জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষায় রাসূলুল্লাহ সা.-এর সুদৃঢ় কর্মকৌশল


২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০০

॥ এম. মুহাম্মদ আব্দুল গাফ্্ফার ॥
মহান রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেন, নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। (সূরা আল আহযাব : ৩৩)। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার এ ঘোষণা থেকে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, মহানবী সা. বিশ্ববাসীর সকল সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে একমাত্র অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। আল্লাহর রাসূল সা. নিছক কোনো একজন ব্যক্তিই ছিলেন না। তিনি ছিলেন পৃথিবীর এক বিশাল অতুলনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যার উপমা একমাত্র মহাসমুদ্রের সাথেই হতে পারে। একটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবন, শিক্ষা জীবন, সামাজিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন, রাষ্ট্রীয়, বিচারিক, সামরিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কিত যাবতীয় ব্যবস্থাদিসহ আধ্যাত্মিক ও জ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রসমূহের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে মহানবী সা.-এর জীবনাদর্শের মধ্যে।
মহানবী সা. তাঁর জীবদ্দশায় শুধু একটি ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি, বরং তিনি এ রাষ্ট্রটির সার্বিক নিরাপত্তা বিধান করে বিশ্বের সামনে এ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন যে, শুধু কোনো দেশ জয় বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেই একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব পালনের যথার্থতা প্রমাণ হয় না। ঐ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ়করণসহ নাগরিকদের জানমাল সুরক্ষার পদক্ষেপ গ্রহণপূর্বক জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা। আল্লাহর রাসূল সা.-এর এদিকে দৃষ্টি ছিল অত্যন্ত প্রখর। মহানবী সা. মক্কা থেকে মদীনায় পৌঁছেই ইহুদি, সন্ত্রাসী ও লুণ্ঠনকারীদের উপদ্রব থেকে মুসলমানদের জানমাল রক্ষার জন্য সাহাবীদের নিয়ে নৈশকালীন পাহারার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে সাহাবীগণ (রা.) আল্লাহর রাসূল সা.-এর নিরাপত্তার জন্য সদাসতর্ক দৃষ্টি রাখতেন।
হারাম মাসগুলো ব্যতীরেকে মদীনাকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত রাখা মহানবী সা. কোনোক্রমেই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করতেন না। মদীনার আশপাশে এমন সব বেদুঈনের অবস্থান ছিল যারা লুটতরাজ এবং ডাকাতি করার জন্য সবসময় মুসলমানগণের অমনোযোগিতাজনিত সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো। এ কারণে আল্লাহর রাসূল সা. খায়বার অভিযানের প্রাক্কালে বেদুঈনদের ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আবান বিন সাঈদের নেতৃত্বে নাজদের দিকে এক বাহিনী প্রেরণ করেন। আবান বিন সাঈদ তার ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালন শেষে প্রত্যাবর্তন করলে খায়বারে নবী সা.-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। (আর রাহীকুল মাখতুম)। আল্লাহর রাসূল সা. আহযাব (খন্দক) যুদ্ধ, বনি কুরাইযা যুদ্ধ ও খায়বার অভিযান থেকে যখন অবসর পেলেন, তখন বেদুঈনদের প্রতি মনোযোগদানের সুযোগ লাভ করলেন। ঐসব বেদুঈন যারা নাজদের বালুকাময় প্রান্তরে শিবির স্থাপন করে বসবাস করতো এবং মাঝে মাঝে ডাকাতি ও লুটতরাজে লিপ্ত থাকতো। এসব বেদুঈন স্থায়ী কোনো জনপদ কিংবা শহরের অধিবাসী ছিল না। তাদেরকে অন্যায় ও অনিষ্টতা থেকে বিরত রাখার ব্যাপরটি ছিল অত্যন্ত কঠিন। এ প্রেক্ষিতে বেদুঈনদের মনে ভয়ভীতির সঞ্চার করার লক্ষ্যে নবী করীম সা. যে শাস্তিমূলক আক্রমণ পরিচালনা করেন, তা যাতুর রিকা যুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ।
