রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:০০
॥ ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম ॥
আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্বদ্যিালয়ের অধ্যাপক ম্যাকলোয়েন চার্লস মানুষের দুর্দশার চিত্র আঁকতে গিয়ে বলেছেন, “আমার মতে ইতিহাসের কোনো যুগেই কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এত কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়নি, প্রশাসনের সামনে বিচার বিভাগ কখনো এতটা অসহায়ত্ববোধ করেনি, এ বিপদ অনুভব করা এবং তার প্রতিকারের ব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্বে কখনো চিন্তা করার এতটা তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয়নি, যতটা আজ দেখা দিয়েছে।” ১২ ডিসেম্বর ২০১৩, ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। এই দিনটি ইতিহাসে একটি কালোদিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই দিনে বিশ্বের ইতিহাসে একজন নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অপব্যবহার করে হত্যা করা হয়েছে। ইতিহাস হয়তো একদিন প্রমাণ করবে এটি ছিল একটি রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড। দার্শনিক সক্রেটিসকে হ্যামলক বিষ প্রয়োগে হত্যার রায় দিয়েছিল আদালত। জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় আদালতের নির্দেশেই। হাজার বছর পর এসে প্রমাণিত হয়েছে দুটি রায়ই ভুল ছিল। বিচার-ইতিহাসে এ ধরনের রায়ের অসংখ্য নজির রয়েছে- যার ভিত্তিতে কথিত অভিযুক্ত ব্যক্তি হত্যার পর প্রমাণিত হয়েছে, আদালতের দেয়া রায়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ছিল না। জামায়াত নেতা শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার বিষয়েও হয়তো ভবিষ্যতে এমনটি বলা হতে পারে- যে রায়ের ভিত্তিতে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে, তা সঠিক ছিল না। সেটি জানার জন্য খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বিশ্ববাসী জানল আবদুল কাদের মোল্লাকে রাষ্ট্রীয় আয়োজনের মধ্য দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তার রায়ে বলেছেন, আসামি রিভিউ আবেদনের সুযোগ পাবেন। অথচ শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়- আবদুল কাদের মোল্লা কি ন্যায়বিচার পেয়েছেন? রিভিউয়ের পূর্ণাঙ্গ সুযোগ পেলে তিনি হয়তো খালাস পেতেন। এরকম আরো হাজারো প্রশ্ন দেখা দিবে আনাগত সময়ে।
পৃথিবীর সকল নীতি-নৈতিকতা, মানবাধিকার, সব উপেক্ষা করে যাকে হত্যা করা হয়েছে, তিনি একাধারে একজন রাজনীতিবিদ, প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, লেখক, ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও সদালাপী প্রাণপুরুষ। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হদয় নিংড়ানো ভালোবাসা আর চোখের অশ্রুসিক্ত, হয়ে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা এ ভুবন ত্যাগ করেছেন। এই দিন শুধু একজন আবদুল কাদের মোল্লাকেই হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে মানবাধিকার, সত্যপন্থা, কল্যাণ সুন্দর আর ন্যায়ের প্রতীক আবদুল কাদের মোল্লাকে। যিনি নিজেই তার দীর্ঘ সাফল্যমণ্ডিত কর্মের আবিষ্কারক। যিনি ২ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার জরিপারডাঈী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মো. সানাউল্লাহ মোল্লা এবং মাতা বাহেরুন্নেসা বেগম।
দীনের দায়ী হিসেবে সারা বাংলাদেশে নয়, বরং ছুটে বেড়িয়েছেন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর অনেক প্রান্তে। মিথ্যা কালিমা আর ষড়যন্ত্রের কালো কাপড়ের আচ্ছাদন কি সেই আলোচ্ছটাকে আবৃত করতে পারে? যেই শির আজন্ম এক পরওয়ারদিগার ছাড়া কারো কাছে নত হয়নি, ফাঁসির আদেশে সেই শির দুনিয়ার কোনো শক্তির কাছে নতি শিকার করতে পারে? শাহাদাতের পূর্বে আল্লাহর দীনের মুজাহিদের জবানিতে এমন সাহসী উচ্চারণ উদ্দীপ্ত করেছে সারা বিশ্ববাসীকে। তিনি বললেন, “বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামী আন্দোলনের জন্য আমি আমার জীবন উৎসর্গ করেছি। আমি অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করিনি, করব না। দুনিয়ার কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। জীবনের মালিক আল্লাহ। কীভাবে আমার মৃত্যু হবে, তা আল্লাহই নির্ধারণ করবেন। কোনো ব্যক্তির সিদ্ধান্তে আমার মৃত্যু কার্যকর হবে না। আল্লাহর ফয়সালা অনুযায়ীই আমার মৃত্যুর সময় ও তা কার্যকর হবে। সুতরাং আমি আল্লাহর ফয়সালা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেব।” কোনো এক ব্যক্তি রাসূলূল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! কবরে সকল মুমিনের পরীক্ষা হবে, কিন্তু শহীদের হবে না, এর কারণ কী? হুজুর (সা.) জবাবে বলেন, তার মাথার ওপর তলোয়ার চমকানোই তার পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট।’
শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের সাথে অসংখ্য স্মৃতি আজ নাড়া দেয় প্রতিনিয়ত। ২০০৯ সালে আবদুল কাদের মোল্লা ভাই সৌদি সরকারের রয়েল গেস্ট হিসেবে আর আমি ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে পবিত্র হজ পালন করতে যাই। মোল্লা ভাইয়ের সাথে মদীনায় সাক্ষাৎ। তার সফর ছিল সংক্ষিপ্ত। তাই মদীনায় একটি কমিউনিটি সেন্টারে একটি মতবিনিময় অনুষ্ঠানে মোল্লা ভাই ছিলেন প্রধান অতিথি আর আমি ছিলাম বিশেষ অতিথি। অনুষ্ঠানে আমি যখন সারা দেশে আমাদের ভাইদের ওপর আওয়ামী লীগের জুলুম-নির্যাতন এবং শহীদ ভাইদের ঘটনা বর্ণনা করছিলাম, তখন উপস্থিত সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। আমি মোল্লা ভাইকে অনেকবার চোখের পানি মুছতে দেখেছি। আলোচনায় তিনি বললেন, “বাংলাদেশে শিবিরের যুবক-তরুণরা জীবন দিচ্ছে দীনের জন্য। সুতরাং আপনারা শুধু দান-খয়রাত করলে মুক্তি পাবেন না। কারণ আপনারা এমন জায়গায় আছেন, যেখানে রাসূল (সা.) শুয়ে আছেন। বদর, উহুদ সব এখানেই। সুতরাং দীনের পথে ত্যাগ কুরবানি ছাড়া আমাদেরও মুক্তি মিলবে না।” আজ তিনি নিজেই সারা পৃথিবীর মুসলিম উম্মাহর কাছে একটি প্রেরণা, একটি ইতিহাস, এই দুঃসাহসিক দুর্জয় পথে দুরন্ত সাহস।
শাহাদাতের জন্য মোল্লা ভাইয়ের মন কেমন পাগলপারা ছিল- এ ঘটনা থেকে তা উপলব্ধি করা যায়। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টন ট্র্যাজেডি প্রতি বছরই এ দিবসটি অত্যন্ত মর্যাদার সাথে পালন করা হয়। পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিনই সবাই কাঁদবে আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠার আঘাতে যারা শহীদ আর গাজী মর্যাদায় ভূষিত হয়েছে, তাদের জন্য। আর খুনিরা কিয়ামত পর্যন্ত মানবতার অভিশাপ পেতে থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। খুব সম্ভব ২০০৯ সালের ২৮ অক্টোবর ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ইসলামী ছাত্রশিবির আয়োজন করে আলোচনা সভা। অতিথিবৃন্দ উপস্থিত, আলোচনা সভা শুরু হয়ে গেছে। ঠিক মাঝখানে আমাদের প্রিয় মোল্লা ভাই প্রোগ্রামে এসে হাজির। আমি দাঁড়িয়ে রিসিভ করে বললাম, সরি মোল্লা ভাই আপনি আসছেন এজন্য মোবারকবাদ। কারণ মোল্লা ভাই আমাদের দাওয়াতি মেহমানের মধ্যে ছিলেন না। তবু তিনি নিজ উদ্যোগে আলোচনা সভায় হাজির হয়েছেন। বলতে না বলতে তিনি বললেন, শোন ২৮ অক্টোবর ২০০৬ সালে আমি ঐ প্রোগ্রামে অনুপস্থিতির বেদনা আমাকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়। পল্টনে আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। যেখানে আমাদের ভাইদের শহীদ আর গাজী হয়েছে। ঐ দিন আমি ঢাকায় ছিলাম, কিন্তু আমীরে জামায়াত আমাদের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে সব খোঁজখবর রাখতে বললেন। এজন্য আমি পল্টনে ছিলাম না। সেদিনের এ অনুপস্থিতির বেদনা থেকে তোমাদের দাওয়াত না পেয়েও বেদাওয়াতে এখানে উপস্থিত হয়ে গেলাম। এ কথাগুলো মোল্লা ভাই স্টেইজে বসে বসে বললেন। তখন বুঝতে পারিনি, কিন্তু আজ সারা পৃথিবী জানে তিনি কত গভীর ভাবে শাহাদাতের চেতনাকে লালন করতেন।
শাহাদাতের রাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা তার স্ত্রী, পুত্র, মেয়ের কাছ থেকে এভাবেই শেষ বিদায় নিয়েছিলেন, “আমি তোমাদের অভিভাবক ছিলাম। এ সরকার যদি আমাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, তাহলে সেটা হবে আমার শাহাদাতের মৃত্যু। আমার শাহাদাতের পর মহান রাব্বুল আলামিন তোমাদের অভিভাবক হবেন। তিনিই উত্তম অভিভাবক। সুতরাং তোমাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। ইসলামী আন্দোলনকে বিজয়ী করার মাধ্যমে আমার হত্যার প্রতিশোধ নিও। শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধেই আমাকে হত্যা করা হচ্ছে। শাহাদাতের মৃত্যু সকলের নসিবে হয় না। আল্লাহ তায়ালা যাকে শহীদি মৃত্যু দেন, সে সৌভাগ্যবান। আমি শহীদি মৃত্যুর অধিকারী হলে তা হবে আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। আমার প্রতিটি রক্তকণিকা ইসলামী আন্দোলনকে বেগবান করবে ও জালেমের ধ্বংস ডেকে আনবে। আমি নিজের জন্য চিন্তিত নই। আমি দেশের ভবিষ্যৎ ও ইসলামী আন্দোলন নিয়ে চিন্তিত। আমি আমার জানামতে কোনো অন্যায় করিনি।
সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা