অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন : সাফল্য ব্যর্থতা প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ


২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০০

॥ ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া ॥
বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্রটি পরিচালিত হচ্ছে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে। একটি সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এ অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে এ অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তথা সর্বস্তরের ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক-জনতার সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সমর্থনের প্রেক্ষিতেই আগস্ট মাসে এ গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটেছে, গঠিত হয় জনগণের একটি সরকার। গণসমর্থিত এ সরকারের প্রতি সাধারণ জনগণের প্রত্যাশাও বেশি। বুকভরা আশা নিয়ে জনগণ অপেক্ষা করছে দেশ ও জনগণের মুক্তির আকাক্সক্ষায়। এ সরকারের কাছে জনগণের স্বল্পমেয়াদের প্রত্যাশা হচ্ছে- দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সরকার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান, বাজারের সিন্ডিকেট ভেঙে নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ জনগণের নাগালের মধ্যে আনা, ভেজালমুক্ত খাদ্য ও চাঁদাবাজমুক্ত একটি দেশ। শিল্পকারখানায় স্বাভাবিক উৎপাদন অব্যাহত রাখা; সর্বোপরি একটি স্থিতিশীল দেশ গঠন। একশত দিন পর গণপ্রত্যাশার কতটুকু পূরণ করতে পেরেছেন, তার হিসাব মেলাচ্ছেন জনগণ। অপরদিকে দেশের পত্রপত্রিকাগুলোও ড. ইউনূসের ১০০ দিনের সরকারের খতিয়ানের চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যমণি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণে তার সরকারের ১০০ দিনের সরকার কী কী কাজ করেছে এবং আগামী দিনে কী কী করবে তার একটি নাতিদীর্ঘ বিবরণ তুলে ধরেছেন।
বিগত একশত দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের যেমন কিছু সাফল্য আছে, তেমনি অনেক ব্যর্থতাও আছে। তবে এ ১০০ দিনেও অন্তর্বর্তী সরকারের বেশ কয়েক ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। যেমন রেমিট্যান্সপ্রবাহ বৃদ্ধি, রফতানি বৃদ্ধি, সন্তোষজনক রিজার্ভ, রাজনীতিতেও একটি সহনশীল পরিবেশ; সর্বোপরি দেশে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও রয়েছে যেমন- নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, হয়নি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কাক্সিক্ষত উন্নয়ন, রাজধানীসহ শহরগুলোর যানজট, ফুটপাত দখল ও চাঁদাবাজি অব্যাহত রয়েছে। তাই এ সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনীতি থেকে শুরু করে অর্থনীতি, প্রশাসন ও পুলিশসহ সর্বস্তরের অনৈতিকতা ও দুর্নীতি বন্ধ করে রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাওয়া।
সাধারণত প্রতিটি দেশেই যখন নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন ১০০ দিনে কর্মসূচি নিয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ১০০ দিনের কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেনি।
এর কারণ হলো এটি কোনো স্বাভাবিক সরকার নয়। যারা আজ সরকারের দায়িত্বে আছেন, তারা গত আগস্ট মাসের ১ তারিখও ভাবেননি যে, তাদের ৮ আগস্ট বাংলাদেশের সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। এক অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে ৫ আগস্ট ১৬ বছরের এক ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটে এবং ৮ আগস্ট দেশের ছাত্র-জনতার পক্ষে তাদের ক্ষমতা গ্রহণ করতে হয়। তাই তাদের পক্ষে ৮ আগস্ট ১০০ দিনের কোনো কর্মসূচি দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে সরকার বিগত ১০০ দিনে দেশ ও জাতির জন্য কী করেছে, প্রধান উপদেষ্টা গত ১৭ নভেম্বর এক ভাষণে তার কিছু বিবরণ তুলে ধরেছেন।
গণপ্রত্যাশা
