অনৈক্যের ঝড় নয় : প্রয়োজন নয়া সংবিধান প্রণয়ন


২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০০

॥ জামশেদ মেহ্দী ॥
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে গত ১৭ নভেম্বর রোববার সন্ধ্যা ৭টায় জাতির উদ্দেশে রেডিও ও টেলিভিশনে ভাষণ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নাতিদীর্ঘ এ ভাষণে তিনি অনেক কথা বলেছেন। কিছু লোক উৎকর্ণ ছিলেন এ বিষয়টি শুনতে- নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় বা মাস বা তারিখ তিনি উল্লেখ করেন কিনা। ড. ইউনূস স্পষ্ট করে বলেছেন যে, নির্বাচনের ট্রেন রেললাইনে অলরেডি উঠেছে এবং যাত্রা শুরু করেছে। তবে এখনো সম্পূর্ণ রেললাইন বসানো হয়নি। অনেকগুলো স্টেশনে তাকে থামতে হবে। থামার পর চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছাবে। চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছার আগে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে ঐকমত্য থাকতে হবে।
ঐদিকে ১ বা ২ দিন আগে তিনি যখন আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে ছিলেন, তখন তিনি আল-জাজিরাকে একটি ইন্টারভিউ দিয়েছেন। ঐ ইন্টারভিউয়ে তিনি নতুন কিছু কথা বলেছেন। যেমন- ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ ৪ বছর হতে পারে। আল-জাজিরার প্রতিনিধির এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাই বলে তার ইন্টারিম সরকারের মেয়াদ চার বছর হবে না। এটি চার বছরের কম হবে। কত কম হবে, সেটি নির্ভর করবে যেসব সংস্কার কাজে তারা হাতে নিয়েছেন, সেসব সংস্কার কত দ্রুত সম্পন্ন করা যায়। এ পর্যায়ে তিনি এ-ও বলেছেন যে, যদি রাজনৈতিক দলসমূহ কোনো সংস্কার না চায়, তাহলে অবিলম্বে তিনি নির্বাচন দিয়ে সরে যাবেন। এমন একটি পরিস্থিতিতে কতগুলো জ¦লন্ত প্রশ্নের উদয় হয়। এগুলোর সন্তোষজনক জবাব না পেলে ভবিষ্যতে আমাদের রাজনীতি কোনদিকে যাচ্ছে সে সম্পর্কে ধারণা পেতে অসুবিধা হবে।
ড. ইউনূস সরকার সংস্কারের জন্য ১০টি কমিশন গঠন করেছে। ১০টির মধ্যে ৯টি কমিশন নিয়ে মানুষের খুব একটা আগ্রহ নেই। মানুষের আগ্রহ একটি কমিশনকে নিয়ে। সেটি হলো নির্বাচন সংস্কার কমিশন। সেই শুরু থেকেই মানুষের মনে প্রশ্নÑ যে সংবিধানটি এখনো বহাল রয়েছে, সেটি সংস্কার করা হবে? নাকি সেটি বাদ দিয়ে নতুন একটি সংবিধান রচনা করা হবে? সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ স্পষ্ট বলেছেন, বর্তমান সংবিধান সংশোধন করার কোনো সুযোগ নেই। দেশকে একটি ভালো সংবিধান উপহার দিতে হলে সংবিধানের পুনর্লিখন প্রয়োজন হবে। দেখা যাচ্ছে, এ পয়েন্টে দেশে সুস্পষ্টভাবে দুটি ভাগ রয়েছে। একদল চান বর্তমান সংবিধানেই সংশোধন আনা হোক। বিএনপি তো বলছে, সংবিধানে ব্যাপক সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যতটুকু সংশোধনী দরকার ততটুকুই করা হোক।
একটু আগেই বলেছি, মানুষের প্রত্যাশা হলো একটি ভালো সংবিধান। ভালো সংবিধানের সংজ্ঞা কী? সংবিধান নিয়ে যেসব আলোচনা হচ্ছে, তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট উঠে এসেছে। সেটি হলো, সেটিই সবচেয়ে ভালো সংবিধান, যেটি জনগণের অভিপ্রায় বা আকাক্সক্ষা ধারণ করে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের নায়করা; বিশেষ করে ছাত্ররা, রাখঢাক না করে বলছেন, ঐ বিপ্লবে ১ হাজার ৬০০ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন এবং ২৬ হাজার মানুষ গুরুতর আহত হয়েছেন এজন্য নয় যে আওয়ামী লীগ বিদায় হয়ে অন্য একটি দল ক্ষমতায় আসবে। ক্ষমতার পালাবদলের জন্য এত বড় বিপ্লব হয়নি। এ বিপুল রক্তপাত হয়েছে এ কারণে যে, তাদের ভাষায় দেশের অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে ‘নতুন বন্দোবস্ত’ আসুক।