আল্লাহর রাসূল সা. আনমার অথবা বনু গাতফান গোত্রের দুটি শাখা সালাবাহ এবং মুহারিবের লোকজনদের সমবেত হবার সংবাদ পেয়ে আবু যার কিংবা উসমান (রা.)-এর ওপর রাজধানী তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্পণ করে ৪০০ কিংবা ৭০০ মুজাহিদের বাহিনী নিয়ে বের হন। মদীনা হতে দুদিনের দূরত্বে অবস্থিত নাখল নামক স্থানে গিয়ে পৌঁছলে দুদল মুখোমুখি হয়। উভয় পক্ষই ভীত ও সন্ত্রস্ত ছিল কিন্তু যুদ্ধ হয়নি, তবে রাসূলুল্লাহ সা. ঐ সময় খাওফের (যুদ্ধাবস্থার) সালাত আদায় করেন। এভাবে দেখা যায় যে, মহানবী সা. সন্ত্রাসী বনু মুলাওওয়াহ গোত্রকে শায়েস্তার জন্য গালিব বিন আব্দুল্লাহ লায়সীর পরিচালনায় কুদাইদ অঞ্চলে, হযরত ওমর বিন খাত্তাবের নেতৃত্বে বনু হাওযিনের বিরুদ্ধে, বাশীর বিন সাদ আনসারীর নেতৃত্বে ফাদাক অঞ্চলের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানে প্রেরণ করেন। বাশীর বিন কাব আনসারীর নেতৃত্বে ৩০০ মুজাহিদ বাহিনীকে ইয়ামান ও জাবার এলাকায় বনু ফাযারা ও বনু উযরা এলাকায় প্রেরণ করা হয় মদীনার ওপর আক্রমণ চালানোর লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণরত এক বিরাট বাহিনীকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়ার জন্য। মুসলিম বাহিনী রাত্রিবেলা পথ চলতেন এবং দিবাভাগে বিশ্রাম তথা আত্মগোপনে থাকতেন। মুসলিম বাহিনী পলায়নরত শত্রুবাহিনীর দুই ব্যক্তিকে বন্দী করে তাদের গবাদিপশু হস্তগত করে মদীনায় পৌঁছেন।
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মহানবী সা. এর গাবা অভিযান ছিল একটি চমকপ্রদ তথা অত্যন্ত আকর্ষণীয় দৃঢ় পদক্ষেপ। জুশাম বিন মুআবিয়া গোত্রের এক ব্যক্তি অনেক লোকজন নিয়ে গাবা নামক স্থানে কায়স গোত্রের জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে মদীনার ওপর হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মহানবী সা. মুসলিম গোয়েন্দাদের মাধ্যমে এ সংবাদ অবগত হয়ে আবু হাদরাদ (রা.) ও তাঁর সাথে অপর দুজন সমর বিশেষজ্ঞ সাহাবীসহ মোট তিন সদস্য বিশিষ্ট কমান্ডো বাহিনীকে উক্ত অঞ্চলে প্রেরণ করেন। এ ক্ষুদ্র বাহিনী মাগরিবের সময় শত্রুপক্ষের এলাকায় পৌঁছে যায়। তারপর আবু হাদরাদ এক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং তাঁর দুই সঙ্গী আরেক স্থানে অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। এদিকে শত্রুপক্ষের গোত্রের প্রধান রাত্রির প্রথম প্রহরে বের হয়ে হাদরাদ (রা.) এর নিকট দিয়ে অতিক্রম করার সময় তার বক্ষস্থল লক্ষ করে তীর নিক্ষেপ করলে সে তৎক্ষণাৎ পড়ে যায়, হাদরাদ (রা.) তার মস্তক ছিন্ন করে ফেলেন এবং সাহসের সাথে শত্রু বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে তাকবীর ধ্বনি দিতে থাকেন; অন্যদিক হতে তাঁর সঙ্গীদ্বয়ও তাকবীর ধ্বনি দিয়ে আক্রমণ করেন। হাদরাদ (রা.) এমন এক যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করলেন, যার ফলে শত্রুদের সকলে পালিয়ে যায়। এ ক্ষুদ্র মুসলিম কমান্ডো বাহিনী শত্রুদের উট, ভেড়া ও বকরীর পাল খেদিয়ে নিয়ে বিশ্বনবী সা.-এর দরবারে উপস্থিত হন। (যাদুল মাআদ ২য় খণ্ড, রহমাতুল্লি আলামিন ২য় খণ্ড ২২৯-২৩১ পৃ:)। মহানবী সা.-এর এ ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে এক সংগঠিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা থেকে মদীনা রক্ষা পায়।
