মহানবী (সা.)-এর ক্ষমার আদর্শ


৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:২৭

॥ ড. ইকবাল কবীর মোহন ॥
হিজরতের দ্বিতীয় বছর। ১৭ রমজান। বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হলো। যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয় লাভ করল। আবদুল্লাহ আল খুজাই নামক এক কুরাইশ তাদের পরাজয়ের খবর নিয়ে প্রথমে মক্কায় এলো। আবদুল্লাহ তার উট নিয়ে কাবাঘরের আঙিনায় এসে থামল। আর অমনি কুরাইশরা তাকে ঘিরে ধরল। খুজাইকে তারা বদর যুদ্ধের খবর জানাতে অনুরোধ করল।
খুজাই বলল, ‘যুদ্ধে উতবা বিন রবীআ, শাইবা বিন রবীআ, আবু আল-হাকাম বিন হাশিম, উমাইয়া বিন খলফসহ অনেকে নিহত হয়েছে। আর মুসলমানরা আমাদের অনেককে বন্দী করেছে।’ এ সময় সুফিয়ান বিন উমাইয়া বিন খলফ কাবার হাতিমে বসেছিলেন। সুফিয়ান খুজাইয়ের কাছে তার পরিবারের সদস্যদের খবর জানতে চাইলেন। খুজাই বলল, ‘আমি তোমার পিতা ও ভাইকে নিহত হতে দেখেছি।’
এভাবে কুরাইশদের পরাজয়ের বিষয়টি আবদুল্লাহ আল খুজাই নিশ্চিত করল। ক্ষণিকের মধ্যেই এ খবর মক্কার ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল। ফলে সর্বত্র নেমে এলো বিষাদের ছায়া।
আবু সুফিয়ান ছিলেন অস্ত্র ব্যবসায়ী। তিনি অনেক সম্পদের মালিক ছিলেন। তার চাচাতো ভাই উমায়ের বিন ওয়াহহাব ছিল ভয়ঙ্কর লোক। সে তখন হাতিমে বসে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছিল। কুরাইশদের পরাজয়ের খবর শুনে সে খুবই উত্তেজিত এবং অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল। তখন আবু সুফিয়ান বললেন, বদরের পর জীবন আর সুন্দর রইল না। আমি মনে করি, যেভাবেই হোক প্রতিশোধ গ্রহণ করতে হবে।’
উমায়ের বলল, ‘মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যা করার পুরো পরিকল্পনা আমার আছে। তবে এখন আমার বড় ঋণ রয়েছে এবং আমার ছেলেমেয়েরা এখনো বেশ ছোট। আবু সুফিয়ান এরপর বললেন, ‘তুমি এ নিয়ে ভেবো না। আমি তোমার ঋণ পরিশোধ করে দেব এবং আমার মৃত্যু পর্যন্ত তোমার ছেলেমেয়েদের আমার ছেলেমেয়ের মতো দেখভাল করব।’
এরপর আবু সুফিয়ান উমায়েরের কাছে মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যার পরিকল্পনা জানতে চাইলেন। উমায়ের বলল, ‘আমি জানি মুহাম্মদ (সা.) কোনো ব্যক্তিগত প্রহরী রাখেন না। আমি আমার খঞ্জরে শক্তিশালী বিষ মিশিয়ে নেব। মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে যাব আমাদের বন্দীদের নিয়ে আলোচনা করার জন্য। আর যখন সুযোগ পাব, খঞ্জর দিয়ে মুহাম্মদ (সা.)-কে আঘাত করব। ফলে বিষের আঘাতে তিনি মারা যাবেন।’
আবু সুফিয়ান উমায়েরের কথায় খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন, ‘তাহলে আমার সাথে হাত মিলাও। তুমি শপথ কর যে, তোমার এ পরিকল্পনা আর কেউ জানবে না।’
উমায়ের দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘আমি আমার কাজ অতিদ্রুত সম্পন্ন করব। আমি মদিনায় যাব আমাদের বন্দীদের মুক্ত করার মিশন নিয়ে। এ কথা বলে উমায়ের এক পৈশাচিক হাসি হাসল। আবু সুফিয়ান তার ঘরে চলে গেলেন এবং তার তরবারিতে সাধ্যমতো ধার দিলেন। তরবারিতে তিনি বিষ মাখলেন। তারপর তিনি এটি উমায়েরের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘যাও তুমি। মদিনার উদ্দেশে রওনা কর।’
উমায়ের সময় নষ্ট না করে মদিনার উদ্দেশে রওনা করল। আর আবু সুফিয়ান ভালো কোনো খবরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
এদিকে উমায়ের যথাসময়ে মদিনায় গিয়ে উপস্থিত হলো। তবে উমায়েরের উপস্থিতি ওমর (রা.)-এর চোখে পড়ল। ওমর (রা.) উমায়েরের চরিত্র সম্পর্কে ভালো করেই জানেন। সে ইসলামের বড় শক্র। তাই ওমর (রা.) ভাবলেন, নিশ্চয়ই সে কোনো কুমতলব নিয়ে এখানে এসেছে।
ওমর (রা.) উমায়েরের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি উমায়েরকে ধরে মহানবী (সা.)-এর কাছে নিয়ে গেলেন। এরপর ওমর (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সে আমাদের বড় শত্রু। এখানে এসেছে খারাপ মতলব নিয়ে।’ মহানবী (সা.) বললেন, ‘সে যাই হোক, তুমি ওকে ছেড়ে দাও।’
হযরত ওমর (রা.) রাসূল (সা.)-এর কথা মান্য করলেন। তবে তিনি কয়েকজন সাহাবীকে সতর্ক থাকতে বললেন। এই বিশ্বাসঘাতককে চোখে চোখে রাখার কথা তাদের পরামর্শ দিলেন।
মহানবী (সা.) উমায়েরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘উমায়ের! এখানে তুমি কি উদ্দেশ্যে এসেছ?’
