আলোকে তিমিরে : শুভ পরিবর্তন বনাম অশুভ পরিবর্তন


২৯ নভেম্বর ২০২৪ ০০:০০

॥ মাহবুবুল হক ॥
আমরা পরিবর্তন চেয়েছিলাম। আল্লাহর রহমতে বড় ধরনের একটা পরিবর্তন এসেছে। সেই পরিবর্তনের নানা নামকরণ করা হয়েছে। সেদিকে আজ আর যাব না। কারণ চধংঃ রং ঢ়ধংঃ, গতস্য শোচনা নাস্তি, গুজাস্তা জামানা ফের আতা নেহিÑ এসব পুরনো কথা। আমরা পুরনোরাই এসব বাক্য ব্যবহার করি। পরিবর্তন চলছে সবাই জানে। কিন্তু গত জামানার মতো সবাই কথা বলছে না। তবে একটু পরিবর্তন তো আছে। আগে শতকরা হয়তো ৫ জন সাহসী বীর কথা বলতেন। এখন হয়তো সে জায়গায় ১০ জন বলছেন। এটা কম কীসে? কিন্তু দুঃখজনক হলো, যারা এ পরিবর্তনকে স্বাধীনতা বলে কয়েকদিন আকাশ-বাতাস কাঁপিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ১৯৪৭ নাই, ১৯৭১ নাই, এটাই প্রকৃত স্বাধীনতা। ব্রিটিশ বেনিয়া চলে যাওয়ার পর এ প্রথমবার আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমার বেয়াদবি নেবেন না। এখন আর কেউ স্বাধীনতার শব্দটি উচ্চারণ করছেন না। এখন আন্দোলন বলা শুরু হয়েছে। আন্দোলন তো আমাদের জীবনে ডাল-ভাত। এ তো আমরা হরহামেশাই করছি। এখন তো ক্ষুদ্র, মাঝারি সবশ্রেণির পেশাজীবীর টালমাটাল আন্দোলন চলছে। রাজধানী ঢাকার উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, ঈশান, অগ্নি, নৈরূৎ, বায়ু- এ আট জায়গায় আটরকম আন্দোলন, চট্টগ্রাম বা চাটগাঁয়ে সনাতনদের নানা ভেলকিবাজি। সেসবের রূপ, প্রকৃতি, আবহ, বিন্যাস সম্পূর্ণ আলাদা। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্ন, সামঞ্জস্যহীন; থাক সেসব কথা। সেসব বিষয় কমবেশি আপনারা জানেন। সমাধানের জন্য যার যার মতো চেষ্টাও করছেন।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, স্কুল, কলেজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিনোদন, খেলাধুলা, হাটবাজারসহ যত অ্যাসোসিয়েশন, সমিতি, সংঘ গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগাররা নিষ্ঠুরভাবে দখলে রেখেছিল, সেসবে এখন আর তারা নেই। সে জায়গায় অন্যরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দখলে নিয়ে নিয়েছেন। এর জন্য সরকারি কোনো নিয়ম, বিধি, প্রজ্ঞাপন, আদেশ, নিষেধ কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়নি। স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে গেছে। মা-বাবা মারা গেলে এত সহজে দখলি স্বত্ব পাওয়া যায় না। কিন্তু এক্ষেত্রে নীরবে-নিভৃতে লোকচক্ষুর অন্তরালে হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ ক্ষেত্রে একটি নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। পূর্বে আওয়ামী লীগই ছিল একচ্ছত্র দখলদার। এখন অবশ্য স্থান ও পাত্রভেদে দখলদার হয়েছেন কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীগণ।
