উপভোগের ইসলামী নীতি ও সম্পদ প্রবৃদ্ধি
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০০
॥ মনসুর আহমদ ॥
সব সৃষ্টিই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মুখাপেক্ষী। আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকে প্রতিপালন করেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য ব্যবস্থা করে থাকেন। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করে তার টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেছেন, আহারের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন। মানুষ সবসময় ভোগ করে আসছে। বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে খাদ্য-বস্ত্রের মতো মৌলিক বস্তুসমূহ ভোগ করার অনুমতি দিয়েছেন। ব্যবহারবিধিও তিনি মানুষকে বলে দিয়েছেন। যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ কুরআনে এসেছে চমৎকার ভাষায় ও বর্ণনা ভঙ্গিতে।
কুরআনে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষকে হালাল ও পবিত্র খাদ্য গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, ‘ইয়া আইয়্যুহান্নাসু কুলু মিম্মা ফিল আরদে হালালান তাইয়্যেবান… হে মানবজাতি! পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তুসামগ্রী ভক্ষণ বা আহার কর।’ (আল বাকারা : ১৬৮)।
‘তিনিই লতা ও বৃক্ষ-উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং খেজুর বৃক্ষ, বিভিন্ন স্বাদ-বিশিষ্ট খাদ্যশস্য জায়তুন ও দাড়িম্ব সৃষ্টি করেছেন এগুলো একে অন্যের সাদৃশ এবং বিসাদৃশও। যখন এসব ফলবান হয়, তখন তাদের ফল আহার করবে আর ফসল তুলবার দিনে অপরকে প্রদান করবে এবং অপচয় করবে না; নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন।’ (সূরা আনআম : ১৪১)।
‘আল্লাহই তোমদের জন্য আনআম সৃষ্টি করেছেন- যেন তোমরা এগুলোর কতকের ওপর আরোহণ কর এবং কতক তোমরা আহার কর।’
‘আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং তাতে উদ্গত করেছি নয়ন প্রীতিকর সর্বপ্রকার উদ্ভিদ, আল্লাহর অনুরাগী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ। আকাশ থেকে আমি বর্ষণ করি কল্যাণকর বৃষ্টি এবং তদ্বারা আমি সৃষ্টি করি উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি ও সমুন্নত খেজুর বৃক্ষ- যাতে আছে গুচ্ছ ছড়ায় খেজুর।’ (সূরা কাফ : ৭-১০)।
জন লক্ (১৬৩২-১৭০৪) মনে করেন, ‘প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে মানুষ নিজের শ্রম মিশিয়ে চূড়ান্ত উৎপাদনের মধ্যে তার নিজেরই একটা অংশ মিশিয়ে দেয়, আর এভাবেই উৎপন্ন বস্তুটা ‘তার’ হয়ে যায় ব্যহার বা ভোগের জন্য।’(১)
ইসলাম তার উৎপন্ন বস্তুতে নিজের ছাড়াও নিজের আত্মীয়-স্বজনদের পাওনা আছে বলে বিশ্বাস করে। তাই তাদেরও সম্পদের অংশীদার বানাতে উৎসাহ প্রদান করে। আল্লাহ বলেন, আত্মীয়-স্বজনদের তাদের প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। যারা অপব্যয় করে, তারা তো শয়তানেরই ভাই এবং শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ। (সূরা বনী ইসরাইল : ২৬-২৭)।
