শহীদ আসলাম হুসাইন একটি নাম একটি ইতিহাস
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০০
॥ ইকবাল হোসাইন ॥
ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে ৬ কি.মি. দক্ষিণে ঢাকা-যশোর মহাসড়ক থেকে ২ কি.মি. পূর্বে নিরিবিলি, ছায়াঘেরা পরিবেশে, যেখানে বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাস বয়, ঝরা মুকুলের গন্ধ ভেসে আসে, আজানের সুর কিছুটা বিলম্বিত হয়ে সবাইকে মুখরিত করে, প্রকৃতির ওপর বাতাস ছড়িয়ে দেয় হালকা নীল নীল কুয়াশা, পাখিরা একটু আগবাড়িয়ে নীড়ে ফিরে আসে, যেন একখণ্ড নীরবতা সর্বদা ভর করে থাকে- এমন একটি শান্ত, মনোরম স্থান বুজিডাঙ্গা মুন্দিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক শান্ত-সুন্দর যুবক। কে জানত এই সে একদিন ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবে। যাকে নিয়ে আলোচনা চলছেই এবং আগামীতেও তা চলতে থাকবে, এ আলোচনা যেন শেষ হবার নয়। আর তিনিই হলেন সবার একান্ত প্রিয় শহীদ আসলাম হুসাইন। আসলাম হুসাইনের পিতার নাম ডা. জিন্নাত আলী। ৪ ভাই যথাক্রমে আসলাম হোসাইন, আব্দুস সালাম, আব্দুর রহমান, আব্দুস সবুর, আর বোন যথাক্রমে লতিফুন্নেচ্ছা, হায়াতুন্নেচ্ছা, খুরশিদা বেগম, রশিদা বেগম, শিউলি বেগম ও জোছনা বেগম। ভায়েরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে চাকরি ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাঠে চাষযোগ্য ১৬ বিঘা জমি এবং ১০ শতক জমির ওপর একটি বাড়ি রয়েছে তাদের গ্রামে, অবশ্য গ্রামের বাড়িতে এখন আর তেমন কেউ বসবাস করেন না, মেজো ভাই মাওলানা আব্দুস সালাম মাঝে মাঝে গ্রামে গিয়ে বসবাস করেন।
শহীদ আসলাম হুসাইনের পিতা ডা. জিন্নাত আলী সমাজসেবক হিসেবে এলাকায় বেশ সমাদৃত ছিলেন। জনসেবার অংশ হিসেবে ১৯৫৫ সালে তিনি পরপর তিনবার রায়গ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর পদে নির্বাচিত হন এবং সে সময় তিনি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণসহ বহু উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। জনসেবা ও চিকিৎসা পেশার পাশাপাশি তিনি একজন আদর্শ কৃষকও ছিলেন। ১৯৬০ সালে তিনি যশোর কৃষিক্লাব থেকে প্রথম কৃষি পুরস্কার লাভ করেন। দাতা হিসেবেও এলাকায় তার পরিচিতি রয়েছে। তিনি বুজিডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য ২ বিঘা ও কেয়াবাগান কলেজের জন্য ১ বিঘা জমি দান করেছেন। বুজিডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তার অবদান রয়েছে। তবে বড় ছেলে আসলাম হুসাইন শহীদ হলে বুকে একটা বড় ধাক্কা খান পিতা ডাক্তার জিন্নাত আলী। কোনো সমাবেশে বক্তব্য দিতে গেলে আসলাম হুসাইনের নাম উচ্চারণের সাথে সাথে ডুকরে কেঁদে উঠতেন তিনি। নিজেকে সামলে নিয়ে বলতেন, আমি এক আসলামকে হারিয়ে হাজারো আসলামকে আমার সামনে পেয়েছি। তোমাদের দ্বারা যেদিন এদেশে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, সেদিনই আমার আসলাম হুসাইনের আত্মত্যাগ সার্থক হবে। তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পিতা জিন্নাত আলীর বুকের সে ক্ষত আর সেরে ওঠেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইসলামের খেদমতে একজন নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি। ২০২১ সালের ৭ জুলাই ৯০ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আসলাম হুসাইন ১৯৬১ সালের ২ ফেব্রয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ব ও খনিজবিদ্যা বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ধারণা করতেন , তিনি এতটাই মেধাবী ছিলেন যে, শিক্ষাজীবন শেষে তিনি একজন গবেষক বা বিঞ্জানী হতে পারতেন। অত্যন্ত সমৃদ্ধ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তিনি, থাকতেন নবাব আব্দুল লতিফ হলের ৩২৯ নং কক্ষে। