৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লব, কিছু কথা


৮ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৫৫

॥ মুজতাহিদ ফারুকী ॥
বাংলাদেশ নামের এ ভূখণ্ডে বসবাসকারী বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস ১৯৭১-এর স্বাধীনতা থেকে শুরু হয়নি। এ ইতিহাস বহু পুরনো এবং প্রায় হাজার বছরের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আজ পর্যন্ত এসেছে। প্রাচীনকালের হিন্দু বৌদ্ধ ও মধ্যযুগের মুসলিম শাসকদের সময়কাল পেরিয়ে আমরা আধুনিক সময়ে এসে পৌঁছেছি ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে উপমহাদেশের শাসনক্ষমতা হারিয়ে। আর সবশেষ ১৯৭১ সালে আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
১৯৭১-এর এ স্বাধীনতাকে জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে গত ৫৩ বছর ধরে প্রচার করা হয়েছে। প্রচারণা চালিয়েছে সেই রাজনৈতিক দলটিই, যারা স্বাধীনতা-সংগ্রামে এবং মুক্তিযুদ্ধ সংঘটনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
দেশ স্বাধীন করার রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রকাশ্যে ঘোষণা না করে ‘তলে তলে’ একটি বৈরী শক্তির সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পক্ষে কাজ শুরু করে। এমন একসময় দলটি এ কাজ শুরু করে, যখন ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে সদ্য একটি নতুন দেশ গঠন হয়েছে এবং যেটি হয়েছে একান্তভাবেই মুসলিম ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার পরিপূরণ ঘটিয়ে। সেই পাকিস্তানের প্রধানতম শত্রু ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কেন বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডটিকে স্বাধীন করলো আওয়ামী লীগ? এ প্রশ্ন এখন তোলার সময় এসেছে। কারণ গত ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে আওয়ামী সরকারের লেনদেনের যে সম্পর্ক, তা এদেশের মানুষের চোখ অনেকটাই খুলে দিয়েছে। জাতি দেখেছে, একের পর এক ভারতের সব স্বার্থ বিনা শর্তে পূরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ আদায় করা তো দূরের কথা, উত্থাপন পর্যন্ত করা হয়নি। দেশকে দুর্বল করা হয়েছে, নিরাপত্তা ভঙ্গুর করে তোলা হয়েছে, মানুষের জীবনের কোনো মূল্য দেয়া হয়নি। সীমান্তে প্রতিবেশীর অস্ত্রে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ, ক্ষমতাসীনরা টুঁ শব্দটি করেননি। তারা শুধু একটি জিনিসই চেয়েছিলেন, ক্ষমতার মসনদে চিরস্থায়ীভাবে থেকে যাওয়া আর জনগণকে শোষণ করে নিজেদের আমোদ-ফুর্তির রসদের জোগান নিশ্চিত করা।
গত ৫ আগস্টের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পর অনেকেই বলছেন, আর দুই এক মাস ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারলে সম্ভবত পুরো দেশটাই আওয়ামী লীগ ভারতের হাতে তুলে দিত। আমরা স্পষ্ট করেই বলি, গণবিপ্লবের শেষ কয়েকদিনে যেভাবে হিন্দিভাষী অস্ত্রধারীদের ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছুড়তে দেখা গেছে, তাতে ওই সন্দেহ আর সন্দেহে আটকে থাকেনি, রীতিমতো বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়েছে।
এখন বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশ টালমাটাল পায়ে হাঁটছে। প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা ও চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অন্তর্বর্তী সরকারকে এগোতে হচ্ছে।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিপ্লব যখন ঘটেছিল, সেটিও ছিল জাতীয় জীবনের এমনই এক নাজুক ক্রান্তিকাল। জাতি এ দিনটিকে সিপাহি-জনতার বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করেছে, কারণ এবারের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মতোই সেই বিপ্লব সফল করেছিল সেনানিবাসের আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সদস্য ও সাধারণ জনগণ। সদ্য পতিত ও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকারের ভয়াবহ দুঃশাসন, নৈরাজ্যকর শাসন, আত্মদম্ভ ও লুটপাটের শাসন এদেশের মানুষ গত ১৫ বছর শুধু চোখে দেখেছে তাই নয়, বরং হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে, এ অভিজ্ঞতা তাজা ও জ্বলজ্বলে। আর ১৯৭৫ সালের ঘটনাবলি কেবল তাদেরই মনে আছে যাদের বয়স এখন ন্যূনতম ৬০ থেকে ৬২ বছর।