সম্পদ ব্যবহারে কৃপণতা করা যাবে না আবার এমনভাবে বিলানো উচিত হবে না- যাতে সে নিজেই পরমুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তুমি তোমার হস্ত গ্রীবায় আবদ্ধ করে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণভাবে প্রসারিত কর না, তাহলে তুমি তিরস্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে।’ (সূরা বনী ইসরইল : ২৯)।
ব্যয়ের ব্যাপারে আল্লাহ মানুষকে এক সুন্দর নীতি প্রদান করেছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘বিত্তশালী ব্যক্তি তার বিত্ত অনযুায়ী ব্যয় করবে। যে ব্যক্তি সীমিত পরিমাণে রিযিকপ্রাপ্ত, সে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তা থেকে ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যা দিয়েছেন তদপেক্ষা বেশি ব্যয় করার আদেশ কাউকে করেন না। আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দেবেন।’ (সূরা আত-তালাক : ৭)।
ইসলামের দৃষ্টিতে ভোগ-উপভোগ বলতে যা বোঝায় তা একটি নিরীহ ধারণা মাত্র। এটি কোনো সমস্যাজনক ধারণা নয়। কিন্তু ভোগ যখন তার সীমানা অতিক্রম করে ভোগবাদে রূপ নেয়, তখনই সমস্যা হয়। ভোগবাদ এখন জীবনশৈলীতে পরিণত হয়েছে, যা পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা থেকে ইসলামী অর্থব্যবস্থার ধরন আলাদা। ‘ইসলামের বিধান হচ্ছে, ধন- সম্পদ কিছুতেই গুটিকতক ধনীর মধ্যে আবর্তিত হতে দেয়া চলে না। এটি আরও বিধান দেয় যে, রাষ্ট্র যেকোনো উপায় তার সব নাগরিকের জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান করবে- তা সে উপযুক্ত কাজের সংস্থান করেই হোক বা কেউ কর্মে অক্ষম হলে তাকে সরকারি কোষাগার থেকে বৃত্তি দিয়েই হোক।’(২)
উপর্যুক্ত আয়াতসমূহে ইসলামের সম্পদ ব্যবস্থার কথাই আলোচিত হয়েছে। মুসলমানের জীবন পরিচালনা কেমন হওয়া উচিত, তা ফুঠে উঠেছে রাসূল সা. এর কথায়। রাসূল সা. এরশাদ করেন, ‘পৃথিবীতে এমনভাবে থাকো যেন তুমি একজন অপরিচিত বা মুসাফির।’ (৩)
‘রাসূলের এ কথায় একটি শক্তিশালী রূপক ফুটে উঠেছে। মানুষের জীবনকে সফরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। গন্তব্যে না পৌঁছা পর্যন্ত পথিমধ্যে অন্য কাজে অতিশয় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়াটা অনাকাক্সিক্ষত। পথিমধ্যে মুসাফির যে কাজই করবে, যা কিছু অর্জন করার চেষ্টা করবে, তা তার গন্তব্যে ভালোভাবে পৌঁছানোর জন্যই হওয়া উচিত। মূলত মানুষের উচিত এ পৃথিবীতে দায়িত্বশীল জীবনযাপন করা, যার ফল তাকে মৃত্যুর পর ভোগ করতে হবে।’… বিশ্বাসীর জন্য দুনিয়া ও এর মধ্যকার সামগ্রী তাই কখনো পরম আরাধ্য হতে পারে না। এটা তার উপকরণ মাত্র। সম্পদ তার হাতে থাকলেও কখনো হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারে না। এ পরম রুহানি সত্যকে ভুলে যারা দুনিয়ার পিছে ছুটে চলে, তাদের মধ্যে কখনোই পূর্ণতা আসবে না। ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইসলামী ধর্মতাত্ত্বিক ইবনুল কায়্যিম আল- জাওজিয়্যাহ তাঁর মাদারিজ আস-সালিকিনে দারুণভাবে ব্যাপারটি তুলে ধরেছেন- ‘মানব অন্তরে একটি শূন্যতা বিদ্যমান, যা আল্লাহকে ভালোবাসা তার দিকে প্রত্যাবর্তন, তাকে সর্বদা স্মরণ এবং তার প্রতি সত্য আন্তরিকতা ছাড়া কখনো দূর হয় না। তাকে যদি পৃথিবীর সব সম্পদ দেওয়া হয়, এরপরও এ শূন্যতা কখনো দূর হবে না।’ (৪)
