মায়ার বাঁধন
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:২১
পি এম শরিফুল ইসলাম : মাগরিবের সালাত আদায় করে শনিরআখড়া বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় একটা দৃশ্য দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। দৃশ্যটা একেবারে আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। ব্রিজের উত্তর দিকে খানিকটা দূরে রাস্তার পাশে দেখতে পেলাম, একটা কিশোরী মেয়ে কী যেন বিক্রি করছে। বিষয়টি আমাকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলল। তাৎক্ষণিক কাছে গিয়ে দেখলাম, মেয়েটা মুরালি বিক্রি করছে। ওর পরনে ময়লাযুক্ত পুরনো ছেঁড়া একটি জামা। অবশ্য হিজাব পরিধান করায় ওকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। আমার দারুণ মায়া লাগল তার প্রতি। এতটুকু একটা শিশু মেয়ে এসব বিক্রি করে তার জীবিকা নির্বাহ করছে। এ বয়সে যে কিনা স্কুলের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, এমন সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে গুনগুনিয়ে পড়ার কথা, অন্য আট-দশটা ছেলেমেয়ের মতো হই-হুল্লোড় করে আনন্দে কাটিয়ে দেওয়ার কথা সারা দিনÑ সে কিনা এ বয়সে ফেরি করে বেড়াচ্ছে?
আমি কাছে গিয়ে স্নেহমাখা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-এই যে, তোমার নাম কী?
সে খানিকটা লজ্জিত হয়ে অনেকটা নির্ভয়ের সাথে জবাব দিল,
-মিম।
-পুরো নামটা যেন কী তোমার?
এবার সে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে জবাব দিল,
-হুমায়রা জান্নাত মিম।
-মাশাআল্লাহ! খুব সুন্দর নাম তো তোমার।
হাতের ব্যাগটা নিচে রেখে অনুমতি সাপেক্ষে দুটি মুরালি মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলাম,
-আচ্ছা তোমার মা-বাবা কোথায়? আর তুমি এত ছোট একটা মানুষ। এই বয়সে এগুলো কেন বিক্রি করছো?
এবার সে অনেকটা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জবাব দিল,
-“ভাইয়া, পেটের দায়ে এসব কাজ করছি। আমাগো তো আর দেহার মতো কেউ নাই। বাপজান মারা যাওয়ার পর থেইকা আমার স্কুল যাওন বন্ধ। ছোট দুইটা ভাই-বোন আছে। মা মাইনসের বাসায় বুয়ার কাজ করে। আর আমি এইগুলা বেইচা মারে সহযোগিতা করি।”
মেয়েটির কথাগুলো শুনে আমার হৃদয়টা কেঁপে উঠল। আপ্লুত হয়ে গেলাম। চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো অশ্রুবিন্দু জমে। বললাম,
-আচ্ছা শুনো মিম, তুমি দেখতে একেবারে আমার ছোট বোনের মতো। তুমি তো অনেক ভালো মেয়ে। মাকে সহযোগিতা করছো এ ছোট্ট অবোধ বয়সে। থাক, কান্না করো না। আল্লাহ তোমাকে উত্তম কল্যাণকর প্রতিদান দান করুন এবং তোমার জীবনকে সহজ করে দিন। বলে ওকে সান্ত্বনা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।
ও আমার কথা শুনে নিজেকে স্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো।
-আচ্ছা মিম আপুমণি, আমাকে দুই কেজি মুরালি দাও তো।
ও দুই কেজি মুরালি মেপে পলিথিনে ভরে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। আমি আনমনা হয়ে মুরালির প্যাকেটটা ব্যাগের ভেতর রাখলাম। মানিব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে ওর নিষ্পাপ হাতে ধরিয়ে দিলাম।
ও তাৎক্ষণিক টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো,
– ভাইয়া, আমার কাছে তো এত টাকার ভাঙতি নাই।
-ভাঙতি লাগবে না। ফেরত দিতে হবে না আর। তুমি পুরোটাই রেখে দাও।
ও সাত-পাঁচ না ভেবে নিঃসংকোচে বলে ফেললো,
-আমি কারো কাছ থেইকা এভাবে বেশি টেহা নেই না। আমার মা নিতে বারণ করছে। মা বলছে, “কারো দয়ার কিংবা করুণার মুখাপেক্ষী হবি না। কষ্ট করে পরিশ্রম করে উপার্জন করবি। তবুও কারো কাছে হাত পাতবি না।”
আমি খুবই নরম স্বরে আদরের ভঙ্গিতে বললাম,
-তুমি তো আর আমার কাছে হাত পাতনি। আমি তোমাকে খুশি হয়েই দিয়েছি। মনে করো এটা তোমার বড় ভাইয়া তোমাকে হাদিয়া দিয়েছে। তোমার তো বড় ভাই নেই। আর তুমি তো আমাকে ভাইয়া ডেকেছো, তাই না? আমি যদি তোমার বড় ভাইয়া হতাম তুমি কি তখন না করতে পারতে? তুমি কি টাকাটা নিতে না?