জনগণ বিগত পাঁচ-ছয় দশক ধরে রাজনীতিকদের থেকে অনেক প্রতিশ্রুতি শুনেছেন। রাজনীতিকরা জনগণকে বলেছেন, আমরা তোমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র দেব, তোমাদের সব অধিকার প্রতিষ্ঠা করব, তোমাদের খাদ্যবস্ত্রের কোনো অভাব হবে না। কিন্তু জনগণ তাদের প্রত্যাশিত সেই রাষ্ট্রও পায়নি, তাদের অধিকারও ফিরে পায়নি। রাজনীতিকদের ওয়াদার প্রেক্ষিতে জনগণের মধ্যে অনেক প্রত্যাশা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি হতাশাও তৈরি হয়েছে। রাজনীতিকরা বলেছেন, আমাদের ভোট দাও আমরা তোমাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। জনগণ তাদের ভোট দিয়েছে। রাজনীতিকরা বলছেন, জানমাল দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করো তোমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি মিলবে। জনগণ জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি মেলেনি। রাজনীতিকরা জনগণের বাকস্বাধীনতা দেবে, ভোটাধিকার দেবে, আরো অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর জনগণ তা বিশ্বাস করে তাদের প্রত্যাশা পূরণের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, কিন্তু তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। জনগণের মুক্তির ব্যাপারে অনেক ওয়াদা করেছেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাজনীতিকরা। জনগণও তাদের জানমাল দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, রক্ত দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন, কিন্তু তাদের সেই কাক্সিক্ষত মুক্তি ও স্বাধীনতা পাননি। বরং বার বার জনগণ প্রতারিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সবার দ্বারাই জনগণ বঞ্চিত হয়েছেন।
এবার অবশ্য যারা ক্ষমতায় এসেছে বা যারা দায়িত্ব নিয়েছে, তারা অবশ্য এভাবে জনসম্মুখে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা করেননি। বিগত সরকারগুলোর সাথে এখানে তাদের মৌলিক পার্থক্য। এক আকস্মিক গণঅভ্যুত্থানে একটি ফ্যাসিস্টের পতনের পর জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তারা রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। অনেক রক্ত ও জানের বিনিময়ে ফ্যাসিস্টের পতনের পর যারা রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন তাদের প্রতি জনগণের প্রত্যাশাটি একটু বেশিই মনে হচ্ছে। কারণ এখন যারা দায়িত্বে আছেন, তারা কিন্তু সিজনস পলিটিশিয়ান তথা জাত রাজনীতিক নন। তারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ, তারা রাজনীতি করে বা প্রত্যক্ষ আন্দোলন করে ক্ষমতায় আসেননি। তবে তারা রাজনীতিবিদের যে দায়িত্ব, সেই দায়িত্বটাই কাঁধে তুলে নিয়েছেন। বিগত পাঁচ দশকের রাজনীতিকদের ভুলের কারণে দেশটা যে ধ্বংসের মুখে নিপতিত হয়েছে তা থেকে জনগণ উত্তরণ চায়। আর এ উত্তরণ তথা মুক্তির পথটা প্রস্তুত করার কাজটির প্রত্যাশা করছে তাদেরই কাছে, যারা আজকে রাষ্ট্রের শাসনভার কাঁধে তুলে নিয়েছেন। বর্তমানে সরকারের যারা দায়িত্বে আছেন তাদের কাছে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশাটা অনেক বেশি। জনগণের বিশ্বাস যে, তারা দেশ ও জাতিকে মুক্তির জন্য যথাযথ সংস্কার করে দেশটিকে রাইট ট্রাকে তথা সঠিক পথে তুলে দিতে পারবেন।
স্বল্পমেয়াদে সাফল্য
বর্তমান সরকারের বড় সাফল্য হচ্ছে দেশ স্থিতিশীল। আর স্থিতিশীলতার মূল ফ্যাক্টর হচ্ছে দেশের সর্বস্তরের জনগণ বর্তমান সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। দেশের সাধারণ জনগণ; বিশেষ করে তৃণমূলের সাধারণ মানুষ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। তারপরও সরকারকে মনেপ্রাণে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। অর্থনীতির ক্ষেত্রে সাফল্য হচ্ছে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ৪০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্সের এ প্রবাহ আগের মাসের তুলনায় ৮ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশিরা মোট ৬ হাজার ৫৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। গত অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪ হাজার ৯০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। রফতানি খাতেও বিগত কয়েক মাসে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের রফতানি আয় ২০ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেড়ে ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে এটি ছিল ৩ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। গত ১০ নভেম্বর বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এ তথ্য প্রকাশ করেছে। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরের মধ্যে রফতানি ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ বেড়ে ১৫ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৪ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। এ সরকারের এ সফলতাকে স্বল্পমেয়াদে কিঞ্চিত সাফল্য বলা যেতে পারে। তবে সফলতার একটি বড় কাজ হয়েছে, সেটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে ফ্যাসিস্টদের বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে।
অনিচ্ছাকৃত ব্যর্থতা