তাই তারা বলতে চান, বর্তমানে যে সংবিধানটি বহাল আছে, সেটি ১৯৭২ সালের সংবিধান। ১৭টি সংশোধনীর পর সেটির আঙ্গিকে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে মাত্র। কিন্তু মূল স্পিরিট অক্ষত রয়েছে। এ সংবিধানটি একটি পক্ষের বা একটি রাজনৈতিক দলের এজেন্ডাকে ধারণ করে। ১৭ কোটি মানুষের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে না। কারণ এ সংবিধান আওয়ামী লীগের ৬ দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতার চূড়ান্ত ফসল। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৭০ সালে সারা পাকিস্তানভিত্তিক নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মূল সুরই ছিল ৬ দফা বাস্তবায়ন। নির্বাচনের পর জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি ৬ দফাকে পুরোপুরি মেনে নিতে পারেনি। পক্ষান্তরে শেখ মুজিব ৬ দফা থেকে কোনো দাঁড়ি কমাও বাদ দিতে রাজি ছিলেন না। চূড়ান্ত পরিণামে পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন হয় এবং বাংলাদেশ নাম ধারণ করে। এসব কথা সকলেই জানেন।
কিন্তু যেটি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলোÑ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যারা জনপ্রতিনিধি হয়েছিলেন, তারা জনপ্রতিনিধি হন সমগ্র পাকিস্তানের জন্য একটি শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে। যারা পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের নিয়েই বাংলাদেশের সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠন করা হয়। এটি ছিল আইনি বা সাংবিধানিক সবচেয়ে বড় ত্রুটি।
সংবিধান রচনার জন্য আলাদাভাবে গণপরিষদ গঠন করতে হয়। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হন, তাদের মধ্যে মুসলিমপ্রধান অঞ্চলের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। এর মধ্যে ভারত বিভক্ত হওয়ার পর ঐ গণপরিষদ পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার কাজে ব্যাপৃত থাকলেও তারা দেশটি শাসনের জন্য পার্লামেন্ট হিসেবেও কাজ করে। অনুরূপভাবে ভারতেও ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ভিত্তিতে গণপরিষদ গঠিত হয়। এ গণপরিষদ ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের সংবিধান কমিটি গঠন করে। প্রায় ৩ বছর পর সংবিধান কমিটি খসড়া সংবিধান পেশ করলে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। অতঃপর ঐ সংবিধান মোতাবেক ১৯৫১ এবং ১৯৫২ সালে দুই পর্বে ভারতে লোকসভা তথা পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানেও ঐ গণপরিষদ ৯ বছর কাজ করার পর ১৯৫৬ সালে শাসনতন্ত্র পাস করে। অতঃপর ঐ শাসনতন্ত্র মোতাবেক ১৯৫৮ সালে পার্লামেন্ট গঠনের জন্য সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়। কিন্তু জেনারেল আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করেন এবং শাসনতন্ত্র বাতিল করেন। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো গণপরিষদ গঠিত হয়নি। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য গঠিত গণপরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যরা স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদ হিসেবে বিবেচিত হন। এটি ছিল সংবিধান এবং আইনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রথম গলদ। এ গণপরিষদ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান পাস করে। ফলে এটি শুধু আওয়ামী ঘরানার লোকজনের অভিপ্রায় বা আকাক্সক্ষা ধারণ করে, অবশিষ্ট জনগোষ্ঠীর অভিপ্রায় বা আকাক্সক্ষা ধারণ করেনি।
২১ দফা, ৬ দফা বা ১৯৭০-এর আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো, ইয়াহিয়ার কাছে পেশকৃত শেখ মুজিবের সাংবিধানিক খসড়া এবং মুজিবনগরে ১০ এপ্রিল গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতা বা ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করার অঙ্গীকার ছিল না। ঐতিহাসিক ২১ দফা কর্মসূচির মূলনীতি হিসেবে বিধৃত ছিল নিম্নোক্ত লাইনসমূহ, ‘কুরআন ও সুন্নার মৌলিক নীতির খেলাফ কোনো আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।’ ২১টি দফার একটি দফায়ও সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো দফা ছিল না। অথচ তারপরও ৭২-এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এগুলো তো জনগণের আকাক্সক্ষা বা অভিপ্রায়ের বিপরীত।
