আলোর পথের যাত্রী


১৪ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০০

॥ রফিক মুহাম্মদ ॥
দৃশ্য-১
আলো নাকি অন্ধকার ইয়ামিন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ভোরের ঠিক আগে অর্থাৎ ঠিক সুবেহ সাদিকের মুহূর্তটার মতো এক আলো আঁধারির খেলা চলছে ওর চোখে। রাতের ঘুটঘুটে আঁধার শেষ হয়ে পূর্ব দিগন্তে কিছুক্ষণ পরই হয়তো রক্তের আভায় উঁকি দেবে নতুন সূর্য। শুরু হবে নতুন ভোর, একটি নতুন দিনের।
ইয়ামিন কি অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে, নাকি এক অনন্ত আলোর জগতে পা দিচ্ছে, কিছুই তো বুঝতে পারছে না। বার বার তাকাতে চেষ্টা করছে, কিন্তু ওর চোখ দুটো বার বার বুজে যাচ্ছে। সাঁজোয়া যানের ওপর তাকে ফেলে রেখে তার মনে হয় কে যেন জিব দিয়ে দেহটাকে কোণ আইক্রিমের মতো চেটে চেটে খাচ্ছে। ইয়ামিনের খুব ঘৃণা হচ্ছে। ঘৃণার থুথু নিক্ষেপ করে সে। কিন্তু মুখ থেকে থুথু বের হয় না। ইয়ামিনের বুক, গলা সব শুকিয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো কিছুতেই খুলতে পারছে না। এক অসীম অন্ধারে তলিয়ে যাচ্ছে সে। না, না, এ কোনো অন্ধকার নয়। এতো এক অসীম আলোর জগতের হাতছানি। হ্যাঁ, ওই তো কিছুটা দূরেই গোল এক আলোকবর্তিকা সে দেখতে পাচ্ছে। পৃথিবীর গোলকের মতোই ওর সামনে আলোকবর্তিকাটি ঘুরছে। ইয়ামিন মনে মনে এ আলোকবর্তিকাকে ডাকে। হে আলোকবর্তিকা তুমি আমার কাছে এসো। আমাকে তুমি অতল অন্ধকারে তলিয়ে যেতে দিও না।
কী আশ্চর্য আলোকবর্তিকা থেকে কণ্ঠ ভেসে আসে, হে যুবক তুমি ভয় পাচ্ছো কেন? তোমার মধ্যেই তো আমি আছি।
: এবার ইয়ামিন সত্যি ভয়ে কেঁপে ওঠে। এ কী! আলো তাকে অভয় দিচ্ছে, তার সাথে কথা বলছে! কী ভয়ঙ্কর!
: কি হলো তুমি তো দেখছি সত্যি সত্যি ভয় পাচ্ছো।
: হ্যাঁ, ভয় পাচ্ছি তো। এইযে দেখতে পাচ্ছো না ওরা তাদের বীভৎস জিভ দিয়ে চেটে চেটে আমার শরীরের সব রক্ত চুষে নিচ্ছে। আমিতো ধীরে ধীরে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমি তো অন্ধকারে থাকতে চাই না, আলো চাই। চারদিকে আলোর মশাল জ্বালাতে চাই।
: কে বলে তুমি অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছো। তুমি তো এখন এক আলোর শিখা। আমি তো তোমার মধ্যে এখন বিচরণ করছি।
: তাই? তাহলে আমি যে অন্ধকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলাম, যে আঁধার দূর করে আলো জ্বালাতে চেয়ে ছিলাম, সে আলোয় কি আমার দেশ আলোকিত হবে?