এ ১০০ দিনে যেমন কিছুটা সাফল্য আছে, তেমনি ব্যর্থতাও আছে। যেমন প্রাথমিক পর্যায়ের ব্যর্থতা হচ্ছে হাসিনার দুর্নীতি চিহ্নিত ও উদ্ঘাটন না হওয়া, ফ্যাসিস্টদের তালিকা করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারা, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, আলু, ব্রয়লার মুরগি ইত্যাদির দাম কমানে না পারা। এছাড়া রাজস্ব আদায়ে শ্লথগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে না পারা, দেশব্যাপী দখল আধিপত্য ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসরদের চিহ্নিত করতে বিলম্ব হওয়া। সরকারি অফিসগুলোয় আগের মতোই ঘুষ লেনদেন হচ্ছে, যদিও তার প্রমাণ দেয়া যাবে না। কারণ যারা বিভিন্ন কাজের জন্য বাধ্য হয়ে সরকারের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেন, যারা তারা ব্যক্তিগতভাবে বললেও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করতে চান না আর যারা গ্রহণ করেন, তাদের তো স্বীকার করার প্রশ্নই আসে না। তাই সরকারি অফিসগুলোর ঘুষ দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া কঠিন। অপরদিকে প্রশাসনে রুটিন কাজ ছাড়া বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে না। বরং একটি নীরব অস্থিরতা চলছে।
বিশাল চ্যালেঞ্জ
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মূল দায়িত্বটা হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কার থেকে শুরু করে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, আইন ও বিচার বিভাগ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার করে দেশে একটি সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা। একটি সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির পর একটি নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। এককথায় একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
এদিকে অন্তর্র্বর্তী সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) গত ১৪ নভেম্বর ‘আ নিউ এরা ইন বাংলাদেশ? দ্য ফার্স্ট হানড্রেড ডেজ অব রিফর্ম’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আইসিজি ঐ প্রতিবেদনে বলেছে, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেক্টরে যে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা খুব সহজ নয়। জনগণের আকাশচুম্বী প্রত্যাশাই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে দাবি করছে সংস্থাটি।
এদিকে অন্তর্র্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে গত ১৭ নভেম্বর রোববার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস দেশের গুরুত্বপুর্ণ কয়েকটি বিষয় সম্পাদনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অত্যাবশ্যকীয় কিছু সংস্কার কাজ শেষ করেই কাক্সিক্ষত নির্বাচন আয়োজন করা হবে ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, জুলাই-আগস্টে বিপ্লব চলাকালে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-শ্রমিক-জনতার শহীদি মৃত্যু হয়। এ বিপ্লবে আহত হয়েছেন ১৯ হাজার ৯৩১ জন। আহত ব্যক্তিদের জন্য ঢাকার ১৩টি হাসপাতালসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিদিনই তালিকায় আরও নতুন নতুন শহীদের তথ্য যোগ হচ্ছে, যারা স্বৈরাচারের আক্রোশের শিকার হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি হত্যার বিচার আমরা করবই। জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচারের যে উদ্যোগ আমরা নিয়েছি, তার কাজও বেশ ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকেও আমরা ভারত থেকে ফেরত চাইব।’
শুধু জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডই নয়, গত ১৫ বছরে সব অপকর্মের বিচার করা হবে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, অসংখ্য মানুষ গুম হয়েছে, খুন হয়েছে এ সময়ে। গুমের তদন্তে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনপ্রধান তাকে জানিয়েছেন, অক্টোবর পর্যন্ত তারা ১ হাজার ৬০০ গুমের তথ্য পেয়েছেন। তাদের ধারণা, এ সংখ্যা ৩ হাজার ৫০০ ছাড়িয়ে যাবে। অনেকেই কমিশনের কাছে গুমের অভিযোগ করতে ভয় পাচ্ছেন এই ভেবে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা তারা আবার আক্রান্ত হতে পারেন, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে কমিশনকে অভিযোগ জানানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘কারো সাধ্য নেই আপনাদের গায়ে আবার হাত দেয়।’