এ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে সব দল বিলোপ করে একটিমাত্র দল রাখা হয়, যার নাম বাকশাল। তার স্লোগান ছিল, ‘এক নেতা এক দেশ/বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। জাতীয় সংসদের মেয়াদ ৫ বছরের জায়গায় ৭ বছরে বৃদ্ধি করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে আজীবন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়। এসব মৌলিক এবং বিশাল পদক্ষেপের জন্য জনগণের কোনো ম্যান্ডেট ছিল না। সুতরাং শেখ হাসিনাই প্রথম ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করেননি। স্বৈরাচার প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এখন আসছি বর্তমান সংবিধানের সংশোধন অথবা নতুন সংবিধান রচনার প্রশ্নে।
গত ১৬ নভেম্বর শনিবার এক আলোচনা সভায় অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, সংবিধান এখনো বহাল রয়েছে। এ সরকার আদতেই সংবিধান সংশোধন করতে পারবে কিনা, সেটা ভেবে দেখতে হবে। কারণ বর্তমান সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ ছাড়াও ৭ (ক) ও (খ) এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে এ সংবিধানের সংশোধনীর ক্ষমতা ভবিষ্যৎ পার্লামেন্টের নিকট থেকে স্থায়ীভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। কারণ ঐ দুটি অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে, তার ফলে সংবিধানের ৫০টির বেশি অনুচ্ছেদ চিরদিনের জন্য সংশোধনের ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো অসাংবিধানিক পন্থায় ঐসব অনুচ্ছেদ স্থগিত, রদ বা বাতিল করলে সেটা হবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ এবং সেজন্য নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ সাজা, অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড। অ্যাটর্নি জেনারেলের মন্তব্য, (৯৩ অনুচ্ছেদ) এবং ৭ (ক) ও (খ) অনুচ্ছেদের পর এ সংবিধানের কোন জায়গাটিতে হাত দেওয়া সম্ভব?
ড. ইউনূস বহুবার ঐকমত্যের কথা বলেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের মূলনীতি অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে কি কোনো ঐকমত্য হতে পারে? পঞ্চদশ সংশোধনীতে শেখ মুজিবকে জাতির পিতা এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন- এসব পয়েন্টে কি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব?
এ ধরনের মৌলিক বিষয় নিয়ে অখণ্ড পাকিস্তানে শাসতন্ত্র প্রণয়নে লেগেছিল ৯ বছর। বাংলাদেশে সেই মৌলিক প্রশ্নগুলোতেই শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা এ ৫৩ বছরেও একমত হতে পারেননি। ড. ইউনূসের কথা মোতাবেক আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাসের মধ্যে কি কোনো অলৌকিক কাণ্ডের ফলে ঐসব মৌলিক প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে? অভিজ্ঞতা বলে, সেটি হবে না।
তাই দেশে নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন নয়া সংবিধান প্রণয়ন। এক কথায় এর একমাত্র সমাধান নতুন সংবিধান। সেই ম্যান্ডেট ইউনূস সরকারের আছে। কারণ কয়েকজন উচ্ছিষ্টভোগী আওয়ামী লুটেরা এবং মাফিয়া ছাড়া অবশিষ্ট ১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব ড. ইউনূসকে সরকারপ্রধান নির্বাচন করেছেন। বর্তমান সংবিধান অনুসরণ করে হাসিনার ফ্যাসিবাদকেও হটানো হয়নি এবং ইন্টারিম সরকারও গঠন করা হয়নি। উভয় কাজই করা হয়েছে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা এবং ইচ্ছা অনুসারে। এ সার্বভৌম ক্ষমতা এবং ইচ্ছার অধীন হলো সংবিধান, সংবিধানের অধীন মানুষের ইচ্ছা এবং সার্বভৌম ক্ষমতা নয়।