১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে এসে ক্ষমতার মসনদে বসেন শেখ মুজিবুর রহমান। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে জাতি তাকে বরণ করে নেয় জাতির সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, যা যা আমাদের ছিল না পাকিস্তানি শাসনের ২৪ বছরে সেই সব না পাওয়া অধিকার নিজেরাই যুদ্ধ করে অর্জনের বিপুল গর্বে উজ্জীবিত জাতি শেখ মুজিবের বাংলাদেশে অধিকার পাওয়ার আকাক্সক্ষা নিয়ে দেশ গঠনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু খুব সামান্য কিছুদিন যেতেই দেখা যায়, মুজিব জাতিকে নেতৃত্ব দিতে পারছেন না। নেতৃত্ব দেয়া তো দূরের কথা, দলের নেতাদের লুটপাট, লাইসেন্স, পারমিটবাজি, চোরাচালান, কালোবাজারি, মজুদদারি কোনোটাই সামলাতে পারছেন না। সব জিনিস সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে পাচার করে দেয়ায় দেশে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। অর্থনীতি দ্রুতই ধসে পড়ে। খাবারের অভাব দেখা দেয়। জিনিসপত্রের দাম বাড়ে হুহু করে। মুক্তিযুদ্ধ ফেরত বিভিন্ন বাহিনীর অনেকেই অস্ত্র হাতে ডাকাতি-রাহাজানির মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। অপরাধ বাড়তে থাকে দেশজুড়ে। সেইসঙ্গে শুরু হয় প্রতিবাদ বিক্ষোভ। নবগঠিত জাসদ সারা দেশে তৎপর হয়ে ওঠে। তারা আওয়ামী লীগের লুটপাটসহ নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। গোপন বাহিনী তৈরি করে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করে।
এমনই বিশৃঙ্খল সময়ে দেশবাসীর স্বাধীনতার আনন্দ যখন বিলীন। মানুষ দু’বেলা খাবার জোটাতে পারছে না, ঠিক সেই সময় শেখ মুজিবের দুই ছেলের সোনার টোপর মাথায় বিয়ের ছবি ছাপা হয় পত্রিকার পাতায়। তার এক ছেলের তো ব্যাংক লুটের মতো কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। মানুষের মধ্যে বঞ্চনাবোধের পাশাপাশি সৃষ্টি হয় প্রতারিত হওয়ার অনুভূতি। যিনি গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখাতেন, মানুষের সমঅধিকারের কথা বলতেন, মানবাধিকারের কথা বলতেন, তারই শাসনে দেশজুড়ে চলতে থাকে শোষণ ও লুটপাটের মহোৎসব। বিদেশ থেকে টন টন সাহায্যসামগ্রী আসে। সবই দলের নেতারা লুট করে, আত্মসাৎ করে। মুজিব মুখে বলেছেন, চাটার দল সব খেয়ে ফেলছে। কিন্তু সেই চাটার দলকে তিনি সামলাতে পারেননি। আইনশৃঙ্খলা ফেরাতে একাধিকবার সেনাবাহিনী ডেকেছেন। সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে যেসব অপরাধীকে ধরেছে, তারা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা অথবা কর্মী। দলের নেতা; এমনকি খোদ শেখ মুজিবের সুপারিশে তারা মুক্তি পেয়েছে।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যায়, সেখানে মেজর ডালিমের স্ত্রীকে অপহরণের মতো ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনার বিচার তো দূরের কথা, ন্যূনতম সালিশ মীমাংসাও করে দিতে পারেননি মুজিব। সব দিক থেকেই মুজিবের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা জাতির সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়ে। বস্তুত গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলা, বিক্ষোভ করা আর দেশ চালানো যে, এক নয় সেটা মুজিবের ব্যর্থতা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়।
মুজিব শুধু দেশ চালাতেই ব্যর্থ হননি। প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, সমালোচনা বন্ধ করতে চরম ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ শিকদারকে রাজপথে গুলি করে হত্যা করে সংসদে দাঁড়িয়ে সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন, কোথায় সিরাজ শিকদার! তার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে ভারতের সহায়তায় সৃষ্ট রক্ষীবাহিনী দিয়ে শুরু করেছিলেন বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের গুম, খুন ও হত্যার বিশাল যজ্ঞ। এক জাসদেরই অন্তত ৪০ হাজার কর্মীকে খুন করে রক্ষীবাহিনী।