সম্পদ ব্যয়ে উপরোক্ত নীতিমালা গ্রহণের সাথে সাথে সমাজের সাধারণ মানুষের আর্থিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সামান্যভাবে শুরু হয়ে উনবিংশ শতাব্দীতে অর্থনৈতিক চিন্তাধারা ক্লাসিক পুঁজিবাদী চিন্তাধারা রূপ ধারণ করে জগতে ছড়িয়ে পড়ে। এ চিন্তাধারা মতে, ‘জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য প্রথম শর্ত হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে নিরাপদ করা। কারণ যদি সম্পত্তি রাখার অধিকারকে স্বীকৃতি না দেয়া হয়, তাহলে কাজের আগ্রহ কমে যাবে আর সম্পদের উৎপাদন হ্রাস পাবে।
এ সূত্রের একটি বহুল ব্যবহৃত উদাহরণ ছিল ইংরেজদের সম্পদ আর তুর্কিদের দারিদ্র্যের মধ্যে তুলনা। উদারপন্থীদের বক্তব্য অনুসারে প্রাচীনকালে তুরস্ক রাজ্যটি ছিল পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক সম্পদশালী দেশ যাদের বড় বড় শহর, সমৃদ্ধ কৃষি, প্রচুর রফতানি আর শিল্পোৎপাদন ছিল বিশ্ববিখ্যাত। কিন্তু একসময় স্বৈরাচারী আর উচ্ছৃঙ্খল সরকার অযৌক্তিকভাবে লোকের সম্পদ কেড়ে নেয়, জুলুমবাজ কর বসায়, অর সেখানে বিচার এবং প্রশাসন ব্যবস্থায়ও ঘুষের প্রচলন হয়। এসব অনাচারের ফলে তাদের সমৃদ্ধি খতম হয়ে যায়। তারপর থেকে তুর্কিরা দারিদ্র্যে নিস্তেজ হয়ে আসে তাদের কাজ-কারবার, উৎপাদনের বা সঞ্চয়ের ইচ্ছেও নেই। কারণ তারা মনে করে ওসবের ফল দুর্নীতিপূর্ণ সরকার কেড়ে নেবে বা নষ্ট করে দেবে, যে পরিশ্রম করবে তার ভোগে আসবে না। অপরদিকে সুখী আর সম্পদশালী ইংল্যান্ডের সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কারণ সেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ব্যক্তির কর্মপ্রেরণা সুরক্ষিত থাকার ফলে যে যা সম্পদ উৎপাদন করত, তাতে তার অধিকার ছিল। বিচার আইন অনুসারে হতো, মুখ চিনে নয়। বেসরকারি পর্যায়ের চুক্তির মর্যাদা রক্ষা করা হতো এবং কারো সম্পত্তি সরকারি কাজের জন্য ন্যায়সঙ্গত ক্ষতিপূরণ ছাড়া নেওয়া হতো না। মনুষ যা উপার্জন করতে পারতো। তা সে আইন ও রুচির পরিসীমার মধ্যে থেকে যেভাবে ইচ্ছা খরচ করতে পারতো। অর্থনৈতিক উদারপন্থীদের মতে, সরকারের কর্তব্য অতি অল্প সম্পত্তিরও নিরাপত্তা দান, সুবিচারের ব্যবস্থা রাখা এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা। এ কাঠামোর মধ্যে অর্থনীতি কোনোরকম বাহ্যিক সহায়তা বা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কাজ করবে। ব্যক্তির কর্মপ্রেরণা জাতীয় সম্পদ গড়ে তুলবে।’ (৫)
তথ্যসূত্র:
১. ড্যানিয়েল ফাসফেল্ড-অর্থনীতিবিদদের ভূমিকা।
২. ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্ম -অনুবাদকের আরজ: মুহাম্মদ হাসান রহমতী।
৩. বোখারী, হাদিস নং-৬৪১৬।
৪. শিহান বিন ওমর-ভোগবাদ ও নব্য-উপনিবেশবাদের অভিঘাত: খালদুনের প্রাসঙ্গিকতা : (ইবনুল কায়্যিম আল- জাওজিয়্যাহ, মাদারিজ আস সালেকীন। (৩ : ১৫৬)।
৫. ড্যানিয়েল ফাসফেল্ড-অর্থনীতিবিদদের ভূমিকা।