৮ম হিজরীতে মুতার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল রোম সম্রাটের বিরুদ্ধে। ঐ যুদ্ধে দুই লক্ষ রোমক বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র তিন হাজার মুসলিম মুজাহিদগণ রোমক বাহিনীর আক্রমণ সাফল্যের সাথে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সিরিয়া, জর্ডান ও আরব সীমান্তে বিদ্রোহী আরব বেদুঈন ও রোম সম্রাটের বালকা অঞ্চলের গভর্নরগণের উসকানিতে মুসলিমবিদ্বেষী গোত্রসমূহ সবসময় লুটতরাজ, হত্যাসহ বিভিন্ন প্রকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকতো এবং শান্তিপ্রিয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার ষড়যন্ত্র করতো। মহানবী সা. তাঁর জীবনের শেষলগ্নে স্বীয় প্রিয়পাত্র হযরত উসামা বিন জায়েদ রা.-এর হাতে পতাকা তুলে দিয়ে ঐ এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুর্বৃত্তদের দমনের ফরমান জারি করেন। ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী ঐ এলাকায় অভিযানে বিশিষ্ট সাহাবীদেরও অংশগ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। মহানবী সা.-এর ইন্তেকাল হবার কারণে ওই অভিযান হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর খেলাফাতের সময় সর্বাগ্রে পরিচালিত হয়েছিল।
মহানবী সা. তাঁর অধিনায়কত্বে সর্বশেষ সামরিক যে অভিযানটি সংঘটিত হয়েছিল তা ছিল তাঁবুক অভিযান। রোম সম্রাটের বিরুদ্ধে এ অভিযানে তিনি স্বয়ং নিজে শেষবারের মতো সেনাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মদীনাকেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষা ও জনসাধারণের নিরাপত্তাসহ বৈদেশিক শক্তির আগ্রাসনকে প্রতিহত করার লক্ষ্যেই মহানবী সা.-এর নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। এভাবে দেখা যায় যে, আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সুরক্ষায় সদা তৎপর ছিলেন এবং এ লক্ষ্যে অসংখ্য অভিযান পরিচালনা করে দুর্বৃত্তপরায়ণ গোত্রসমূহকে দমনে সাফল্য লাভ করেছিলেন।
মহানবী সা. ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয় ও হুনায়ন যুদ্ধে হাওয়াযিন সম্প্রদায়কে পরাজিত করে রাজধানী মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন। আল্লাহর রাসূল সা. সুনিশ্চিতভাবে জানতে পারলেন যে কিছুসংখ্যক লম্পট, ডাকাত, সন্ত্রাসী জনগোষ্ঠী জিদ্দার তীরবর্তী অঞ্চলে একত্রিত হয়ে মক্কাবাসীদের ওপর ডাকাতি, লুটতরাজসহ নানা প্রকার সন্ত্রাসী অপকর্ম চালানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। মহানবী সা. আল কামাহ বিন মুজাযযির মুদলিজী রা.-এর নেতৃত্বে তিনশত মুসলিম বাহিনীকে দুর্বৃত্তদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। আলকামাহ রা. সমুদ্র উপকূলে অবতরণপূর্বক এক উপদ্বীপ পর্যন্ত অগ্রসর হন। লম্পট বাহিনী মুজাহিদদের আগমনের সংবাদ অবগত হওয়া মাত্র ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। মহানবী সা. এর তাৎক্ষণিক দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে সদ্য বিজিত মক্কা নগরী লুটতরাজ, ডাকাতিসহ মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞের করালগ্রাস হতে রক্ষা পায়। এ ঘটনা ঘটেছিল রবিউস সানী মাসে। (ফাতহুল বারী: ৫৯ পৃ:)।
আমরা বিগত কিছু দিনের ঘটনায় লক্ষ করেছি যে, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার ঐতিহাসিক বিজয়ের পর একদল সুযোগসন্ধানী ডাকাত, লুণ্ঠনকারী ও সন্ত্রাসী গ্রুপ এ বিজয়কে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে রাজধানীতে ডাকাতি, রাহাজানীসহ অনেক রকম অপকর্মে লিপ্ত হতে চেয়েছিল কিন্তু আন্দোলনকারী অতন্দ্রপ্রহরী ছাত্র-জনতা ও বিপ্লবী সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের কারণে দুর্বৃত্তরা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। আমাদের মহানবী সা.-এর কর্মকৌশলকে অনুসরণ করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন। আমীন।
লেখক : সদস্য, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, দরগাহ রোড, সিরাজগঞ্জ।