নভেম্বর বিপ্লব আলেখ্য
৮ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৪৭
॥ অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম ॥
এ জাতির আত্মজাগৃতির ইতিহাসে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায়। জাতির রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এদিনটি অনিবার্য মাইলফলক। এই দিনে এ জাতি আত্মগৌরব তথা আত্মমহিমায় নতুন করে অবগাহন করেছে। নতুন করে নিজের পরিচয়, নিজের স্বরূপকে আবিষ্কার করেছে। ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে সহসা আত্মপ্রতিষ্ঠায় বিজয়ী হয়েছে। এ বিজয়ের মহানায়ক ছিলেন শহীদ জিয়াউর রহমান। তিনি বিপ্লবের অনুঘটক ছিলেন না। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে সেই সময়ে সংশ্লিষ্ট সকল ঘটনা। ১৯৭৫ সালের আগস্ট-পরবর্তীকালে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের পটভূমিতে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে তার আবির্ভাব ঘটে। এ জাতির প্রতি তার দায়দায়িত্ব, নিষ্ঠা, কর্তব্যবোধ এবং সব মহলের আস্থা তাঁকে রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যমণিতে পরিণত করে। সে সময়ে নেতৃত্বের সংকটাপন্ন জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হিসেবে তিনি তাৎক্ষণিক নেতৃত্বে বরিত হন। তিনি যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বরিত হন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যাকরণে তা ছিল একটি অভাবনীয় ঘটনা। বস্তুত ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সিপাহি-জনতার বিপ্লব ছিল সমসাময়িক পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা (‘Entirely a new story never known or told before,’ Emajuddin Ahamed; 1988)। সৈনিকরা নির্দেশের পদসোপান অগ্রাহ্য করে শৃঙ্খলার ব্যারিকেড ভঙ্গ করে জীবন বাজি রেখে অভীষ্ট বিপ্লব যেভাবে সফল করেছিল, স্বাভাবিক সময়ে স্বাভাবিক নিয়মে তা কল্পনাও করা যায় না। এটি প্রথাগত অভ্যুত্থান নয়। এটি কোনো প্রতিবিপ্লবও নয়। মনীষী এরিস্টটল বিপ্লবের যে গতি-প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেছেন, সে দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি অবশ্যই একটি বিপ্লব। জিয়াউর রহমান ছিলেন এ বিপ্লবের উৎসমূল, অনুপ্রেরণা এবং অভিভাবক।
পটভূমি
১৫ আগস্টের ঘটনাবলি পৃথিবীর এ অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য (balance of power) নষ্ট করে দিয়েছিল। তৎকালীন বৈশ্বিক রাজনীতি (global politics)-এর প্রেক্ষিতে যে দ্বিমেরু বিশ্ব (bi-polar world)-এর কথা আমরা জানি, সেখানে ১৫ আগস্ট পশ্চিমা পাল্লা ভারী করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে সম্প্রসারণবাদী শক্তি প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উন্মুখ হয়েছিল। ৩ নভেম্বরের প্রতিবিপ্লব ছিল ঐ হারানো ভারসাম্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি ব্যর্থ ষড়যন্ত্র। প্রতিবিপ্লবের খবরে ভারতীয় প্রচারমাধ্যমে খুশির বন্যা বয়ে যায়।
প্রতিবিপ্লবের নেতা খালেদ মোশাররফ দরকষাকষির একপর্যায়ে বৃহৎ প্রতিবেশীর অনুকূল পররাষ্ট্রনীতি অনুসৃত হলে খোন্দকার মোশতাককেও মেনে নিতে রাজি হন। বামপন্থী গবেষক Lifschultz তার গ্রন্থ Unfinished Revolution-এ স্বীকার করেছেন, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করার পরিকল্পনা খালেদের ছিল। মিছিলের কথা সবারই জানা। ৩ নভেম্বর ’৭৫ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি মিছিল ধানমন্ডির সেই ৩২ নম্বর সড়ক পর্যন্ত যায়। সেই মিছিলের সংবাদটি সবকিছু তছনছ করে দেয়। সৈনিক এবং জনতার মাঝে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ভারতীয় মদদে পতিত বাকশালের পুনঃপ্রত্যাবর্তন রুখে দেয় সৈনিক-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব।
জিয়ার ভূমিকা