কেবল দেশে নয়, গুম-খুন ও জুলাই-আগস্ট গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের আন্তর্জাতিক আদালতেও বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের প্রধান কৌঁসুলি করিম খানের সঙ্গে তার ইতোমধ্যে কথা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার মতে, নির্বাচন আয়োজনে যে সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় রাজনৈতিক দল এবং দেশের সব মানুষের মতামত অপরিহার্য, সেটি হচ্ছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এ কমিশনের সুপারিশমালার যে অংশ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, তার ভিত্তিতে নির্বাচনী আইন সংশোধন করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত নই, সংস্কার প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নের সুযোগ আমরা কতটুকু পাব। তবে কথা দিচ্ছি, আপনারা সুযোগ দিলে প্রয়োজনীয় কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার কাজ শেষ করেই আমরা কাক্সিক্ষত নির্বাচন আয়োজন করব। ততদিন পর্যন্ত আমি আপনাদের ধৈর্য ধরার অনুরোধ করব।
‘আমরা এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে চাই, যা যুগ যুগ ধরে অনুসরণ করা হবে। এর ফলে সাংবার্ষিক রাজনৈতিক সংকট থেকে আমাদের দেশ রক্ষা পাবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকু আমি আপনাদের কাছে চেয়ে নিচ্ছি। নির্বাচনী সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে খুব দ্রুত আপনারা নির্বাচনের রোডম্যাপ পেয়ে যাবেন।’
এ সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য, অকার্যকর করার জন্য বিশাল অর্থে বিশ্বব্যাপী এবং দেশের প্রতিটি স্থানে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এক মহাপরিকল্পনা প্রতি মুহূর্তে কার্যকর রয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের একটি বড় চেষ্টা হচ্ছে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। পতিত সরকারের নেতারা, যারা এ দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে নিয়ে গেছে, সে অর্থে বলীয়ান হয়ে তারা দেশে ফিরে আসার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের কিছুতেই সফল হতে দেবেন না। তারা সফল হওয়া মানে জাতির মৃত্যু। সাবধান থাকুন। তাদের সব হীন চেষ্টাকে আমাদের ঐক্যের মাধ্যমে নস্যাৎ করে দিন। যেভাবে নস্যাৎ করেছিলেন তাদের বন্দুকের গুলিকে। তাদের আয়নাঘরকে। প্রতি পায়ে তাদের অনাচারের শিকলকে। এ ব্যাপারে সবাই একমত থাকুন, ঐক্যবদ্ধ থাকুন।’
বর্তমান সরকার রাজনীতিকদের মতো নির্বাচনী মেনিফেস্টো ঘোষণা করে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেননি। যার কারণে রাজনীতিকদের মতো প্রতিশ্রুতি পালন করতে চ্যালেঞ্জ নিতে বাধ্য নয়। তারপরও সরকার প্রধান ড. ইউনূস তার গত ১৭ নভেম্বর রোববারের ভাষণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ব্যাপারে নয়া দিগন্তের সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন তার ‘ঘৃণায় ইর্ষায় আবৃত সময়’ গ্রন্থে ‘শ্রেষ্ঠ বসন্তের অন্বেষায়’ নামক নিবন্ধে, রাজনীতিকদের প্রসঙ্গে এক মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর মন্তব্য তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, মালয়েশিয়ার এক মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম ‘এক্সেলেন্সি, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর এ দুর্দশা কেন? অনেক কথার মাঝে তিনি বললেন, দেখুন না, আপনাদের দেশের কথাই। একসময়ে আমাদের ছেলেরা আপনাদের ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসত, চাকরির আশায় এখানে আসত। এখন আপনারাই যাচ্ছেন। কারণ জানতে চাইলাম, তিনি বললেন (কিছু বিশ্লেষণের পরে) আপনারা সৎ নেতৃত্ব পাননি। যাও বা পেয়েছিলেন, তারা টেকেননি। অথচ আমরা পরপর তিনজন সৎ নেতৃত্ব পেয়েছিলাম, এরা মালয়েশিয়াকে মালয়েশিয়া বানিয়ে দিয়ে গেছেন।’ সম্পাদক আলমগীর তারপর লেখেন, এ মন্ত্রীকে আমি স্মরণ করি। চমৎকার কথার জন্য। জাতির ভাগ্যে বসন্তের উদয় হতে পারে শুধু সৎ নেতৃত্বের কারণে। সে ভাগ্য কি এ জাতির ভাগ্যে হবে?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- মালয়েশিয়ার মতো বাংলাদেশ কি আগামী দিনে সৎ নেতৃত্ব পাবে? মুক্তি মিলবে কি এ দেশের লাখকোটি বনি আদমের, যারা বিগত কয়েক যুগ ধরে রক্ত দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন। এ অন্তর্বর্তী সরকার কি পারবে রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে এমন একটি ব্যবস্থার প্রবর্তন, যার মাধ্যমে আগামী দিনে বাংলাদেশ সৎ নেতৃত্ব পাবে এবং ঐ সৎ নেতাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। গড়ে উঠবে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি ও দেশ। জনগণের প্রত্যাশা, এ অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের প্রথম ধাপটি সম্পন্ন করবে।