একপর্যায়ে ১৯৭৪ সালের শেষদিকে সারা দেশে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। এতে এক থেকে সাত লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। অথচ সে বছর দেশে খাবারের ঘাটতি ছিল না। পুরো ব্যাপারটাই ঘটে খাদ্য ব্যবস্থাপনার অভাব এবং নেতাদের চুরি-চামারি ও পাচারের কারণে।
জনগণ তখন হতাশ, তাদের স্বপ্ন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বরং মুজিবের দুঃশাসন থেকে মুক্তির প্রহর গুনছে মানুষ। কিন্তু তখনো সময় হয়নি। মুজিব নিজের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার ব্যবস্থা করেন। গণতন্ত্রের যে মুখোশটা এতদিন পরে ছিলেন সেটা ছুড়ে ফেলে হয়ে ওঠেন একনায়ক। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে, সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়ে একদলীয় ব্যবস্থা কায়েম করেন, যেখানে একটি মাত্র দল বাকশাল এবং একজন মাত্র নেতা শেখ মুজিব থাকবেন।
এমনই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর কজন সদস্য ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসেন। তারা বিদ্রোহ করেন এবং শেখ মুজিবকে হত্যা করে ফ্যাসিস্ট মুজিবের দুঃশাসনের অবসান ঘটান। সেটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা।
এরপর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগেরই নেতাদের নিয়ে সরকার গঠন করা হয়। কিন্তু তখনো শেখ মুজিবের হত্যার রেশ কাটেনি। দেশে অনিশ্চিত পরিস্থিতি। মুজিবের পুরনো মিত্র ভারত কখন আবার সরাসরি হস্তক্ষেপ করে এমন শঙ্কা চারদিকে। এভাবে দুই মাসও পেরোয়নি। নভেম্বরের ৩ তারিখে শেখ মুজিবকে হত্যাকারী সেনাসদস্যরা দেশ ছেড়ে যান। ওই দিনই ঘটে সেনাবিদ্রোহ। মূলত সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ নিজে সেনাপ্রধান হওয়ার চেষ্টা করেন। সফলও হন। এতে খন্দকার মোশতাকের পতন ঘটে। কিন্তু খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় ফিরছে এমন সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয় সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে। জাসদের নেতা কর্নেল অব. তাহেরের নেতৃত্বে সেনাসদস্যদের একটি অংশ বিদ্রোহ করে। মুজিব হত্যার সঙ্গে জড়িত সেনা অফিসারদের একজন সেনাবাহিনীতে থেকে গিয়েছিলেন। তিনি মেজর মহিউদ্দিন। তার নেতৃত্বে সৈন্যরা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন এবং তাকে বরণ করে নেন সেনাপ্রধান হিসেবে। আর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যায়, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন ও ভারতীয় আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার সন্দেহের কারণে। এতে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে অনুগত সৈন্যদের ভূমিকা ছিল। তাহের চেয়েছিলেন, জিয়ার জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাতে। জিয়ার বৃদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার কারণে সেটি ব্যর্থ হয়। পরে সিপাহি-জনতার দাবির মুখে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বেও আসেন জিয়াউর রহমান।
মূলত ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দেশের স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ থেকেই ঘটে ৭ নভেম্বরের বিপ্লব।
২০২৪ সালের বর্তমান ক্রান্তির সময়টা যে চেতনা নিয়ে আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে এগোচ্ছি ঠিক, সেই একই চেতনা ছিল ৭ নভেম্বরের বিপ্লবেরও। ৭ নভেম্বরের বিপ্লবে বহু মানুষের জীবনহানি ঘটেনি। কিন্তু ২০২৪-এর বিপ্লবে হাজারও তরুণ ছাত্র ও জনতা জীবন দিয়েছে উন্মত্ত ক্ষমতালোভী হাসিনার হাতে। এ বিপ্লব কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের সেনা সহায়তা বা ছত্রছায়ায় ঘটেনি। এ দেশের স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-জনতা নিজের শক্তিতে এ বিজয় অর্জন করেছে। এ অর্জন কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কবি।