যারা দেশপ্রেমিক, যারা সরকারকে মান্য করেন, যাদের কিছুটা নীতিবোধ আছে, তারা এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন, কথাবার্তা বলছেন, যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাৎক্ষণিক কোনো ফল হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে পূর্বের মতো ঢালাও নির্বাচন যদি হয়, তাহলে যে সরকার গঠিত হবে, সে সরকার তার সময়কাল পর্যন্ত টিকতে পারবে না। এক অন্যায়কে দূর করে আরেক অন্যায় স্থায়ী হতে পারে না। অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতনে এসবের বিরুদ্ধে কীভাবে দাঁড়াতে হয়, সে বিষয়ে ছাত্র-তরুণদের মাথা খুলে গেছে। সুতরাং স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায়, যারা এবারের বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের উদ্যোক্তা, তারা মিস্টার ঢ-এর বদলে মিস্টার ণ-কে চাননি। চেয়েছেন সিস্টেমের পরিবর্তন। দলের বা মানুষের পরিবর্তন নয়। সেজন্যই বৈষম্যের কথাটা উচ্চকিত ও সমুজ্জ্বল হয়েছে। পরিবর্তন মানে তারা চেয়েছেন শুভ পরিবর্তন। ঝঁংঃধরহধনষব ঈযধহমব আকাক্সিক্ষত না ভুল বললাম; বহু আকাক্সিক্ষত। সে পরিবর্তনের জন্য মোটামুটি নয়, কোনো কোনো বিষয়ে আমূল পরিবর্তন দরকার। সেই সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে বা মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে নির্বাচনে ঝাঁপ দেয়া মানে নিজেদের ভবিষ্যৎ ও প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার গহ্বরে ঠেলে দেওয়া। যে রিস্ক বুঝে-শুনে নয়, বুঝে-সুজে গ্রহণ করা এ জাতির পক্ষে সম্ভব নয়।
নতুন জামানার নতুন ওয়াজ
রবিশস্যের মৌসুমে কৃষকদের হাতে কিছু টাকা-পয়সা থাকে বলে প্রাচীনকাল থেকে অপরাহ্ণের পর নানা কিসিমের আনন্দ-উৎসবসহ ধর্মীয় আলাপ-আলোচনায় স্থানীয়ভাবে বা অঞ্চল ভিত্তিতে আয়োজিত হয়ে আসছে। আমাদের লোকজীবনে অতীতে যা কিছু ছিল এবং এখনো যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তার অধিকাংশই সাঁঝের আঁধার থেকে শুরু হতো। আমাদের জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল গান, মর্সিয়া, পল্লীগীতি, পালাগান, যাত্রাপালা থেকে শুরু করে কবিগান, সার্কাস, পুথিপাঠ সবই প্রায় শীতকালে লোকজীবনে উদ্ভাসিত হতো। আজ থেকে ৭০ বছর পূর্বের কথা আমার বেশ মনে আছে। উপরে যা কিছু বললাম, তার সাথে মাযহাবভিত্তিক কিছু ওয়াজের ব্যবস্থা হতো। যে মানুষটি প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে যাত্রাপালায় অংশগ্রহণ করতো, সে একই মানুষ খোলা আকাশের নিচে শামিয়ানার তলে বসে মৌলভী সাহেবদের বয়ান শুনে কান্নাকাটি করতেন। শুধু যে মুসলিমরাই ওয়াজ শুনতো তাই নয়, সনাতন ধর্মের লোকেরাও মন্দিরের সামনে বসে কীত্তনসহ গীতা, রামায়ণ, মহাভারত শুনতো। যেমন মুসলিমরা শুনতো মর্সিয়াসহ ইউসুফ-জুলেখা, গাজীকালু-চম্পাবতী, লাইলী-মজনুসহ স্থানীয় ভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পুথিপাঠ শুনতো। স্থানীয় লোক, কবিগণ বিভিন্ন কাহিনীকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের কবিগান তৈরি করতো। সেগুলো আবার ভুলভাল ছাপাও হতো। এক পয়সা দুই পয়সায় সেসব আবার দিনের বেলা হাটে-বাজারে বিক্রয় হতো এবং রাতের বেলা হ্যাচাক লাইটের আলোয় সেসব পড়ে শোনাত। সেসব নিয়ে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হতো।
সময়ের পরিবর্তনে ধীরে ধীরে সব উধাও হয়ে গেছে। বেশিরভাগ অপসৃত হয়েছে ৪০ থেকে ৫০-এর দশকের রাজনৈতিক উত্থান-পতনে এবং পরবর্তীতে ৭০ ও ৮০’র দশকে বিস্ময়কর বিষয় হলো শুধু সনাতন ধর্মের পালা-পার্বণ নয় উপজাতিদের পালা-পার্বণেও মুসলিমরা অংশগ্রহণ করত। আবার উপর্যুক্ত ধর্মের লোকেরা মুসলিমদের ন্যায্য ও অন্যায্য পালা-পার্বণে যুক্ত হতো। ধর্ম সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াতো না।