শহীদ জিয়া কোনোভাবেই আগস্ট অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ছিলেন না। এক একাডেমিক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন ঢাকা ব্রিগেড প্রধান ও ৩ নভেম্বর প্রতিবিপ্লবের মূল নায়ক কর্নেল শাফায়াত জামিল এ লেখককে এ কথা বলেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকার কারণে গোটা সেনাবাহিনীতে জিয়ার একটি পপুলার ইমেজ ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জিয়াকে তার সেনাপ্রধানের ন্যায্য প্রাপ্য পদ থেকে বঞ্চিত করা হলেও তিনি কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া পোষণ করেননি। জিয়া ছিলেন নিয়মতন্ত্রের প্রতি একান্তই অনুগত। আগস্ট অভ্যুত্থানের পর জিয়া সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের নিয়মানুক্রম অনুসরণের কথা বলেন। সেনাপ্রধান নিযুক্তির পরও তিনি সুকঠিনভাবে ‘চেইন অব কমান্ড’ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। আগস্ট বিপ্লব থেকে উৎসারিত সিনিয়র বনাম জুনিয়র দ্বন্দে জিয়া অফিসিয়াল এবং ফর্মাল অবস্থান গ্রহণ করেন। এতে উভয় পক্ষই অসন্তুষ্ট হন। খালেদ ২ নভেম্বর রাতে জুনিয়রদের বিরুদ্ধে কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণের আলটিমেটাম দিলে জিয়া পরদিন সেনা সদরে সভা আহ্বানের প্রস্তাব করেন। খালেদ তা অগ্রাহ্য করেন এবং জিয়াকে বন্দি করেন। পরে তাকে পদচ্যুত করে খালেদ নিজে সেনাপ্রধান হন। এই অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলি এবং খালেদ মোশাররফের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা জানাজানি হলে সেনাছাউনিতে বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থার সৃষ্টি হয়।
কর্নেল তাহের প্রসঙ্গ
এ অবস্থায় জাসদের গোপন ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র লোকেরা কর্নেল তাহেরকে ভূমিকা পালনের আহ্বান জানায়। কর্নেল তাহের এ অবস্থাকে তার স্বপ্নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটানোর মাহেন্দ্রক্ষণ বলে ধরে নেন। গবেষণাক্রমে এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে, কর্নেল তাহের জিয়াকে উদ্ধার করার জন্য ঐ বিপ্লবের অবতারণা করেননি। বরং তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে ব্যবহার করে সাধারণ সৈনিকদের বিভ্রান্ত করে ছলে-বলে-কৌশলে উদ্দেশ্য সাধন করতে চেয়েছেন। তার পরিকল্পনা ছিল জিয়াকে এক বন্দিত্ব থেকে আর এক বন্দিত্বে নিয়ে আসা। সেনাবাহিনীর বিশ্বস্ত বাছাই করা কতিপয় এনসিও জিয়াকে বন্দিত্ব থেকে মুক্তির জন্য যখন যান, তখন শত শত সাধারণ সৈনিক তাদেরসহ গমন করলে জিয়ার পুনঃবন্দিত্বের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
তারা যখন এলিফ্যান্ট রোডে জিয়াবিহীনভাবে ফিরে আসে, তখন বাসার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা তাহেরের প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘Where is Zia?’ যখন তিনি শোনেন যে, সাধারণ সৈনিকরা তাকে Second field regiment এ নিয়ে গেছে, তখন তিনি ‘All lost, Everything lost’ বলে আহাজারি করতে থাকেন। এরপর একদল চতুর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোক আবার ফিরে যায় জিয়ার কাছে। তারা জিয়াকে বলেন, স্যার কর্নেল তাহের এ বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন। চলুন শহরে গিয়ে তার সাথে দেখা করবেন। তখন বুদ্ধিমান দূরদর্শী জিয়া বলেন, ‘একদিন তাকে অপমানিত হয়ে এখান থেকে চলে যেতে হয়েছে। যাও এখানে নিয়ে এসো। তিনি এখান থেকেই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবেন।’ এরপর রেডিও রেকর্ডিংয়ের নাম করে তারা জিয়াকে আর একবার শহরে নিয়ে আসার চেষ্টা চালায়। সেখানে উপস্থিত ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক উল্টো রেকর্ডিং ইউনিট সেনানিবাসে নিয়ে আসার পরামর্শ দিলে সেবারও তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। এভাবে শহীদ মিনারে ভাষণ দেয়ার আবেদনও তিনি অগ্রাহ্য করেন। অবশেষে ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় রেডিওতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকেরা গোলযোগ সৃষ্টি করলে সেখানে জিয়া যান এবং সেই কথিত ১২ দফা দাবিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এভাবে বার বার তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। যখন তাহেররা বুঝতে পারে জিয়ার কাঁধে বন্দুক রেখে তাদের উদ্দেশ্য সাধন সম্ভব নয়, তখন তারা বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দেয়। তারা তাদের উত্থিত স্লোগান, ‘অফিসারদের রক্ত চাই’, ‘সুবেদারের ওপর অফিসার নাই’ বাস্তবেই কার্যকর করতে শুরু করে। অনেক অফিসার এদের হাতে নিহত হয়।
সাধারণ সৈনিকদের ভূমিকা
একথা সত্য যে, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা বিপ্লবের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু প্রকারান্তরে এরা সাধারণ সৈনিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও তাহেরপন্থীরা নিজেদের সংখ্যাস্বল্পতা এবং চরমপন্থা অবলম্বনে সাধারণ সৈনিকরা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ট্রাকে ট্রাকে কার্যকিরা ‘নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দেয়। ‘জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি ছিল কমন। কোনো কোনো সৈনিক দল খোন্দকার মোশতাকের ছবিও বহন করে। এতেই বোঝা যায়, তাহেরপন্থীরা শেষের দিকে তাদের উদ্দেশিত বিপ্লব ধরে রাখতে পারেনি। সাধারণ সৈনিকরা যে রাজনৈতিক চাতুর্যের শিকার হয়েছেন, অবিলম্বে তারা তা বুঝতে পারেন।
জিয়া ও বিপ্লব-পরবর্তী ভূমিকা
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যে কণ্ঠ গোটা জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল, সেই কণ্ঠ আবারও শোনা যায়। ‘আমি জিয়া বলছি’ শিরোনামে রেডিও-টেলিভিশনে সংক্ষিপ্ত ভাষণ বার বার প্রচার হতে থাকে। তার এ আহ্বানে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসা হাজার হাজার সৈনিক আবার ব্যারাকে ফিরে যায়। অবশ্য বেশকিছু বিভ্রান্ত সৈনিক কর্নেল তাহেরের ফিরে না যাওয়ার আহ্বানে সাড়া দেয়। তারা অস্ত্র গুদাম লুট করে যে বিপুলসংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র বাইরে নিয়ে এসেছিল, তা আশু বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা একেবারেই ভেঙে পড়ে। পলায়মান অফিসারদের ধরে ধরে জিয়া সংগঠিত করেন। সৈনিকদের মাঝে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ব্যারাকেই কাটিয়ে দেন। এ সময় মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী জিয়াকে মূল্যবান সহায়তা দেন। জিয়ার অপরিসীম পরিশ্রম ও অকুতোভয় মনোভাবের কারণে অবশেষে আমাদের জাতীয় সেনাবাহিনী ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।
জনতার সংহতি
সৈনিকরা যে বিপ্লব করেছে, জনগণ মিছিলের স্রোত আর উল্লাস দিয়ে তাকে স্বাগত জানিয়েছে। জনগণের যে উদ্বেলিত ও ভাবাবেগ ঐ দিন প্রকাশিত হয়, তা ছিল অভূতপূর্ব। ঈদের খুশিতে আনন্দ-উদ্বেলিত হয় মানুষ। ব্যক্তিগতভাবে সেদিন ঢাকা মহানগরবাসীর আনন্দ-খুশিকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। মানুষের এত খুশি আমি জীবনেও দেখিনি। সেদিন জিয়ার আহ্বানে মানুষ শান্ত থেকেছে। সেই ‘lawlessness’-এর সময়টায় তেমন কোনো অপরাধ, অরাজকতা ঘটেনি। অন্তত সাধারণ মানুষের দ্বারা জিয়ার প্রতি, জিয়ার আদর্শের প্রতি, সাধারণ মানুষের এই অসাধারণ সমর্থন ব্যক্ত হয়েছে বার বার ১৯৭৮, ১৯৭৯, ১৯৯১, ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে। আজ ২০২৪ সালে যে ছাত্র গণবিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার সাথে নভেম্বর বিপ্লবের চেতনা, গণমানস ও ঘটনাবলিতে অন্তর্নিহিত অপূর্ব মিল রয়েছে। বাংলাদেশের হৃদয়ে ইসলামের অনুরণন যে চিরজাগরুক রয়েছে, তা আবার প্রমাণিত হলো। এই চেতনা ও দর্শন এ জাতিকে অবশ্যই একদিন আদর্শিক লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।