ও একপ্রকার বাধ্য হয়ে অনেক রিকুয়েস্ট করার পর টাকাটা নিল। ওর সাথে আরও কিছুক্ষণ আলাপচারিতা করে জানতে পারলাম, ওর মা রাবেয়া বেগম তিনটা বাসায় রান্নার কাজ করে। সারা দিন কাজ করে রাতে বাসায় এসে আবার মুরালি তৈরি করেন। সকালে যেন বিক্রি করতে পারে সে। ওর ছোট দুটি ভাই-বোন আছে। ওর ছোট ভাইটা ক্লাস টু-তে পড়ে। আর একেবারে ছোট বোনটার বয়স চার কি পাঁচ বছর। গত বছর সর্বশেষ ও ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে। আর্থিক অসচ্ছলতা, অভাব অনটনের কারণে ওর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। সঙ্গী হয় মুরালি বিক্রির ব্যবসায়। আর ছোট্ট মিমও হয়ে যায় খুদে ব্যবসায়ী।
সন্ধ্যার আধো আলো-আঁধার কেটে রাত্রির ঘন কালো অন্ধকার নেমে এলো। কিন্তু ঢাকা শহরে রাত দিনের কোনো বালাই নেই। রাতের ঢাকায় যেন অন্ধকারের কোনো ঠাঁই নেই। রাস্তার নিয়নবাতি আর মার্কেটের বৈদ্যুতিক লাইটের আলোকোজ্জ্বলতায় রাতের ঢাকা যেন দিনের মতোই থাকে সবসময়। তবুও রাজধানীতে রাত যত গভীর হয়, অন্যায় ও অপকর্ম তত বাড়তে থাকে। বেশি রাত হয়ে গেলে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। তাই ওকে কিছু উপদেশমূলক কথা বলে, দোয়া ও সালাম বিনিময় করে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এলাম।
বাসে উঠে জানালার পাশে বসে লক্ষ করলাম দূর থেকে মিম আমার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক মায়ার দৃষ্টিতে। আমিও ছলছল চোখে শেষবারের মতো ওকে হাত নেড়ে বিদায় জানালাম। আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম, ইস! ও যদি আমার ছোট বোন হতো। ওকে কত্ত আদর করতাম। হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেতাম। অভিমান করে না খেলে নিজ হাতে খাইয়ে দিতাম। শুক্রবার ছুটির দিনে ওকে নিয়ে ঘুরতে যেতাম। সারাক্ষণ ওর সাথে খুনসুটি ও আদর আহ্লাদে মেতে থাকতাম।
গাড়ি আস্তে আস্তে ছাড়তে শুরু করেছে। ওর নিষ্পাপ মুখে “ভাইয়া” ডাকটা আমাকে মুগ্ধ ও আনন্দিত করেছে খু-উ-ব। ওর জন্য অন্তরাত্মার গহিনে অনেক মায়ার টান অনুভব করতে লাগলাম। আর সেই মায়া ও ভালোবাসার টানে দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল আমার। সম্ভবত এটাই মায়ার বাঁধন।