উমায়ের জবাবে বলল, ‘আমার ছেলে আপনার এখানে বন্দী। তাকে মুক্ত করার জন্য আমি এসেছি।’
মহানবী (সা.) মজা করে বললেন, ‘তাহলে বলো তোমার গলার চারদিকে কেন তুমি তরবারি ঝুলিয়ে রেখেছ? আমাকে তুমি সত্যি করে বল উমায়ের, এখানে কেন এসেছ?’
উমায়ের জোর দিয়ে বার বার বলতে চাইল, সে তার ছেলেকেই নিতে এসেছে। এবার আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন, ‘আচ্ছা তুমি বল, হাতিমে বসে তাহলে তুমি এবং আবু সুফিয়ান কী বিষয় নিয়ে আলাপ করেছিলে? তুমি বলেছিলে, তোমার যদি ঋণ এবং ছোট ছোট ছেলেমেয়ে না থাকত, তাহলে তুমি মুহাম্মদকে (সা.) হত্যা করার জন্য বেরিয়ে পড়তে। এরপর সুফিয়ান তোমার ঋণ এবং তোমার ছেলেমেয়েদের দেখভাল করার দায়িত্ব নিল। যাতে তুমি আমাকে হত্যা করতে পারো। কিন্তু তোমার আর আমার মধ্যে আল্লাহই বাধা তৈরি করে দিয়েছেন।’
মহানবী (সা.)-এর কথা শুনে উমায়ের যেন আকাশ থেকে পড়ল। সে একেবারে হতচকিত হয়ে গেল। সে জানে আবু সুফিয়ান এবং উমায়ের ছাড়া তার পরিকল্পনার কথা আর কেউ জানে না। অথচ আল্লাহর রাসূল (সা.) এ খবর জানলেন কী করে? উমায়ের এবার মহানবী (সা.)-এর সত্যবাদীতা সম্পর্কে আস্থাশীল হলো।
উমায়ের বলল, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল। আপনার কাছে আকাশ থেকে যে খবর আসে আমরা এতদিন অস্বীকার করতাম। আবু সুফিয়ান এবং আমি যে আলোচনা করেছি, তা অন্য কেউ জানে না। আল্লাহর কসম! আল্লাহ সাহায্য ছাড়া আপনি কোনোভাবেই আমাদের পরিকল্পনা জানার কথা নয়। আমি সেই আল্লাহর প্রশংসা করছি, যিনি আমাকে ইসলাম গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন এবং আমাকে সোজা-সরল পথ দেখিয়েছেন।’
এ ঘটনার পর আল্লাহর নবী (সা.) তার সাহাবীদের বললেন, ‘তোমার ভাইকে ধর্ম বিষয়ে শিক্ষা দাও। তার কাছে কুরআন পাঠ করো আর বন্দীদের মুক্ত করে দাও।’ উমায়ের এতদিন নবীজিকে ঘৃণা করেই এসেছে। মহানবী (সা.)-এর চরিত্র যে এতটা নিষ্কুলষ এবং উন্নত সে কল্পনাও করতে পারেনি। এখন সে তা নিজের চোখের সামনেই তা দেখতে পেল। তাই উমায়ের তার আগের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইল। আল্লাহর নবী (সা.) তাঁকে ক্ষমা করে দিলেন।
এদিকে আবু সুফিয়ান মক্কায় অপেক্ষা করছিলেন। উমায়ের ভালো কোনো খবর নিয়ে আসবে, তিনি তাই ভাবছিলেন। তাই মদিনা থেকে যত যাত্রী মক্কায় আসছিল সুফিয়ান সবার কাছে উমায়েরের খবর জানতে চাইলেন। একদিন এক লোক মদিনা থেকে মক্কায় ফিরল। সে আবু সুফিয়ানকে জানাল যে, ‘উমায়ের ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে।’
এ কথা শুনে আবু সুফিয়ান খুব ক্ষেপে গেলেন। তিনি শপথ করে বললেন, ‘আমি আর কখনো উমায়েরের সাথে কথা বলব না। তাকে সাহায্যও করব না।