সুসাহিত্যিক মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন : সাহিত্য ও কর্মজীবন


১৪ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০০

॥ অধ্যাপক আশরাফ জামান ॥
ব্রিটিশ শাসনামলের শেষের দিকে বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঔপন্যাসিকদের মধ্যে বিশেষভাবে স্মরণীয় হলেন কথাসাহিত্যিক মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন। পাবনা জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৮৭৮ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পেশা হিসেবে তিনি শিক্ষকতার জীবন গ্রহণ করেন।
গ্রামীণ জীবনের পটভূমিকায় তিনি লেখনী ধারণ করেন। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি পল্লিতে কাটিয়েছেন। এজন্য সে অভিজ্ঞতাই তার লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন, তাই তার লেখা প্রথম পুস্তক বিলাতী বর্জন রহস্য ১৩১১ বঙ্গাব্দে ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে।
নজিবর রহমানের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস আনোয়ারা ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয়। সামাজিক ও পারিবারিক বিষয়বস্তু অবলম্বনে তা রচিত হয়। উপন্যাসটি প্রকাশের পর অল্পদিনেই পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে। উপন্যাসটিতে মুসলিম সমাজ জীবন ও পারিবারিক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে পল্লী বালিকা আনোয়ারা এবং পাটের ব্যবসায়ী ও ডাক্তার নূরুল ইসলামের প্রেম ও দাম্পত্য জীবনের চমৎকার ছবি অঙ্কিত হয়েছে। তবে কেউ কেউ আদর্শবাদ দেখানো হয়েছে বলে উপন্যাসটির ত্রুটি বলেছেন। তবু আমরা বলব, আনোয়ারার কাহিনী বাঙালি মুসলমানের মনে সে আমলে যথেষ্ট আবেদন সৃষ্টি করেছিল, যা পাকিস্তান আমলেও সত্তর দশক পর্যন্ত উজ্জীবিত ছিল। অত্যধিক জনপ্রিয়তার জন্য আনোয়ারা উপন্যাস অবলম্বনে ছায়াছবি ও নাটক হয়েছে একাধিকবার। বাংলাদেশ আমলেও বিটিভিতে ধারাবাহিকভাবে আনোয়ারা অভিনীত হয়েছে। আশির দশকে আনোয়ারার পরিপূরক গ্রন্থ ‘প্রেমের সমাধি’ প্রকাশিত হয়। স্বামীর আরোগ্য লাভের জন্য সতী স্ত্রীর একনিষ্ঠ সাধনা এতে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন।
১৯২৩ সালে নজিবর রহমানের ‘গরীবের মেয়ে’ প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি গ্রামীণ জীবন ও মুসলিম সমাজ ব্যবস্থার একটি চমৎকার পটভূমিকায় রচিত। নূরী এ উপন্যাসের নায়িকা। এর কাহিনীর সঙ্গে আনোয়ারার কাহিনীর মিল লক্ষ করা যায়।
লেখকের ‘পরিণাম’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এতে লেখকের আদর্শবাদ প্রচার ও উপদেশ প্রদানের সুস্পষ্ট প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
লেখক ইতিহাসের পটভূমিকায় চাঁদ তাপ বা হাসন গঙ্গা বাহমনি উপন্যাস রচনা করেন। গ্রন্থটিতে মুসলিম যুবকের প্রতি হিন্দু যুবতীর প্রেমের কাহিনী তুলে ধরেছেন।
এতে লেখক হিন্দু-মুসলমানের মিলন কামনা করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, ‘আমরা চাই প্রত্যেকের ধর্মে প্রত্যেকের বাস্তবিক যেটুকু বিধিনিষেধ আছে, তাহা মানিয়া চলিয়া হিন্দু-মুসলমান ছাত্র ভাই ভাই গলায় গলায় মিশিয়া যাও, এক বিছানায় ওঠাবসা কর, আলাপ-পরিচয়ে সচরাচর পারিবারিক কুশল অবগত হও। ছুটির পর একে অন্যের বাসায় যাও, মিলিয়া মিশিয়া আমোদ আহ্লাদ কর।’
নজিবর রহমানের উপন্যাসের ভাষা সহজ এবং প্রাঞ্জল হওয়ার কারণে তৎকালীন সময়ে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। শরৎচন্দ্রের সহজ-সরল ভাষা ও কাহিনী যেমনভাবে বাঙালি পাঠক সমাজে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, তেমনিভাবে নজিবর রহমানের উপন্যাসগুলো বাঙালি মুসলমান পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশেষভাবে মুসলিম পাঠক মহলে তার লেখা উপন্যাসগুলো পঠিত হতো সে আমলে। প্রতিটি উপন্যাসে লেখক ইসলামী আদর্শকে উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
সুসাহিত্যিক নজিবর রহমান ১৯২৫ সালে ইহজগত ছেড়ে পরলোক গমন করেন।
টাঙ্গাইল শহরে আমার আব্বা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভের পর ‘আজাদ বুক ডিপো’ নামে একটি বইয়ের দোকান করেন। আমি সে দোকানে নজিবর রহমানের লেখা আনোয়ারা, প্রেমের সমাধি, গরিবের মেয়ে উপন্যাস তিনটি খুব বিক্রি হতে দেখেছি সত্তর দশকে।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের মতো তার গ্রন্থগুলো অত্যন্ত প্রচারিত ছিল। শরৎচন্দ্র হিন্দু-সমাজের নর-নারীর চাওয়া-পাওয়া, প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে উপন্যাস রচনা করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উপনীত হয়েছিলেন। সুসাহিত্যিক নজিবর রহমানও বাঙালি মুসলিম সমাজের নর-নারীর চরিত্র, প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে উপন্যাস রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্র-নজরুলের সমসাময়িককালে লিখেও জনপ্রিয়তার আলাদা একটি আঙিনা তৈরি করেছিলেন।
এ সময় আর একজন বিখ্যাত মুসলিম লেখক ছিলেন মীর মশাররফ হোসেন। তার লেখা ‘বিষাদ সিন্ধু’ উপন্যাসটি পাঠক সমাজে অত্যন্ত প্রচারিত ছিল। লেখক আব্দুল হাই শিকদারের লেখা প্রবন্ধে পড়েছি। তিনি লিখেছেন, ‘মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু উপন্যাস সর্বসাকুল্যে পঞ্চাশ লাখ কপি প্রকাশিত হয়েছিল।’