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্য ছিলেন এবং ওই একই হলের সভাপতির দায়িক্ত পালন করতেন। পোস্টার ছেড়াকে কেন্দ্র করে ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে কিছুটা কথা কাটাকাটি হয় এবং একটু উত্তেজনাও দেখা দেয়। রাতের খাবার শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। ১৯৮৮ সালের ১৭ নভেম্বর হঠাৎ রাত সাড়ে ১২টার দিকে সংগ্রাম পরিষদের দুর্বৃত্তরা আসলাম হুসাইনের কক্ষের দরজা ভেঙে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তার রুমে প্রবেশ করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে শহীদ করে। তার লাশও গুম করার চেষ্টা করা হচ্ছিল আর হলের সামনে অবস্থানরত পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যময়। নবাব আব্দুল লতিফ হলের ইসলামী ছাত্রশিবিরের দায়িত্বে থাকা মেধাবী ছাত্র সবার প্রিয় আসলাম হুসাইন শাহাদাতবরণ করলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এবং তার জন্মস্থান ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে নেমে আসে শোকের ছায়া। পরদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি আব্দুল লতিফের নেতত্বে কালীগঞ্জ সরকারি নলডাঙ্গা ভূষণ হাইস্কুল মাঠে বিরাট জানাযা শেষে তাকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। তবে মাসাধিকাল যেন আসলাম হুসাইন ছাড়া কালীগঞ্জে বা তার আশপাশে আর কোনো আলোচনা ছিল না। আসলাম হুসাইন ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের একজন অকুতোভয় সৈনিক। ছাত্রদের চরিত্র গঠন ও দাওয়াতি কাজকে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। তার বাল্যবন্ধু মাওলানা আব্দুর রহমান জানান, কলেজে অধ্যয়নকালে আমরা তাকে নিয়ে এত গল্প শুনেছি যে, তাকে একনজর দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়তাম। সে রাজশাহী থেকে বাড়িতে বেড়াতে এলে অনেকেই তাকে একনজর দেখার জন্য তার গ্রামের বাড়ি বুজিডাঙ্গা মুন্দিয়া গ্রামে ছুটে যেতেন। তার বাড়ি থেকে জানানো হতো তিনি দাওয়াতি কাজে বের হয়ে গেছেন। দাওয়াতি কাজের জন্য তার মধ্যে সবসময় ব্যাকুলতা কাজ করতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি পাঞ্জাবি-টুপি ব্যবহার করতেন। সর্বদা সুন্নতের পোশাকে ঢাকা দেখে বোঝার উপায় নেই, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সর্বদা জোর কদমে হাঁটতেন আর বলতেন আমার ছুটি শেষ হয়ে এলো। কিন্তু টার্গেট অনুযায়ী এখনো দাওয়াতি কাজ শেষ করতে পারিনি। সেবার রাজশাহী থেকে ছুটিতে বাড়িতে এলে মায়ের নাড়িতে যেন কেমন টান লেগেছিল, শহীদ হবার পূর্বে, শেষবার যখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন মা কিছুটা বাধ সেধেছিল। মা বলেছিলেন, শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ভালো নয় আরো কিছুদিন বাড়িতে থেকে যাও বাবা। তিনি বলিছেলেন, মা আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে না গেলে আমার কর্মীরা হয়তো ভাববে আমি নিরাপদে থাকার জন্য বাড়িতে অবস্থান করছি। ছেলের বিদায়লগ্নে মা সেদিন ছেলের পিছু পিছু হেঁটে অনেকটা রাস্তা এগিয়ে দিয়েছিলেন। মাকে সান্ত্বনা দিয়ে আসলাম হুসাইন বলেছিলেন, বাড়িতে ফিরে যাও মা, চিন্তা করো না, আমার কোনো ক্ষতি হলে বা আমি যদি আল্লাহর দীনের পথে থেকে ইসলামী আন্দোলনের জন্য কখনো শহীদ হয়ে যাই, তাহলে অচিরেই তোমার সাথে আমার জান্নাতের সিঁড়িতে দেখা হবে। মায়ের সাথে শহীদ আসলাম হুসাইনের এটাই ছিল শেষ কথা। ছেলে রাজশাহী থেকে আবার বাড়িতে এসেছিলেন, কিন্তু লাশ হয়ে। তাই মায়ের বুকে জমে থাকা সেই কথাগুলো আর বলা হয়ে ওঠেনি।
এ বছর আসলাম হুসাইনের শাহাদাতবার্ষিকীতে উপজেলা জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে তার অংশ হিসেবে শহীদ আসলাম হুসাইনের নামে তার গ্রামের বাড়িতে একটি ইসলামী পাঠাগার নির্মাণ করা হয়েছে। সেটা ৭ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধরন করা হয়। এ সময় কালীগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা ওলিউর রহমান, নায়েবে আমীর মাওলানা আবু তালিব, সেক্রেটারি মাওলানা মতিউর রহমান, শহীদ আসলাম হুসাইনের ঘনিষ্ঠ মাওলানা আব্দুর রহমান ও আব্দুল হক মোল্যা এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঈসা খান ও গোলাম মোর্ত্তজা উপস্থিত ছিলেন। আমরা শহীদ আসলাম হুসাইনের ৩৬তম শাহাদাতবার্ষিকীতে তার রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক : সাংবাদিক ও সভাপতি, উপজেলা নজরুল সাহিত্য পরিষদ, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।