: আলোকবর্তিকা এবার স্থির। কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বলে, নিশ্চয় তুমি সফলকাম হয়েছ। যারা নিজেদের এভাবে উৎসর্গ করে তারা অবশ্যই আলোকিত হয়। আর তাদের আলোয় অন্ধকার দূর হয়ে চারদিক উদ্ভাসিত হয়। তুমি তো এখন সেই আলোকবর্তিকা, আলোতেই তোমার বাস।
অতঃপর আলোকবর্তিকাটি ঘুরতে ঘুরতে ইয়ামিনের চোখের মণিতে এসে স্থির হয়ে যায়। ইয়ামিন ঘুমিয়ে পড়ে। না, না, ঘুম নয়, এক অনন্ত-অসীম আলোর জগতে সে মিশে যায়।
দৃশ্য-২
মুগ্ধর আজ কিছুই ভালো লাগছে না। ঘুম থেকে ওঠে বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বস্তি লাগছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে দূর আকাশের দিকে তাকায়। শ্রাবণের আকাশে মেঘেরা কেমন এলোমলো হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। অথচ কোথাও বৃষ্টির ছিটেফোঁটা পর্যন্ত নেই। খাঁ খাঁ রোদের ঝাঁজে মনে হচ্ছে আগুনের জিভ চারদিকে লক লক করছে। সবকিছু যেন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। হ্যাঁ তাই তো হচ্ছে। বর্ষা এখনো শেষ হয় নাই। অথচ খাল-বিল কেমন শুকিয়ে গেছে। কৃষকের ক্ষেত শুকিয়ে আছে। পানির অভাবে তারা ক্ষেতে আমন ধানের চারা রোপণ করতে পারছে না। প্রকৃতির এমন বিরূপতা দেখে মন মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায়। শ্রাবণের প্রকৃতি হবে স্নিগ্ধ, শ্যামল, এক মায়াময়। গাঢ় সবুজ প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে যায়। টলটলে পানিতে পূর্ণ থাকে খাল-বিল, নদী-নালা। খালে-বিলে ফুটে থাকে শাপলা ফুল। কিন্তু এসব দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। খাল-বিল এখন অবৈধ দখলে চলে গছে। একশ্রেণির দুর্বৃত্ত এসব দখল করে ভরাট করে সেখানে অট্টালিকা নির্মাণ করছে। প্রকৃতিকে এভাবে ধ্বংস করে আমাদের সবার জীবনকে এক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। প্রকৃতি আজ বিরূপ হয়ে উঠেছে। বর্ষাতেও বৃষ্টি নেই। আবার অসময়ে বৃষ্টি এসে সব কিছু ডুবিয়ে দিচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো এসব প্রকৃতিক দুর্যোগে দেশের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে। শুধু কি খাল-বিল দখল? গোটা দেশটাকেই দখল করে চলেছে বেপরোয়া লুটপাটকারীরা। যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকে অনিয়ম আর দুর্নীতি। চারশ’ টাকার বালিশ কেনা হয় চার হাজার টাকা দিয়ে। হাজার পনেরশ’ টাকার পর্দা কেনা হয় লাখ টাকা দিয়ে। বিদ্যু উৎপাদন না করেই ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে মাসে মাসে লাখ লাখ টাকা নেওয়া হয়। এসব অনিয়ম, দুর্নীতির কথা বলতে গেলে গুম-খুনের শিকার হতে হয়। না, এই অনিয়ম দুর্নীতি আর সহ্য করা যায় না। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে। অন্যায় অনিয়ম দূর করে একটি বৈষম্যহীন সুশাসনের নতুন বাংলাদেশ গঠন করতে হবে।
