপুরের সংগঠনের কিছু নেতৃবৃন্দও ওখানে উপস্থিত হতে পেরেছিলেন। তারা আমার চাচা ও প্রশাসনের সহযোগিতায় আব্বুর জন্য কবর খুঁড়ে রেখেছিলেন। রাত সাড়ে ৩টার দিকে চাচা আব্বুর লাশ রিসিভ করেন। লাশ আমাদের দেয়ার পরপরই প্রশাসন লাশ দাফন করার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু আমাদের সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও আমার চাচা বলেন যে, লাশের মুখ না দেখে ও একটা জানাযা না হলে তারা লাশ দাফন করবেন না। বেশ কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির পরে পুলিশ ও প্রশাসন বাধ্য হয় কাঠের কফিন খুলে আব্বুর মুখ দেখাতে। আমার চাচা ও অন্য আত্মীয়-স্বজনরা এবং সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আব্বুর মুখ দেখে নিশ্চিত হবার পর সাথে সাথেই প্রায় ৩-৪শ’ লোকের একটা জানাযা আমাদের বাড়ির উঠানে অনুষ্ঠিত হয়। বুক বিদীর্ণ করা আল্লাহ আল্লাহ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে চারপাশ। জানাযা শেষ করার পরই আব্বুর আত্মীয়-স্বজন ও সংগঠনের ভাইয়েরা আব্বুর লাশ কবরে নামান ও দাফন সম্পন্ন করেন। তখন প্রায় ফজরের নামাযের সময় হয়ে গেছে। আমার দাদা-দাদির পাশেই সমাহিত হলেন আব্বু। আমি, আম্মু, আমার বোন-ভাইরা ঢাকায় বসে শুনলাম সবকিছু। রাত ১টার দিকে আবার সরকারের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে ফরিদপুর নিয়ে যেতে চাইলে আমরা অস্বীকৃতি জানাই।
এভাবে জুলুম-নির্যাতন আর অমানবিক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে আমার প্রাণপ্রিয় আব্বু মহান আল্লাহর দরবারে পাড়ি জমালেন, যেখানে এ বিশ্বের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অনন্ত সুখ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। তার ফাঁসির পরে আমি জানতে পারি যে, তিনি জমজমের পানি পান করতে করতে ও খেজুর খেতে খেতে ফাঁসির মঞ্চের দিকে হেঁটে যান। তার পরিধেয় কাপড় ও ব্যবহার করা নানা জিনিস তিনি জেলের কয়েদিদের দান করে গিয়েছিলেন। তিনি নিজেই ফাঁসির রশি গলায় পরেন ও ফাঁসির ঠিক আগ মুহূর্তে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে জোরে জোরে চিৎকার করেছিলেন।
এভাবে ইসলামের মর্দে মুজাহিদদের শাহাদাত বরণ করার কথা আমি শুধু ইতিহাসের পাতায় পড়েছি। কিন্তু আমার খালেছ, নির্ভীক, সৎব্যক্তিত্ব আব্বুও যে একদিন এতবড় মর্যাদার অধিকারী হবেনÑ এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করার মতো কোনো ভাষা আমার জানা নেই। আমি বা আমাদের পরিবারের সদস্যদের কারো ওপর কোনো প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা নাই। আমরা দুনিয়ার কোনো আদালতে এর বিচারও চাই না। শুধু দেখতে চাই, আব্বুসহ হাজার হাজার শহীদ যে আদর্শ ধারণ করে জীবন উৎসর্গ করলেন, হাসতে হাসতে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করলেন, সে আদর্শের পতাকাতলে লাখকোটি লোক সমবেত হয়েছে এবং তা বহন করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেদিনের জন্য যেন আমি-আমরা কাজ করতে পারি, আল্লাহ যেন তাওফিক দেন। আমিন।
লেখক : শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার পুত্র।