ধীরে ধীরে ধর্মের বিষয়গুলো ছাকনির মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হতে লাগলো। অমল, বিমল ও পরিচ্ছন্ন হতে শুরু করল। ৬০-এর দশকের পর থেকেই স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও মসজিদের শিক্ষক-ওস্তাদগণ সারা দেশে যে ওয়াজ করতেন, তা ছিল মোটামুটি শোভন, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য। যেসব আলেমের কথা উল্লেখ করলাম, তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের মুক্তির তাগিদে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজনের প্রয়াস পেতেন। এভাবেই ওরস শরীফ, বার্ষিক ওয়াজ-মাহফিলের উদ্ভব হয়। মোটামুটিভাবে এরশাদের আমল থেকে এ বিষয়গুলো বাণিজ্যের রূপ ধারণ করে। দেশবাসী জানেন এ যুগেই দুর্নীতির প্রসার ঘটে। সরকারিভাবেই এ দুর্নীতির উত্থান ও বিস্তার ঘটে। এরশাদ সাহেবের প্রায় ১০ বছরের শাসনকালে সরকারের ও সমাজের এমন কোনো জায়গা ছিল না, যেখানে দুর্নীতির প্রতিষ্ঠা হয়নি। সত্য কথা বলতে, এ সময় দুর্নীতি ও সুনীতি একাকার হয়ে যায়। এরশাদ সাহেব মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানাসহ ওলামাদের সাথে নিজের স্বার্থে সখ্য গড়ে তোলেন। শুরু হয় নতুন ধরনের ওয়াজ। এরশাদ এবং জাতীয় পার্টি বলতে গেলে ওয়াজের নামে একটি নতুন ধারার ওয়াজ মাহফিল প্রচলন করে বসেন। যেখানে একসময় ছিল সত্যপন্থী আলেমদের উদ্যোগ। সে জায়গায় শুরু হয়ে যায় প্রচণ্ড ধর্ম ব্যবসা। হাজার হাজার টাকা থেকে শুরু করে লাখ লাখ টাকার ব্যবসা শুরু হয়। হাদিয়া নয়, পূর্বেই বার্গেইন করে সবকিছু ঠিক করা হয়। যদিও আমাদের জীবনবিধান আছে। কুরআন বা আল্লাহ ও রাসূলের বাণী প্রচার ও প্রসার করার জন্য কোনো বিনিময় নেয়া যাবে না। সেই বিষয়টিকে দারুণভাবে উপেক্ষা করা হয়। ওরসের বিষয়টি হলো পীর, মাজার বা বিভিন্ন মাযহাব ও উপমাযহাবের বিষয়। সেসব বিষয়ে আমরা এখানে কথা বলতে চাই না।
গত ১৬ বছরে আওয়ামী সরকার তাদের পক্ষে ওয়াজ-নসিহতের মহাব্যবস্থা জারি রেখেছিল। সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে বিদ্যমান ঝগড়া-ঝাঁটি, মারামারি, গোলাগুলি ও মামলা-মোকদ্দমা এসব ওয়াজ-মাহফিলকে কেন্দ্র করে অনেক বড় বড় সামাজিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। আলেমগণ অসম্মানিত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন এবং নিগ্রহ ভোগ করেছেন প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে। এর ভেতর দিয়েও নানাভাবে অত্যাচারিত হওয়ার পরও সত্যপন্থী কিছু আলেম আমাদের জীবনবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ওয়াজ-নসিহত করার চেষ্টাও করেছেন। এ ধরনের নিবেদিতপ্রাণ ওলামা ও ওয়ায়েজিনের সংখ্যা বড়জোর ২৫ থেকে ৩০ জন হবেন। কিন্তু আমাদের উপজেলা হলো ৪৯৬টি। আমরা যদি খুব কম করেও ধরি, তাহলে অন্তত প্রতিটি উপজেলায় একজন করে হলেও অস্বচ্ছ আলম আছেন। যারা ইসলামের মূল বাণীকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করে তাদের মাহফিল করে যাচ্ছেন।
ঠিক এ জায়গাটিতে যদি সংস্কার করা না হয়, তাহলে ইসলামের শোভনতা, সৌন্দর্য ও মূল চরিত্র তছনছ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।