মুগ্ধ নেমে আসে রাজপথে। রাজপথ আজ ছাত্র-জনতার মিছিলে উত্তাল। অনিয়ম-দুর্নীতি আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার। সবার কণ্ঠে এক কথা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। খাঁ-খাঁ রোদে পুড়ছে কালো রাজপথ। রোদের মধ্যেই স্লোগানে মুখরিত মিছিল রাজপথ প্রকম্পিত করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বৈরাচারের দোসরাও মিছিল প্রতিহত করার জন্য টিয়ার শেল, সাউন্ডগ্রেনেড নিক্ষেপ করছে। তাতেও কিছু হচ্ছে না। সব বাধা অতিক্রম করে মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে। আজরাঈলের প্রেতাত্মারা এবার মিছিলে গুলি চালায়। এতে কয়েকজন লুটিয়ে পড়ে। রাজপথ রক্তে লাল হয়ে যায়। তবু মিছিল থামে না। এবার দাবি আদায় না করে কেউ ঘরে ফিরবে না। এই স্বৈরাচারের পতন না ঘটিয়ে মিছিল থেকে কেউ যাবে না। এরই মধ্যে তৃষ্ণায় অনেকের গলা শুকিয়ে গেছে। মিছিলে কণ্ঠ মেলাতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও থামছে না কেউ। মুগ্ধ তখন তাদের জন্য পানি নিয়ে এগিয়ে আসে। মিছিলে সামনে, মাঝে যে পানি নিয়ে ছুটে চলে। তার কণ্ঠে তখন ভিন্ন স্লোগান ‘পানি লাগবে পানি…। এ স্লোগানে অনেকে সাড়া দিয়ে তার হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে তৃষ্ণা মেটায়। মুগ্ধর স্লোগান থামে না। মিছিলে অগ্রভাগে এসে সে কণ্ঠ ছাড়ে ‘পানি লাগবে পানি…।’ হঠাৎ এক বুলেট এসে তার কপালে লাগে। পানির বোতল হাতে মুগ্ধ রাজপথে লুটিয়ে পড়ে। ওর রক্তে সে পানিও লাল হয়ে যায়। মুগ্ধর কণ্ঠ তখনো থামে না। আকাশে বাতাসে সে কণ্ঠ ছড়িয়ে পড়ে… ‘পানি লাগবে…পা…নি…।’
দৃশ্য-৩
ফজরের আজান হলো অনেকক্ষণ। চারদিক বেশ ফর্সা হয়ে গেছে। মনোয়ারা ঘুম থেকে উঠে হাঁস-মুরগির খোঁয়াড়ের দরজাটা খুলে দেয়। হাঁসগুলো ডানা ঝাঁপটা দিয়ে প্যাক প্যাক করতে করতে বাড়ির সামনের পুকুরের দিকে চলে যায়। মুরগিগুলো কক কক করে মনোয়ারার চারপাশে ঘুরতে থাকে খাবারের জন্য। মনোয়ারা একটি মাটির মালশাতে রাতের কিছু বাসিভাত এবং চালে কুঁড়া মিশিয়ে মুরগিগুলোকে খেতে দেয়। শ্রাবণ মাস তবুও বৃষ্টি বাদলের কোনো দেখা নেই। খাল-বিল এখন পানিতে থৈ থৈ করার কথা অথচ প্রকৃতিতে চলছে চৈত্রের খরা। চারদিক বিরান মরুভূমির মত। প্রকৃতির এই বিরূপ আচরণের জন্য অনেকে অনেক কথা বলেন। কেউ বলেন অধিক গাছ কাটার ফলে পরিবেশের এ বিরূপ প্রতিক্রিয়া, আবার কেউ বলেন, নদী-নালা খাল বিল ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ করায় এমন হচ্ছে। আবার কেউ বলে ফারাক্কার মরণ বাঁধের কারণে শ্রাবণ মাসেই চৈত্রের বিরাণভূমির মতো হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি। মনোয়ারা এসব কিছুই ভাবে না। ফারাক্কার মরণ বাঁধ যে এ অঞ্চলের নদী-নালাকে শুকিয়ে মারছে সেটাই সে বুঝে এবং জানে। তার ছাওয়ালও বলেছে, মা ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে আমাদের দেশের নদীগুলোকে শুকিয়ে মারছে। আমাদের উত্তরবঙ্গকে শুকিয়ে মরুভূমি বানাচ্ছে। এ অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না। আমরা এ নতুন প্রজন্ম এখন এর প্রতিবাদ করবো মা। প্রয়োজনে আমরা আমাদের পানির ন্যায্য অধিকার আদায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যাব। মনোয়ারার ছেলে আবু সাঈদ এরকমই। অন্যায়কে সে সহ্য করো। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেই। আবু সাঈদের কথা মনে পড়তেই মনোয়ারার মনটা কেমন ভারী হয়ে যায়। কতদিন হয় ছাওয়ালটা বাড়ি আসে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি এখন পড়ার খুব চাপ। তাই আগামী মাসের শেষের দিকে বাড়ি আসবে বলেছে। আবু সাঈদ হয়েছে খুব প্রতিবাদী। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে সবসময় সোচ্চার। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবসময় নানা বিষয় নিয়ে মিছিল মিটিং করে। মনোয়ারা কত নিষেধ করে, কিন্তু সাঈদ তাকে উল্টো বুঝিয়ে দেয়। এবার সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। সঈদ মনোয়ারাকে বলেছে, ‘মা এ কোটা পদ্ধতির কারণে আমাদের মতো সাধারণ ছাত্ররা বিসিএস দিয়ে সরকারি ভালো চাকরি পায় না। তাই কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আমরা আন্দোলন করছি। আমাদের এ দাবি যৌক্তিক। এ দাবি মেনে নিলে আমরা বিসিএস দিয়ে ভাল চাকরি পাব।’ মনোয়ারা কোটা পদ্ধতি, বিসিএস এসব এত কিছু না বুঝলেও এটা বুঝেছে যে- সরকারি ভাল চাকরির আশায় তার ছাওয়াল আন্দোলন করছে। এ আন্দোলন সফল হলে সে ভাল সরকারি চাকরি পাবে। মনোয়ারার বুক ছিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়। মনে মনে বলে, ‘আল্লাহ তুমি আমার ছাওয়ালডার মনে আশা পূরণ কইরো। পড়া লেখা শেষ করে ও যেন একটা ভালো চাকরি পায়।’
সকাল থেকে আবু সাঈদের কথা খুব মনে পড়ছে মনোয়ারার। আল্লাহ জানে সে কেমন আছে। তার কোন অসুখ-বিসুখ হয় নাই তো। হে অল্লাহ তুমি আমার ছাওয়ালরে ভাল রাইখো। সকাল থেকে মনোয়ারার মনটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। কোনো কাজে মন বসাতে পারছে না। সারাটা দিন গেল কোন কিছুই ভালা লাগছে না। সকালে শুনেছে রংপুর শহরে ছাত্রদের সাথে পুলিশের মারামারি হয়েছে। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও পুলিশ গেছে। হায় আল্লাহ কী জানি হয়। আল্লাহ তুমি মেহেরবান। তুমি রহম করো আল্লাহ। মসজিদ থেকে আসরের আজান ভেসে আসে। মনোয়ারা দাওয়ায় বসে শুধু ছেলের কথা ভাবছে। এ সময় মেয়ে সুমি এসে তার পাশে বসে। মায়ের শাড়ির আঁলটা হাতে নিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে বলে, ওমা তুমি শুধু শুধু চিন্তা করতাছ। ভাইয়ের কিছু অইবো না। ভাই তো অন্যায় কিছু করতাছে না। ভাই আমারে কইছে, সে বিসিএস দিয়া একটা বড় অফিসার অইবো। তুমি শুধু শুধু চিন্তা কইরো না। মায়ের মন তবু কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। মনোয়ারার ভেতরটা কেমন যেন করছে।
এ সময় বাইরে থেকে হঠাৎ অনেক মানুষের কলরব ভেসে আসে। মনোয়ারা এবং সুমি দু’জনেই উঠে দাঁড়ায়। বাড়ির সামনে থেকে অনেক মানুষের কণ্ঠ ভেসে আসে। সবাই পড়ছে-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু…। কলেমা পড়তে পড়তে একদল লোক একটা খাটিয়া কাঁধে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে। মনোয়ারার সামনে গিয়ে খাটিয়াটা নামিয়ে রাখে। মনোয়ারার বুঝতে আর বাকি থাকে না। সে খাটিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘হামার বাবা, হামার ছাওয়ালকে ওরা ওরা মেরে ফেলল ক্যান’? মায়ের সাথে সাথে ছোট বোন সুমিও কফিনকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘ভাই ও ভাই হামাক এনা বোন কয়া ডাকো রে। হামার ভাই বেঁচে থাকলে হামার স্বপ্নপূরণ করিল হয়। হামার এখন কী হবি…।